ঢাকা ১২ মাঘ ১৪৩১, রোববার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫
English
রোববার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ মাঘ ১৪৩১

মানুষের অশেষত্বের রূপকার সমরেশ বসু

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:১১ পিএম
আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:১১ পিএম
মানুষের অশেষত্বের রূপকার সমরেশ বসু
আঁকা: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

সমরেশ বসুর চার দশকের রচনাসম্ভারের দিকে ফিরে তাকালে বোঝা যায়, কথাসাহিত্যের বহুবিচিত্র পথে সঞ্চারিত ছিল তার সৃষ্টিপ্রতিভা। দক্ষিণপন্থি অপরচুনিজম এবং অতিবাম অ্যাডভেঞ্চারিজম নিয়ে আগ্রহ ছিল না তার। মানবজীবনের জটিলতা, সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির সম্বন্ধ, দেশকালের যথার্থ উপলব্ধি- এসবই ছিল তার অন্বিষ্ট। এ কারণেই তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে আছেন।…

শিলারের কথার সূত্র ধরে ওরহান পামুক উপন্যাসকে দুটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করে ব্যাখ্যা করেছেন। এর একটি ‘নেইভ’ বা প্রাকৃতিক, অন্যটি ‘সেন্টিমেন্টাল’ বা ‘আবেগনির্ভর’। এই দ্বিতীয় শ্রেণির রচনাই সাহিত্য- উপন্যাস হচ্ছে এই সাহিত্যের একটা ধারা। উপন্যাসের প্রধান দিকটি হচ্ছে, পামুকই বলছেন, সুচারুভাবে গল্প বলতে পারা। সমরেশ বসুকে নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু তিনি যে চমৎকার করে গল্প বলতে পারতেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে গল্প বলাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। দীর্ঘ সময় ধরে উপন্যাস লেখার পর আত্মকথায় তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমি রাজনৈতিক দিক থেকে কমিটেড বলতে যা বোঝায় আজ আর তা নই। কিন্তু সমগ্র মানবসমাজের কাছে আমি কোনো না কোনোভাবে কমিটেড বটেই, কারণ আমি তো সকল মানুষের মধ্যেই আছি। সেই অর্থে আমি নিজের কাছেই কমিটেড।’ রেমন্ড উইলিয়ামসও লেখক প্রসঙ্গে বলেছিলেন ‘…আ রাইটার কমিটস হিমসেল্ফ’। এই কমিটেড বা দায়বদ্ধতা লেখকের নিজের কাছে নিজের, যা উত্তীর্ণ হয়ে ছুঁয়ে যায় পাঠককে। সমরেশ বসুও 
আরেক জায়গায় বলেছেন, তার কাছে লেখালেখিটা হচ্ছে ‘নিরন্তর রচনায় জীবনচর্চা’, অর্থাৎ লেখক হিসেবে সেই কমিটেড থাকা। তিনি এই জীবনচর্চার সফল রূপকার। মহান এই ঔপন্যাসিকের জন্মশতবর্ষে পৌঁছে এ কথাটাই আবার মনে পড়ল।

মোহিনীমোহন বসু ও শৈবলিনী বসুর চার সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ সমরেশ বসুর জন্ম ১৯২৪ সালের ১১ ডিসেম্বর। জন্মেছিলেন ঢাকার রাজনগরে, মাতুলালয়ে। তার পিতৃপ্রদত্ত নাম সুরথনাথ। ঢাকার সুতানুর একবালপুরে তার ছোটবেলা কেটেছে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন ঢাকার গ্রাজুয়েট স্কুলে। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় বারো বছর বয়সে পিতা তাকে নৈহাটি পাঠান। নৈহাটিতে থাকতেন রেলে কর্মরত বড়ো ভাই মন্মথনাথের রেল কোয়ার্টারে। পড়াশোনার চাইতে তার ঝোঁক ছিল ছবি আঁকায়, সংগীতচর্চায়, শরীরচর্চায় আর সামান্য লেখালেখিতে। পড়াশোনা না হওয়ায় বড়ো ভাই তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন। কিছুদিন ঢাকেশ্বরী মিলে শিক্ষানবিশীর কাজ করলেন। পনেরো বছর বয়সে আবার তাকে ফিরিয়ে আনা হলো নৈহাটিতে। সমরেশ ব্যস্ত হলেন অভিনয়চর্চায়। ঢাকায় মঞ্চে অভিনয় করেছিলেন। নৈহাটিতে এসে বাঁশি বাজানো, গান, ছবি আঁকা আর সাহিত্যচর্চায় তার দিন কাটতে লাগল। নৈহাটির বন্ধু দেবশংকর মুখোপাধ্যায় তার নাম রাখলেন ‘সমরেশ’। তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় নৈহাটির হাতেলেখা পত্রিকা ‘বাণী’তে।

একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে বন্ধুর বড়ো বোন গৌরি তার সেবা করেন। গৌরির সঙ্গে সমরেশের ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠল। আঠারো বছরের সমরেশ তার চেয়ে চার বছরের বড়ো গৌরিকে বিয়ে করেন। বাসা বাঁধেন বস্তিতে। দারিদ্র্যের সঙ্গে তখন থেকে তার সংগ্রামের শুরু। যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। পার্টির জন্য তিনি পোস্টার লিখতেন, বিনিময়ে পেতেন আটা-চাল। এর পর চাকরি জোটে কাছের একটা সমরাস্ত্র কারখানায়। সেখানে প্রায় পাঁচ বছর কাজ করেছিলেন। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হলে ওই বছরই তিনি কলকাতা থেকে গ্রেপ্তার হন। স্পেশাল ব্রাঞ্চে জেরা করার পর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় প্রেসিডেন্সি জেলে। জেলবন্দি ছিলেন এক বছর। তখন গৌরি চার সন্তানকে নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ডা. বিধানচন্দ্র রায় বন্দি সমরেশের পরিবারের জন্য দেড় শ টাকা মাসোহারার ব্যবস্থা করেন। ছাড়া পাওয়ার পর মাসোহারা চলে যায়। দারিদ্র্যের কষাঘাতে পরিবারটি তখন জর্জরিত। সমরেশ সিদ্ধান্ত নিলেন, ‘লিখব। লিখেই বাঁচব।’ পরবর্তী ৩৮ বছর (১৯৫১-১৯৮৮) তিনি নিরন্তর লিখে গেছেন আর খ্যাতির শীর্ষে উঠে বাঁচার মতো বেঁচেছেন।

২.
সমরেশের প্রথম লেখা একটি গল্প ‘আদাব’। প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ সালের শারদীয় ‘পরিচয়’ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’, প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে। তবে তার প্রথম রচিত উপন্যাস ‘নয়নপুরের হাট’, লিখেছিলেন সেই সমরাস্ত্র কারখানার কাজের ঘরে বসে। প্রথম গল্পেই তিনি বুঝিয়ে দেন অন্যদের তুলনায় কতটা আলাদা। সমাজ-সম্প্রদায়-গোষ্ঠী-পার্টির মধ্যে থেকেও ব্যক্তির পূর্ণায়ত হওয়ার অদম্য বাসনাই তার অভিজ্ঞান। ব্যক্তির মধ্যে তিনি খুঁজছিলেন মানুষের অশেষত্বকে। আটত্রিশ বছরে সমরেশ বসুর প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা ১০০। গল্পসংকলনের সংখ্যা ১৫, গল্পসংখ্যা দুই শ। কালকূট ছদ্মনামে লিখেছেন ভ্রমণকাহিনি। ছোটদের জন্য লিখেছেন গল্প, গোয়েন্দাকাহিনি, উপন্যাস; চলচ্চিত্রের জন্য গল্প-উপন্যাসের চিত্রনাট্য। সম্পাদনা করেছেন একটি মাসিক সাহিত্যপত্র। সমরেশ বসু ছিলেন বহুপ্রজ পরিশ্রমী লেখক। সাহিত্যই ছিল তার জীবিকা। ‘গঙ্গা’ উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার (১৯৫৮ আর ‘শাম্ব’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (১৯৮০)। 

সমরেশ বসুর উপন্যাসগুলোর নয়টি শ্রেণিবিভাগের কথা বলেছেন বিশিষ্ট একজন গবেষক, এগুলো হচ্ছে : 

১. গ্রামীণ ও শ্রমিক সমাজ; ২. পেটি-বুর্জোয়া সমাজের অবক্ষয়; ৩. মধ্যবিত্তের আশ্রয়হীনতা, অস্থিরতা, ক্রোধ, পাপবোধ; ৪. হৃতমূল্যবোধের সন্ধান ও বিচার; ৫. প্রেমের অন্বেষণ, ব্যক্তির মূল্যসন্ধান; ৬. অস্থির তারুণ্যের জীবনের মূল্যসন্ধান; ৭. নিঃসঙ্গ ব্যক্তিমানুষের একক সংগ্রাম; ৮. সামগ্রিক যুগচিত্র এবং ৯. জীবনী-উপন্যাস। 

