ঢাকা ১২ মাঘ ১৪৩১, রোববার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫
English
রোববার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ মাঘ ১৪৩১

রূপার জন্য

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৪২ পিএম
রূপার জন্য
অলংকরণ : নিয়াজ চৌধুরী তুলি

রূপা চলে গেছে। রূপা আমার স্ত্রী। কোথায় গেছে বলে যায়নি। একটা চিঠিও লিখে যায়নি।

ছ’বছর আমাদের বিয়ে হয়েছে। কোনোদিন এমনটা হয়নি। বরং উল্টোটাই হয়েছে। আমিই কোথাও চলে গেছি ওকে কিছু না বলে। আবার হঠাৎ করেই একদিন ফিরে এসেছি। রূপা কোনোদিন কিছু বলেনি।

রূপাকে প্রথম দেখেছিলাম শুভদৃষ্টির সময়। তার আগে কখনো ওকে দেখার প্রয়োজন হয়নি। রূপা আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমিও ওর নিষ্পলক চোখ দুটো দেখছিলাম। তার পর কীভাবে যেন ছয় বছর পার হয়ে গেল।

ছ’ছ-টা বসন্ত পেরিয়ে গেল রূপার সঙ্গে। অথচ আমাদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। রূপার এ ব্যাপারেও কোনো ক্ষোভ নেই আমার বিরুদ্ধে। রূপা কখনো বলেনি, চলো একবার ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করে আসি। আমিও বলিনি কখনো।

ঘরে রান্নার কিছু নেই, বাজারে যেতে হবে, রূপা কখনো ধমক দিয়ে আমার হাতে বাজারের ব্যাগটা ধরিয়ে দেয়নি। বলেনি, ‘ঝটপট বাজারটা নিয়ে এসো তো। সঙ্গে একটু মাছও এনো। অনেকদিন ইলিশ খাওয়া হয় না। শুনেছি এখন দামটা একটু কমেছে।’

বরং রূপা নিজেই সবকিছু করে। বাজার-হাট সবকিছু। আমাকে কিছুই করতে হয় না।
রূপার মতন একটা মেয়ে পেয়েছি বলেই হয়তো আমি এতটা নিশ্চিন্ত! কিন্তু কোথায় যেতে পারে রূপা? রূপার তো কেউ নেই আমি ছাড়া!

ছোটবেলা ওর মা মারা গেছে। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছে। রূপার মামারাও রূপাকে তেমন ভালোবাসে না। এ ছাড়া তো রূপার আর কেউ নেই! আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কেউ না!

সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই চা নিয়ে হাজির হতো রূপা। লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে আসত। পাশেই ঠাকুর ঘর থেকে ধুপের গন্ধটা ভেসে আসত। আমি চোখ বুজে একবার সেই গন্ধটা নিতাম। তার পর রূপার হাতে বানানো চায়ে চুমুক দিতাম। ততক্ষণে বারান্দার জানালাগুলো খুলে দিত রূপা। সকালের নরম রোদের আলো বারান্দা পেরিয়ে এ ঘরে ঢুকত। সেই সঙ্গে প্রচুর টাটকা অক্সিজেন। আমার গোটা শরীর সকালের মিষ্টি হওয়ায় কেঁপে উঠত। রূপা সেটা বুঝতে পারত। তাই প্রিয় নীল শালটা কখন যে আলতো করে জড়িয়ে দিত আমার গায়ে।

আমাদের বিয়ের পর প্রথমবার রূপার সঙ্গে যখন দার্জিলিং গিয়েছিলাম। তখনই রূপা পছন্দ করে আমার জন্য শালটা কিনেছিল। রূপার পছন্দের অনেককিছুই আমার সঙ্গে মিলে যায়। যেমন- নীল রংটা আমার ভীষণ পছন্দের। রূপা নীল রঙের শাল কিনল। সঙ্গে একটা সোয়েটার আর মাফলার। সেটাও নীল রঙের। সব আমার জন্য। রূপা বলেছিল, ওগুলো পরলে নাকি আমাকে ভালো মানাবে। বুঝেছিলাম, রূপা আমাকে নিয়ে সারাক্ষণ ভাবে।

বাড়ি ফিরে এসে হঠাৎ খেয়াল হলো, আরে, রূপার জন্য তো কিছুই কেনা হলো না?

রূপা এরকমই। কখনো নিজের জন্য কিছু ভাবে না। কোনোকিছু মুখ ফুটে চায়ও না। যেন আমার কাছে ওর কোনো দাবি নেই!
আজ সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি রূপা নেই। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছি। কিন্তু চা দেওয়ার কেউ নেই। সারা রাত ঘরটা বন্ধ থাকায় বাতাসগুলো ভারী হয়ে উঠেছে। অক্সিজেনের অভাবে কেমন যেন দম আটকে আসছে। অথচ দরজাগুলো খুলে দেওয়ার কেউ নেই। এতক্ষণে বোধহয় বাইরে রোদ উঠে পড়েছে। সকালের টাটকা বাতাসকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢোকার জন্য ছটফট করছে। তবু পর্দা সরিয়ে জানালা খুলে দেওয়ার কেউ নেই। ঠাকুর ঘর থেকে আজ কোনো ধুপের গন্ধ আসছে না।
কোথায় যে গেল রূপা? এত সকালে তো না বলে কোথাও বেরোয় না ও!

বিছানা ছেড়ে ঠাকুর ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। রূপা নেই। তাহলে কি ফুল তুলতে গিয়ে এত দেরি হচ্ছে?

পর্দা সরিয়ে বারান্দার জানালাগুলো খুলে দিলাম। এই প্রথম আমি একা নিজের হাতে জানালাগুলো খুললাম। সঙ্গে সঙ্গেই একটা ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে এসে ঢুকল। সকালের মিষ্টি বাতাস গোটা শরীরে দোলা দিয়ে গেল। সেই সঙ্গে অল্প অল্প শীত অনুভবও হলো। গায়ে কিছু একটা জড়ানো দরকার। কিন্তু আমার নীল শালটা কোথায়? সেটাও তো রূপা জানে। আমি তো ওসব নিয়ে ভাবিনা কখনো!

