গত সংখ্যার পর
কথা বলার ফাঁকে মুক্তিবাহিনীর একজন জিজ্ঞেস করেন- আপনার হাসপাতালে এখন মোট কতজন নির্যাতিত মহিলা আছে, স্যার? এরা কোন কোন অঞ্চলের?
সঠিক সংখ্যা বলা তো মুসকিল। তবে হাসপাতালের রেজিস্টারে সবারই নাম-ঠিকানা আছে। কিন্তু সংকটও আছে- বেশির ভাগ মেয়েই তাদের ঠিকানা গোপন রাখতে চায়। অনেককে চিকিৎসার পর ছেড়েও দেওয়া হয়েছে। ওরা রিফিউজি ক্যাম্পে গেছে। কারও কারও আত্মীয়স্বজন এসে নিয়ে গেছে। সম্ভবত এখনো তিন শ-এর মতো আছে। কিন্তু সবার কেস সমান নয়। তোমরা যে মেয়েটির কথা শুনেছ সে খুবই ক্রিটিক্যাল। আমরা চেষ্টা করে চলেছি, ভগবান যদি সহায় হন।
সার্জন দত্তের কামরায় চা-নাশতার পর্ব চলছিল। হঠাৎ দেখা গেল মুক্তিবাহিনীর একজন সদস্য প্রচণ্ড ইমোশনাল হয়ে খাবারের প্লেট দূরে সরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সার্জন দত্ত ওর দিকে তাকিয়ে বললেন- উঠ না তুমি, বোস, প্লিজ, যা কিছু একটা মুখে দাও?
কিন্তু ছেলেটি জোরে কেঁদে ওঠে। সে কান্নার শব্দে চারদিকের বাতাস ভারি হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের খাবার সরিয়ে রাখে অন্যরা। ওদের দুজন আসন ছেড়ে সহযোদ্ধাকে শান্ত করার চেষ্টা করে।
কিন্তু ছেলেটি শান্ত হয় না। আবেগপ্রবণ হয়ে সে বলতে থাকে-
ঠিক ওই সাবিনার মতোই একটা বোন আছে আমার, আমি জানি না
আমার বোনটা কোথায় আছে, কেমন আছে। আমি জানি না আমার মা
কেমন আছে?
সহযোদ্ধাকে সামলাতে সামলাতে দলের একজন সার্জন দত্তের দিকে তাকিয়ে বলে- স্যার, কিছু মনে করবেন না, আমরা আর কিছু মুখে দিতে পারব না। আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আপনি দয়া করে মেয়েটির জন্য কিছু করুন।
সার্জস দত্তের টেবিলে খাবারগুলো পড়ে রইল। ক্রুদ্ধ, আবেগপ্রবল মুক্তিবাহিনীর দলটি ধীরে বেরিয়ে গেল।
এর কিছুদিন পর ইন্ডিয়ান রেডক্রস চিঠি দিয়ে জানাল, ওরা সাবিনার চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করবে। আগরতলার ডা. সুজিত দে, চিরকুমার মানুষ- শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ। তিনিও এগিয়ে এলেন। বুদ্ধিবিবেচনা দিলেন। সুজিত বাবু এক অসাধারণ মানুষ। ওর রবীন্দ্রপল্লির বাসভবনটি হয়ে ওঠে বাংলাদেশের সামরিক কর্মকর্তাদের প্রায় সার্বক্ষণিক ঘাঁটি।
যাই হোক, সার্জন রথীন দত্ত দিল্লি, কলকাতা, পাটনা হয়ে সপ্তাহখানেকের বেশি সময় পর আগরতলায় ফিরলেন। মনে তার অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস এখন। কেন যেন মনে হতে থাকে বড় একটি যুদ্ধে যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পেরেছেন তিনি। বাড়ি ফিরে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই হাসপাতালে হাজির হলেন সার্জন দত্ত। আনন্দিত সহকর্মীরা সহাস্যে জানাল, সাবিনার ক্ষতস্থানগুলো একটু একটু করে শুকাতে শুরু করেছে। কিন্তু ইন্টারনাল ইনজুরির উন্নতি নেই। এখনো ব্লিডিং হচ্ছে। খবর শুনে সার্জন দত্ত দৌড়ে গেলেন সাবিনার কাছে। ওর চুল ও মুখে হাত বুলিয়ে আদর করলেন।
বললেন- মারে, তুই ভাবিস নে, তোকে আমরা সারিয়ে তুলব, তুই ভালো হবি, হবিই মা। এমন আশ্বাস শুনে সাবিনার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। চোখ দুটি বড় করে বলে- বড় আব্বা, আমি কি স্কুলে যেতে পারব? বাংলাদেশ কি স্বাধীন হবে? ওই শয়তানদের কি বিচার হবে?
