নাইট ডিউটি চলছিল। শেষরাতের একটু আগে আগে চোখ দুটি ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছিল। দুবার চোখে পানি ছিটিয়েও ঘুম তাড়াতে না পেরে সিরাজ অগত্যা বাইরের দিকের বাড়তি সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠেছিল একটি সিগারেট ধরাতে। এই বাড়তি সিঁড়িটা মোটামুটি ফাঁকাই থাকে। নেহাত দরকার না হলে এটি কেউ বড় একটা ব্যবহার করতে যায় না। ছাদে উঠে প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে চেপে ধরে দেয়াশলাই বের করতেই থেমে যেতে হয়েছিল তাকে। একটি শব্দ তার হাত দুটিকে থামিয়ে দিয়েছিল। খাড়া করে দিয়েছিল কান দুটিকে।
কান্নার শব্দটা আসছিল পানির ট্যাংকের উল্টোপাশ থেকে। ফুঁপিয়ে কান্না। ভীষণ ভড়কে গিয়েছিল সে। মনের ভেতর জেগে উঠেছিল বেপরোয়া কৌতূহল। ট্যাংকের যে পাশে ছিল সেখান থেকে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেয়েছিল মাথাটাকে সামনে বাড়িয়ে। কান দুটো খাড়া হয়ে গিয়েছিল। দেয়ালঘেঁষে আলগোছে এগিয়ে গিয়ে নিজেকে পুরোপুরি লুকিয়ে রেখে মাথাটাকে মিনিটের কাঁটা বানিয়ে ধীরে ধীরে সামনে বাড়িয়ে ট্যাংকের ও-পাশটাতে নজর বুলিয়েই সে দেখতে পেয়েছিল এক মেয়ে মুখে ওড়না চেপে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
ভীষণ খটকা লেগেছিল সিরাজের। ভালো করে তাকিয়েছিল। আবছা আলো। চেনা যাচ্ছিল না। সিঁড়ির সামনে একটি বাল্ব জ্বলছিল যদিও, কিন্তু দরজার পাল্লার ও-পাশে বলে এটির আলো সরাসরি ছাদে আসছিল না। চোখ সরু করে পুরো ফোকাসে মেলেও সে চিনতে পারল না। হয়তো নতুন এসেছে। গার্মেন্টসে নতুন চাকরিতে ঢুকে অনেক মেয়ে কাজের চাপে দিশেহারা হয়ে কাঁদে অবশ্য, কিন্তু কেন যেন সিরাজের এ কান্নাকে সে ধরনের কান্না মনে হচ্ছিল না। তবে কি...!
ভাবনাটা আরেকটু সামনে বাড়ার আগেই ত্রস্তব্যস্ত হয়ে আরেকজন মেয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ছাদে পা রেখে প্রথমে এদিক-সেদিক নজর বুলিয়ে কী একটা খুঁজল; তার পর জোর কদমে পা চালিয়ে ট্যাংকের দিকে ছুটে এল। বোধ করি ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ কানে যেতেই। এসেই কাঁদতে থাকা মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল:
‘কী রে পিরু! তুই এনে এম্বায় কাঁনতাছস ক্যা?’
গলার স্বর শুনেই চিনে ফেলেছিল সিরাজ। রোকেয়া। অ্যামব্রয়ডারি বিভাগের সিনিয়র অপারেটর। সিরাজেরও সিনিয়র। অনুমান করে নিয়েছিল, এই রোকেয়া আপাই নতুন এই মেয়েকে এনেছেন। পিরু নামের কাঁদতে থাকা মেয়ে এবার রোকেয়াকে জড়িয়ে ধরে শরীর কাঁপিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। রোকেয়া তাকে বুকে চেপে ধরে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করেছিল:
‘এহন আমারে ক ছেন, তোর কী অইছে? তোরে না সুপারভাইজার স্যার আইস্যা বসের রুমে নিয়া গেল? আমারে কইয়া গেল, তোরে বলে কী একখান কা গেলাম যেম বুঝাইয়া দিব মালিক। আমি তো আরও খুশি অইয়া গেলাম যে, যাক, তোর ওপরে মালিকের সুনজর পড়ছে!’
‘আমার সব্বোনাশ অইছে রোকেয়া বু! আমারে...’
