রবীন্দ্রোত্তর যুগের অবসান ঘটলে বাংলা উপন্যাসে শুরু হয় তিন বন্দ্যোপাধ্যায়- বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর ও মানিকের উপন্যাসচর্চার কাল। সোনালি সেই পর্ব পেরিয়ে সতীনাথ ভাদুড়ী, আশাপূর্ণা দেবী, সন্তোষকুমার ঘোষ, বিমল কর, রমাপদ চৌধুরী, গৌরকিশোর ঘোষ, সমরেশ বসু, মহাশ্বেতা দেবী, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ও অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধারাবাহিকতায় চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে আবির্ভাব ঘটে আরও কয়েকজন প্রতিভাবান ঔপন্যাসিকের। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, নবারুণ ভট্টাচার্য, সুবিমল মিশ্র, সমরেশ মজুমদার প্রমুখ।
এই যে ঔপন্যাসিকদের কথা বলছি এদের সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রটি হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু ওই একই সময়ে বাংলা উপন্যাসের চর্চা পূর্ববঙ্গেও প্রবহমান ছিল। বিশেষ করে ভারত বিভাগের পর পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে আমাদের উপন্যাস পশ্চিমবঙ্গের সমকালীন ঔপন্যাসিকদের প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক, শওকত আলী ও সৈয়দ শামসুল হকের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। কিন্তু আমার আজকের লেখার প্রসঙ্গ সমগ্র বাংলা উপন্যাস নয়, আমি আলোকপাত করব শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ওপর। লক্ষ করলে দেখা যাবে, যে ঔপন্যাসিকদের কথা আমি বলেছি তাদের মধ্যে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এখনো লেখালেখিতে সক্রিয় রয়েছেন।
২
সমকালীন উপন্যাসের কাছে পাঠক কী প্রত্যাশা করেন? এরকম একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে মিলান কুন্ডেরা বলেছিলেন, ‘ব্যক্তির আত্মসত্তার অন্তর্গত জীবনের উন্মোচন ঘটিয়ে থাকেন ঔপন্যাসিক।’ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও তার উপন্যাসে অস্তিত্বের অন্বেষায় জীবনকে খুঁজে ফেরেন। একটা সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘জীবনকে আঁতিপাতি করে খুঁজতে গিয়েই লিখে চলেছি আজও। হয়তো সমাধান দিতে পারি না, কিন্তু প্রশ্ন থাকেই। এই প্রশ্ন, নিজের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তাই মনুষ্যত্বের খানিকটা ভাগিদার করে রেখেছে আমায়।’ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের এই যে অন্বেষণ, লক্ষ করলে দেখা যাবে, জীবনকে ছাড়িয়ে অস্তিত্বের অনুভবে ছড়িয়ে পড়তে চায়।
শীর্ষেন্দুর প্রথম প্রকাশিত রচনা একটা গল্প- ‘বিকেলের মৃত্যু’। এর পর তার বেশ কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয়। শুরু থেকেই অস্তিত্বকে খুঁজে ফেরার আর্তি তার লেখালেখির অন্বিষ্ট হয়ে ওঠে। জীবন থেকেই এই অভিজ্ঞানের অধিকারী হয়েছিলেন তিনি।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৫ সালে, সেকালের বিক্রমপুরে। ময়মনসিংহ শহরে কাটে জীবনের প্রথম এগারো বছর। বাবার ছিল রেলের চাকরি, তাই প্রায় ভ্রামণিক জীবনের স্বাদ পেয়েছিলেন তিনি। আসাম, বিহার, জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, কাটিহার, মাল জংশন, দমহানি, ইত্যাদি নানান জায়গায় থেকেছেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে পাস করার পর পড়াশোনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্কুলশিক্ষকতা দিয়ে পেশাগত জীবনের শুরু। পরে ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় যোগ দেন। দীর্ঘকাল ‘দেশ’ পত্রিকায় চাকরি করেছেন। বিচিত্র জনপদ আর বিচিত্র মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি।
৩