স্থান-স্বল্পতার কারণে এখানে আমি দু-তিনটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস সম্পর্কে আলোচনা করছি। 

‘গঙ্গা’ সমরেশ বসুর প্রথম পর্বের সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস। এটি নায়কপ্রধান এমন একটি উপন্যাস যেখানে সমকালীন সমাজের বিবর্ণ শ্রান্ত পরিবেশে এক আশ্চর্য মানবিক ঔদ্ধত্যের দেখা পাই। জীবন চলিষ্ণু স্রোত। মানুষ শ্রমে, স্বেদে, ক্লান্তিতে অপরাজেয়। কিন্তু আকাঙ্ক্ষা তার দুর্মর। নদী তার অস্তিত্বে জাগিয়ে তোলে সমুদ্রের স্বপ্ন। 

‘মহাকালের রথের ঘোড়া’ তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। পার্টি থেকে সরে এসে পার্টির মধ্যেই ফাটল, ভাঙচুর দেখতে পায় এর নায়ক। শ্রেণিশত্রু সম্পর্কেও তার মনে প্রশ্ন জাগে। সমরেশের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী উপন্যাস ‘যুগ যুগ জীয়ে’। দেশকালের জটিল রূপটি এই উপন্যাসে ধরতে চেয়েছেন সমরেশ।

এভাবেই ব্যক্তির মুক্তি বিস্ফোরক হয়ে ধরা পড়েছে তার আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘বিবর’-এ। এই উপন্যাসে ভণিতাহীন, নিষ্করুণ, আত্মসমালোচনামূলক, বিদ্রুপাত্মক স্বগতোক্তির মধ্যদিয়ে সুবিধাবাদী মধ্যবিত্তকে নগ্নভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। অনায্য সমাজব্যবস্থায় ভণ্ডামি ও মিথ্যাচারের গণ্ডিতে আবদ্ধ ব্যক্তিসুখের ‘বিবর’ থেকে নিষ্ক্রমণের এই গল্পটি মধ্যবিত্ত যুবসমাজের অকপট সত্যভাষণ হয়ে উঠেছে। সমরেশের অন্বেষা ছিল ব্যক্তির এই মুক্তি। ‘বিবর’, ‘প্রজাপতি’, ‘পাতক’ ইত্যাদি উপন্যাসে সমরেশ ব্যক্তির বিপন্ন অস্তিত্ব বনাম তার স্বাধীনতার দ্বন্দ্বময় সমগ্রতাকে নানাভাবে হাজির করেছেন। ‘বিজন বিভুঁই’, ‘অভিজ্ঞান’, ‘শিকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে’, ‘তিন পুরুষ’, ‘খণ্ডিতা’ উপন্যাসে প্রধান হয়ে উঠেছে ধনতন্ত্রের মধ্যে ক্ষতবিক্ষত, বিমূঢ়, বিভ্রান্ত তৃতীয় বিশ্বের যুবাশ্রেণির ব্যক্তিক সংকট। জীবনের অন্তিমে রামকিঙ্কর বেইজকে নিয়ে লেখা ‘দেখি নাই ফিরে’ জীবনীভিত্তিক উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে ব্যক্তির স্বাধীনতা সংগ্রামের যন্ত্রণাবিদ্ধ ক্লাসিক রূপক।

৩.
সমরেশ বসুর চার দশকের রচনাসম্ভারের দিকে ফিরে তাকালে বোঝা যায়, কথাসাহিত্যের বহুবিচিত্র পথে সঞ্চারিত ছিল তার সৃষ্টিপ্রতিভা। দক্ষিণপন্থি অপরচুনিজম এবং অতিবাম অ্যাডভেঞ্চারিজম নিয়ে আগ্রহ ছিল না তার। মানবজীবনের জটিলতা, সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির সম্বন্ধ, দেশকালের যথার্থ উপলব্ধি– এসবই ছিল তার অন্বিষ্ট। এ কারণেই তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে আছেন। পামুক যাকে বলেছিলেন, উপন্যাসকে হতে হয় ‘সেন্টিমেন্টাল’ বা নান্দনিক বিনির্মাণ, সমরেশ বসু ছিলেন তারই উজ্জ্বল প্রতিনিধি। তার জন্মশতবর্ষের মুহূর্তে বাংলা সাহিত্যের মহান এই লেখকের প্রতি জ্ঞাপন করছি সশ্রদ্ধ অভিবাদন।