আর কোনো কথা বলতে পারল না পিরু নামের এই মেয়ে। হাউমাউ করে কেঁদে রোকেয়াকে আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরেছিল। যা বোঝার বুঝে গিয়েছিল রোকেয়া। দূরে দাঁড়িয়ে সিরাজও বুঝেছিল। তবে ওদের বুঝতে দেয়নি। রোকেয়াও কেঁদে উঠেছিল এবং এর পরপরই নিজেদের অবস্থান বুঝতে পেরে সতর্ক হয়ে উঠেছিল। যে কেউ এখন ছাদে উঠে আসতে পারে। এদিক সেদিক তাকিয়ে নিজের ওড়না দিয়ে পিরুর মুখ চেপে ধরে তাকে শান্ত করার চেষ্টায় ফিসফিসিয়ে বলেছিল-
‘খবরদার! এই কথা য্যান্ কেউ কুনুদিন জানবার না পারে! আমি দেহি কী করবার পারি। আমাগো তো বুইন পুড়া কপাল! মাইনষের নাত্থি-গুঁতা খাইয়া আর বেইজ্জতি অইয়াই আমাগো বাঁইচ্যা থাহুন লাগে। এহন যুদি আমি কিছু কইবার যাই তাইলে তোর তো চাকরি যাইবই, আমারও চাকরি চইল্যা যাইব। বুইন রে, প্যাটের জ্বালা অইতাছে বড় জ্বালা। আমার খালা, তোর মা যে মরুন্যা ব্যারামে পড়ছে, হ্যারে বাঁচাইয়া রাখবার চাইলে তোর তো চাকরি করুনই লাগব। তোরে কি কমু বোইন, আমার নিজেরও কইলাম কম বেইজ্জতি অইতে অয় নাই! এই বেবাক কিছু সইবার পারছি বইল্যাই না চাকরিতে আমার ইট্টু উন্নতি অইছে! তয় তোরে আর আমি বেইজ্জতি অইবার দিমু না...’
সিরাজ আর ওদের কোনো কথা শুনতে পেল না। পিরুকে কিছুটা শান্ত করে টেনে তুলে ছাদের দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করেছিল রোকেয়া। সিঁড়ির গোড়ায় আলোতে যাওয়ার পর সিরাজ পিরুর চেহারা দেখতে পেয়েছিল। শ্যামলা। তবে দেখতে বেশ!
ব্যাপারটাকে নিজের ভেতর চেপে রেখে এর পর থেকে পিরুর ওপর নজর রাখছিল সিরাজ। নিছক কৌতূহলের বশেই। এমনিতে কারও কোনো ব্যাপারে কখনো কোনো আগ্রহ জাগে না তার। নিজের কাজ নিয়ে থাকে। নিজের মতো চলে। নিজের সমস্যায় এমন নাকানি-চুবানি খেতে থাকে যে, অন্য কারও বা অন্য কিছুর কথা ভাববারও ফুরসত থাকে না। লেখাপড়া শেষ করতে পারার আগেই আয়-রোজগারের উপায় খুঁজে নিতে হয়েছিল তাকে। বাবা ছিলেন পদ্মাপারের এক প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। বছর পাঁচেক আগে মা মারা যাওয়ার পর থেকেই সংসারে ভাটার টান শুরু হয়েছিল। বাবা দিন দিন জাগতিক সব কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছিলেন। মাঝে মাঝেই তবলিগের চিল্লায় চলে যেতেন। তখন সংসারের কোনো খোঁজই রাখতেন না। বড় বোনের অবশ্য বিয়ে হয়েছিল মা মারা যাওয়ার আগেই। তিন ভাইবোনের ভেতর সে বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান। লেখাপড়ায় খুব একটা ভালো ছিল না। কোনোরকমে এসএসসি পাস করার পর শহরে গিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। একটা মেসে থাকত আর টিউশনি করে চলত। ছোট বোনটা বেশ মেধাবী। ক্লাসে ফার্স্ট হতো। কিন্তু সে এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারার আগেই চিল্লা থেকে জটিল রোগ বাঁধিয়ে ফিরে এসে বিছানায় পড়েছিল বাবা। অগত্যা সিরাজ পড়াশোনা ফেলে চলে এসেছিল সংসারের হাল ধরতে। বাবার কোনো জমানো অর্থ ছিল না। বাড়ির পাশে ছোট্ট এক প্লট জমি ছিল। সেটি বিক্রি করে বাবার চিকিৎসা করাতে ঢাকায় নিয়ে এসেছিল। কিন্তু চিকিৎসা শুরু হওয়ার আগেই তিনি মারা যান। বেদিশা হয়ে পড়েছিল সিরাজ। হাতে যে টাকা-পয়সা ছিল তা খরচ করে বাধ্য হয়ে ছোট বোনকে বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তার ছোট বোনকে শ্বশুরবাড়ির অনেক অত্যাচার সইতে হচ্ছিল। সিরাজ দু-চোখে অন্ধকার দেখে গ্রামের পরিচিত একজনের হাত ধরে ঢাকায় এসে গার্মেন্টসে স্টিকার ম্যান হিসেবে এই চাকরিটা নিয়েছিল। ছোট বোনকে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার থেকে রক্ষায় প্রায়ই তাকে টাকা পাঠাতে হচ্ছিল। গার্মেন্টসে এই চাকরিটা ছাড়াও টোঙা বানিয়ে বিক্রি করে এবং এটা-সেটা করে তাকে টাকা জোগার করতে হচ্ছিল। অবশেষে অত্যাচার সইতে না পেরে মাস ছয়েক আগে তার ছোট বোন আত্মহত্যা করেছে।
