ঢাকা ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪

নৈশসঙ্গী ও একটি ব্রিফকেস

প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:১৩ পিএম
নৈশসঙ্গী ও একটি ব্রিফকেস
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

বাস থেকে নামতেই শরীরটা ছমছম করে উঠল। খুব যে রাত হয়েছে, তা নয়। এখনো ১০টা বাজেনি। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডে কোনো লোকজন নেই। অসম্ভব নীরব। স্ট্রিটলাইট জ্বললেও রাস্তার দুই পাশে গাছগাছালির লম্বা ঘন ছায়া পরিবেশটাকে ভূতুড়ে করে তুলেছে। দুই স্টপেজ আগেই বাস খালি হয়ে যায়। এমনকি বাসের হেল্পারও নেমে পড়ে। বাসচালক তাকে একা নিয়েই পল্লবী সাড়ে এগারো পর্যন্ত চলে আসে। এখানেই তাকে নামতে হবে। চালকটা যেন একটু তড়িঘড়িই করছে। এর পরেরটাই মিরপুর-১২ লাস্টস্টপেজ।

খুব ক্লান্ত লাগছে। তবু হুড়োপাড়া করেই তাকে নামতে হলো। হাতে ব্রিফকেস।

ব্রিফকেসটা তার নিত্য সাথী। বিশেষ করে অফিসে আসা-যাওয়ার পথে। কাকরাইলে তার অফিস। বাসা মিরপুরের প্রায় শেষ মাথায়- সাড়ে এগারো পল্লবীতে। শহরের এ মাথা-ও মাথা। মেইন রাস্তা থেকে ভেতরের দুই রাস্তা পরেই তার বাসা। পাড়ার রাস্তাগুলো দিনের বেলাতেও প্রায় ফাঁকা থাকে। আর রাতে তো ঝুম নীরবতা। এর মধ্য দিয়েই তার প্রতি রাতে ঘরে ফেরা। বাস থেকে নামলেই গা ছমছম করে ওঠে। তার পরই ভয় আর থাকে না। নিজের পাড়া। দীর্ঘদিনের বাস। গটগট করে পা ফেলে চলে আসে বাসায়। ব্রিফকেসটা হাতেই থাকে। ওতে কোনো ঐশ্বর্য নেই, দামি কিছুও নয়, রয়েছে খালি একটি টিফিন বক্স- দুপুরের জন্য ঘরের টিফিন নিয়ে যায় ওই কৌটায়।

সোহান আজও নামল বাস থেকে। যথারীতি গা ছমছম আমেজ নিয়ে। সেই নিঝুম বাসস্টপেজে। আজ রাত ১০টা পেরিয়ে গেছে।

বাস থেকে নেমে সে এদিক-ওদিক তাকাল। কোথাও কেউ নেই। রাস্তায় নামলে একটা কুকুর এসে দাঁড়ায় তার পাশে। বাসা পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিয়ে যায়। আজ কুকুরটাকে দেখা গেল না। হয়তো অন্য কোথাও কোনো কাজে ব্যস্ত। হয়তো কোথাও সুস্বাদু ভোজের সন্ধান পেয়েছে।

বাসার দিকে পা বাড়াতেই নজর পড়ল, কোনার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল একজন লোক। দাঁড়াল তার সামনে। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল: রাইতবিরেত, যাইবেন কই?

ঠিক এ সময়ই কোত্থেকে যেন কুকুরটির উদয়। সোহান ও লোকটির মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

সোহান একটু ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল। কুকুরটাকে দেখে তার ভিতর সাহস ফিরে এল। খানিকটা মেজাজ দেখিয়ে বলল: এখানেই আমার বাসা। আপনার কোনো অসুবিধা?

লোকটা বলল: রাইত হইছে। সাবধানে যাইয়েন।

লোকটা গাছের ছায়ায় হারিয়ে গেল।

কুকুরটি সারা পথ সোহানের সঙ্গে। বাসায় পৌঁছে গেট খুলে পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখে: কুকুরটি কোথাও নেই।

প্রতিদিনকার ঘটনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোহান বাসায় ঢুকল।

কয়েকদিন পর। সে রাতেও যথারীতি বাস থেকে নামল। বাসস্টপেজ থেকে কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই চারপাশটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা মনে হলো সোহানের। এ সময় রাস্তাঘাট তো ফাঁকাই থাকে, এর পরও মনে হচ্ছে আজ রাতে তার সঙ্গে একটা কিছু নেই যেন। ব্রিফকেসটা কি? সেটা তো তার হাতেই ধরা। ওতে খালি টিফিন বক্স ছাড়া আর কিছু নেই।

আচমকাই সোহানের সামনে এসে দাঁড়াল এক বালক। হাফ প্যান্ট পরনে পুরো গা খালি। কখন যেন সে উল্টোদিকের গলি থেকে রাস্তা পেরিয়ে এসে তার পথ আগলে দাঁড়িয়েছে।

সোহানের ভুরু জোড়া কুঁচকে গেল। বিরক্ত হয়ে বলল: কে রে তুই?

এই রাতেও ছেলেটার মুখে কোনো ভয়ডরের চিহ্ন নেই। নির্বিকার কণ্ঠে বলল: আমি রাস্তার পোলা। রাস্তাতেই থাহি। আপনেরে হুঁশিয়ার করতে আইছি।
থমকে দাঁড়াল সোহান। সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল ছেলেটার দিকে। উদোম গায়ে ধুলোবালিতে গড়াগড়ির নোংরা ছাপ। ছায়া ছায়া ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে আলো-আঁধারিতে- কেমন এক রহস্যময় ভঙ্গি।
 
ছেলেটা বাঁকা ঠোঁটে মনে হলো একটুখানি হাসল। বলল: সার, আপনের ডেরাটা তো ওই রাস্তা পারাইয়া পরের রাস্তায়। হেইদিকে কয়ডা গুন্ডা মার্কা মানুষরে যাইতে দেখছি। দেইখা-শুইনা হিসাব-কিতাব কইরা যাইয়েন।