সেই সময়ই মাথাটা ধরে এল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই চা খাওয়ার অভ্যেস বরাবরের। কিন্তু আজ রূপা নেই। তাই চা খাওয়াও হয়নি। মাথাটা যেন জাঁকিয়ে কামড়ে ধরছে।

একবার ভাবলাম বাইরে দোকান থেকে গিয়ে চা খেয়ে আসি। কিন্তু রূপার কথা মনে পড়ল আবার। দোকানের চা একদম পছন্দ করে না রূপা। জানলে রাগ করবে ভীষণ। যদিও রূপাকে কখনো রেগে যেতে দেখিনি আমি। রূপা আমার সঙ্গে কখনো রেগে কথা বলেনি কোনোদিন!

এই প্রথম রান্নাঘরে ঢুকলাম আমি। রূপার সবকিছুই সাজানো-গোছানো। চায়ের কেটলি, চিনি, চা-পাতা সব হাতের কাছেই রাখা ছিল। রূপাই হয়তো সব রেখে গেছে গুছিয়ে। আমি গ্যাস জ্বালিয়ে জল বসিয়ে দিলাম। দোকানে বসে বেশ কয়েকবার রতনকে চা বানাতে দেখেছি।

এককাপ চা হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বাইরে বেলা বাড়ছে। সেই সঙ্গে রোদের তাপও চড়া হচ্ছে ক্রমশ। এতো দেরি করছে কেন রূপা?

চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে নাক-মুখ থেকে জল বের করে ফেললাম। চিনি হয়নি, লিকারটাও বেশি পড়ে গেছে। প্রথমবার নিজের হাতে চা বানিয়ে খাচ্ছি। ভুল তো একটু হতেই পারে! মনকে সান্ত্বনা দিলাম। তার পর প্রায় চোখ বন্ধ করেই বাধ্য ছেলের মতো বাকিটা গিললাম।

ঘড়ি ধরে ঠিক নয়টায় স্নান সারলাম। নীল পাঞ্জাবিটা চেয়ারের ওপরেই রাখা ছিল। পরে নিলাম। এই পাঞ্জাবিটাও রূপার দেওয়া। আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে।

মনে আছে, সেদিন অনেক রাত করে বাড়ি ফিরেছিলাম। দেখি বারান্দার একপাশে দাঁড়িয়ে রূপা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। রূপা নীল রঙের একটা শাড়ি পরেছে। নীল রঙের শাড়ি পরলে রূপাকে অন্যরকম দেখায়। কেমন যেন অন্য মেয়েদের থেকে কিছুটা আলাদা। ওকে দেখে হঠাৎ খেয়াল হয়েছিল, আজ তো তাড়াতাড়ি ফিরব বলে কথা দিয়েছিলাম রূপাকে। বলেছিলাম, সন্ধ্যাটা দুজনে একসঙ্গে কাটাব। বাইরে কোথাও ঘুরব-ফিরব, খাওয়া-দাওয়া করব। সব বেমালুম ভুলে বসে আছি। মনটা খারাপ হয়ে গেল রূপার জন্য। কিন্তু আশ্চর্য, রূপা আমার কাছে বিন্দুমাত্র অভিযোগ জানাল না। জানতে চাইল না, কেন ফিরতে এতো দেরি হলো? কেন কথা দিয়েও ওকে অপেক্ষায় রাখলাম এতক্ষণ?

রূপা শুধু আমাকে নীল পাঞ্জাবিটা ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ফ্রেস হয়ে পরে নাও। তার পর রান্না ঘরে ফিরে গেছিল নিজের মতো করে।

আজ সেই নীল পাঞ্জারিটা পরেছি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে একবার তাকাই। খুব কি খারাপ লাগছে? জানি না। রূপা থাকলে হয়তো বলতে পারত।

চোখ গেল টেবিলের ওপরে রাখা আমার আর রূপার ছবিটার দিকে। ওটাও সেবার দার্জিলিংয়ে তোলা। ম্যালে। রূপাই জোর করে পাশে দাঁড়িয়ে তুলেছিল। সেই প্রথম আমরা দুজনে ক্যামেরার সামনে। তার পর আর কোনো ছবি তুলিনি ওর সঙ্গে। রূপাও আবদার করেনি কখনো। আমিও না।

ঠিক দশটায় কলিংবেলটা বেজে উঠল। ছুটে গেলাম বারান্দার দিকে। ভাবলাম, রূপা এসেছে নিশ্চই। দরজা খুলে দেখলাম রূপা কোথায়, অল্প বয়সী ছেলেটা দুধের প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমি অবাক হলাম। ছেলেটি বোধহয় আরও বেশি। মনে মনে ভাবলাম, এই রোজ দুধ দিয়ে যায় এ বাড়িতে? ছেলেটি চলে যেতেই ফিরে এলাম ঘরে।

সকাল থেকে এখন এত বেলা হয়ে গেছে পেটে কিছুই পড়েনি। খিদেয় ভেতরে ভতরে বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে। মনে হলো, খিদে পেলে এতটা কষ্ট হয় আগে কখনো তো অনুভব করিনি! রূপা কখনো সেই সুযোগই দেয়নি। এতক্ষণে ঠিক গুণে গুণে তিনটে রুটি, সবজি, আর একটা ডিম সিদ্ধ বানিয়ে এনে দিত।

এত দেরি করছে কেন রূপা? তবে কি ফুল তুলে বাজারে গেছে? একবারে বাজারটা সেরে বাড়ি ফিরবে?

