ওমর খৈয়ামের কবিতার অনুবাদ করেন কান্তি চন্দ্র ঘোষ, তখন রবীন্দ্রনাথ তাকে লিখেছিলেন: ‘তোমার তর্জ্জমা পড়ে আমার একটা কথা বিশেষ করে মনে উঠেচে। সে হচ্ছে এই যে বাংলা কাব্যে ভাষার শক্তি এখন এত বেড়ে উঠেচে যে, অন্য ভাষার কাব্যের লীলা অংশও এ-ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব। মূল কাব্যের এই রস-লীলা যে তুমি বাংলা ছন্দে এমন সহজে বহমান করতে পেরেচ এতে তোমার বিশেষ ক্ষমতা প্রকাশ পেয়েচে। কবিতা লাজুক বধূর মত এক ভাষার অন্তঃপুর থেকে অন্য ভাষার অন্তঃপুরে আসতে গেলে আড়ষ্ট হয়ে যায়। তোমার তর্জ্জমায় তুমি তার লজ্জা ভেঙ্গেচ, তার ঘোমটার ভিতর থেকে হাসি দেখা যাচ্চে...’।
ওমর খৈয়াম পারস্যের এক বিস্ময়কর কবি। তিনি মূলত গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ, গ্রহ-নক্ষত্র বিশারদ, বীজগণিতের সূত্র আবিষ্কারক। তিনি তার অন্য সব পরিচয় ছাপিয়ে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছিলেন কবি হিসেবে। তার কবিতার মধ্যে সমকালীন সময় ও সমাজ, প্রিয়ার বিরহ ও মিলন, প্রকৃতি ও বসন্তের রূপ, অদৃষ্ট বা নিয়তির প্রতি শ্লেষ, ভণ্ড বা বকধার্মিকদের বিরুদ্ধে ঘৃণা, ধর্ম-শাস্ত্রবিরুদ্ধ কবিতা, সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা অন্যতম। তার রুবাইয়ের মধ্যে এমন এক দার্শনিক প্রজ্ঞা রয়েছে যা প্রগতিশীল মানুষের মধ্যে নতুন চিন্তার সৃষ্টি করেছে। তার প্রশ্ন ছিল আমি কে, আমি কোথায় ছিলাম, কেন এই পৃথিবীতে এসেছি, শুধুই আসা-যাওয়া না কি তার পরে আবার কিছু আছে। কোনো কোনো দার্শনিকের মতে, জগৎ মিথ্যা, ব্রহ্ম সত্য। উপনিষদের বাণীর সঙ্গে খৈয়ামের মতের অনেক মিল রয়েছে। আবার অমিলও রয়েছে। যে কয়দিন বাঁচ সাকি ও শরাবের মধ্যে ডুবে থাক। কারণ, একদিন সবাইকে মাটিতে মিশে যেতে হবে, এর কোনো অন্যথা হবে না।
ইংরেজ কবি ফিটজেরল্ড সাহেবের কল্যাণে ওমর খৈয়ামের নাম সারা বিশ্বে পরিচিত। তার ‘রোবাইয়াত’ বা ‘রুবাইয়াৎ’ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। তিনি জ্যোতিষ-শাস্ত্রবিদ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি গ্রহতত্ত্ব ও গ্রহ-নক্ষত্র, গণিতশাস্ত্র, জড়বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান সম্পর্কে বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন বলে জানতে পারা যায়। ওমর খৈয়ামের আরেকটি বিশেষ পরিচিতি নাস্তিক হিসেবে। কারণ তার প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মমত সম্পর্কে এক নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী ছিল। তার অধিকাংশ রুবাই থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রচলিত ধর্মবিধির প্রতি তার অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধা ছিল। তিনি ছিলেন স্বাধীন চিন্তার পক্ষপাতী। সত্যের সন্ধানে তিনি প্রচলিত শাস্ত্র-নির্দিষ্ট পথ পরিহার করেছিলেন। সুফিদের রহস্যময় সাধন-পথেরও পরিপন্থি ছিলেন, যা তার রুবাইগুলোর মধ্যে দেখা যায়। তার রচনার অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মতত্ত্বের নিগূঢ় পরিচয়ের মধ্যে প্রচলিত ধর্মমত শাস্ত্রবিদ বা যাজক পুরোহিত সম্প্রদায়ের বিপক্ষে তীব্র কটাক্ষ দেখতে পাওয়া যায়। তার সম্পর্কে বলা হয়, তিনি চার্বাক মতের অনুসারী, এপিকিউরিয়ান বা জড়বাদী ও দেহাত্মবাদী। অনেকেই মনে করেন তার রুবাইয়ের মধ্যে সুরা ও সাকির রূপকের মধ্যেই রয়েছে অরূপের সন্ধান। তিনি তার দেশের যুক্তিহীন অসার ধর্ম ও মিথ্যা উপাসনার ভণ্ডামি কখনো সহ্য করেননি।
রোবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম-এর ভূমিকায় প্রমথ চৌধুরী লিখেছেন: ‘এ কবিতার জন্ম হৃদয়ে নয়, মস্তিষ্কে। ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন মহাপণ্ডিত। তিনি সারা-জীবন চর্চা করেছিলেন শুধু বিজ্ঞানের, কাব্যের নয়। অঙ্কশাস্ত্র ও জ্যোতিষে তিনি সেকালের সর্ব্বাগ্রগণ্য পণ্ডিত ছিলেন। এই জ্ঞান-চর্চার অবসরে গুটিকয়েক চতুষ্পদী রচনা করেন, এবং সেই চতুষ্পদী কটিই তার সমগ্র কাব্যগ্রন্থ।’
ওমর খৈয়ামের কবিতা প্রথমে ইউরোপের মানুষের কাছে নতুন পথের সন্ধান দেয়। যখন খ্রিষ্টান পাদ্রিদের কথামতো সবকিছু পরিচালিত হতো। ওমর খৈয়ামের আবির্ভাব সেকালের সমাজের মানুষ সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। তার কাব্যে সম্পূর্ণ নতুন দার্শনিক কথা। প্রায় প্রত্যেক ধর্মের অনুসারী তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে থাকেন। কিন্তু ওমর সবকিছুকে নস্যাৎ করে দিয়ে বললেন, এসব মিথ্যে আর মানুষের মনগড়া কল্পনা মাত্র। একথা বলার পর ওমরকে নানা রকম লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছিল। প্রমথ চৌধুরীর মতে, ওমরের সব কবিতার ভিতর দিয়ে যা ফুটে উঠেছে, সে হচ্ছে মানুষের মনের চিরন্তন এবং সব চাইতে বড় প্রশ্ন: ‘কোথায় ছিলাম, কেনই আসা, এই কথাটা জানতে চাই/ যাত্রা পুনঃ কোন লোকেতে’? এই প্রশ্নের জবাবে ওমর খৈয়াম বলেন: ‘সব ক্ষণিকের, আসল ফাঁকি, সত্য মিথ্যা কিছুই নাই।’ ওমর যে সেকালের মুসলমান সমাজে উপেক্ষিত হয়েছিলেন, এবং একালের ইউরোপীয় সমাজে আদৃত হয়েছেন, তার কারণ এই জবাব। যারা মুসলমান ধর্মে বিশ্বাস করেন, তাদের কাছে এ মত শুধু অগ্রাহ্য নয়- একেবারে অসহ্য; কেননা এ কথা ধর্ম মাত্রেরই মূলে কুঠারাঘাত করে। অপরপক্ষে এ বাণী মেনে নেওয়ার জন্য এ যুগের ইউরোপের মন সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল। ইউরোপের মন একান্ত বিজ্ঞান-চর্চার ফলে, খ্রিষ্টধর্মের ওপর তার প্রাচীন বিশ্বাস হারিয়ে বসেছিল, কিন্তু তার পরিবর্তে কোনো নতুন বিশ্বাস খুঁজে পাইনি। সুতারাং, ওমরের কবিতায় বতমান ইউরোপ তার নিজের মনের ছবিই দেখতে পেয়েছিল।
কাজী নজরুল ইসলাম ফার্সি জানতেন। তিনি ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’-এর অনেকটা ভাবানুবাদ করেছেন। তিনি ভূমিকায় লিখেছেন: ওমরকে তাঁর কাব্য পড়ে যারা Epicurean বলে অভিহিত করেন, তাঁরা পূর্ণ সত্য বলেন না। ওমর খৈয়ামের কবিতা বা রুবাইয়ের মধ্যেকার বিষয়গুলির মধ্যে এক গভীর দর্শন নিহিত রয়েছে। তাঁর অভিযোগ অদৃষ্টের প্রতি। কবি মনে করেন, এই পৃথিবী নামক গ্রহে মানুষ এক অসহায় জীব। তার এমন কি এমন, অপরাধ যার জন্য তাঁকে পাপ-পুণ্যের সাজা ভোগ করতে হবে। মানুষের প্রচলিত ধারণা মানুষ ইন্দ্রিয় বা রিপু দ্বারা পরিচালিত হয়ে পাপ অথবা পুণ্য করে। তাই ওমরের প্রশ্ন, গর্তে বোঝাই করে পাপ রেখে মানুষের অসহায় অবস্থার প্রতি খেলা বিধাতার এ কোন খেলা। তিনি মনে করেন মানুষের প্রতি ঈশ্বরের একরকম অবিচার। তাই ওমরের জিজ্ঞাসা :
মানব সৃজন ক’রলে দিয়ে মৃত্তিকাতে পাপের ছাপ,/ ...মানুষ তোমায় ক’রছে ক্ষমা- তুমিও দেব, ক্ষমিও তায়!
অন্য একটি রুবাইয়ে, ভাগ্যে বা অদৃষ্টে যা আছে তা হবেই, তার বিরুদ্ধে যাওয়াটা বোকামি। কোনো লোভের বশবর্তী হয়ে তিনি শরাব সাকি ত্যাগ করতে পারবেন না। নগদ যা পাওয়া যায় তার পরিবর্তে ধারে স্বর্গ কিনতে তিনি নারাজ। তার কাছে মানুষের জীবনের সার্থকতা প্রেমে। ‘সেই নিরালা পাতায়-ঘেরা বনের ধারে শীতল ছায়,/ খাদ্য কিছু, পেয়ালা হাতে ছন্দ গেঁথে দিনটা যায়!’ তার কাছে তাই প্রিয়ার সান্নিধ্য, এক পেয়ালা সুরা, একটি কবিতার বই পেলেই তিনি স্বর্গে যেতে ইচ্ছক নন। খৈয়ামের চিন্তাধারা তাই বাস্তববাদী মানুষের একান্ত প্রিয়। ধর্মশাস্ত্র নিয়ে যারা বেশি মাতামাতি করেন তিনি তাদের নিরেট মূর্খ বলে অভিহিত করেছেন। মানুষের জীবনকে উপভোগ করার যে বার্তা তিনি তার রুবাইয়ের মধ্যে দিয়েছেন, যার মর্ম পাশ্চাত্যের মানুষ অনুধাবন করেছে। ওমরের নিকট সব ধর্মের উপাসনা অপ্রয়োজনীয়। আমাদের কাছে মনে হয়, ওমরের দর্শন পৃথিবীর অগনিত মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে। ওমরের কাছে একটি কবিতার বই, একটুকরো রুটি, শারাব আর সাকি হলেই আর স্বর্গ প্রয়োজন নেই। ওমরের জীবন-দর্শনের মূল সুর মূলত এটি।