ছেলেটা কি ভয় দেখাতে এসেছে, নাকি সত্যি সত্যি সতর্ক করতে? একটু ভয় ভয় করছে অবশ্য। তবু ছেলেটা তাকে সাবধান হওয়ার সুযোগ করে দিল। ধন্যবাদ তাকে জানানোই যেতে পারে। কিছু বখশিশও দেওয়া যেতে পারে। হিপ-পকেটে মানিব্যাগ আছে, কিন্তু সেখানে কোনো টাকা নেই। সকালে অফিসে যাওয়ার সময় বৌয়ের কাছ থেকে গুনে গুনে টাকা নিয়ে আসে যাতায়াতের খরচা বাবদ। টানাটানির হিসাবের সংসার। সোহান প্যান্টের সাইডপকেটে হাত দিল। ওখানে কয়েকটা খুচরো কয়েন থাকার কথা। দুটো কয়েন পেয়েও গেল। বের করে দিতে গিয়ে দেখতে পেল, ছেলেটা নেই। চারপাশে তাকিয়ে কোথাও তাকে দেখতে পেল না। সারা শরীর শিউরে উঠল তার। পেয়ে বসল ভয়ানক নিঃসঙ্গতা। এ সময়ই খেয়াল হলো, তার নিত্যকার রাতসাথী কুকুরটি আজ নেই। বাস থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে দেখতে পায়। পুরো পথটাতেই সে সঙ্গ দেয় তাকে। আজ রাতে এই বেলায় কোথাও তার দেখা নেই। 

মনটা ভার হয়ে গেল। বিষণ্ণ মনে পা ফেলল বাসার পথে।

সোহানের মাথায় এখন নানান আশঙ্কা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। ছেলেটা কোথা থেকে তার সামনে এসে হাজির হলো? একে তো এর আগে এদিকে কখনো দেখা যায়নি? আজ কোথায় থেকে তার উদয় ঘটল? শুধুই কি তাকে সাবধান করতে? কেন?

ছেলেটা যে গুন্ডামার্কা লোকদের দেখেছে, তারাই বা কোথা থেকে এসে এই পাড়ায় ঘোরাঘুরি শুরু করল? কী মতলব তাদের?

এর চাইতেও রহস্যজনক, বেছে বেছে ঠিক আজকের রাতেই কুকুরটা গরহাজির! কেন? এর মাঝেও কি কোনো রহস্য রয়েছে? নাকি ওই গুন্ডাগুলোই কুকুরটাকে সরিয়ে দিয়েছে? 

সে নিজেই কি গুন্ডাদের হামলার টার্গেট? সম্ভাবনাটা সে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল। তার কাছে তো কিছুই নেই। শুধু এই ব্রিফকেসটা আর এর ভিতর খালি টিফিন বক্স। অবশ্য এটা কি আর এই গুন্ডারা জানে?

কিছুটা ভয়ে কিছুটা আশঙ্কায় হাঁটতে হাঁটতে সে বাসায় যাওয়ার রাস্তার মোড়ে এসে গেল। হাঁটতে হাঁটতেই তার মনে হচ্ছিল, দুজন লোক তার পেছনে পেছনে আসছে। কারা আসছে, বোঝার জন্য তার পেছনে তাকিয়ে দেখার সাহস হয়নি।

কোথা থেকে যেন দুজন লোক তার সামনে এসে দাঁড়াল। ওদের হাতে চাকু আর ছুরি। তাকে থমকে দাঁড়াতেই হলো। পেছনে ফিরে ছুটে পালাবে কিনা- এই ভাবনা থেকে ঘুরতে গিয়েই টের পেল, তার ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে পেছনের লোক দুজনও। একজনের হাতে লোহার রড, আরেকজনের হাতে ছোট সাইজের একটা পিস্তল।

সোহানের ভিমরি খাওয়ার অবস্থা। হাঁটু দুটোই কাঁপাকাঁপি করছে। সামনের একজন লোক কাঁধ ধরে তাকে সামলালো। আরেকটা হাতে ব্রিফকেস ধরল।
এ সময়ই কুকুরের গর্জন। ফিরে এসেছে সোহানের নৈশসঙ্গী। সে ঝাঁপিয়ে পড়ল ব্রিফকেস-লুটেরা লোকটির ওপর। চারজন গুন্ডাই একসঙ্গে তেড়ে আসতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেল, এক দঙ্গল কুকুর তাদের ঘিরে ধরে সমস্বরে ঘেউ ঘেউ শুরু করেছে। রাস্তার দুই পাশের বাসাবাড়িগুলোর জানালার কপাট খুলে গেছে। কৌতূহলী পাড়া-পড়শীরা রাস্তার ঘটনার দিকে মুখ বাড়িয়েছে। ওরা রাস্তায় নেমেও আসতে পারে। গুন্ডারা বেগতিক দেখে যার যার মতো সটকে পড়ল।

এ যাত্রায় বেঁচে গেল সোহান। গায়ের কাঁপুনি তখনো থামেনি। ব্রিফকেসটা দুই হাতে বুকে জড়িয়ে সে তার বাসার দিকে হাঁটতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে কুকুরগুলোও।

সব কুকুর সোহানের বাসা পর্যন্ত এল না। পথের মাঝখানেই তারা যার যার মতো কেটে পড়ল। সঙ্গে রইল শুধু তার প্রিয় নৈশসঙ্গী। বাসা অবধি।
বাসার গেটের কাছে এসে সোহান দাঁড়াল। সাথীকে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য সে পেছনে ফিরল। রাস্তার ওপর লাইটপোস্টের আলো ঠিকরে পড়ে ঝিকঝিক করছে। শূন্য রাস্তা। কোথাও কোনোখানে কুকুরটি নেই।

কয়েকদিন পরই আরেকটা ঘটনা। সেদিন অফিস থেকে বেরোতে সোহানের দেরি হয়ে যায়। বাসস্ট্যান্ডে এসে লাস্ট বাসটা পেয়ে যায়। প্যাসেঞ্জারের সংখ্যা কম, আসনগুলো ভরাট হয়নি। বাসের একপাশে একটা আস্তো বেঞ্চের দখলে নিয়ে সে বসে পড়ল। কোলের ওপর ব্রিফকেসটা দুই হাতে জড়িয়ে ধরে  রইল।

বাস চলতি পথে একেকটা স্টপেজে যতগুলো যাত্রী নামাল, তার অর্ধেক যাত্রীও উঠল না। এমন করতে করতে যাত্রী সংখ্যা একদম পাতলা হয়ে এল। যে কজন এখনো আছে, সবাই ঝিমুচ্ছে। ঝিমুনি সোহানকেও পেয়ে বসছে। যত ঝিমুনি ততই সে তার ব্রিফকেসটা আঁকড়ে ধরছে। মিরপুর-১০ নম্বরে এসে যাত্রীশূন্য হয়ে গেল বাসটি। এমনকি বাসের হেল্পারও নেমে গেল। আজ রাত ১২টার কাছাকাছি। ড্রাইভার একবার শুধু জানতে চাইল: কোথায় যাবেন? সাড়ে এগারো পল্লবীতে তো?

