সমরেশ বসুর চার দশকের রচনাসম্ভারের দিকে ফিরে তাকালে বোঝা যায়, কথাসাহিত্যের বহুবিচিত্র পথে সঞ্চারিত ছিল তার সৃষ্টিপ্রতিভা। দক্ষিণপন্থি অপরচুনিজম এবং অতিবাম অ্যাডভেঞ্চারিজম নিয়ে আগ্রহ ছিল না তার। মানবজীবনের জটিলতা, সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির সম্বন্ধ, দেশকালের যথার্থ উপলব্ধি- এসবই ছিল তার অন্বিষ্ট। এ কারণেই তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে আছেন।…
শিলারের কথার সূত্র ধরে ওরহান পামুক উপন্যাসকে দুটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করে ব্যাখ্যা করেছেন। এর একটি ‘নেইভ’ বা প্রাকৃতিক, অন্যটি ‘সেন্টিমেন্টাল’ বা ‘আবেগনির্ভর’। এই দ্বিতীয় শ্রেণির রচনাই সাহিত্য- উপন্যাস হচ্ছে এই সাহিত্যের একটা ধারা। উপন্যাসের প্রধান দিকটি হচ্ছে, পামুকই বলছেন, সুচারুভাবে গল্প বলতে পারা। সমরেশ বসুকে নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু তিনি যে চমৎকার করে গল্প বলতে পারতেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে গল্প বলাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। দীর্ঘ সময় ধরে উপন্যাস লেখার পর আত্মকথায় তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমি রাজনৈতিক দিক থেকে কমিটেড বলতে যা বোঝায় আজ আর তা নই। কিন্তু সমগ্র মানবসমাজের কাছে আমি কোনো না কোনোভাবে কমিটেড বটেই, কারণ আমি তো সকল মানুষের মধ্যেই আছি। সেই অর্থে আমি নিজের কাছেই কমিটেড।’ রেমন্ড উইলিয়ামসও লেখক প্রসঙ্গে বলেছিলেন ‘…আ রাইটার কমিটস হিমসেল্ফ’। এই কমিটেড বা দায়বদ্ধতা লেখকের নিজের কাছে নিজের, যা উত্তীর্ণ হয়ে ছুঁয়ে যায় পাঠককে। সমরেশ বসুও
আরেক জায়গায় বলেছেন, তার কাছে লেখালেখিটা হচ্ছে ‘নিরন্তর রচনায় জীবনচর্চা’, অর্থাৎ লেখক হিসেবে সেই কমিটেড থাকা। তিনি এই জীবনচর্চার সফল রূপকার। মহান এই ঔপন্যাসিকের জন্মশতবর্ষে পৌঁছে এ কথাটাই আবার মনে পড়ল।
মোহিনীমোহন বসু ও শৈবলিনী বসুর চার সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ সমরেশ বসুর জন্ম ১৯২৪ সালের ১১ ডিসেম্বর। জন্মেছিলেন ঢাকার রাজনগরে, মাতুলালয়ে। তার পিতৃপ্রদত্ত নাম সুরথনাথ। ঢাকার সুতানুর একবালপুরে তার ছোটবেলা কেটেছে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন ঢাকার গ্রাজুয়েট স্কুলে। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় বারো বছর বয়সে পিতা তাকে নৈহাটি পাঠান। নৈহাটিতে থাকতেন রেলে কর্মরত বড়ো ভাই মন্মথনাথের রেল কোয়ার্টারে। পড়াশোনার চাইতে তার ঝোঁক ছিল ছবি আঁকায়, সংগীতচর্চায়, শরীরচর্চায় আর সামান্য লেখালেখিতে। পড়াশোনা না হওয়ায় বড়ো ভাই তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন। কিছুদিন ঢাকেশ্বরী মিলে শিক্ষানবিশীর কাজ করলেন। পনেরো বছর বয়সে আবার তাকে ফিরিয়ে আনা হলো নৈহাটিতে। সমরেশ ব্যস্ত হলেন অভিনয়চর্চায়। ঢাকায় মঞ্চে অভিনয় করেছিলেন। নৈহাটিতে এসে বাঁশি বাজানো, গান, ছবি আঁকা আর সাহিত্যচর্চায় তার দিন কাটতে লাগল। নৈহাটির বন্ধু দেবশংকর মুখোপাধ্যায় তার নাম রাখলেন ‘সমরেশ’। তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় নৈহাটির হাতেলেখা পত্রিকা ‘বাণী’তে।
একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে বন্ধুর বড়ো বোন গৌরি তার সেবা করেন। গৌরির সঙ্গে সমরেশের ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠল। আঠারো বছরের সমরেশ তার চেয়ে চার বছরের বড়ো গৌরিকে বিয়ে করেন। বাসা বাঁধেন বস্তিতে। দারিদ্র্যের সঙ্গে তখন থেকে তার সংগ্রামের শুরু। যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। পার্টির জন্য তিনি পোস্টার লিখতেন, বিনিময়ে পেতেন আটা-চাল। এর পর চাকরি জোটে কাছের একটা সমরাস্ত্র কারখানায়। সেখানে প্রায় পাঁচ বছর কাজ করেছিলেন। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হলে ওই বছরই তিনি কলকাতা থেকে গ্রেপ্তার হন। স্পেশাল ব্রাঞ্চে জেরা করার পর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় প্রেসিডেন্সি জেলে। জেলবন্দি ছিলেন এক বছর। তখন গৌরি চার সন্তানকে নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ডা. বিধানচন্দ্র রায় বন্দি সমরেশের পরিবারের জন্য দেড় শ টাকা মাসোহারার ব্যবস্থা করেন। ছাড়া পাওয়ার পর মাসোহারা চলে যায়। দারিদ্র্যের কষাঘাতে পরিবারটি তখন জর্জরিত। সমরেশ সিদ্ধান্ত নিলেন, ‘লিখব। লিখেই বাঁচব।’ পরবর্তী ৩৮ বছর (১৯৫১-১৯৮৮) তিনি নিরন্তর লিখে গেছেন আর খ্যাতির শীর্ষে উঠে বাঁচার মতো বেঁচেছেন।
২.
সমরেশের প্রথম লেখা একটি গল্প ‘আদাব’। প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ সালের শারদীয় ‘পরিচয়’ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’, প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে। তবে তার প্রথম রচিত উপন্যাস ‘নয়নপুরের হাট’, লিখেছিলেন সেই সমরাস্ত্র কারখানার কাজের ঘরে বসে। প্রথম গল্পেই তিনি বুঝিয়ে দেন অন্যদের তুলনায় কতটা আলাদা। সমাজ-সম্প্রদায়-গোষ্ঠী-পার্টির মধ্যে থেকেও ব্যক্তির পূর্ণায়ত হওয়ার অদম্য বাসনাই তার অভিজ্ঞান। ব্যক্তির মধ্যে তিনি খুঁজছিলেন মানুষের অশেষত্বকে। আটত্রিশ বছরে সমরেশ বসুর প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা ১০০। গল্পসংকলনের সংখ্যা ১৫, গল্পসংখ্যা দুই শ। কালকূট ছদ্মনামে লিখেছেন ভ্রমণকাহিনি। ছোটদের জন্য লিখেছেন গল্প, গোয়েন্দাকাহিনি, উপন্যাস; চলচ্চিত্রের জন্য গল্প-উপন্যাসের চিত্রনাট্য। সম্পাদনা করেছেন একটি মাসিক সাহিত্যপত্র। সমরেশ বসু ছিলেন বহুপ্রজ পরিশ্রমী লেখক। সাহিত্যই ছিল তার জীবিকা। ‘গঙ্গা’ উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার (১৯৫৮ আর ‘শাম্ব’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (১৯৮০)।
সমরেশ বসুর উপন্যাসগুলোর নয়টি শ্রেণিবিভাগের কথা বলেছেন বিশিষ্ট একজন গবেষক, এগুলো হচ্ছে :
১. গ্রামীণ ও শ্রমিক সমাজ; ২. পেটি-বুর্জোয়া সমাজের অবক্ষয়; ৩. মধ্যবিত্তের আশ্রয়হীনতা, অস্থিরতা, ক্রোধ, পাপবোধ; ৪. হৃতমূল্যবোধের সন্ধান ও বিচার; ৫. প্রেমের অন্বেষণ, ব্যক্তির মূল্যসন্ধান; ৬. অস্থির তারুণ্যের জীবনের মূল্যসন্ধান; ৭. নিঃসঙ্গ ব্যক্তিমানুষের একক সংগ্রাম; ৮. সামগ্রিক যুগচিত্র এবং ৯. জীবনী-উপন্যাস।
