শীতকাল, ঘুম থেকে জেগে ওঠে রমা। শব্দহীন চুপচাপ ঘর থেকে বেরোয়। মা জেগে গেলে যাত্রা হবে না, বাধা আসবে। মাকে ফাঁকি দিতে ভোররাতেই রওনা। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে চারটে। এখনই সঠিক সময়- ঘড়ি দেখে হিসাব করে রমা। মায়ের জন্য ভীষণ কষ্ট হতে থাকে। অনেক রাত অব্দি ঘুম আসেনি। অন্তরের কষ্ট বুকে চেপে রাখতে হয়েছে। রমেন্দ্র কুমার দাস ওরফে রমা তার নাম। বয়স একুশ ছুঁইছুঁই। এলোমেলো লম্বা চুল। গায়ের রং ফর্সা হলেও এই কদিনে তামাটে বর্ণ ধরেছে।
শরণার্থী ক্যাম্পের তিন দিনের অভিজ্ঞতায় বৃদ্ধা মাকে ওখানে রেখে আসা ছাড়া উপায় ছিল না ওর। এটা অবশ্য পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা।
এক সময় সংসার বলতে ছিল রমা, নববিবাহিত স্ত্রী কবরী আর তার মা। বাবাকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছে। কবরীকে ধরে নিয়ে গেছে পাকবাহিনী। গায়ে দিয়েছে আগুন। নারী-পুরুষ-বউ-ঝি-শিশু-কিশোর সবাই পালিয়েছে। এসব ঘটনার পরদিনই সুনামগঞ্জের ভাঙ্গাডহর থেকে পূর্বপুরুষের ভিটে ছেড়ে ভারতের মেঘালয়ের পাদদেশে এসে থামতে হয়েছে ওর।
পুরো ছয়দিন রাস্তায় কেটেছে, নৌকা, পায়ে হাঁটা পথ আর মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ। মায়ের ঠিকানা এখন মৈলাম ক্যাম্প। তাকে তো ট্রেনিংয়ে যেতেই হচ্ছে। কিন্তু বউ? বউ যে তার আত্মা। বউকে ভুলে যাওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা করার পরও বারবার মুখখানি উঁকি মারছে চোখে। মায়াময় সেই দুটো ছলছল চোখ। মেয়েদের পোড়াপ্রাণে স্বামী শাসক হলেও তার এখন যেন উল্টোটা হচ্ছে। এই মুহূর্তে রমার মনে হয় জীবন ও যৌবনরাজ্যে কবরীর স্থান অতি উচ্চে।
ঝুপড়ি শিবিরে কনকনে রাত পেরিয়ে যখন ভোরের আলো ফোটে, তখনই রওনা দেওয়ার কথা ছিল তার। শীতবস্ত্রের বদলে আগুনই এখানে শীত নিবারণের একমাত্র ভরসা। দু-চারজনের থাকলেও, অধিকাংশ শরণার্থীর ঘরেই নেই শীত ঠেকানোর ব্যবস্থা। তাই দিনের বেলায় কুড়িয়ে আনা লাকড়ির পরিত্যক্ত অংশ জ্বালিয়ে কোনোরকমে শীত থেকে বাঁচার উপায় খোঁজার চেষ্টা অসহায় মানুষগুলোর। রমার বস্ত্র বলতে পরনের একখানি লুঙ্গি আর গায়ে হাফহাতা শার্ট। প্রচণ্ড শীত, শরীর কাঁপছে; তবু ট্রেনিংয়ে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়ায় লম্বা সড়কের কিনারে।
হঠাৎ অচেনা একটি লোক এসে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কি রমা?’ মাথাসমেত হাঁটুঅব্দি লম্বাকোট পরা মানুষ।
লোকটির দিকে চোখ বুলিয়ে ‘হাঁ’ শব্দটি মুখে উচ্চারণ না করেও আস্তে মাথা নেড়ে বুঝাল, সঠিক।
রমা আবারও তাকাল চেহারার দিকে।
রং ফর্সা, গোল মুখ। সত্তরোর্ধ্ব লোকটি কাপড়ের পুঁটলি দিয়ে বলল, ‘এগুলো তোমার।’
গায়ের চাদর আর গরমকাপড় পেয়ে প্রাণ ফিলে পেল শীতবস্ত্রহীন রমা।
খুশি হলো। হাঁ-না প্রশ্ন করল না রমা। কথা বলতেই কি ভুলে গিয়েছিল? নিজেকেই জিজ্ঞেস করে- লোকটি কে? কিছুক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকল লোকটির দিকে। নীরবে চলে যাচ্ছে কোটপরা কুঁজো লোকটি।
