নগরজীবনের মানুষের বাস্তব জীবনকে কেবলই যে বিভূতিভূষণ ব্যথা-বঞ্চনার বিড়ম্বিতরূপে দেখেছেন তা নয়। বেদনায় মলিন না হলেও এ কথা সত্য যে, সাধারণ মানুষের জীবন নিতান্তই একঘেয়ে বিবর্ণ। তবুও জীবন সম্পর্কে বিভূতিভূষণ চিরদিনই পরম আস্থাশীল। তার দৃষ্টিতে জীবন সব আপাততুচ্ছতা সত্ত্বেও কখনোই অর্থহীন নয়, বরং অপরূপ সুন্দর, অর্থবহ। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লেখা দুটি সুন্দর গল্প: ‘সিঁদুরচরণ’ (ক্ষণভঙ্গুর) ও ‘একটি ভ্রমণ কাহিনী’ (উপলখণ্ড)। এই আপাততুচ্ছ জীবনের তাৎপর্য-সন্ধান নিয়ে আরেকটি সার্থক রচনা ‘একটিদিন’ (যাত্রাবদল)। ব্যর্থ-বিড়ম্বিত জীবনের যে উত্তরণ-প্রবণতা বা গূঢ় আশাবাদের ইঙ্গিত মেলে বিভূতিভূষণ-এর গল্পে, তার মূলে আছে বঞ্চিত হতভাগ্য মানুষের জন্য অন্তহীন মমত্ববোধ।…
‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো, পার কর আমারে’। এই গানটি লিখেছিলেন কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩-১৮৯৬)। আর এই গানটি ব্যবহার করেছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়। ১৯৯১ সালে অস্কার জয় করেছিল তার ‘পথের পাঁচালী’ চলচিত্র। ভারত ছাড়িয়ে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি লাভ করেছেন। তিনি নিজে একজন শিল্পী, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। শিল্প ও জীবন নিয়ে তার ভাবনাগুলো চলচ্চিত্রে নির্মাণ করেছিলেন।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) বাংলা সাহিত্যে একজন ব্যতিক্রমী কথাকার। বিভূতিভূষণ তার সাহিত্যে জীবনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন, তাই অন্যদের মতো তিনি হতে পারেননি। তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, স্মৃতিকথা লিখেছেন। সাহিত্যের মধ্যে জীবনের আস্বাদন পেয়েছেন। তার ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’, ‘আরণ্যক’, ‘ইছামতি’, ‘দৃষ্টিপ্রদীপ’, ‘আদর্শ হিন্দুহোটেল’ অন্যতম। এই উপন্যাসগুলোর মধ্যে তিনি মানুষকে খুঁজেছেন। তিনি অসংখ্য ছোটগল্প লিখেছেন, যার মধ্যে মানুষ ও প্রকৃতি প্রাধান্য পেয়েছে। আমরা তার ছোটগল্প বিষয়ে এই দিকটির আলোচনা করব।
বিভূতিভূষণের গল্পে আমরা কয়েকটি প্রবণতা লক্ষ্য করি। প্রকৃতিচেতনা, মহাকালের স্বরূপ উপলব্ধি, অতীত দিনের স্মৃতিরস এবং আধ্যাত্মবিশ্বাস। তবে এখানে একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, বিভূতিভূষণ আদৌ জীবনবিমুখ ছিলেন না, বরং বিশ্বলোক ও মহাকালের বিশাল পটভূমিতে মানবজীবনকে নিরীক্ষণ করে, সৃষ্টির বিস্ময়কর মহিমা ও মানব জীবনের অমেয়কে, ঐশ্বর্যকে প্রকাশ করেছিলেন। তার গল্পগুলো আমাদের সংবেদনশীল করে বেদনার অপার পথের দিকে নিয়ে যায়। তিনি কল্লোলীয় জীবনদৃষ্টির বিপরীত দিকের শিল্পী। নির্জন আকাশ, মাঠ আর নিঃসঙ্গ নদীতীরের গোপন সাহচর্য তার ভালো লাগে। চিত্র ও সংগীত-ধর্মের বৈচিত্র্যময় নিসর্গশিল্পী বিভূতিভূষণ সিদ্ধিলাভ করেছিলেন তার গল্প ও উপন্যাসে।