জবাব দিতে গিয়ে সোহানের তোতলামি ভাবটা কেন জানি এসে গেল: হ্যাঁ। পল্লবী। সাড়ে এগারো।

আর কোনো কথা নেই। জনমানবশূন্য রাস্তায় বাস ছুটে চলল। একটানে এসে থামল পল্লবীতে।

সোহান নেমে যেতে না যেতেই বাস সোহানকে পুরোপুরি একা করে দিয়ে ছুটে গেল তার শেষ গন্তব্যের দিকে।

সোহান এদিক-ওদিক চারপাশ তাকাল। কোথাও কোনো প্রাণের সাড়া নেই। এমনকি গাছে গাছে পাতাও নড়ছে না। 

বাসার দিকে পা বাড়াতেই নৈশকালের সঙ্গী কুকুরটি এসে হাজির। বরাবর সে সোহানের সামনে বা পেছনে দাঁড়ায়। হাঁটতে শুরু করলেই সে পিছু নেয়। বাসা পর্যন্ত তাকে অনুসরণ করে।

কুকুরটা আজ তার পাশে দাঁড়াল। কখনোই যেটা সে করে না, আজ রাতে সেটাই করছে। কেন জানি হাতে ধরা ব্রিফকেসটায় নাক লাগাচ্ছে। কী যেন শুঁকছে।

সোহান খানিকটা অবাক হলো। কুকুরটা ব্রিফকেস থেকে কীসের গন্ধ পাচ্ছে? দুর্গন্ধ কি? কীসের?

ব্রিফকেসে টিফিন বক্সটি আছে। যথারীতি খালি। দুপুরের টিফিন খাওয়ার পর সোহান বক্সটি নিজের হাতে পরিষ্কার করে। আজ অবশ্য তাড়াহুড়োয় বক্সটি আধোয়া অবস্থাতেই রেখে দিয়েছে। দুর্গন্ধটা কি সেখান থেকেই পাওয়া যাচ্ছে?

বাসা পর্যন্ত কুকুরটি একইভাবে ব্রিফকেসে নাক ঠেকিয়ে ঠেকিয়েই এল। মাঝে মাঝে গলা উঁচিয়ে ঘেউ ঘেউও করল।

কিন্তু বাসার কাছে এসেই এবার কুকুরটা অদ্ভুত কাজ করে বসল। বরাবর সে পেছন থেকেই অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু আজ রাতে সেটা হলো না। 
সোহান বাসার গেট খুলে ভেতরে ঢোকার উদ্যোগ করতেই কুকুরটা ব্রিফকেস শোঁকা ছেড়ে পথ আগলে দাঁড়াল। তার চোখজোড়া যেন জ্বলছে। উচ্চস্বরে ঘেউ ঘেউ ডেকে উঠল।

চমকে উঠল সোহান। খানিকটা ভয়ও পেল। ব্রিফকেসটা এতক্ষণ সে হাতে ঝুলিয়ে নিয়েছিল। এখন সেটা বুকে জড়িয়ে নিল। কুকুরটাকে প্রায় ঠেলেই ভিতরে ঢুকে গেটটায় তালা লাগিয়ে দিল। তাড়াহুড়োয় চলে এল নিজের ফ্ল্যাটে। বেডরুমে ঢুকে সাইডটেবিলে ব্রিফকেসটা রেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল।

ঘরে তখন কেবলমাত্র বৌ জেগে অপেক্ষা করছিল। ছেলেমেয়েরা যার যার রুমে ঘুমোচ্ছে। বৌ অবাক হয়ে সোহানের আচরণ দেখছিল। আজকে তার চলাফেরায় কেমন যেন অস্থিরতা ও ছটফটে ভাব। ঘরে ফিরে এমন অস্থিরতা এর আগে কখনো দেখা যায়নি।

বৌ বলল: আজ এমন করছ কেন? অফিসে কি কোনো ঝামেলা?

সোহান প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে বলল: ব্রিফকেসটা এখনই আলমারিতে রেখে দাও।

বৌ আরও অবাক। বলল: ব্রিফকেস তো টেবিলেই থাকে। আজ আলমারিতে ঢুকবে কেন? ওতে কি আজ সোনাদানা আছে?

সোহান বৌকে টেনে টেবিলের সামনে নিয়ে এল। ব্রিফকেসটা খুলল। সেদিকে তাকিয়ে বৌয়ের চোখ ছানাবড়া। বিস্মিত স্বর বেরিয়ে এল: এতো টাকা!
সোহান ফিসফিস করে বলল: একটা পার্টি দিয়েছে। ওদের ফাইলটা তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিতে হবে।

বৌয়ের মুখ গম্ভীর। সে আর কোনো কথা বলল না, মন্তব্যও না। ব্রিফকেস থেকে টিফিন বক্সটা বের করে নিল। টাকাসহ ব্রিফকেসটা রেখে দিল আলমারিতে।

হাতমুখ দিয়ে সোহান রাতের খাবার নিয়ে ডাইনিং রুমে বসল। খেতে খেতে সে বৌকে শোনাল আজ রাতে কুকুরটির অদ্ভুত আচরণের কথা। 