স্থান-স্বল্পতার কারণে এখানে আমি দু-তিনটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস সম্পর্কে আলোচনা করছি।
‘গঙ্গা’ সমরেশ বসুর প্রথম পর্বের সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস। এটি নায়কপ্রধান এমন একটি উপন্যাস যেখানে সমকালীন সমাজের বিবর্ণ শ্রান্ত পরিবেশে এক আশ্চর্য মানবিক ঔদ্ধত্যের দেখা পাই। জীবন চলিষ্ণু স্রোত। মানুষ শ্রমে, স্বেদে, ক্লান্তিতে অপরাজেয়। কিন্তু আকাঙ্ক্ষা তার দুর্মর। নদী তার অস্তিত্বে জাগিয়ে তোলে সমুদ্রের স্বপ্ন।
‘মহাকালের রথের ঘোড়া’ তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। পার্টি থেকে সরে এসে পার্টির মধ্যেই ফাটল, ভাঙচুর দেখতে পায় এর নায়ক। শ্রেণিশত্রু সম্পর্কেও তার মনে প্রশ্ন জাগে। সমরেশের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী উপন্যাস ‘যুগ যুগ জীয়ে’। দেশকালের জটিল রূপটি এই উপন্যাসে ধরতে চেয়েছেন সমরেশ।
এভাবেই ব্যক্তির মুক্তি বিস্ফোরক হয়ে ধরা পড়েছে তার আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘বিবর’-এ। এই উপন্যাসে ভণিতাহীন, নিষ্করুণ, আত্মসমালোচনামূলক, বিদ্রুপাত্মক স্বগতোক্তির মধ্যদিয়ে সুবিধাবাদী মধ্যবিত্তকে নগ্নভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। অনায্য সমাজব্যবস্থায় ভণ্ডামি ও মিথ্যাচারের গণ্ডিতে আবদ্ধ ব্যক্তিসুখের ‘বিবর’ থেকে নিষ্ক্রমণের এই গল্পটি মধ্যবিত্ত যুবসমাজের অকপট সত্যভাষণ হয়ে উঠেছে। সমরেশের অন্বেষা ছিল ব্যক্তির এই মুক্তি। ‘বিবর’, ‘প্রজাপতি’, ‘পাতক’ ইত্যাদি উপন্যাসে সমরেশ ব্যক্তির বিপন্ন অস্তিত্ব বনাম তার স্বাধীনতার দ্বন্দ্বময় সমগ্রতাকে নানাভাবে হাজির করেছেন। ‘বিজন বিভুঁই’, ‘অভিজ্ঞান’, ‘শিকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে’, ‘তিন পুরুষ’, ‘খণ্ডিতা’ উপন্যাসে প্রধান হয়ে উঠেছে ধনতন্ত্রের মধ্যে ক্ষতবিক্ষত, বিমূঢ়, বিভ্রান্ত তৃতীয় বিশ্বের যুবাশ্রেণির ব্যক্তিক সংকট। জীবনের অন্তিমে রামকিঙ্কর বেইজকে নিয়ে লেখা ‘দেখি নাই ফিরে’ জীবনীভিত্তিক উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে ব্যক্তির স্বাধীনতা সংগ্রামের যন্ত্রণাবিদ্ধ ক্লাসিক রূপক।
৩.
সমরেশ বসুর চার দশকের রচনাসম্ভারের দিকে ফিরে তাকালে বোঝা যায়, কথাসাহিত্যের বহুবিচিত্র পথে সঞ্চারিত ছিল তার সৃষ্টিপ্রতিভা। দক্ষিণপন্থি অপরচুনিজম এবং অতিবাম অ্যাডভেঞ্চারিজম নিয়ে আগ্রহ ছিল না তার। মানবজীবনের জটিলতা, সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির সম্বন্ধ, দেশকালের যথার্থ উপলব্ধি– এসবই ছিল তার অন্বিষ্ট। এ কারণেই তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে আছেন। পামুক যাকে বলেছিলেন, উপন্যাসকে হতে হয় ‘সেন্টিমেন্টাল’ বা নান্দনিক বিনির্মাণ, সমরেশ বসু ছিলেন তারই উজ্জ্বল প্রতিনিধি। তার জন্মশতবর্ষের মুহূর্তে বাংলা সাহিত্যের মহান এই লেখকের প্রতি জ্ঞাপন করছি সশ্রদ্ধ অভিবাদন।