সুধারাম বলেছিল- শীতবস্ত্র পাবে। তোমাকে দিয়ে যাবে একজন। তবে কী এ-ই লোক? রমা রাস্তা ধরে সামনের দিকে হেঁটে হেঁটে সুধারামের অপেক্ষা করে। সে-ই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে লক্ষ্যে।
এই মুহূর্তে চলতি পথেও রমাকে ভাবায় ওর স্ত্রী কবরী। মন উচাটন করে, কখনো দুচোখে পানি ভরে ওঠে। বিয়ের কয়েকদিন পরই যেন আরও সুন্দর হয়ে উঠেছিল। অধিক উজ্জ্বল হয়েছিল গাত্রবর্ণ। টানাটানা চোখ দুটো যেন আরও পরিষ্কার, আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। পরনে সাদা-নীল ফুলে আঁকা লালপেড়ে শাড়ি পরার পর চোখ সরাতে ইচ্ছে করত না রমার। সম্ভবত সৌন্দর্য এমন একটি জিনিস যা হাতে ধরা যায় না। এমনকি এখনো কনে দেখার মুহূর্তটি কোনোভাবেই চোখ থেকে সরতে চায় না।
কবরীদের বাড়ি ছিল অতি সুন্দর। চারদিকেই কী সবুজ। সে কি ভোলা যায়! আম, জাম, কাঁঠাল তো আছেই, এর বাইরে নাম না-জানা অসংখ্য গাছগাছালি। কী স্নিগ্ধ। চোখ জুড়িয়ে যেত সেই গ্রামের দৃশ্য। বাড়িতে পৌঁছবার মুহূর্তে রমা দেখল- ছোট সরু রাস্তা। মাঝে মাঝে কচুরিপানাভর্তি খাল। ছোট ছোট পানাপুকুর, সরু সরু গ্রাম্য রাস্তা।
এর পর পাত্রী দেখার বড় রকমের আয়োজন বাড়িময়। টিনের ছাউনি, কাঠের বাড়িঘর, ফুল, লতাপাতা আঁকা দরজা। বৈঠক ঘরের জানালায় নারীদের উৎসাহী, উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত মুখ। পাত্রী দেখা ও আপ্যায়নের আয়োজন করা হয়েছে ওখানেই।
সারবাঁধা চেয়ার, জলচৌকি আর বেঞ্চ পাতা ঘরে। নেচে নেচে উঠছে সেসব দৃশ্য।
চেয়ার টেনে বসতে বসতে প্রতিবেশী ষাটোর্ধ্ব বয়সী ছালাম মাতবর বললেন, ‘দিনের অবস্থা ভালো নয়। আকাশে মেঘ জমেছে। যা করবার তাড়াতাড়ি।’
রমার চেনাজানা বন্ধুবান্ধব এসেছে। বিবাহের প্রথম পর্ব এটি। জীবনের এই অধ্যায়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ছেলের পাত্রী দেখতে এসেছেন রমার বাবা। তিনিও সায় দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, আকাশে কয়দিন থেকে যেন মেঘ বাসা বেঁধেছে।’
পাত্রীপক্ষের অভিভাবকমণ্ডলীর একজন বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘আজ্ঞে, আপনারা যদি দয়া করেন তাহলেই মঙ্গল। যেভাবে বলবেন সেভাবেই হবে। আমাদের সবকিছু তৈরি।’
ঝাঁকবাঁধা শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী ঠেলে ফাঁকা করা হলো ঘরে ঢোকার জায়গা। এর পর লালশাড়ি পরিয়ে বউ বউ ধরনের সাজগোজ করে পাত্রীকে সামনে আনা হলো।
‘নাম।’
‘কবরী।’
পাত্রীর গড়ন দেখেই তৃপ্তির হাসি খেলল প্রধানসঙ্গী ছালাম মুরুব্বির মুখে।
‘দাঁড়াতে হবে, আমাদের দাঁড়িয়ে দেখাতে হবে।’
কবরী দাঁড়াল। ছালাম মাতব্বর বললেন, ‘হাঁটাচলা দেখি।’
কবরী ঘরেই দুটি চক্কর দিয়ে হাঁটল।
ছালাম মুরুব্বির মন্তব্য, ‘দারুণ ফিগার। এবার বসো।’
কবরী বসল।
বরপক্ষের একজন বলল, ‘উঁহু, মুখচোখের গড়ন দেখতে হবে। কপাল-মুখ এত ঢাকাঢাকি কেন?’