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’ (১৯৬৭)। এর নায়ক শ্যামের মাধ্যমে যে জীবনের কথা পাই, সে-জীবন অবক্ষয়, নৈরাশ্য আর অন্তঃসারশূন্যতায় ক্ষয়ে যাওয়া আধুনিক জীবন। উপন্যাসটি ভোগবাদী জীবনকে অতিক্রম করে মহাজাগতিক এক জীবনের সন্ধান দেয়। শীর্ষেন্দুর উপন্যাসের এটি হচ্ছে প্রধান লক্ষণ। জাগতিক জীবনকে তিনি মহাজাগতিক জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেন। তার উপন্যাসকে তাই ‘কসমিক’ লক্ষণাক্রান্ত বললেও ভুল হবে না। জীবনের শুরুতেই তার মধ্যে ভর করেছিল বিষাদ। এই বিষাদ জাগতিক ছিল না। তিনি নিজেই জানাচ্ছেন, ‘দু-কোটি টাকা জমল না, এমন জাগতিক বিষাদ নেই আমার। কিন্তু আমি কোথা থেকে এলাম, কোথায় যাব, মহাবিশ্বের সঙ্গে আমার যোগটাই-বা কী, এইসব প্রশ্ন তাড়া করে আমায়।’
ভারতীয় দর্শনের এই প্রতিফলন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসকে দিয়েছে বিশিষ্টতা। ঈশ্বর, আধ্যাত্মিকতা ও পুনর্জন্মে প্রবল বিশ্বাস তার। ‘পারাপার’ উপন্যাসের লোলিতের শিশু হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসার মধ্যে তার সেই ভাবনার প্রতিচ্ছবি দেখা যাবে। একটা সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আত্মাকে অধিকার করে যা কিছু আছে, সেটাই তো আধ্যাত্মিকতা। নিজেকে জানাটাই আধ্যাত্মিকতা।’ একেবারে গ্রিক দর্শনের প্রতিধ্বনি পাচ্ছি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথায়- ‘নো দাইসেলফ্।’ কথাটা প্রথম বলেছিলেন সক্রেটিস। পরে পাশ্চাত্যের সমগ্র চিন্তনবিশ্বে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই অভিজ্ঞানটি নানাভাবে আলোচিত ও বিবৃত হয়েছে।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ‘মানবজমিন’। অসংখ্য চরিত্র, বিস্তৃত ঘটনা, জটিল নানান সমস্যাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এর আখ্যান। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের টানাপোড়েন, স্বপ্ন ও বাস্তব, ঘাত-প্রতিঘাত, বেদনা ও বাঁচবার বাসনা; প্রেম, ঘৃণা, অবিশ্বাস, জৈবিক তাড়না, উচ্চাকাঙ্ক্ষা- সবমিলিয়ে মানবজীবনের বহুমাত্রিক প্রান্তকে একসূত্রে গেঁথে তুলবার অসংখ্য ঘটনার চমকপ্রদ সমাবেশ ঘটেছে এই উপন্যাসে। নানা ধরনের মানুষের বিচরণ ঘটছে এই পৃথিবীতে, এই মানবজমিনে।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হচ্ছে- ‘পারাপার’, ‘কাগজের বউ’, ‘পার্থিব’ ইত্যাদি। সাহিত্যচর্চাকে শীর্ষেন্দু সাধনা বলে মনে করেন। এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘লেখালেখিটা ঠিক কলাকৌশল নয়। এই শিল্পগুণ ভিতরে থাকতে হবে। তার পর নিরলস সাধনা করে যেতে হবে।’
ঘটনাবহুল বাইরের জগৎ কীভাবে মানুষের অন্তর্জগৎকে নির্মাণ করে দেয়, শীর্ষেন্দু তার উপন্যাসে ও গল্পে সে কথাই বলতে চেয়েছেন। জীবন সরল নয়, জটিল; কিন্তু একেবারে লক্ষহীন নয়। অস্থিরতার শেষে বিশ্বাসের ভূমিতে মানুষ স্থির হয় অথবা হতে হয়। এই আস্তিক্যবোধই শীর্ষেন্দুর উপন্যাসের শীর্ষবিন্দু। দেশভাগের যন্ত্রণা, মধ্যবিত্তের দুঃসহ নাগরিক জীবন, মূল্যবোধের অবক্ষয়, ব্যক্তিসত্তায় বিপন্ন জনজীবনকেই বারবার তিনি তুলে এনেছেন তার লেখায়।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় অজস্রপ্রসূ লেখক। তার উপন্যাসের সংখ্যা এখন পর্যন্ত ৮৫। ছোটগল্পের সংকলন ৩৭টি। লিখেছেন জীবনী, ভ্রমণকাহিনি, কল্পবিজ্ঞান, শিশুসাহিত্য। চলচ্চিত্রায়িত রচনার সংখ্যাও অনেক। পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ আর সাহিত্যের সর্বভারতীয় অধিকাংশ সম্মাননা- সাহিত্য অকাদেমি, বিদ্যাসাগর পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার ইত্যাদি।
ব্যক্তিগত জীবনে পুরোপুরি বাঙালিয়ানায় বিন্যস্ত তার জীবন। মাতৃভূমির টানে বহুবার বাংলাদেশে এসেছেন। বাংলাদেশ নিয়ে তার রয়েছে বিশেষ আবেগ ও ভালোবাসা। লেখালেখিতে এখনো সমানভাবে নিরলস ও পরিশ্রমী তিনি। জন্মদিন উপলক্ষ্যে সমকালীন বাংলা কথাসাহিত্যের বর্ণাঢ্য এই পরিব্রাজকের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।