বিভূতিভূষণ একদিকে যেমন সহজ, অকপট, অন্যদিকে তেমনই অবাধ প্রাণশক্তিতে পূর্ণ। জীবনের কঠিন বাস্তবতা সম্পর্কে তার গল্পের পাত্রপাত্রীরা যথেষ্ট সচেতন। লেখক শিল্পী বলেই কখনো মনে হয় তার সব রচনা মিলে শেষ পর্যন্ত তৈরি হয় একটি অখণ্ড ‘পথের পাঁচালী’। কোথাও নায়কের (বা স্বয়ং লেখকের) দৃষ্টিকোণ, কোথাও-বা কালের পরিবর্তনের স্রোত এই ঐক্যসূত্র রচনা করেছে। কখনো কখনো মনে হয় গল্পের সংখ্যা উপন্যাসের চেয়ে বেশি হয়েছে, অন্যদিকে ছোটগল্পের বিষয়গত বৈচিত্র্য উপন্যাসের চেয়ে অধিক পরিস্ফুট হয়েছে। তার গল্পে মানুষের প্রাধান্য বেশি, প্রকৃতি নয়।
একান্তভাবে মানুষের মানবিক পরিচয়-সন্ধানই সেখানে লেখকের অন্বিষ্ট। বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনপটে মুখ্যত মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সহজ আনন্দ-বেদনার কথা বিভূতিভূষণ তার গল্পে বলেছেন। প্রায় ৩০টি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, প্রায় দুই শতাধিক গল্পের মধ্যে বিষয়গত শ্রেণিবিন্যাস কঠিন। তবুও বিভূতিভূষণের গল্পগুলো বিশ্লেষণ করলে জীবন-জগৎ ও মানুষ সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গির কয়েকটি তাৎপর্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর প্রবণতার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বিভূতিভূষণের শিল্পীসত্তা। তার এই দৃষ্টিভঙ্গি বা চেতনা প্রবণতা-আপাত-তুচ্ছ জীবনের তাৎপর্য সন্ধান, সাধারণ মানুষের বেদনা-বঞ্চনা এবং তা থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রবণতা, স্নেহ-মমতা-মাটির তৃষ্ণা বা নস্টালজিয়া, প্রেম ও রোমান্স-চেতনা, মৃত্যুর পটভূমি-জীবনের চেতনা, কালপ্রবাহের চেতনা, অতিপ্রাকৃত চেতনা, আধ্যাত্ম-প্রবণতা, প্রকৃতি-চেতনা ও অন্যান্য।
তার গল্পগুলো পড়লে অনেক সময়েই এদের আদৌ কোনো সচেতন শিল্পসৃষ্টি বলে মনে হয় না। কিন্তু জীবন ও জগতের উপেক্ষিত বর্ণহীন উপকরণ একপাশে পড়েছিল, তা অন্য কোনো লেখকের চোখে পড়েনি। তার সার্থক গল্পগুলো জীবনের যে গূঢ় পরিচয় বা রসসৌন্দর্য সংকেত বহন করুক না কেন, তাদের বাস্তবতা, ঘটনা, চরিত্র, সংলাপ, পরিবেশ পাঠকের পুরোপুরি প্রত্যয়সিদ্ধ। পুঁইমাচা, মৌরিফুল, আহ্বান, মণ্ডুলমামার বাড়ী ইত্যাদি গল্প স্মরণীয়। ‘মৌরীফুল’ গল্পের স্বামীপ্রেমবঞ্চিতা সুশীলা, ‘পুঁইমাচা’র অকালমৃতা ভাগ্যহীনা মেয়েটি, ‘সংসার’ গল্পের নিতান্ত গরিব ঘরের অসহায় বধূ তারা, ‘ডাকগাড়ী’ গল্পের দুঃখিনী বাল্যবিধবা রাধা, ‘বিপদ’ গল্পের পতিতা হাজু- এরকম অসংখ্য নারী চরিত্র বিভূতিভূষণের গল্পের জগতে স্থান পেয়েছে ; যাদের জীবনের একটি