অভিভাবকমণ্ডলীর দিকে তাকাল কবরী। আড়াল থেকে কেউ হাঁ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। কবরী কপাল-মুখ খুলে দেখাল।
‘দাঁত দেখাও?’ বরপক্ষের কেউ একজনের কণ্ঠ।
‘খুব সুন্দর। অবশ্য মেয়ের বয়স কম।’ দাড়ি হাতাতে হাতাতে ছালাম মুরুব্বির মন্তব্য।
কনের অভিভাবকমণ্ডলীর মধ্যে থেকে প্যান্ট পরা এক প্রৌঢ় উচ্চারণ করলেন, ‘সতেরো। কলেজে ভর্তি হইছিল।’
সড়কের কিনারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে অতীতে ডুবে গিয়েছিল রমা।
বিরাটাকৃতির পাথরটির পাশেই দাঁড়ানো সে। জায়গাটি অচেনা। শনাক্ত করার একমাত্র উপায় পাথর আর কিছু কিছু পাহাড়ি গাছ। এখানেই আসার কথা মুক্তিযোদ্ধা সুধারামের। কিছু একটা ভেবে স্বগতোক্তির মতো রমা উচ্চারণ করল, এখানেই অপেক্ষা করব।
ভোরের আলো ফুটে এখন দিন শুরু হতে যাচ্ছে। দেখা গেল, এক যুবতীর কোলে দুই বছরের শিশু। পাশে আরেকটি পাঁচ বছর বয়সের কন্যাশিশু, প্রস্রাব করছে রাস্তার ওপাশে, পিঠছেঁড়া জামা। কোলের শিশুটি সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, চোখ-মুখ দেখেই অনুমান করা যায়। সড়কের পাশে বসে অপেক্ষা সুধারামের। কয়েক মিনিট পর রমা আবারও হাতঘড়ি দেখে, সাড়ে ছ’টা।
সুধারাম এল আচমকা। যাতে শীত স্পর্শ না করতে পারে, পোশাক সেভাবেই পরা তার। ত্রিশ বছরের তরুণ। মাথা-গলায় হলুদ-লাল রঙের মাফলার দিয়ে প্যাঁচানো। মুক্তিযুদ্ধে নাম-ঠিকানা লেখানোর সব রাস্তাঘাট মুখস্থ। এসেই তাড়া দিয়ে বলল, ‘চল, বেলা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের তো ৭টায় পৌঁছাতে হবে। মৈলাম ক্যাম্পেই বাইজা গেল সাড়ে ৬টা।’
রমা বলল, ‘আমি যথাসময় এসেছি। কখন থেকেই অপেক্ষায় আছি!’