রূপার কাছে কোনো ফোন নেই। তাই ওর সঙ্গে যোগাযোগের কোনো উপায়ও নেই। এ ব্যাপারেও অবশ্য রূপার কোনো অভিযোগ নেই। রূপা কখনো মোবাইল চায়নি। আমিও কিনে দিইনি ওকে।

আচ্ছা, কোন বাজারটায় যায় রূপা? চৌমাথার রাস্তা পেরিয়ে সেই সকালের বাজারটায়? নাকি স্টেশনের ওদিকের সবজি বাজার? আজ কী বার? রূপা কি একবারে বাজার করে বিকেলের হাট সেরে তবে বাড়ি ফিরবে? কিন্তু কাল রাতেও তো রূপা তেমনটা কিছু জানায়নি। আমারও অবশ্য কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি।

একবার মনে হলো, এগিয়ে দেখি। খুঁজে আনি রূপাকে। আবার মনে হলো, কোন বাজারে খুঁজব ওকে? যদি বাজারে না গিয়ে অন্য কোনো কাজে? আর আমি খুঁজতে বেরিয়ে, এদিকে যদি রূপা ফিরে আসে। তাহলে তো ব্যাপারটা আরও খারাপ হবে। আমাকে না পেয়ে তো আরও দুশ্চিন্তায় পড়বে রূপা।

এসব সাত-পাঁচ ভাবছি, তখনই কী খেয়াল, একবার ফ্রিজটা খুলে দেখলাম। রূপা হয়তো কিছু খাবার রেখে গেছে আমার জন্য। খিদেটাকে আর বাগে আনতে পারছি না। মাথাটাও ধরে আসছে। শরীরটাও কেমন জানি ছেড়ে দিচ্ছি ভেতর থেকে।

ফ্রিজ খুলে সত্যি সত্যি কিছু খাবার পেয়ে গেলাম। সত্যি রূপা সব গুছিয়ে রেখে গেছে আমার জন্য। একদম তৈরি খাবার। গোগ্রাসে সেগুলো গিললাম। খিদের আগুন নিভল। মনে মনে ভাবলাম, যাক এবেলা তো পেরিয়ে গেল। ওবেলায় না হয় কিছু একটা ব্যবস্থা হবে ঠিক। এর মধ্যে নিশ্চয়ই রূপা ফিরে আসবে কাজ সেরে।

দুপুরের পর হঠাৎ করেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। চারদিক কালো করে আবহাওয়াটা হঠাৎ বেশ খারাপ হয়ে গেল। ঠিক তখনই রূপার কথা মনে পড়ল আবার। রূপা কি ছাতা নিয়ে বেরিয়েছে? বৃষ্টির জল ওর একদম সহ্য হয় না। অল্পতেই ঠাণ্ডা-জ্বর-সর্দি। রূপা নিশ্চয়ই বৃষ্টিতে ভিজবে না। ও খুব বুদ্ধিমান। হয়তো কোথাও দাঁড়িয়ে থাকবে। অপেক্ষা করবে। তার পর বৃষ্টি কমলে ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরবে।

আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। আমার চোখ তখন সেই বৃষ্টি ছাপিয়ে বকুল গাছটার দিকে। কেমন থমকে গেলাম হঠাৎ। দুটো শালিক পাশাপাশি বসে আছে। বৃষ্টিতে ভিজছে। আবার একে অপরের গায়ে ঠোঁট দিয়ে জল সরিয়ে দিচ্ছে। ওরা নিশ্চই প্রেমিক-প্রেমিকা। কত সুখ ওদের!

হঠাৎ রূপার জন্য মনটা কেমন করে উঠল। এই প্রথম খুব একা একা লাগল। মনে হলো, একা থাকতে একদম ভালো লাগছে না। এখনই এক দৌড়ে ছুটে যাই রূপার কাছে। তার পর দুজনে সারা দিন পাশাপাশি বসে বৃষ্টি দেখি। একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজে হাঁটি।

একটা ঝোড়ো হাওয়া এসে আমার সারা শরীরে জল ছিটিয়ে দিয়ে গেল। কেঁপে উঠলাম। হঠাৎ শরীরটা খারাপ লাগল। গা-টাও বেশ গরম গরম হয়ে আসছে। মনে হলো জ্বর আসবে।

বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে এলাম। হাতের কাছে কিছু না পেয়ে বিছানার চাদরটাই গায়ে জড়িয়ে নিলাম। ততক্ষণে শীতে আমার শরীর ভীষণ কাঁপছে। কিছুতেই যেন কাঁপুনিটাকে থামাতে পারছি না। বিছানার সঙ্গে নিজেকে জাপটে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম।

রূপা থাকলে নিশ্চয়ই এতক্ষণে আমাকে মোটা চাদরে জড়িয়ে নিত। তাতেও কাঁপুনি না থামলে আমাকে ওর নিজের শরীর দিয়ে জড়িয়ে নিত। কাঁপুনি একটু থামলে নিশ্চয়ই ডাক্তারখানা নিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করত।

রূপা নেই। আমি অসহায়ের মতো বিছানায় পড়ে রইলাম। আমার জ্বর বাড়ছে। সেই সঙ্গে কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছি। আমার মাথাটা ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। চোখটাও ঝাপসা হয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে।

ঠিক কখন যে ঘুম থেকে উঠেছি মনে নেই। হুঁশ ফিরতেই দেখি বিছানায় শুয়ে আছি। আমার গায়ে মোটা চাদর। এখন আর জ্বর নেই। মাথাটাও বেশ হালকা লাগছে।

পাশ ফিরে জানালা দিয়ে বাইরে চোখ রাখলাম। বৃষ্টি কখন যে থেমে গেছে। মেঘ সরে বাইরে এখন রোদ ঝলমল করছে। বকুল গাছটা থেকে দুটো শালিক উড়ে গেল এই মাত্র।

তখনই রূপা এল। হাতে এককাপ চা নিয়ে। কাপটা টেবিলে রেখে আমার গা-ঘেঁষে বসল। তার পর ওর হাতটা আমার কপালে রাখল। রূপার হাতটা ভীষণ নরম। ওর নরম হাত দিয়ে আমার মাথাটা বুলিয়ে দিল।

রূপাকে কাছে পেয়ে আর জানতে চাওয়া হলো না, ‘কোথায় গিয়েছিলে? ফিরতে এত দেরি হলো কেন?’