কেন পারবে না তুমি মা, নিশ্চয়ই তুমি স্কুলে যেতে পারবে। তোমার দেশও স্বাধীন হবে। শয়তানদেরও বিচার হবে। কয়েক সপ্তাহের চিকিৎসার পর সাবিনার শারীরিক অবস্থার আরও কিছুটা উন্নতি ঘটলে ডাক্তার দত্ত সার্জারির সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি সময় নষ্ট করলেন না।
সাবিনার মুখ, শরীর ও ক্ষতস্থানগুলো দিনে কয়েকবার নার্সরা মুছে দিচ্ছে। আগের চাইতে ওকে সুস্থ মনে হচ্ছে। অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার আগে ডাক্তার দত্ত রোগীর কাছে গেলেন, বললেন, সাবিনা মা- তুমি কিন্তু সাহস হারাবে না, আমরা তোমাকে সারিয়ে তুলবই। আমাদের কাছে তুমিই বাংলাদেশ, তোমাকে যে সেরে উঠতেই হবে, মা। এই হাসপাতালের সবাই আমরা তোমার পাশে আছি। একদম ভাববে না তুমি।
সার্জন দত্তের আবেগী কথায় সাবিনার চোখ দিয়ে পানি গড়াতে থাকে। সে একটি হাত দিয়ে ডাক্তার দত্তের হাত শক্ত করে ধরে। বলে- বড় আব্বা, তুমি আমাকে ভালো করে দাও, আমি যুদ্ধ করব, আমি ওই পশুদের মারব- একজন একজন করে মারব।
নিশ্চয়ই তুমি যুদ্ধে যাবে মা, নিশ্চয়ই তুমি যাবে। তোমার দেশের ছেলেরা পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্বে অস্ত্র ধরেছে। চারদিকে তমুল যুদ্ধ চলছে। তুমিও যুদ্ধে যাবে বৈকি। কিন্তু মা, তার আগে যে তোমাকে সুস্থ হতে হবে।
সাবিনা খানিকক্ষণ কথা না বলে ডক্টর দত্তের হাত ধরে থাকল। তার পর বলল- আমি কথা দিচ্ছি বড় আব্বা, আমি সুস্থ হব, তোমরা পাশে থাকলেই
সুস্থ হব।
এরপর শুরু হলো ডাক্তার রথীন দত্তের নেতৃত্বে শৈলচিকিৎসার ভয়ংকর এক লড়াই। প্রায় দুই মাস ধরে চলল গোবিন্দ বল্লভ হাসপাতালে লাগাতার এক যুদ্ধ। সাবিনার ক্ষত স্থানগুলো পূরণের অসম্ভব যুদ্ধ। প্রথমত, মূত্রনালি সংস্কার করা হলো। এরপর যৌনাঙ্গ সরিয়ে তোলা হলো। তারও পর মলদার সংস্কার হলো। একদল বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে প্লাস্টিক সার্জারির দুরূহ কাজগুলো সম্পাদন হলো। এই অসাধ্য সাধনে ডাক্তার দত্ত ব্যবহার করলেন পূর্ব জার্মানির প্রসিদ্ধ বার্লিন হাসপাতালের কিছু যন্ত্রপাতি, যেগুলো তিনি এনেছিলেন সেই ১৯৬৪ সালে। তাকে সর্বাত্মক সহায়তা দিলেন আগরতলার আরেক প্রসিদ্ধ ডাক্তার এইচ এস রায়।
চলবে...