‘দেরি হয়ে গেল, মায়ের জন্যি। তাকে কোনোভাবেই বোঝাতে পারি না। আমি ফিরে আসব বিশ্বাস নেই তার। বুঝলে রমা, মা তো? নরম মন, মায়ায় ভরা। নারীরা মায়ের জাতি।’
‘হু’। শব্দ করে উত্তর দেয় রমা। হাঁটা শুরু করার একটু পর রমা জানতে চাইল, ‘আমরা কই যাব পয়লা’।
‘হাঁটো জোরে জোরে, এখন কোনো কথা না।’
রমা উত্তর করে না। হাঁটতেই থাকে। রাস্তা শেষ হয় না। নববিবাহিতা স্ত্রীর মুখটি আবার ভেসে ওঠে। দুই সপ্তাহ কেটেছিল কবরীর সুখ-সংসার। এর মধ্যেই কত কী। পিঠে হাত রেখে শ্বশুর বলেছিলেন, ‘বাবা, হগ্গল বাপের কাছেই তার কন্যা ভালো, উত্তম। তবে আমি বেশি কিছু বলব না, খালি বলব, তুমি ঠকবা না। যদি কখনো-সখনো আমার কবরী ভুল করেই ফেলে, ক্ষমার চোখে দ্যাখবা। মাইয়া আমার মিশুক, সহজ-সরল, হাসি-খুশির।’
রমা মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, ‘কষ্ট দেব না।’
শ্বশুর বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ বাজছে বইলা কাজটা তাড়াহুড়ো করে করছি। কওন তো যায় না।’
রমা মাথা ঝাঁকিয়েছিল হাঁ ভঙ্গিতে।
‘আমার আচানক মেয়ের দিকে খারাপ মাইনষের চোখ পড়েছে।’
রমার জবাব ছিল, ‘আপনি ভাববেন না, ওরে সুখে রাখব। কমতি হবে না।’
‘বাবা-রে ভাবতে চাই না কিন্তু মনটা ভাবে, কান্দে। এই আর কী। তুমি আমার ভরসা।’
রমা এদিনই ভালো করে তাকিয়ে দেখেছিল শ্বশুরকে। বয়স পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন। চোখে পুরু চশমা। ভরা বর্ষাকাল। বিদায়বেলা, নৌকায় দাঁড়িয়ে দুজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিল। চোখে দুজনেরই অনিশ্চয়তার ছায়া। নৌকা ছাড়ার আগ মুহূর্তে অর্থাৎ বিদায়কালে রমা শ্বশুরকে শেষ কথা বলেছিল, ‘এত চিন্তা করবেন না। আমি আছি না?’
সুধারামের কাশির শব্দে রমা সম্বিৎ ফিরে পেল।
‘ঘন কুয়াশা পড়ছেরে রমা।’
সুধার এমন কণ্ঠে হাঁ-না মন্তব্য না করে রমা জানতে চাইল, ‘আর কত দূর?’
‘আইসা পড়ছি, ওই তো দেখা যায়।’ আশ্বস্ত করে সুধা।
রমা সামনে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না, বুঝলও না। ডানে-বায়ে শুধু শরণার্থী শিবিরের লম্বা সারিসারি ঘর চোখের সামনে।
রমা জানতে চাইল, ‘এটা কত নম্বর ক্যাম্প?’
হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দেয় সুধারাম, ‘পাঁচ নম্বর।’
প্রচণ্ড শীত। রমার মনে পড়ে, এক কাপড়ে মাকে নিয়ে গ্রাম ছেড়েছিল সে। গরম কাপড় তো দূরের কথা, কোনো কিছুই মাকে দিয়ে আসতে পারেনি। বাড়ি থেকে প্রাণ নিয়ে আসাটাও ছিল দুরূহ। তিন দিন অনাহারে কেটেছে। ছিল, প্রতিমুহূর্তে যমদূতের আতঙ্ক।
সুধাকে অনুসরণ করতে করতে বিরক্ত হয় রমা। তবু প্রকাশ করে না ক্ষোভ, কষ্ট- দুঃখ। কেউ বলে দেয়, ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে এসবের কোনোটিই নয়।
নতুন রাস্তার অদূরে ত্রিপলের ছাউনিঘেরা ত্রাণকেন্দ্রের পাশে ধানি জমিতে নতুন করে ঘর তৈরি করতে দেখা যাচ্ছে চারজন নানাবয়সী পুরুষকে। শুধু ঘরের ছাউনি দিতে পেরেছে তারা। দাঁড়িয়ে-বসে থাকা নারী-শিশুরা শীতে কাঁপছে। বাঁশের বেড়া ও দুটি ত্রিপল মাটিতে পড়ে আছে। বোঝা যায় খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান সবকিছুই অনিশ্চিত।
রমা জানতে চায়, ‘সুধাদা ওরাও মনে হয় রাইতে আসছে। তাই না?’
‘হু, খুব কষ্টে আছে বাইচ্চারা?’ মুখ ঘুরিয়ে শরাণার্থীদের ওপর চোখ বুলিয়ে নেয় সুধা।
‘আর কত দূর?’
‘অত অস্থির হইলে চলব?’ বিরক্ত কণ্ঠে সুধারামের জিজ্ঞাসা।
‘শীতে পা হিম হয়ে আছে!’