গ্রন্থপরিচয়

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০৭ পিএম
আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০৮ পিএম
গ্রন্থপরিচয়
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

জীবনানন্দ ও তাঁর পরিজন
আপেল মাহমুদ (সম্পাদক)
শ্রেণি: সাহিত্য কাগজ
প্রকাশনী: উয়ারী বটেশ্বর, ঢাকা
প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০২৪
পৃষ্ঠা: ৩৬৮; মূল্য: ৬০০ টাকা
সাগর জলে লাখ লাখ ঝিনুক পাওয়া যায়। কিন্তু সব ঝিনুকে মুক্তো থাকে না। খুঁজে মুক্তো বের করতে হয়। তেমনি জীবনানন্দ দাশের বাক্সবন্দি কবিতা, গল্প-উপন্যাস-ডায়েরি জনসমাজে আনার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন কিছু লেখক-গবেষক। তারা জীবনানন্দের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অসীম প্রতিভাকে প্রস্ফুটনের কাজ করেছিলেন। জীবনানন্দ গবেষণাকে তারা তপস্যা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এদের মধ্যে ডা. ভূমেন্দ্র গুহ, দেবীপ্রাসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, আবদুল মান্নান সৈয়দ, ক্লিনটন বি সিলি, প্রভাতকুমার দাস, সমরেন্দ্র দাশগুপ্ত, গৌতম মিত্র, ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, আমীন আল রশীদ ও মাসউদ আহমদ হলেন অন্যতম। 

জীবনানন্দ বিষয়ক লেখালেখির কোনো অন্ত নেই। বর্তমানে তাকে ঘিরে যে গবেষণা হচ্ছে সেটাও বেশ উল্লেখযোগ্য। পেন্ডরার বাক্স থেকে অনেক চাঞ্চল্যকর পাণ্ডুলিপি বের হয়ে বই হয়ে পাঠকের টেবিলে চলে আসছে। এই অবস্থায় জীবনানন্দকে নিয়ে আরেকটি পাণ্ডুলিপির জন্ম হলো। এর বিষয়বস্তু জীবনানন্দের আত্মীয়-স্বজন, দাস পরিবার, বরিশাল ব্রাহ্মসমাজ, নদনদী, শিক্ষাদীক্ষা প্রভৃতি। প্রসঙ্গক্রমে এসেছে বরিশালের সংস্কৃতি, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, স্কুল-কলেজ, জীবনানন্দের বরিশালের জীবন, তার সহকর্মী ও সহপাঠীদের বিবরণ। এতে কবির প্রথম প্রেম মনিয়া, লাল গির্জা, অক্সফোর্ড মিশন লাইব্রেরি, ব্রজমোহন কলেজ স্কুল, সর্বানন্দ ভবন প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমেরিকান গবেষক ক্লিনটন বি সিলি দীর্ঘদিন অনুসন্ধান চালিয়ে কবি জীবনানন্দকে বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী একজন লেখক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি জীবনান্দকে ‌অনন্য হিসেবে উপাধি দিয়েছেন।... 


মেয়েটিকে বাঁচানো গেল না
ইকরাম কবীর 
শ্রেণি: গল্প সংগ্রহ
প্রকাশনী: রচয়িতা, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০২০
পৃষ্ঠা: ১০০; মূল্য: ২৫০ টাকা


খুদে গল্পের বই
ইকরাম কবীর 
শ্রেণি: গল্প সংগ্রহ
প্রকাশনী: আজব, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, সেপ্টেম্বর ২০২৪
পৃষ্ঠা: ১৫২; মূল্য: ৪০০ টাকা


গল্প একটা বোধ
গল্প একটা চেতনা
গল্প একটা অস্ত্র
গল্পের মাঝে নিজেকে পাওয়া যায়
গল্পের মাঝে মানুষদের খুঁজে পাওয়া যায়।...

পৃথিবীর কোথাও না-কোথাও কিছু না-কিছু ঘটছে। সারাক্ষণ ঘটছে। পার্থিব কিংবা অপার্থিব। বাস্তব কিংবা অবাস্তব। এর কিছু দেখা যায়, শোনা যায়। বেশির ভাগই যায় না। তবে ঘটে। ঘটেছে। শুধু তা বলা হয় না, শোনা হয় না। সেগুলো অন্তর দিয়ে দেখতে হয়, শুনতে হয়। এই না-বলা ঘটনাগুলোই এক সময় গল্প হয়ে যায়। 

মানুষের চোখের দিকে তাকালে বোঝা যায় তার ভেতরে কত গল্প জমে আছে। যেন নিঃশব্দে ঝংকারিত হাজারো সুর সংগীতায়িত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। গল্পগুলো বলার অপেক্ষায়, সুরগুলো শোনার অপেক্ষায়। সবাই গল্পগুলো বলতে পারেন না, সুরগুলো শোনাতে পারেন না। তবে তারা চায় বলতে, শোনাতে। একজন গল্পকারে নৈপুণ্য এখানেই গুরুত্বপূর্ণ। তাকে গল্পগুলো খুঁজে পেতে হয়। উৎস থেকে একটি বীজ আহরণ করে অঙ্কুরিত করাতে হয়। ডালপালা মেলে দিয়ে ফুল ফোটাতে হয়। গল্প লেখা এমনই এক যাত্রা। মনস্তাত্ত্বিক এক যাত্রা যা অন্তরের অনেক গভীর থেকে সঞ্চারিত হয়। প্রায়ই যাত্রাভঙ্গ হয়। আবার নতুন যাত্রা শুরু হয়। এই গ্রন্থে আছে- খুব সাধারণ দৈনিন্দিন প্রেমের গল্প, তেমনই জটিল চিন্তা গল্প। দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, সম্পর্ক, আধুনিকতার অগভীরতা, আধ্যাত্মিকতা- এর সবই দুই মলাটে বন্দি হয়েছে।

দেখতে চাই বইমেলার বাইরে বই বিক্রির সম্ভাবনা কতুটুকু

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৫৫ পিএম
দেখতে চাই বইমেলার বাইরে বই বিক্রির সম্ভাবনা কতুটুকু
রবীন আহসান

এবারের বইমেলায় আপনি অংশগ্রহণ করেননি কেন? 