বৌ কোনো মন্তব্য করল না। অপলক তাকিয়ে রইল তার মুখের দিকে।

সোহান খাওয়াদাওয়া সেরে শোয়ার আয়োজন করছিল। এ সময়ই বৌ তাকে ডেকে নিয়ে এল বারান্দায়। আঙুল তুলে দেখাল গেটের বাইরের দৃশ্য।
সেদিকে তাকিয়ে অবাক হলো সোহান। বাসার বাইরে গেটের সামনে এক দঙ্গল কুকুর হামাগুড়ি দিয়ে বসে আছে। মাথা উঁচিয়ে। তাকিয়ে আছে তাদের বাসার দিকে। মনে হয় পাড়ার সব কুকুরই এসে জড়ো হয়েছে ওখানে। ওদের ঠিক মাঝখানেই দাঁড়িয়ে আছে কুকুরটা। তাদের বাসার দিকেই মুখ করে তারস্বরে ঘেউ ঘেউ করছে।

বৌয়ের ঠোঁটে এক ঝলক বাঁকা হাসি খেলে গেল। সোহানকে জিজ্ঞেস করল: ওই কুকুরটাই তোমার প্রতি রাতের সঙ্গী?

সোহান ঘাড় নাড়ল। বৌয়ের চোয়াল শক্ত: বলছিলে না কুকুরটা তোমার ব্রিফকেস শুঁকছিল! কুকুরদের ঘ্রাণশক্তি প্রবল। সে তোমার ব্রিফকেস নয়, ওর ভেতরে রাখা ঘুষের টাকার দুর্গন্ধ পাচ্ছিল।

সাহিত্য আমার রক্তে-মাংসে মিশে গেছে

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:১০ পিএম
আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:০৮ পিএম
সাহিত্য আমার রক্তে-মাংসে মিশে গেছে
সাদাত উল্লাহ খান

সাদাত উল্লাহ খান স্বাধীন লেখকের জীবন বেছে নেন। লিখেছেন গল্প, প্রবন্ধ ও সমালোচনা। তিনি ১৯৯৮ সাল থেকে নিয়মিতভাবে গবেষণা পত্রিকা ‘প্রতিবুদ্ধিজীবী’ সম্পাদনা করছেন।

আপনার পত্রিকা ‘প্রতিবুদ্ধিজীবী’র ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে গিয়ে কতটা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন? 
পারিবারিকভাবেই অর্থের চাইতে জ্ঞানের দিকে আমাদের মোহ বেশি। আমি স্কুল বয়স থেকেই পারিবারিক পাঠাগার থেকে অনেক বই পড়েছি। তলস্টয়, দস্তয়েভস্কি ও গোর্কিসহ বিভিন্ন বই পড়েই সাহিত্যের প্রতি আমার ভালোলাগা তৈরি হয়েছে। সাহিত্য আমার রক্তে-মাংসে মিশে গেছে। ‘প্রতি বুদ্ধিজীবী’ চালাতে গিয়ে নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছি। পত্রিকাটি নিয়মিতভাবে বের করার জন্য আমার ভাই সলিমুল্লাহ খান যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। প্রয়োজনে জমি বিক্রি করে হলেও পত্রিকাটি বের করার অভয় আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। আমাদের পরিবারের অনেকেই লেখক। যার কারণে সহজেই পত্রিকাটি চালাতে পারছি।   

আপনার পত্রিকাটির ‘প্রতিবুদ্ধিজীবী’ নাম দেওয়ার কারণ কী? 
বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন তা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। বুদ্ধিজীবীরা পরিস্থিতি বুঝতে চায় না। বুদ্ধিজীবীরা ফুটওভার ব্রিজের মতো, মানুষ যেদিকে যায় তার থেকে তারা ১০০ গজ দূরে থাকে। সমাজের গতিবিধি তারা বোঝে না। তারা নিজেদের স্বার্থ বোঝে। অনেক বড় বড় সংকটে বুদ্ধিজীবীরা আন্দাজ করতে পারেন না। ২০২৪ সালে এমন একটি বিপ্লব হবে কোনো বুদ্ধিজীবী ধারণাই করতে পারেননি। ১৯৭১ সালেও একই ঘটনা। এজন্য ‘প্রতিবুদ্ধিজীবী’র অর্থ হলো প্রকৃত প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী। প্রতিবুদ্ধিজীবীরা অরগানিক ইনট্যালেকচুয়াল। এরা প্রথাগত বুদ্ধিজীবী নন। যারা ব্যতিক্রমী, অত্যন্ত সাহসী এবং অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেশের ও মানুষের জন্য কথা বলেন তারাই হলেন প্রতিবুদ্ধিজীবী। এখন বুদ্ধিজীবীরা বেশির ভাগই সুবিধাবাদী। প্রতিবুদ্ধিজীবী বলতে আহমদ শরীফ, সলিমুল্লাহ খান, আহমদ ছফার মতো মানুষদের বোঝায়, যারা কখনই রাষ্ট্র বা সরকারের বিন্দুমাত্র সাহায্য গ্রহণ করেননি। কোনো বুদ্ধিজীবী যদি সরকারের সাহায্য নিয়ে থাকেন তাহলে তার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। যারা প্রতিবাদী চিন্তাবিদ তারাই প্রতিবুদ্ধিজীবী। 

আপনি নিজে ব্যবসায়ী হয়েও কীভাবে সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী হয়ে উঠলেন?
আমরা চিন্তাকে ভালোবাসি, দেশকে ভালোবাসি। মানুষের ভেতরে আলো জ্বালাতে গেলে জ্ঞান ছাড়া পারবেন না। আমি জাপান স্টাডিজ নিয়ে পড়াশোনা করেছি। মানুষকে আলোকিত করার একমাত্র উপায় বইয়ের মাধ্যমে জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া। আমাদের দেশে লেখাপড়া একদমই নেই। শুধু নোট বই পড়ে, পরীক্ষা দেয়, পাস করে। কোনো কবিতার বই প্রকাশকরা ছাপাতে চান না। কারণ, কবিতার বই মানুষ কিনতে চায় না। অথচ সবচেয়ে উচ্চ শিল্প হলো কবিতা। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো অবস্থা হলো লিটল ম্যাগাজিন। লিটল ম্যাগাজিন সব সময় নতুন চিন্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। 