গ্রন্থপরিচয়

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০৭ পিএম
আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০৮ পিএম
গ্রন্থপরিচয়
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

জীবনানন্দ ও তাঁর পরিজন
আপেল মাহমুদ (সম্পাদক)
শ্রেণি: সাহিত্য কাগজ
প্রকাশনী: উয়ারী বটেশ্বর, ঢাকা
প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০২৪
পৃষ্ঠা: ৩৬৮; মূল্য: ৬০০ টাকা
সাগর জলে লাখ লাখ ঝিনুক পাওয়া যায়। কিন্তু সব ঝিনুকে মুক্তো থাকে না। খুঁজে মুক্তো বের করতে হয়। তেমনি জীবনানন্দ দাশের বাক্সবন্দি কবিতা, গল্প-উপন্যাস-ডায়েরি জনসমাজে আনার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন কিছু লেখক-গবেষক। তারা জীবনানন্দের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অসীম প্রতিভাকে প্রস্ফুটনের কাজ করেছিলেন। জীবনানন্দ গবেষণাকে তারা তপস্যা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এদের মধ্যে ডা. ভূমেন্দ্র গুহ, দেবীপ্রাসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, আবদুল মান্নান সৈয়দ, ক্লিনটন বি সিলি, প্রভাতকুমার দাস, সমরেন্দ্র দাশগুপ্ত, গৌতম মিত্র, ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, আমীন আল রশীদ ও মাসউদ আহমদ হলেন অন্যতম। 

জীবনানন্দ বিষয়ক লেখালেখির কোনো অন্ত নেই। বর্তমানে তাকে ঘিরে যে গবেষণা হচ্ছে সেটাও বেশ উল্লেখযোগ্য। পেন্ডরার বাক্স থেকে অনেক চাঞ্চল্যকর পাণ্ডুলিপি বের হয়ে বই হয়ে পাঠকের টেবিলে চলে আসছে। এই অবস্থায় জীবনানন্দকে নিয়ে আরেকটি পাণ্ডুলিপির জন্ম হলো। এর বিষয়বস্তু জীবনানন্দের আত্মীয়-স্বজন, দাস পরিবার, বরিশাল ব্রাহ্মসমাজ, নদনদী, শিক্ষাদীক্ষা প্রভৃতি। প্রসঙ্গক্রমে এসেছে বরিশালের সংস্কৃতি, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, স্কুল-কলেজ, জীবনানন্দের বরিশালের জীবন, তার সহকর্মী ও সহপাঠীদের বিবরণ। এতে কবির প্রথম প্রেম মনিয়া, লাল গির্জা, অক্সফোর্ড মিশন লাইব্রেরি, ব্রজমোহন কলেজ স্কুল, সর্বানন্দ ভবন প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমেরিকান গবেষক ক্লিনটন বি সিলি দীর্ঘদিন অনুসন্ধান চালিয়ে কবি জীবনানন্দকে বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী একজন লেখক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি জীবনান্দকে ‌অনন্য হিসেবে উপাধি দিয়েছেন।... 


মেয়েটিকে বাঁচানো গেল না
ইকরাম কবীর 
শ্রেণি: গল্প সংগ্রহ
প্রকাশনী: রচয়িতা, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০২০
পৃষ্ঠা: ১০০; মূল্য: ২৫০ টাকা


খুদে গল্পের বই
ইকরাম কবীর 
শ্রেণি: গল্প সংগ্রহ
প্রকাশনী: আজব, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, সেপ্টেম্বর ২০২৪
পৃষ্ঠা: ১৫২; মূল্য: ৪০০ টাকা


গল্প একটা বোধ
গল্প একটা চেতনা
গল্প একটা অস্ত্র
গল্পের মাঝে নিজেকে পাওয়া যায়
গল্পের মাঝে মানুষদের খুঁজে পাওয়া যায়।...