নানা কারণে এবারের একুশের বইমেলায় আমরা অংশগ্রহণ করিনি। একটি প্রধান কারণ দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে চলছে মব শাসন! আগের সরকারের সময়ও আমরা দুবার বইমেলায় অশংগ্রহণ করিনি ইচ্ছে করে! আমরা আসলে দেখতে চেয়েছি বইমেলার বাইরে বই বিক্রির সম্ভাবনা কতুটুকু আছে! এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুবিষয়ক বই প্রকাশকদের হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে অনলাইনে, এসব কারণেও আমরা এবারের বইমেলায় অংশ নিইনি।

প্রায় প্রতিবছর আপনার অংশগ্রহণটা ব্যতিক্রমী ছিল। সেটা ধরে রাখতে অন্য কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন কি না?  

বইমেলায় আমরা শ্রাবণ প্রকাশনীতে গত কয়েক বছর একটা খোলা জানালা বানাতাম ‘শ্রাবণের জানালা’। এটা একটা কবিতার মতো বিষয় ছিল! হাজার হাজার মানুষ এই জানালায় ছবি তুলত। এটা মিস করব এবার। মিস করব লেখক-বন্ধু-পাঠকদের ২৮ দিনের আড্ডা! এসবের পরও আমরা অনলাইনে একুশে বইমেলা আয়োজন করেছি মাসব্যাপী! আমাদের ফেব্রুয়ারিবিডি.কম নামে নতুন ওয়েবসাইট থেকে এই মেলার কাজ চলবে।

ফেব্রুয়ারিবিডি.কম-এর মাসব্যাপী অনলাইন বইমেলার আয়োজন করতে যাচ্ছেন। এই ধরনের ব্যতিক্রমী চিন্তা কীভাবে এল? 

২০২১ সালেও আমরা বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলায় অংশ নিইনি। সে বছর আমরা অনলাইন বইমেলার আয়োজন করেছিলাম মাসব্যাপী। ফেব্রুয়ারিবিডি.কম শুধু শ্রাবণ প্রকাশনীর বই বিক্রি করবে না। এ বছর অনলাইন বইমেলায় আমরা প্রগতিশীল লেখক প্রকাশকদের বল বই বিক্রির আয়োজন করছি অনলাইনে।

অনলাইন বইমেলার সুবিধা এবং অসুবিধা কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন? 

অনলাইন বইমেলার বড় সমস্যা হচ্ছে, পাঠক একটি বই ধরে দেখতে পারে না। নতুন বইয়ের গন্ধটা শুকতে পারে না আর বইমেলায় যেভাবে আড্ডা দিতে দিতে চা খেতে খেতে একটা বই কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে কিনতে পারে, এখানে তা পারে না। এ ছাড়া বইমেলার কমিশনেই পাঠক ঘরে বসে আরামে বই কিনতে পারে।

ফেব্রুয়ারিবিডি.কম-এর ওয়েবসাইট আপনি কীভাবে সাজিয়েছেন, যাতে পাঠক উপকৃত হবেন। 

ফেব্রুয়ারিবিডি.কম ওয়েবসাইটটি আমরা মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও প্রগতিশীল বই দিয়ে সাজাচ্ছি; যাতে মুক্তমনা পাঠক তাদের প্রিয় বই সহজেই কিনতে পারে। বই কেনা নয়, শুধু এখানে বই আলোচনা, বই সংবাদ-লেখক সংবাদ থাকবে। আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে বই নিয়ে থাকবে লাইভ অনুষ্ঠান। থাকবে কবিতাসন্ধ্যা আবৃত্তি, গান ও আড্ডা।

অনলাইন বইমেলা কতটুকু জনপ্রিয়তা পাবে বলে আপনি মনে  করেন। ভবিষ্যতে অনলাইন বইমেলা পাঠকদের কাছে পৌঁছাতে আপনার পরিকল্পনা কী?

অনলাইন বইমেলা এখন থেকে চালু হলে অল্প সময়ের মধ্যে এটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন গাড়ি ভাড়া দিয়ে জ্যামে বসে না থেকে তাদের প্রিয় বইটি ঘরে বসে সংগ্রহ করতে চাইবে। এখন তো দুনিয়া ডিজিটাল, মানুষজন ঘরে বসেই কেনাকাটা করছে। ফলে বইকে বইয়ের বিষয় যদি আমরা অনলাইলে জনপ্রিয় করতে পারি, তবে পাঠক বেশি বেশি বই অনলাইন বইমেলা থেকে কিনবে। এখন কিন্তু সারা বছর বই অনলাইনেই বেশি বিক্রি হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো কাগজের বই কিনবে না তার প্রস্তুতি চলছে। ফলে আমরা ডিজিটাল বই প্রকাশের দিকেও এগোব। 

ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।

সাক্ষাৎকার: সানজিদুল ইসলাম সকাল

রবীন আহসান 
শ্রাবণ প্রকাশনী, ঢাকা

নু

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৫২ পিএম
নু
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