আপনার জন্ম মহেশখালীতে, প্রকৃতির সান্নিধ্যেই বড় হয়েছেন। মহেশখালীর প্রকৃতি আপনার লেখায় কীভাবে প্রভাব ফেলেছে? 
মহেশখালী দ্বীপের মানুষের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। মহেশখালীর মানুষ এই দ্বীপের বাইরে আত্মীয়তার সম্পর্ক খুব কম করে। মহেশখালী দুর্যোগপূর্ণ এলাকা হওয়ায় লেখাপড়ায় অনেক পিছিয়ে আছে। অথচ অনেক জ্ঞানী ও শ্রেষ্ঠ মানুষের জন্ম হয়েছে এই মহেশখালীতে। ভৌগোলিকভাবেই এখানে জ্ঞানী মানুষের জন্ম হয়। এই দ্বীপের মানুষ হয়ে আমার ভাই সলিমুল্লাহ খান প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন। এখনো আমাদের দ্বীপের মানুষ সচিব হতে পারেনি। এমনকি সেনাবাহিনীর উচ্চ পদ বা জেনারেল হতে পারেনি। একজন বিচারপতি নেই। এখানকার বেশির ভাগ মানুষ পান চাষ ও মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে। এই দ্বীপে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। তবে আমি আমার লেখায় মহেশখালীর জীবনচিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।

সলিমুল্লাহ খান আপনার লেখায় কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন? 
আমার ভাই সলিমুল্লাহ খান সবসময় লেখাপড়ার প্রতি উৎসাহ দেন। তিনি উপদেশ দিতেন বড় লেখক  হওয়ার জন্য। আমার জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে তিনি যতটুকু সহযোগিতা করেছেন ততটুকু আমার বাবাও করেননি। তিনি আমেরিকায় থাকতে আমি যেসব বই চেয়েছি, তিনি মাটির নিচ থেকে হলেও সেই বই আমাকে খুঁজে বের করে দিয়েছেন। তিনি আমাকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছেন। 

অনুলিখন: সানজিদ সকাল

মন্ত্রীর অসুখ

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৫৫ পিএম
আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৫৫ পিএম
মন্ত্রীর অসুখ
অলংকরণ : নিয়াজ চৌধুরী তুলি