দিকই লেখককে বিশেষভাবে নাড়া দিয়ে গেছে। সেটি তাদের বেদনার ও বঞ্চনার দিক। সাংসারিক জীবনে ব্যর্থ, দুঃখ-যন্ত্রণায় বিড়ম্বিতা অসহায় গ্রাম্য নারী চরিত্রই বিভূতিভূষণের গল্পের একটি প্রধান অংশজুড়ে আছে। নারীকে দেখেছেন তিনি গ্রামীণ জীবনের নানাস্তরে, নানারূপে। বালিকা, অবিবাহিতা তরুণী, গৃহস্থ বধূ, প্রবীণা গৃহিণী, জরাগ্রস্ত বৃদ্ধা, কন্যা, জননী, পতিতা, নানা ধরনের নারীর দুঃখ-ব্যথায় ভারাক্রান্ত অসহায় রূপের একান্ত বাস্তব প্রতিলিপি ফুটে উঠেছে বিভূতিভূষণের রচনায়।
শুধু নারীজীবনের মর্মস্পর্শী ছবি-ই নয়, গ্রামবাংলার অজস্র পুরুষচরিত্র সমাজের নানাস্তর থেকে এসে তার গল্পের জগতে ভিড় করেছে। বিভিন্ন তাদের শিক্ষাদীক্ষা, ধর্মবিশ্বাস, জীবিকা, আর্থিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা-ভূমি। এদের সবাইকে বিভূতিভূষণ ঐকান্তিক সংবেদনা ও বাস্তবনিষ্ঠা নিয়ে চিত্রিত করেছেন। এদের মধ্যে আছে মুসলমান দিনমজুর ফকির, হাটের জুয়াড়ি, দরিদ্র হাতুড়ে চিকিৎসক (মনি ডাক্তার), বৃদ্ধ পুরোহিত (সংসার), পাঠশালার পণ্ডিত, কবি (শাবলতলার মাঠ) প্রভৃতি অতি নগণ্য মানুষের দল। এরা সবাই কোনো-না কোনোভাবে বঞ্চিত, ব্যর্থ। এদের অধিকাংশের আর্থিক দুর্গতির অন্ত নেই, সামাজিক কোনো প্রতিষ্ঠা নেই।
বিভূতিভূষণের গল্পেও নরনারীর প্রেমের আনন্দ-বেদনা লেখকের আপন ব্যক্তিত্বের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিত্বের সেই বিশিষ্ট দিকটি হলো দেহচেতনা ও যৌনতার বর্জন। তার আধ্যাত্মমুখী মন কোনো কোনো গল্পে নারীর ব্যর্থ প্রেমকে মহত্তর দিব্য সাধনার পথে উত্তীর্ণ করে দিতে চেয়েছে- ‘অভিমানী’ (কুশল পাহাড়ি) গল্পের রাখনি চরিত্র এদিক থেকে একটি অনুপম সৃষ্টি। আবার দাম্পত্য প্রেমমূলক গল্পগুলোও দুটি নরনারীকে- দুজন ব্যক্তিকে আশ্রয় করেই রূপলাভ করেছে। সেই প্রেমের সঙ্গে পারিবারিক বা সামাজিক জীবনের অন্য কোনো সমস্যাকে জড়িত করেননি লেখক।
কেবল ব্যক্তিহৃদয়ের বিচিত্র ঐকান্তিক অনুভূতি-ব্যর্থতা, বিষণ্ণতা ও আত্মত্যাগের নিঃশব্দ ব্যঞ্জনা গল্পের মধ্যে মর্মরিত হয়েছে। এ ছাড়া অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে গল্প লিখেছেন তিনি। ছোটগল্পের দর্পণে প্রতিফলিত বিভূতিভূষণের শিল্পীব্যক্তিত্বের স্বরূপ। প্রকরণের দিক থেকেও ছোটগল্পের কেন্দ্রীয় সংহতি বিষয় ও ভাবের একমুখীনতা, অবয়বের দৃঢ়বদ্ধতা ইত্যাদি যথেষ্ট পরিস্ফুট। সব মিলিয়ে বলা চলে যে, গল্প-শরীর গঠনের দিক থেকে বিভূতিভূষণ ত্রুটিহীন নিশ্চয় নন, কিন্তু নিঃসন্দেহে তুলনাহীন। তার ভাষা এত সহজ ও ভারহীন, একই সঙ্গে আশ্চর্য স্বচ্ছ, যেন স্ফটিক-স্বচ্ছ জলধারার মতো। এই ভাষার মধ্যদিয়ে লেখকের চিত্তকে অতি সহজেই প্রত্যক্ষ করা যায়। লেখকচিত্তের সঙ্গে পাঠক-মনের যোগ এর ফলেই একান্ত সহজ ও অবাধ হয়। জয়তু বিভূতিভূষণ!