গত সংখ্যার পর
এ রকম পরিস্থিতিতে সার্জন দত্ত অসহায় হয়ে পড়েন। রাতে ঘুমাতে পারেন না। গভীর রাতেও বিভিন্ন দেশের ব্রুটাল রেপ কেস-এর চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে পড়ালেখা করেন। টেলিফোনে, চিঠি লিখে কলকাতা, দিল্লিতে পরিচিত সার্জনদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। তিনি হারতে চান না। এ হার তার নিজের হার। তার হাতে কত রোগী ভালো হয়েছে, কেউ আবার ভালো হয়নি। কিন্তু সাবিনাকে সুস্থ করে তোলা ছাড়া তার সামনে বিকল্প কই? তিনি হারতে চান না।
রাতে বিছানায় শুয়ে গাইনোকলজিস্ট স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেন। যদি কোনো সমাধান বেরিয়ে আসে।
শেষে একদিন ডা. স্বপ্না দত্ত বললেন- আমি মেয়েটিকে অনেকবারই দেখেছি, কন্ডিশন এখনো বেশ ক্রিটিক্যাল। কয়েকটা মেজর সার্জারি করে একটা রিক্স নেওয়া যেতে পারে। ফিজিক্যালি খুবই উইক সে- মেন্টাল হেলথও ক্রিটিক্যাল। জ্ঞান ফিরলেই ভীত-সন্ত্রস্ত্র হয়ে ওঠে। অসঙ্গত আচরণ করে। এমনিতেই এক মাস হয়ে গেল। তুমি বরং একটা কাজ কর- দিল্লি চলে যাও। এক্সপার্টদের সঙ্গে কথা বল। দেখ, কোনো সলিউশন পাও কিনা।
ঘটনার এ পর্যন্ত বিবরণ দিয়ে সার্জন দত্ত মৃদু হাসলেন। বললেন- বুঝলে শেষ পর্যন্ত একদিন প্লেনের টিকিট কেটে দিল্লি পৌঁছলাম। আমার অনেক বন্ধুবান্ধব সেখানে। প্রথমে গেলাম ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্স’-এ। এক্সপার্টদের সঙ্গে কথা বললাম। এরপর ‘ডাইরেক্টর জেনারেল অব হেল্থ সার্ভিসেস’-এ গিয়ে একের পর এক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সঙ্গে আলোচনা করলাম। সবাই বাংলাদেশের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল।
অতএব, কেসটা নিয়ে সবাই আগ্রহ দেখালেন। এরপর দিল্লির মেডিকেল সপ থেকে সার্জারির নানা বই ও কিছু জার্মান ও রাশিয়ান মেডিকেল জার্নাল কিনলাম। ফেরার পথে একদিন কলকাতায় কাটালাম। সেখানেও আলোচনা চলল। হঠাৎ মনে পড়ল পাটনায় গিয়ে অল ইন্ডিয়া প্লাস্টিক সার্জন অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক আর এন সিন্হার সঙ্গে আলাপ করা উচিত। গেলাম সেখানেও।
মল্লিকা সেনগুপ্ত: এত দেখছি বিশাল কর্মযজ্ঞ আপনার! একটি মাত্র রোগীর জন্য এতকিছু?
সার্জন রথীন দত্ত: সত্যি বলছি মল্লিকা, বিশাল সে কর্মযজ্ঞ! কারণ আমার মন বলছিল সাবিনা সুস্থ জীবন ফিরে পাবে। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। অতএব, কর্মযজ্ঞ বল, সংগ্রাম বল, যুদ্ধ বল- সে তো করতে হয়েছেই। আরও একটি কারণ ছিল- সাবিনা আমার কাছে পূর্ববঙ্গের ধর্ষিতা নারীদের প্রতীকে পরিণত হয়েছিল- লাখো বাঙালি নারীর মুখ দেখেছিলাম আমি ওর মুখে। আমার নিজের মেয়ের মুখ দেখেছিলাম, আমার বোনের মুখ দেখেছিলাম। ওই মুখকে আমি ব্যর্থ হতে দিতে পারিনে।
এ পর্যন্ত বলেই সার্জন রথীন দত্ত থামলেন। ওর চোখ আরেকবার ঝাপসা হয়ে উঠেছে। পাশের টেবিল থেকে একটা আই ড্রপ ও টিসু পেপার নিলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মল্লিকা সেনগুপ্ত এগিয়ে বলল- স্যার, আমি কি সাহায্য করতে পারি?