নাইট ডিউটি চলছিল। শেষরাতের একটু আগে আগে চোখ দুটি ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছিল। দুবার চোখে পানি ছিটিয়েও ঘুম তাড়াতে না পেরে সিরাজ অগত্যা বাইরের দিকের বাড়তি সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠেছিল একটি সিগারেট ধরাতে। এই বাড়তি সিঁড়িটা মোটামুটি ফাঁকাই থাকে। নেহাত দরকার না হলে এটি কেউ বড় একটা ব্যবহার করতে যায় না। ছাদে উঠে প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে চেপে ধরে দেয়াশলাই বের করতেই থেমে যেতে হয়েছিল তাকে। একটি শব্দ তার হাত দুটিকে থামিয়ে দিয়েছিল। খাড়া করে দিয়েছিল কান দুটিকে।

কান্নার শব্দটা আসছিল পানির ট্যাংকের উল্টোপাশ থেকে। ফুঁপিয়ে কান্না। ভীষণ ভড়কে গিয়েছিল সে। মনের ভেতর জেগে উঠেছিল বেপরোয়া কৌতূহল। ট্যাংকের যে পাশে ছিল সেখান থেকে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেয়েছিল মাথাটাকে সামনে বাড়িয়ে। কান দুটো খাড়া হয়ে গিয়েছিল। দেয়ালঘেঁষে আলগোছে এগিয়ে গিয়ে নিজেকে পুরোপুরি লুকিয়ে রেখে মাথাটাকে মিনিটের কাঁটা বানিয়ে ধীরে ধীরে সামনে বাড়িয়ে ট্যাংকের ও-পাশটাতে নজর বুলিয়েই সে দেখতে পেয়েছিল এক মেয়ে মুখে ওড়না চেপে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

ভীষণ খটকা লেগেছিল সিরাজের। ভালো করে তাকিয়েছিল। আবছা আলো। চেনা যাচ্ছিল না। সিঁড়ির সামনে একটি বাল্ব জ্বলছিল যদিও, কিন্তু দরজার পাল্লার ও-পাশে বলে এটির আলো সরাসরি ছাদে আসছিল না। চোখ সরু করে পুরো ফোকাসে মেলেও সে চিনতে পারল না। হয়তো নতুন এসেছে। গার্মেন্টসে নতুন চাকরিতে ঢুকে অনেক মেয়ে কাজের চাপে দিশেহারা হয়ে কাঁদে অবশ্য, কিন্তু কেন যেন সিরাজের এ কান্নাকে সে ধরনের কান্না মনে হচ্ছিল না। তবে কি...!

ভাবনাটা আরেকটু সামনে বাড়ার আগেই ত্রস্তব্যস্ত হয়ে আরেকজন মেয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ছাদে পা রেখে প্রথমে এদিক-সেদিক নজর বুলিয়ে কী একটা খুঁজল; তার পর জোর কদমে পা চালিয়ে ট্যাংকের দিকে ছুটে এল। বোধ করি ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ কানে যেতেই। এসেই কাঁদতে থাকা মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল:

‘কী রে পিরু! তুই এনে এম্বায় কাঁনতাছস ক্যা?’

গলার স্বর শুনেই চিনে ফেলেছিল সিরাজ। রোকেয়া। অ্যামব্রয়ডারি বিভাগের সিনিয়র অপারেটর। সিরাজেরও সিনিয়র। অনুমান করে নিয়েছিল, এই রোকেয়া আপাই নতুন এই মেয়েকে এনেছেন। পিরু নামের কাঁদতে থাকা মেয়ে এবার রোকেয়াকে জড়িয়ে ধরে শরীর কাঁপিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। রোকেয়া তাকে বুকে চেপে ধরে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করেছিল:

‘এহন আমারে ক ছেন, তোর কী অইছে? তোরে না সুপারভাইজার স্যার আইস্যা বসের রুমে নিয়া গেল? আমারে কইয়া গেল, তোরে বলে কী একখান কা গেলাম যেম বুঝাইয়া দিব মালিক। আমি তো আরও খুশি অইয়া গেলাম যে, যাক, তোর ওপরে মালিকের সুনজর পড়ছে!’
‘আমার সব্বোনাশ অইছে রোকেয়া বু! আমারে...’

আর কোনো কথা বলতে পারল না পিরু নামের এই মেয়ে। হাউমাউ করে কেঁদে রোকেয়াকে আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরেছিল। যা বোঝার বুঝে গিয়েছিল রোকেয়া। দূরে দাঁড়িয়ে সিরাজও বুঝেছিল। তবে ওদের বুঝতে দেয়নি। রোকেয়াও কেঁদে উঠেছিল এবং এর পরপরই নিজেদের অবস্থান বুঝতে পেরে সতর্ক হয়ে উঠেছিল। যে কেউ এখন ছাদে উঠে আসতে পারে। এদিক সেদিক তাকিয়ে নিজের ওড়না দিয়ে পিরুর মুখ চেপে ধরে তাকে শান্ত করার চেষ্টায় ফিসফিসিয়ে বলেছিল-

‘খবরদার! এই কথা য্যান্ কেউ কুনুদিন জানবার না পারে! আমি দেহি কী করবার পারি। আমাগো তো বুইন পুড়া কপাল! মাইনষের নাত্থি-গুঁতা খাইয়া আর বেইজ্জতি অইয়াই আমাগো বাঁইচ্যা থাহুন লাগে। এহন যুদি আমি কিছু কইবার যাই তাইলে তোর তো চাকরি যাইবই, আমারও চাকরি চইল্যা যাইব। বুইন রে, প্যাটের জ্বালা অইতাছে বড় জ্বালা। আমার খালা, তোর মা যে মরুন্যা ব্যারামে পড়ছে, হ্যারে বাঁচাইয়া রাখবার চাইলে তোর তো চাকরি করুনই লাগব। তোরে কি কমু বোইন, আমার নিজেরও কইলাম কম বেইজ্জতি অইতে অয় নাই! এই বেবাক কিছু সইবার পারছি বইল্যাই না চাকরিতে আমার ইট্টু উন্নতি অইছে! তয় তোরে আর আমি বেইজ্জতি অইবার দিমু না...’