কয়েক মিনিটের মাথায় সুধা থেমে গেল। শরণার্থী শিবিরের মাঝখানে একটি ছোট্ট চায়ের দোকানের পাশে বেঞ্চ। বসে পড়ল সুধারাম। পাশের খালি জায়গাটি দেখিয়ে বলল, ‘বসো রমা। চা খাই আমরা, লোকটি এখানে আসবে।’
দোকানটি শরণার্থীদের মধ্য থেকেই কেউ বানিয়ে দিয়েছে এটি। চা-অলার আলাপে ধারণা পায় রমা।
চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে রমা বলল, ‘মুক্তিযুদ্ধে যাব, মুক্তিযুদ্ধ করব, মিলিটারিদের শক্তি শ্যাষ হবে, আর এইটাও সত্য- আমরা স্বাধীন হব একদিন।’
‘এর পর আমার কবরীরে কি পাব, সুধাদা?’
মাঝারি কণ্ঠে সুধা বলল, ‘রমা, তুমি কবরীরে নিয়া ভাবতেছ এখনো? কত কবরী প্রাণ দিয়েছে, মান দিয়েছে, শরীর দিয়েছে পাকিস্তানি মিলিটারিরে- এর সংখ্যা জানো? জানবা না কোনো দিন?’ সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ওপরের দিকে ধোঁয়া ছেড়ে সুধা বলল, ‘বিড়াল ইঁদুর ধরে খেলায়, কখনো নিজেই খেলে, আমাদের মা-বৈইনরে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি মিলিটারিরা ইঁদুর খেলা শুরু করছে, বুঝলা?’
রমা বুঝতে পারে আগ্রহ ও ভীতি মিশে আছে কথাগুলোয়। সুধার চোখের দিকে তাকিয়ে রমা সন্দেহমাখা প্রশ্ন করল, ‘আমরা পারব, দাদা?’
‘শহরে ছিলাম, আমি তো ছাত্ররাজনীতি করেছি, মিটিং-মিছিল কম করি নাই। বহু বই পড়েছি, পৃথিবীর স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস জেনেছি। কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ভিন্ন? কোনো যুদ্ধের লগে মিল নাই।’ ভেঙে ভেঙে কথাগুলো বলে সুধারাম।
‘আমরা পারব তো?’ রমা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আবারও প্রশ্নের জবাব জানতে চায়। উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না সুধারাম।
রমা চোখ ঘুরিয়ে দেখে বহু শরণার্থী খোলা আকাশের নিচে। চা-অলা বলল, ‘ঘরে ছাউনি দিতে পারে নাই ওরা। চাটাই নাই, দড়ি নাই, আলপিন নাই।’
সকাল সাড়ে ৭টা হলেও রোদের দেখা নেই। সাদা কাপড় পরা এক বৃদ্ধা চা-দোকানির কাছে এসে জানতে চাইল, ‘পানি বসাইছ?’
সুধারাম একটু দূরে গিয়ে আরেকটি সিগারেট জ্বালাল। মাথা উঁচিয়ে আছে দূরের দিকে। কাউকে যেন সে খুঁজছে।
‘দেখা যায়?’
পেছন দিকে না তাকিয়ে সুধা ‘না’ ইঙ্গিতে হাত নাড়ল।
রমা আগ্রহ নিয়ে শুনছিল চায়ের দোকানি আর বৃদ্ধার কথা। এবার নিজেই কথা শুরু করে বৃদ্ধার সঙ্গে। ‘আপনারা কবে আসছেন এইখানে?’
বৃদ্ধা বললেন, ‘বাইশ দিন হইল। কোনো গরম কাপড় নেই, একটা ঝুপড়িঘরে পরিবারের এগারো নারী ও শিশু নিয়া গাদাগাদি করে থাকছি। লগে পুরুষ মানুষ নাই একটাও। এইখানে, আসবার পথে তাদের ধরে নিয়ে গেছে পাঞ্জাবি মিলিটারিরা। রেজাকারেরা ঘরবাড়ি জ্বালাইয়া দিছে। ওগোরে আমি বাংলাদেশি জানোয়ার বলি।’
শব্দটি রমার পছন্দ হলো। ‘বাংলাদেশি জানোয়ার?’