সার্জন দত্ত হাত বাড়িয়ে বারণ করলেন, বললেন,- আমিই পারব। তুমি বোস।
এদিকে আগরতলা জিবি হাসপাতালের বিস্ময়কর চিকিৎসা অভিযানের কথাটি প্রচার হয়েছে নানা মহলে। মেয়েটির নাম-পরিচয় গোপন রেখে আগরতলা ও কলকাতার কিছু পত্রিকা খবরও প্রকাশ করেছে। অতএব, অনেক মহলে জানাজানি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ সাবিনাকে একদিন দেখতে এলেন, সঙ্গে দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সম্পাদক ভূপেন দত্ত ভৌমিক ও স্থানীয় সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য। সাবিনাকে দেখে মেজর খালেদ সরাসরি সার্জন দত্তের রুমে যান, আলোচনা করেন।
এরই মধ্যে মেলাঘরের ফিল্ড হাসপাতাল থেকে ডা. মবিন ও ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী সাবিনাকে দেখে গেলেন। সাবিনার মায়ের সঙ্গে দেখা করে সান্ত্বনা দিয়ে ডা. মবিন বললেন- আপা, আপনার মেয়ে ভালো হবে, চিন্তা করবেন না। ডাক্তাররা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন- নিশ্চয়ই সুস্থ হবে।
সাবিনার মা ঘোমটা টেনে ওয়ার্ডের এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কোনো কথা বলতে পারেননি। শুধু কেঁদে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ পাশের বিছানা থেকে আরেকজন ঘোমটা পরা মধ্য বয়স্ক নারী প্রশ্ন করেন- এক মাস তো হলো, আসলেই কি মেয়েটা ভালো হবে?
ডা. জাফরউল্লাহ উত্তরে বললেন- দেখেন মা, আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের যে হাসপাতালটি চালাই ওখানে ছোটখাটো অপারেশন হয়, গুলি-বোমায় ইনজুর্ডদের চিকিৎসা হয়। বড় রকমের কোনো জটিল অপারেশন করা সম্ভব নয় সেখানে। কিন্তু আপনারা চিন্তা করবেন না, ডাক্তার রথীন দত্তের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে, তার মতো একজন বড় সার্জন যখন আছেন তখন আমরা অবশ্যই ভরসা করতে পারি।
পাহাড় অঞ্চলের ট্রেনিং ক্যাম্পগুলো থেকে গেরিলা যোদ্ধারা মাঝেমধ্যে আগরতলায় ঘুরতে আসে। ছুটির দিনে বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়। শহরের একটি সিনেমা হলে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছবি চলছিল। কেউ কেউ এরই ফাঁকে সিনেমা দেখে। রাজবাড়ি দেখে, কলেজ টিলা ও শ্রীধর ভিলায় গিয়ে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে । ছোট খাটো কেনাকাটা সারে।
সপ্তাহখানেক আগে এর রকমই একটি দল জিবি হাসপাতালে ঢুকে পড়ে সাবিনাকে দেখার জন্য। অসময়ে হাসপাতালে প্রবেশ করা থেকে ওদের বিরত রাখার চেষ্টা করে প্রহরিরা। কিন্তু পেরে ওঠে না। মুক্তিবাহিনীর চারজন সদস্য অনেকটা জোর করেই ঢুকে পড়ে। খবর পেয়ে সার্জন দত্ত ছুটে আসেন। তিনি সহাস্যে মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের সঙ্গে পরিচিত হন, ওদের বাড়িঘর কোথায় জানেন, কে কোন ক্যাম্পে আছে তার খোঁজখবর নেন এবং সাবিনাকে দেখিয়ে আপ্যায়নের জন্য ওদের নিজের কামরায় নিয়ে যান।
চলবে...