পৃথিবীর কোথাও না-কোথাও কিছু না-কিছু ঘটছে। সারাক্ষণ ঘটছে। পার্থিব কিংবা অপার্থিব। বাস্তব কিংবা অবাস্তব। এর কিছু দেখা যায়, শোনা যায়। বেশির ভাগই যায় না। তবে ঘটে। ঘটেছে। শুধু তা বলা হয় না, শোনা হয় না। সেগুলো অন্তর দিয়ে দেখতে হয়, শুনতে হয়। এই না-বলা ঘটনাগুলোই এক সময় গল্প হয়ে যায়। 

মানুষের চোখের দিকে তাকালে বোঝা যায় তার ভেতরে কত গল্প জমে আছে। যেন নিঃশব্দে ঝংকারিত হাজারো সুর সংগীতায়িত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। গল্পগুলো বলার অপেক্ষায়, সুরগুলো শোনার অপেক্ষায়। সবাই গল্পগুলো বলতে পারেন না, সুরগুলো শোনাতে পারেন না। তবে তারা চায় বলতে, শোনাতে। একজন গল্পকারে নৈপুণ্য এখানেই গুরুত্বপূর্ণ। তাকে গল্পগুলো খুঁজে পেতে হয়। উৎস থেকে একটি বীজ আহরণ করে অঙ্কুরিত করাতে হয়। ডালপালা মেলে দিয়ে ফুল ফোটাতে হয়। গল্প লেখা এমনই এক যাত্রা। মনস্তাত্ত্বিক এক যাত্রা যা অন্তরের অনেক গভীর থেকে সঞ্চারিত হয়। প্রায়ই যাত্রাভঙ্গ হয়। আবার নতুন যাত্রা শুরু হয়। এই গ্রন্থে আছে- খুব সাধারণ দৈনিন্দিন প্রেমের গল্প, তেমনই জটিল চিন্তা গল্প। দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, সম্পর্ক, আধুনিকতার অগভীরতা, আধ্যাত্মিকতা- এর সবই দুই মলাটে বন্দি হয়েছে।

দেখতে চাই বইমেলার বাইরে বই বিক্রির সম্ভাবনা কতুটুকু

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৫৫ পিএম
দেখতে চাই বইমেলার বাইরে বই বিক্রির সম্ভাবনা কতুটুকু
রবীন আহসান

এবারের বইমেলায় আপনি অংশগ্রহণ করেননি কেন? 

নানা কারণে এবারের একুশের বইমেলায় আমরা অংশগ্রহণ করিনি। একটি প্রধান কারণ দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে চলছে মব শাসন! আগের সরকারের সময়ও আমরা দুবার বইমেলায় অশংগ্রহণ করিনি ইচ্ছে করে! আমরা আসলে দেখতে চেয়েছি বইমেলার বাইরে বই বিক্রির সম্ভাবনা কতুটুকু আছে! এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুবিষয়ক বই প্রকাশকদের হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে অনলাইনে, এসব কারণেও আমরা এবারের বইমেলায় অংশ নিইনি।

প্রায় প্রতিবছর আপনার অংশগ্রহণটা ব্যতিক্রমী ছিল। সেটা ধরে রাখতে অন্য কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন কি না?  

বইমেলায় আমরা শ্রাবণ প্রকাশনীতে গত কয়েক বছর একটা খোলা জানালা বানাতাম ‘শ্রাবণের জানালা’। এটা একটা কবিতার মতো বিষয় ছিল! হাজার হাজার মানুষ এই জানালায় ছবি তুলত। এটা মিস করব এবার। মিস করব লেখক-বন্ধু-পাঠকদের ২৮ দিনের আড্ডা! এসবের পরও আমরা অনলাইনে একুশে বইমেলা আয়োজন করেছি মাসব্যাপী! আমাদের ফেব্রুয়ারিবিডি.কম নামে নতুন ওয়েবসাইট থেকে এই মেলার কাজ চলবে।

ফেব্রুয়ারিবিডি.কম-এর মাসব্যাপী অনলাইন বইমেলার আয়োজন করতে যাচ্ছেন। এই ধরনের ব্যতিক্রমী চিন্তা কীভাবে এল? 

২০২১ সালেও আমরা বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলায় অংশ নিইনি। সে বছর আমরা অনলাইন বইমেলার আয়োজন করেছিলাম মাসব্যাপী। ফেব্রুয়ারিবিডি.কম শুধু শ্রাবণ প্রকাশনীর বই বিক্রি করবে না। এ বছর অনলাইন বইমেলায় আমরা প্রগতিশীল লেখক প্রকাশকদের বল বই বিক্রির আয়োজন করছি অনলাইনে।

অনলাইন বইমেলার সুবিধা এবং অসুবিধা কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন? 