দক্ষিণ এশিয়ার কোনো একটা দেশের (ভারত নয়) স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কয়েকদিন ধরে বুক ব্যথা করছে।
তিনি ঠিকমতো অফিস করতে পারছেন না। অফিসে বসেই তিনি কোঁত কোঁত শব্দ করেন! বুকব্যথায় যে কেউ কোঁত কোঁত শব্দ করতে পারে, এটা কারও জানা ছিল না। তবে শব্দটা সব সময় হয় না, মাঝে মাঝে হয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার ব্যক্তিগত ডাক্তারকে ডেকে পাঠালেন। ডাক্তার এসে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেন, এক বস্তা ফাইল বানালেন, কোনো রোগ বের করতে পারলেন না।
মন্ত্রী বলে কথা! 
দেশের সব বড়ো বড়ো ডাক্তারের সমন্বয়ে বোর্ড মিটিং বসেছে। কী করে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কোঁত কোঁত শব্দ বন্ধ করা যায়! 
বোর্ডপ্রধান স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বললেন, স্যার, আপনার উচিত ইমিডিয়েট বিদেশে চলে যাওয়া। আপনার হার্ট বোধহয় নষ্ট হয়ে গেছে! 
স্বাস্থ্যমন্ত্রী রেগে গিয়ে বললেন, কী বলছেন এসব? আমি এখনো আমার বউকে ভালোবাসি। হার্ট নষ্ট হলে বউকে ভালোবাসতে পারতাম? ভালোবাসা যে হার্টে থাকে, এইটা আপনারা জানেন না? কোন চুলের ডাক্তার হইছেন? তাছাড়া আমাদের দেশের চিকিৎসাসেবা তো আন্তর্জাতিক মানের। পিরোজপুর থেকেও আমাদের চিকিৎসাসেবা উন্নত। আমি এই দেশের একজন মহান নেতা। আমি কেন বিদেশে যাব?
স্বাস্থ্যসচিব মন্ত্রীর কানে কানে বললেন, স্যার, ওটা পিরোজপুর হবে না, সিঙ্গাপুর হবে। পিরোজপুর তো স্যার বাংলাদেশের একটা জেলার নাম!
স্বাস্থ্যমন্ত্রী চিৎকার করে বললেন, পিরোজপুর হোক আর সিঙ্গাপুর হোক, আমি বিদেশে চিকিৎসা করাব না। আমি দেশপ্রেমিক নেতা। মরলে দেশের মাটিতেই মরব। কী করতে হবে বলেন!
স্বাস্থ্যসচিব বললেন, স্যার, বুকের এক্স-রে করা লাগবে। কিন্তু আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলোর বেশির ভাগ এক্স-রে মেশিন তো নষ্ট! 
এক্স-রে মেশিন খালি নষ্ট হয় কেন? কী করেন আপনারা? 
সরকারি হাসপাতালের এক্স-রে মেশিন নষ্ট হলেই ডাক্তারদের লাভ। তারা তখন বাইরে রোগী পাঠিয়ে ভালো টু-পাইস কামাতে পারে। এটা তো আর মন্ত্রীকে বলা যায় না, তাই তিনি বললেন, স্যার, আমরা আসলে মেইড ইন চায়না নামের যে মেশিনগুলো কিনি, ওগুলো মেইড ইন জিঞ্জিরা। আসমানে এবং জমিনে এমন কোনো জিনিস পয়দা হয়নি, যার নকল বাংলাদেশের জিঞ্জিরায় পাওয়া যায় না। ব্যাটারা ওপরে চায়না লিখে ভিতরে জিঞ্জিরার রদ্দি মাল গছিয়ে দেয়। 
স্বাস্থ্যমন্ত্রী ধমকের সুরে বললেন, যেভাবে হোক, এক্স-রে মেশিন ঠিক করেন। আমি সরকারি হাসপাতালেই চিকিৎসা করাব। প্রয়োজন হলে বাংলাদেশের ধোলাই খাল থেকে পার্টস নিয়ে আসেন। শুনেছি ওখানে পুরাতন ভালো ভালো পার্টস পাওয়া যায়। ইমিডিয়েট এক্স-রে করানোর ব্যবস্থা করেন। যদি ধোলাই খালে না পান, তবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ‘জবাই দেন’-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শুনছি এবারের নির্বাচনে উনি জয়লাভ করেছেন! 
স্যার, ঠিকই শুনেছেন, তবে উনার নাম জবাই দেন নয়, জো বাইডেন!
ওই হলো আর কি! তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করেন। ও মাই গড! এতো আধুনিক দেশ আমাদের, আমাদের দেশ ‘শিঙাড়াপুর’ থেকেও উন্নত, অথচ এক্স-রে মেশিন নেই! এইটা একটা কথা! আজই সবার চাকরি নট করব…
সব ডাক্তার মন্ত্রীর এক্স-রে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করল। দেশের সব চিকিৎসাসেবা এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ রইল। মন্ত্রীর চিকিৎসা বলে কথা!
এক সপ্তাহ পর আবার বোর্ড মিটিং বসেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বললেন, খবর কী? এক্স-রে মেশিন কি ঠিক হয়েছে? 
স্বাস্থ্যসচিব বললেন, আমরা এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিক-নির্দেশনা চেয়েছি। ফাইল চালাচালি হচ্ছে স্যার। মাসখানেকের মধ্যে সমাধান এসে যাবে। 
স্বাস্থ্যমন্ত্রী কোঁত করে শব্দ করে বললেন, এক মাসের মধ্যে মেশিনের সমাধান আসবে? ততদিন কি আমি বাঁচব বলে মনে হয়? 
বোর্ডপ্রধান বললেন, আমাদের কিছুই করার নেই, স্যার। এটাই এই দেশের সিস্টেম। আমরা দোয়া-দুরুদ পড়ছি স্যার, আপনিও পড়ুন। আপনার পরিচিত কোনো পীর-ফকির থাকলে পানি পড়া এনেও খেতে পারেন। কোনো মাদ্রাসায় গিয়ে কোরআন মজিদ খতম করাতেও পারেন।
অনেক দেন-দরবার করে এক্স-রে মেশিন ঠিক করা হয়েছে। মন্ত্রীর বুক এক্স-রে করা হয়েছে।
আবার বোর্ড মিটিং বসেছে। বোর্ডপ্রধান বললেন, একটা সমস্যা ধরা পড়েছে, স্যার।
মন্ত্রী অবাক হয়ে বললেন, কেন? কী হয়েছে? 
তেমন কিছু না, স্যার। আপনার এক্স-রে রিপোর্টে তেলাপোকা পাওয়া গেছে। আপনার বুকে তেলাপোকা দৌড়াদৌড়ি করছে, এ জন্যই আপনার মুখ দিয়ে কোঁত কোঁত শব্দ হয়।
অসম্ভব! মন্ত্রী চিৎকার করে বললেন। আমার বুকে তেলাপোকা থাকতে পারে না। তেলাপোকা দেখলেই আমার বউ অজ্ঞান হয়ে যায়। আমার বুকে তেলাপোকা থাকলে বউ অজ্ঞান হয় না কেন?
সত্যি বলছি স্যার। আপনার বুকে তেলাপোকা দৌড়াদৌড়ি করছে। টিকটিক টিকটিক আওয়াজ করে।
মন্ত্রী অসহায় গলায় বললেন, ওরে আল্লাহ রে! তেলাপোকা টিকটিক আওয়াজ করে? ব্যাটা গাধার গাধা! 
সচিব বললেন, স্যার অন্য দেশের তেলাপোকা টিকটিক আওয়াজ করে না, আপনার বুকে কেন করছে বুঝতে পারছি না। এই নিয়ে গবেষণা চালাতে হবে। তবে এই গবেষণার ফল পেতে কয়েক দশক লেগে যেতে পারে। এই তেলাপোকা আপনার হার্ট খেয়ে ফেলছে। তেলাপোকা মেরে ফেললেই আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। সমস্যা হচ্ছে, এই তেলাপোকা কীভাবে মারতে হয়, আমরা জানি না। আমরা মনে করছি, কোনো পীর-ফকিরের পানি পড়া খেলেই কাজ হয়ে যাবে। আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই রোগের চিকিৎসার কথা জানা নেই স্যার। রোগটা একেবারে নতুন! এমন জটিল রোগের কথা পৃথিবীর মানুষ আগে কখনো শোনেনি। 
তেলাপোকার কথা শুনে মন্ত্রী অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ চোখেমুখে পানি দেওয়ার পর তার জ্ঞান ফিরল। তিনি আকুল গলায় বললেন, আমার কি বাঁচার কোনো আশা নেই? 
স্বাস্থ্যসচিব কাচুমাচু মুখে বললেন, এই তেলাপোকা রোগের চিকিৎসা এখনো বের হয়নি স্যার। তবে চিন্তা করবেন না, বিজ্ঞানীরা একদিন ঠিকই এর চিকিৎসা বের করে ফেলবে, তবে ততদিন আপনি বেঁচে থাকবেন কিনা তা বুঝতে পারছি না! 
স্বাস্থ্যমন্ত্রী অসহায় ভঙ্গিতে চিৎকার করে বললেন, আমাদের চিকিৎসাসেবা আন্তর্জাতিক মানের। যেভাবেই হোক একটা বুদ্ধি বের করেন। নইলে সবার চাকরি নট!
মন্ত্রীর ব্যক্তিগত ডাক্তার মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললেন, একটা চিকিৎসা আছে স্যার, এটা প্রয়োগ করলে নিশ্চিত তেলাপোকা মারা পড়বে! 
মন্ত্রী চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বললেন, এতক্ষণ বলেননি কেন? কোন ঘোড়ার আন্ডা ভাজছিলেন? এক্ষুনি চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। এই চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে একটা ফিচার লিখে আন্তর্জাতিক জার্নালে পাঠিয়ে দেন। বিশ্ববাসীর উপকার হোক। পদ্ধতিটা কী?
কিছু না স্যার, আপনাকে বিষ খেতে হবে। বিষ খেলে আমি নিশ্চিত তেলাপোকা মারা পড়বে, তবে আপনি বেঁচে থাকবেন কিনা তা বুঝতে পারছি না! 
মন্ত্রী আবার ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেন। কিছুক্ষণ কোঁত কোঁত শব্দ করলেন। কোঁত কোঁত করতে করতেই বললেন, আমাদের চিকিৎসাসেবা আন্তর্জাতিক মানের হলেও আমাদের দেশের বিষ আন্তর্জাতিক মানের না। বাজারের বেশির ভাগ বিষ নকল। আমি নাও মরতে পারি। ছাত্রজীবনে একবার আমার প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আমি বিষ খেয়েছিলাম। মরিনি। বিষ খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
স্বাস্থ্যের ডিজি বললেন, সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি লাগবে, স্যার। যেহেতু আপনি মন্ত্রী পরিষদে আছেন, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া আপনার বিষ খাওয়া উচিত হবে না। 
মন্ত্রী বললেন, আপনাদের কারও বিষ খাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে? আমি সারা জীবন করে এসেছি আলু-পটোলের ব্যবসা, বিষ খাওয়ার ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা কম। তার পরও একবার খেয়ে দেখেছি। আপনারা খেয়েছেন? আছে কারও অভিজ্ঞতা?
লজ্জিত মুখে সবাই স্বীকার করল, এর আগে বিষ খাওয়ার অভিজ্ঞতা কারও নেই। তবে অভিজ্ঞতার দরকার ছিল! 
এক সপ্তাহ পর মন্ত্রী পরিষদের মিটিং বসেছে। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিষয়টা জানানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই উপমহাদেশের সেরা হার্ট বিশেষজ্ঞ হচ্ছেন ভারতের দেবী শেঠি। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত। 
প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে এক শ এক সদস্যবিশিষ্ট কমিটির দল ভারত গেল দেবী শেঠির পরামর্শ নিতে!
সব শুনে দেবী শেঠি বললেন, আমি নিজ চোখে রোগী দেখতে চাই।
বিশেষ বিমানে করে সেই দেশে দেবী শেঠিকে উড়িয়ে নেওয়া হলো। 
দেবী শেঠি এসে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাগজপত্র সব দেখলেন, এক্স-রে রিপোর্ট দেখে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তার পর স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, মাননীয় মন্ত্রী, আপনার দেশ কাগজে-কলমে সিঙ্গাপুর থেকে উন্নত হলেও বাস্তবে বাঙ্গিপুর থেকেও পিছিয়ে আছে। 
দেবী শেঠির কথা শুনে মন্ত্রী মুখ কালো করে ফেললেন। তার কথাটা পছন্দ হয়নি। কিন্তু কী আর করা! ব্যাটা তার তেলাপোকার চিকিৎসা করতে এসেছে বলে কিছু বলা গেল না। নইলে তিনি দেখিয়ে দিতেন, তারা দেশকে কোথায় নিয়ে গেছেন। 
দেবী শেঠি মন্ত্রীর মনোভাব বুঝেও পাত্তা না দিয়ে বললেন, আসলে আপনার কিছুই হয়নি। আপনার বুকের ব্যথাটা হচ্ছে গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা। কয়েকদিন গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে। আর, আপনার বুকে তেলাপোকা দৌড়াদৌড়ি করছে না, এক্স-রে করার সময় ওটা এক্স-রে মেশিনের ওপর দৌড়াদৌড়ি করেছিল!
স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার দেশের ডাক্তারদের ডেকে বললেন, আমি না হয় আলু-পটোলের ব্যবসায়ী। আপনারা? আপনাদের সবার চাকরি নট করা হলো।
ডাক্তার সাহেবরা মন্ত্রীর কথায় গ্রাহ্য করে না। মুখ টিপে হাসে। তারা জানে, তারা নট হলে তার আগে মন্ত্রী নিজেই নট হয়ে যাবে। 
সচিব সাহেব মাথা চুলকায় আর ভাবে, দেবী শেঠি এইটা কী বলল? শালার এই বাঙ্গিপুরটা কই?
বাংলাদেশের বরিশাল নয় তো? ওখানে তো শুনেছি ভালো বাঙ্গি চাষ হয়।