সিরাজ আর ওদের কোনো কথা শুনতে পেল না। পিরুকে কিছুটা শান্ত করে টেনে তুলে ছাদের দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করেছিল রোকেয়া। সিঁড়ির গোড়ায় আলোতে যাওয়ার পর সিরাজ পিরুর চেহারা দেখতে পেয়েছিল। শ্যামলা। তবে দেখতে বেশ!

ব্যাপারটাকে নিজের ভেতর চেপে রেখে এর পর থেকে পিরুর ওপর নজর রাখছিল সিরাজ। নিছক কৌতূহলের বশেই। এমনিতে কারও কোনো ব্যাপারে কখনো কোনো আগ্রহ জাগে না তার। নিজের কাজ নিয়ে থাকে। নিজের মতো চলে। নিজের সমস্যায় এমন নাকানি-চুবানি খেতে থাকে যে, অন্য কারও বা অন্য কিছুর কথা ভাববারও ফুরসত থাকে না। লেখাপড়া শেষ করতে পারার আগেই আয়-রোজগারের উপায় খুঁজে নিতে হয়েছিল তাকে। বাবা ছিলেন পদ্মাপারের এক প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। বছর পাঁচেক আগে মা মারা যাওয়ার পর থেকেই সংসারে ভাটার টান শুরু হয়েছিল। বাবা দিন দিন জাগতিক সব কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছিলেন। মাঝে মাঝেই তবলিগের চিল্লায় চলে যেতেন। তখন সংসারের কোনো খোঁজই রাখতেন না। বড় বোনের অবশ্য বিয়ে হয়েছিল মা মারা যাওয়ার আগেই। তিন ভাইবোনের ভেতর সে বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান। লেখাপড়ায় খুব একটা ভালো ছিল না। কোনোরকমে এসএসসি পাস করার পর শহরে গিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। একটা মেসে থাকত আর টিউশনি করে চলত। ছোট বোনটা বেশ মেধাবী। ক্লাসে ফার্স্ট হতো। কিন্তু সে এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারার আগেই চিল্লা থেকে জটিল রোগ বাঁধিয়ে ফিরে এসে বিছানায় পড়েছিল বাবা। অগত্যা সিরাজ পড়াশোনা ফেলে চলে এসেছিল সংসারের হাল ধরতে। বাবার কোনো জমানো অর্থ ছিল না। বাড়ির পাশে ছোট্ট এক প্লট জমি ছিল। সেটি বিক্রি করে বাবার চিকিৎসা করাতে ঢাকায় নিয়ে এসেছিল। কিন্তু চিকিৎসা শুরু হওয়ার আগেই তিনি মারা যান। বেদিশা হয়ে পড়েছিল সিরাজ। হাতে যে টাকা-পয়সা ছিল তা খরচ করে বাধ্য হয়ে ছোট বোনকে বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তার ছোট বোনকে শ্বশুরবাড়ির অনেক অত্যাচার সইতে হচ্ছিল। সিরাজ দু-চোখে অন্ধকার দেখে গ্রামের পরিচিত একজনের হাত ধরে ঢাকায় এসে গার্মেন্টসে স্টিকার ম্যান হিসেবে এই চাকরিটা নিয়েছিল। ছোট বোনকে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার থেকে রক্ষায় প্রায়ই তাকে টাকা পাঠাতে হচ্ছিল। গার্মেন্টসে এই চাকরিটা ছাড়াও টোঙা বানিয়ে বিক্রি করে এবং এটা-সেটা করে তাকে টাকা জোগার করতে হচ্ছিল। অবশেষে অত্যাচার সইতে না পেরে মাস ছয়েক আগে তার ছোট বোন আত্মহত্যা করেছে।

টিফিনের সময় গার্মেন্টসে খুব হুড়োহুড়ি লেগে যায়। সবাই আগে গিয়ে ছাদে বসে সারা দিনের একমাত্র খাবার একটু আরাম করে খেতে চায়। একদিন সিঁড়ি দিয়ে নিজের নিজের টিফিন বক্স নিয়ে দৌড়ে ওঠার সময় একজনের হাতের গুঁতো লেগে পিরুর টিফিন বক্সটি ছিটকে পড়ে গেল একেবারে নিচে। পড়েই ভেতরের খাবারগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেল। সেদিনের পর থেকেই সিরাজ পিরুকে চোখে চোখে রাখছিল। নিজের বোন অত্যাচার সইতে না পেরে নিজেই নিজেকে শেষ করে দিয়েছে। এখন পিরু নামের এই মেয়ে এখানে গোপনে যে অত্যাচার সইছে তাতে অজান্তেই তার ওপর সিরাজের বোন-ভালোবাসা জেগে উঠছিল দিনে দিনে। সে পিরুর এই অবস্থা দেখে এগিয়ে এল এবং পিরুর হাতে নিজের টিফিন বক্সটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘তুমি এই টিফিন বক্সটা নিয়া ছাদের এক কোনায় যাইয়া বসো। আমি তুমার টিফিন বক্স নিয়া আসতেছি।’

পিরু থতমত খেয়ে গেলেও যখন দেখল অচেনা এই লোকটি দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে তার টিফিন বক্সটা কুড়িয়ে আনতে, সে তখন ধীরে ধীরে তার টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে ছাদের এক কোনায় গিয়ে বসে পড়ল। সিরাজ ফিরে এসে তাকে ওভাবে তার টিফিন বক্স নিয়ে বসে থাকতে দেখে একটু রাগের সঙ্গেই বলল, এবং এমনভাবে বলল যেন সে তার কত কালের চেনা! যেন নিজের বোন।
‘কী রে পিরু! এহনও ওইডা হাতে নিয়া বইস্যা আছস! খাইবার পারতাছস না? তোর টিফিন তো সব পইড়্যা গেছে!’
‘বাহ! আমি আপনের টিফিন খামু ক্যা? আপনেরে তো আমি চিনিই না!’
‘চিনুন লাগব না। তোরে তো আমি চিনি।’