‘রেডিও দেই নাই। লুকাইয়া রাখছিলাম। পোলাডা মুক্তিযুদ্ধে গেছে।’
শুধু বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনো আশ্বাস দিতে পারে না রমা। কী করা যায় এখন? কী-ই বা ক্ষমতা। চোখ যায় অদূরে, মেডিকেল ক্যাম্পের দিকে। চিকিৎসা নিতে এসেছেন কয়েকজন নারী। দু-একজনের কোলে ফুটফুটে শিশু। তাদের নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছেন তারা। দুই মাসের একটি ছেলেশিশুর অস্বাভাবিক কান্না। চিৎকারের সঙ্গে মায়ের কোল থেকে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করছে। রমা অনুমান করতে পারে বাচ্চাটি অসুস্থ। মায়া জাগে। এগিয়ে যায় রমা।
‘কী হয়েছে বাচ্চার?’
কাঁচাবয়সী এক নারী কয়েক পলক তাকান রমার দিকে। এর পর অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে জবাব দেন, ‘পাকসেনারা স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে। স্বামীর কোনো খবর জানা নাই। বাপ নাই বাচ্চাদের। বাচ্চারা সবাই অসুস্থ। কলেজে লেকচারার ছিলাম। এখন এতিমের মতো আমি।’
কোলের শিশুটি কেঁদে ওঠে। হাতে বিস্কুট জাতীয় খাবার তুলে দেন মা। নারী আবার কথা শুরু করেন, ‘কোলের বাচ্চাটা ঠাণ্ডা, জ্বর আর কাশিতে ভুগছে, চিকিৎসা নিতে আসছি। মেডিকেল ক্যাম্পে ডাক্তার নেই, আছে খালি নার্স।’ কথা শেষ করে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নারী অন্যদিকে মুখ ফেরান।
শিশুদের কান্নাকাটি আর হইচইয়ের শব্দ পাশের মেডিকেল ক্যাম্পে। হঠাৎ রমার চোখ থেমে গেল মেডিকেল ক্যাম্পের প্রবেশপথের দিকে। একটি মেয়েমুখ তার দিকে চেয়ে আছে, বিস্ময়ে ভরা চোখ। অসুস্থ হলেও হঠাৎ যেন দেহের সব শক্তি নিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা ওর। রমা এগিয়ে যায় মেয়েটির দিকে। চোখজোড়া যেন পরিচিত। যে চোখজোড়া দেখে রমা আকর্ষিত হয়েছিল। তবে কী কবরীর চোখ? একদার প্রিয় স্ত্রী কবরী এখানে এলো কীভাবে? ওর এমন দশা কেন? অসংখ্য প্রশ্ন, জবাব নেই। আরও কাছাকাছি হয় রমা। চিনতে ভুল হয় না।
‘তুমি কি কবরী, না?’
রমার এ প্রশ্নের জবাব নেই নারী মুখটিতে। মায়াময় মুখচোখে অব্যক্ত যন্ত্রণা। মনে হয় এ যেন শতজনমের পরিচিত কেউ।
রোগীর ওপর চোখ রেখে মধ্যবয়স্কা নার্স জবাব দেন, ‘পাকিস্তানি মিলিটারা এ নারীর ওপর এতটাই অত্যাচার করেছে যে, কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।’
‘মানে?’
‘মানে, লিখতে পারে, বলতে পারে না। লিখে জানাল ওর নাম কবরী। বাড়ি বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের দিরাই।
রমাকে খুঁজতে খুঁজতে সুধারাম মেডিকেল ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসে। চোখাচোখি হতেই রমাকে তাড়া দিয়ে সুধারাম বলে, ‘সময় হয়ে গেছে। আমাদের লোক এসে গেছে, আসো তুমি।’
‘কোথায়?’ রমার জিজ্ঞাসা।
‘কেন? যুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধে।’
‘আমার কবরীকে রেখে? স্ত্রীকে রেখে?’ রমার প্রশ্ন।
কোনোদিকেই ভ্রুক্ষেপ নেই সুধারামের। একমাত্র জবাব তার, ‘হাজার হাজার, লাখ লাখ কবরীকে বাঁচাতে হবে, দেশকে রক্ষা করতে হবে। মাটিকে রক্ষা করতে হবে। এটা আমাদের দায়িত্ব, রমা!’
‘না, আমি যাব না, সুধাদা।’
উচ্চকণ্ঠে সুধারামের জবাব, ‘ছাবালের মতো কথা বলবা না। দেরি করা যাবে না।’ রমার প্রাণে বেজে ওঠে রবীন্দ্র সংগীতের সেই দুটি চরণ- নেব সকল বিশ্ব দাও সে প্রবল প্রাণ, করব আমায় নিঃস্ব দাও সে প্রেমের দান’।