সাক্ষাৎকারে মাহরুখ মহিউদ্দীন মেলার অবয়বে নতুন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি দেখতে চাই

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৫০ পিএম
আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৫০ পিএম
মেলার অবয়বে নতুন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি দেখতে চাই
মাহরুখ মহিউদ্দীন

আগামী বইমেলা নিয়ে আপনার মতামত কী?
বাংলাদেশের মানুষের জন্য অমর একুশে গ্রন্থমেলা জাতি হিসেবে আমাদের পরিচয় ও আত্মমর্যাদার একটা গুরুত্বপূর্ণ স্মারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ২০২৪-এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা যেভাবে আমাদের হৃত মর্যাদা পুনরুদ্ধার করেছি, আমি মনে করি আগামী বইমেলায় এর পরিষ্কার প্রতিফলন থাকা প্রয়োজন। আমাদের বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ থাকা থেকে শুরু করে অন্যায্যতার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, আমি মনে করি এবারের বইমেলা সেই চর্চা থেকে মুক্ত হয়ে একটি ন্যায্য প্রক্রিয়ায় প্রকাশক ও লেখকদের জন্য সুযোগ করে দেবে এবং আয়োজনে পাঠকরা সেই ন্যায্যতার প্রতিফলন দেখতে পারবেন। এবারের মেলা হওয়া উচিত অন্য আর সব বছরের চেয়ে বেশি প্রাণবন্ত, সব মত ও পথের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে যেসব ভেদাভেদ সমাজে তৈরি হয়েছে তার বিপরীত স্রোতে গিয়ে একটা ইতিবাচক ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দেওয়ার মতো একটি অভূতপূর্ব আয়োজন এবার আমরা পাব বলে আশা করতে চাই।