এরপর সিরাজ সেদিন রাতে তার সবকিছু জেনে যাওয়া, তার বোনের মর্মান্তিক কাহিনি বলে তাকে সে তার সেই বোনের মতো দেখে, সব সময় তাকে চোখে চোখে রাখে- এসব খুলে বলেছিল। সেদিন থেকেই দুজনে ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল এবং একজন আরেকজনের সব কথা পরস্পরকে খুলে বলেছিল। কিন্তু তারা সেই সুপারভাইজারের চোখ ও কানকে ফাঁকি দিতে পারেনি, যে সুপারভাইজার পিরুকে সেদিন মালিকের রুমে নিয়ে গিয়েছিল। মালিককে সব বলে সে সিরাজকে ছাঁটাই করতে চেয়েছিল, কিন্তু মালিক শুধু ছাঁটাই করাকে যথেষ্ট মনে করেনি। সে একটি চুরির ঘটনা সাজিয়ে সিরাজকে পুলিশে দিয়েছিল। এদিকে পিরুর ওপর অত্যাচারের মাত্রাও বেড়ে গিয়েছিল। সে যাতে চাকরি ছেড়ে পালাতে না পারে সে ব্যবস্থাও পাকা করে রাখা হয়েছিল। রোকেয়া শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে পেরেছে, আর কিছু করতে পারেনি।

ছয় মাসের জেল হয়েছিল সিরাজের। জেলে থাকতেই সে ঠিক করেছিল, ছাড়া পেলে পিরুকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে গিয়ে সংসার পাতবে। পদ্মাপারে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। এক চিলতে যে বসতভিটে ছিল তা পদ্মায় ভেঙে নিয়েছে। তার ইচ্ছে চট্টগ্রামের ইপিজেডে গিয়ে কোনো গার্মেন্টসে কাজ জুটিয়ে নেবে। কিছু একটা করতে পারবে সে আত্মবিশ্বাস তার আছে। তার পর কয়েক বছর টাকা জমিয়ে কোনো গ্রামে গিয়ে জমি লিজ নিয়ে চাষবাস করবে আর একটি গরুর খামার করবে। শুনেছে ঠিকমতো করতে পারলে নাকি তাতে খুব লাভ!

জেল থেকে ছাড়া পেয়েই সেদিন রাতে সে পিরুর মেসে চলে গেল। এর আগে পিরু জেলখানায় তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তারা সবকিছু পাকা করে রেখেছিল। সেদিন নাইট ডিউটি না থাকায় পিরুর মেসে গিয়ে তাকে পেয়ে গেল সিরাজ। পিরুকে সে তখনই সব গুছিয়ে নিতে বলল। পিরু এমন একটাকিছুর জন্য মনে মনে তৈরি হয়েই ছিল। গোছানোর তেমন কিছু নেই। দুই সেট সস্তা থ্রিপিস আর গামছা। ব্যাগ নিয়ে সিরাজের পিছু পিছু যেতে যেতে সে জিজ্ঞেস করল-
‘কই যাইবেন? ঠিক করছেন কিছু?’ 
‘আগে তো বাইর হই, তার পর দেখবানি। নু।’

পরগাছা প্রেম

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৬ পিএম
পরগাছা প্রেম
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

দুজনের ভুল বোঝাবুঝি মেটানোর সব কৌশলই
ভুল নামতায় পাশমার্ক না পেয়ে হাপিত্যেশ করে-
ভুল বোঝাবুঝি অবসানে সচেতন মিটারের বড্ড অভাব। 

অসময় ভেবে পেছনে ফেলে আসা দিনগুলো মিটার দেখে 
তবু দিনাতিপাত করছে...
আমাদের চাকচিক্য জীবন এখন আর অটোতে চড়ে না।
পাঁচ টাকার বাদাম আর তিন টাকার পাকা তেঁতুলের 
চোখে-মুখে সেই সতেজ হাসিটা বিক্রি করে দিয়েছি-
পুরনো বইয়ের সাথে ফেরিওয়ালার কাগজের পাল্লায়। 

সন্ধ্যাগুলো জ্যামে বসে ঘাম পুষে বড্ড ক্লান্ত।

শহরের গাছের ধুলোমাখা ডালপালায় ঝুলে থাকে 
সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো। 
একটি সচল কিংবা সচেতন মিটারের অভাবে 
নিষ্ঠুর গন্তব্য যেন এক একটি পরগাছা প্রেম।

আমাদের নির্বাণকাল

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৫ পিএম
আমাদের নির্বাণকাল
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

তারকাঁটায় হেঁটে হেঁটে একদিন ঠিক পৌঁছে গিয়েছিলাম
নিষিদ্ধ শরীরী বিদ্যায়
আমার শরীর তা জানে 
যেভাবে তোমার অতীত তা মানে

এখন এতদিন পর স্মৃতিচারণের মতো চিহ্নগুলো
গলায় ঝুলিয়ে ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য প্রদর্শন করে চলেছি

আমাকে দেখলেই তোমাদের গৃহপালিত নদী
মুখ লুকায় উত্তাল দিনের সামুদ্রিক সন্ত্রাসে 
তোমাকে দেখলেই আমাদের প্রহরারত মাঠে
অশ্বদৌড় কেঁপে ওঠে মধ্যরাতে অকুণ্ঠ উত্তাপে   

আজকাল ঊনঘুম ঊনঅন্নে রাত জেগে তীর্থ রচনা করি
পুরনো নোটবই ঘেঁটে অনাবশ্যক বাক্য কেটে
                                ভুল শুধরে নিই

আজকাল গঞ্জে বাজারে ঘুরি, নানা বরণ মানুষ ঘেঁটে
চোখে চোখে খুঁজে দেখি শরীরী সম্পর্কের ভাষা

আমাদের এই বিদ্যা ভেসে উঠেছিল 
ঢলে পাওয়া কইমাছের দিনে; আজও কেউ জানেনি তো
দুজনেই মজে আছি সেই এক চিরকালীন নির্বাণের ঋণে