টিফিনের সময় গার্মেন্টসে খুব হুড়োহুড়ি লেগে যায়। সবাই আগে গিয়ে ছাদে বসে সারা দিনের একমাত্র খাবার একটু আরাম করে খেতে চায়। একদিন সিঁড়ি দিয়ে নিজের নিজের টিফিন বক্স নিয়ে দৌড়ে ওঠার সময় একজনের হাতের গুঁতো লেগে পিরুর টিফিন বক্সটি ছিটকে পড়ে গেল একেবারে নিচে। পড়েই ভেতরের খাবারগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেল। সেদিনের পর থেকেই সিরাজ পিরুকে চোখে চোখে রাখছিল। নিজের বোন অত্যাচার সইতে না পেরে নিজেই নিজেকে শেষ করে দিয়েছে। এখন পিরু নামের এই মেয়ে এখানে গোপনে যে অত্যাচার সইছে তাতে অজান্তেই তার ওপর সিরাজের বোন-ভালোবাসা জেগে উঠছিল দিনে দিনে। সে পিরুর এই অবস্থা দেখে এগিয়ে এল এবং পিরুর হাতে নিজের টিফিন বক্সটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘তুমি এই টিফিন বক্সটা নিয়া ছাদের এক কোনায় যাইয়া বসো। আমি তুমার টিফিন বক্স নিয়া আসতেছি।’
পিরু থতমত খেয়ে গেলেও যখন দেখল অচেনা এই লোকটি দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে তার টিফিন বক্সটা কুড়িয়ে আনতে, সে তখন ধীরে ধীরে তার টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে ছাদের এক কোনায় গিয়ে বসে পড়ল। সিরাজ ফিরে এসে তাকে ওভাবে তার টিফিন বক্স নিয়ে বসে থাকতে দেখে একটু রাগের সঙ্গেই বলল, এবং এমনভাবে বলল যেন সে তার কত কালের চেনা! যেন নিজের বোন।
‘কী রে পিরু! এহনও ওইডা হাতে নিয়া বইস্যা আছস! খাইবার পারতাছস না? তোর টিফিন তো সব পইড়্যা গেছে!’
‘বাহ! আমি আপনের টিফিন খামু ক্যা? আপনেরে তো আমি চিনিই না!’
‘চিনুন লাগব না। তোরে তো আমি চিনি।’
এরপর সিরাজ সেদিন রাতে তার সবকিছু জেনে যাওয়া, তার বোনের মর্মান্তিক কাহিনি বলে তাকে সে তার সেই বোনের মতো দেখে, সব সময় তাকে চোখে চোখে রাখে- এসব খুলে বলেছিল। সেদিন থেকেই দুজনে ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল এবং একজন আরেকজনের সব কথা পরস্পরকে খুলে বলেছিল। কিন্তু তারা সেই সুপারভাইজারের চোখ ও কানকে ফাঁকি দিতে পারেনি, যে সুপারভাইজার পিরুকে সেদিন মালিকের রুমে নিয়ে গিয়েছিল। মালিককে সব বলে সে সিরাজকে ছাঁটাই করতে চেয়েছিল, কিন্তু মালিক শুধু ছাঁটাই করাকে যথেষ্ট মনে করেনি। সে একটি চুরির ঘটনা সাজিয়ে সিরাজকে পুলিশে দিয়েছিল। এদিকে পিরুর ওপর অত্যাচারের মাত্রাও বেড়ে গিয়েছিল। সে যাতে চাকরি ছেড়ে পালাতে না পারে সে ব্যবস্থাও পাকা করে রাখা হয়েছিল। রোকেয়া শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে পেরেছে, আর কিছু করতে পারেনি।
ছয় মাসের জেল হয়েছিল সিরাজের। জেলে থাকতেই সে ঠিক করেছিল, ছাড়া পেলে পিরুকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে গিয়ে সংসার পাতবে। পদ্মাপারে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। এক চিলতে যে বসতভিটে ছিল তা পদ্মায় ভেঙে নিয়েছে। তার ইচ্ছে চট্টগ্রামের ইপিজেডে গিয়ে কোনো গার্মেন্টসে কাজ জুটিয়ে নেবে। কিছু একটা করতে পারবে সে আত্মবিশ্বাস তার আছে। তার পর কয়েক বছর টাকা জমিয়ে কোনো গ্রামে গিয়ে জমি লিজ নিয়ে চাষবাস করবে আর একটি গরুর খামার করবে। শুনেছে ঠিকমতো করতে পারলে নাকি তাতে খুব লাভ!
জেল থেকে ছাড়া পেয়েই সেদিন রাতে সে পিরুর মেসে চলে গেল। এর আগে পিরু জেলখানায় তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তারা সবকিছু পাকা করে রেখেছিল। সেদিন নাইট ডিউটি না থাকায় পিরুর মেসে গিয়ে তাকে পেয়ে গেল সিরাজ। পিরুকে সে তখনই সব গুছিয়ে নিতে বলল। পিরু এমন একটাকিছুর জন্য মনে মনে তৈরি হয়েই ছিল। গোছানোর তেমন কিছু নেই। দুই সেট সস্তা থ্রিপিস আর গামছা। ব্যাগ নিয়ে সিরাজের পিছু পিছু যেতে যেতে সে জিজ্ঞেস করল-
‘কই যাইবেন? ঠিক করছেন কিছু?’
‘আগে তো বাইর হই, তার পর দেখবানি। নু।’