এবারের বইমেলায় আপনার প্রকাশনী থেকে কয়টি এবং কী ধরনের বই প্রকাশ করছেন?
ইউপিএল সাধারণত বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় গবেষণাধর্মী, সমাজ, ইতিহাস, রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থ, স্মৃতিকথা, অনুবাদ ইত্যাদি প্রকাশ করে থাকে। এবার সেই সঙ্গে কিছু সাহিত্যগ্রন্থ ও সাহিত্য সমালোচনামূলক গ্রন্থও থাকবে বলে আমরা আশা করছি।
এবারে আমাদের প্রকাশনার তালিকায় উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে থাকবে জাতীয় অধ্যাপক জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাকের ভারতের রাজনৈতিক দল (Political Parties in India-এর অনুবাদ), বিখ্যাত বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ নৃতত্ত্ববিদ ভেলাম ভান সেন্দেলের বাংলাদেশ জনপদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি (A history of Bangladesh-এর অনুবাদ), ক্লিনটন বি সিলির বই Barisal and Beyond Essays on Bangla Literature, অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদের নীল বিদ্রোহ নিয়ে বই Revisiting the Indigo Rebellion, রিচার্ড ইটনের ইসলামের উত্থান ও বাংলা সীমান্ত (রাইজ অব ইসলামের অনুবাদ), সমারি চাকমার কাপ্তাই বাঁধ: বর-পরং ডুবুরিদের আত্মকথন, রঞ্জন সাহা পার্থ, ওবায়দুল্লাহ আল মারজুক, মাসাহিকো তোগাওয়ার সম্পাদিত শরণার্থীর সঙ্গে বসবাস: রোহিঙ্গা ও স্থানীয় বাঙালির প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা, সারোয়ার তুষারের ফিলিস্তিন: একুশ শতকের উপনিবেশের ইতিহাস, সাবরিনা নার্গিস প্রণীত দুর্নীতি সম্পর্কিত আইন ও সচরাচর জিজ্ঞাসা, অধ্যাপক আবদুস সেলিম অনূদিত বিশ্বসাহিত্যের সাতটি নারীবাদী নাটক এবং আরও কিছু বই।

মেলাপ্রাঙ্গণ বা অবয়ব নিয়ে আপনার কোনো বক্তব্য আছে কি?
প্রথমে যেমনটি বলেছি, মেলার বিন্যাস ও অবয়বে আমরা নতুন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি দেখতে চাই, দেখতে চাই জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার, আর বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের আত্মপরিচয়ের নতুন অভিব্যক্তির প্রকাশ। এই ভাবনা বা চাওয়াটা হয়তো অনেকখানিই বিমূর্ত, কিন্তু আয়োজনের নেতৃত্বে যারা থাকবেন তারা আন্তরিকভাবে চাইলে এর রূপায়ণ সম্ভব বলে আমি মনে করি।

আগের তুলনায় বই বিক্রয় কি কম?
আমাদের দেশের পাঠক নানান মাধ্যমে বই পড়েন, তাই মুদ্রিত বইয়ের বিক্রি হয়তো খানিকটা কমে গেছে। এ ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি করোনা মহামারির পর থেকে এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক হয়নি। এখনো আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী। সবকিছু মিলিয়েই হয়তো বই বিক্রিতে কিছু প্রভাব পড়ছে।

আপনি কি বর্তমানে মানসম্মত পাণ্ডুলিপির অভাব বোধ করছেন?
ভালো পাণ্ডুলিপি সবসময়ই সংখ্যায় কম। তবে আমরা বেশ কিছু ভালো কাজ প্রতি বছরই পাই এবং নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে সংগ্রহের চেষ্টায় থাকি। ভালো পাণ্ডুলিপি যেমন আমরা ভালো লেখকদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করি, তেমনি একটা সম্ভাবনাময় পাণ্ডুলিপি তৈরির দায় অনেকটা প্রকাশকের ওপরও বর্তায়।

বইমেলায় কী ধরনের বই বেশি বিক্রয় হয়?
বইমেলায় সব ধরনের বই-ই বিক্রি হয়। ছোটদের বই ও সাহিত্যের পাশাপাশি ধীরে ধীরে ইতিহাস, রাজনীতি ও অন্যান্য মোটিভেশনাল ননফিকশন বইয়ের চাহিদা বাড়ছে। মেলায় কী ধরনের বই বিক্রি হচ্ছে তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া গেলে নির্দিষ্ট করে বলা যেত।
ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।

প্রকাশক: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)

কবি

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৪৪ পিএম
কবি

বৃষ্টির ফোঁটার আহ্বানে মিশে
কথাগুলো ভিজে যায় অগোচরে,
হারিয়ে যায় সোনামুখী রোদ 
নিয়মের রুটিন মেনে,
আকাশের রঙ-রূপ মুছে গিয়ে 
মায়াবী এক রাতের শুরু,
জেগে থাকে রাত চাঁদের আলোয় 
জেগে থাকে ঘর জানালা খুলে
চলে কবিতাপাঠের আসর
আর লেখার উন্মাদনা,
ভুল ঘরে জন্ম নেওয়া কবির কলম
অনবরত লিখে যায়, 
লিখতে লিখতে থেমে যায়
যখন ঘুমিয়ে যায় রাত
যখন জেগে ওঠে ভোর।

চিত্রকল্প

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৪৩ পিএম
চিত্রকল্প

কল্পনায় ছবি লিখি শব্দের বিন্যাসে
বাস্তবতা কিছু যদি উহ্য থেকে যায়
ব্যপ্তির বিচিত্র ঘ্রাণ আত্ম প্রয়োজনে
অব্যক্ত অনুভবে তা দেখে যেতে হয়
ভাবনার চিত্রভাষা দূরত্বের পথে
স্পর্শও উপচে পড়ে তেজস্বী ছোঁয়ায়
প্রেমের সংযোগ ঘটে হৃদয়-প্রবাহে
শ্লথক্লান্তি অবিবেচ্য থাকে- থেকে যায়

হারালে দ্বিত্বের মোহ বিচ্ছেদ প্রকাশে
বিভ্রান্ত আলোক-ভাষ্য যথেষ্ট অচল
তখনি মুহূর্ত শুরু। ভালোবাসা এসে
ভাসিয়ে রাঙিয়ে দেয় দগ্ধ চরাচর
মনের সকল বাঁক, অভিসারপ্রীতি
শরীরে শরীর মিশে চিত্রকল্প হয়