অনলাইন বইমেলার বড় সমস্যা হচ্ছে, পাঠক একটি বই ধরে দেখতে পারে না। নতুন বইয়ের গন্ধটা শুকতে পারে না আর বইমেলায় যেভাবে আড্ডা দিতে দিতে চা খেতে খেতে একটা বই কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে কিনতে পারে, এখানে তা পারে না। এ ছাড়া বইমেলার কমিশনেই পাঠক ঘরে বসে আরামে বই কিনতে পারে।

ফেব্রুয়ারিবিডি.কম-এর ওয়েবসাইট আপনি কীভাবে সাজিয়েছেন, যাতে পাঠক উপকৃত হবেন। 

ফেব্রুয়ারিবিডি.কম ওয়েবসাইটটি আমরা মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও প্রগতিশীল বই দিয়ে সাজাচ্ছি; যাতে মুক্তমনা পাঠক তাদের প্রিয় বই সহজেই কিনতে পারে। বই কেনা নয়, শুধু এখানে বই আলোচনা, বই সংবাদ-লেখক সংবাদ থাকবে। আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে বই নিয়ে থাকবে লাইভ অনুষ্ঠান। থাকবে কবিতাসন্ধ্যা আবৃত্তি, গান ও আড্ডা।

অনলাইন বইমেলা কতটুকু জনপ্রিয়তা পাবে বলে আপনি মনে  করেন। ভবিষ্যতে অনলাইন বইমেলা পাঠকদের কাছে পৌঁছাতে আপনার পরিকল্পনা কী?

অনলাইন বইমেলা এখন থেকে চালু হলে অল্প সময়ের মধ্যে এটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন গাড়ি ভাড়া দিয়ে জ্যামে বসে না থেকে তাদের প্রিয় বইটি ঘরে বসে সংগ্রহ করতে চাইবে। এখন তো দুনিয়া ডিজিটাল, মানুষজন ঘরে বসেই কেনাকাটা করছে। ফলে বইকে বইয়ের বিষয় যদি আমরা অনলাইলে জনপ্রিয় করতে পারি, তবে পাঠক বেশি বেশি বই অনলাইন বইমেলা থেকে কিনবে। এখন কিন্তু সারা বছর বই অনলাইনেই বেশি বিক্রি হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো কাগজের বই কিনবে না তার প্রস্তুতি চলছে। ফলে আমরা ডিজিটাল বই প্রকাশের দিকেও এগোব। 

ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।

সাক্ষাৎকার: সানজিদুল ইসলাম সকাল

রবীন আহসান 
শ্রাবণ প্রকাশনী, ঢাকা

নু

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৫২ পিএম
নু
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

নাইট ডিউটি চলছিল। শেষরাতের একটু আগে আগে চোখ দুটি ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছিল। দুবার চোখে পানি ছিটিয়েও ঘুম তাড়াতে না পেরে সিরাজ অগত্যা বাইরের দিকের বাড়তি সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠেছিল একটি সিগারেট ধরাতে। এই বাড়তি সিঁড়িটা মোটামুটি ফাঁকাই থাকে। নেহাত দরকার না হলে এটি কেউ বড় একটা ব্যবহার করতে যায় না। ছাদে উঠে প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে চেপে ধরে দেয়াশলাই বের করতেই থেমে যেতে হয়েছিল তাকে। একটি শব্দ তার হাত দুটিকে থামিয়ে দিয়েছিল। খাড়া করে দিয়েছিল কান দুটিকে।

কান্নার শব্দটা আসছিল পানির ট্যাংকের উল্টোপাশ থেকে। ফুঁপিয়ে কান্না। ভীষণ ভড়কে গিয়েছিল সে। মনের ভেতর জেগে উঠেছিল বেপরোয়া কৌতূহল। ট্যাংকের যে পাশে ছিল সেখান থেকে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেয়েছিল মাথাটাকে সামনে বাড়িয়ে। কান দুটো খাড়া হয়ে গিয়েছিল। দেয়ালঘেঁষে আলগোছে এগিয়ে গিয়ে নিজেকে পুরোপুরি লুকিয়ে রেখে মাথাটাকে মিনিটের কাঁটা বানিয়ে ধীরে ধীরে সামনে বাড়িয়ে ট্যাংকের ও-পাশটাতে নজর বুলিয়েই সে দেখতে পেয়েছিল এক মেয়ে মুখে ওড়না চেপে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

ভীষণ খটকা লেগেছিল সিরাজের। ভালো করে তাকিয়েছিল। আবছা আলো। চেনা যাচ্ছিল না। সিঁড়ির সামনে একটি বাল্ব জ্বলছিল যদিও, কিন্তু দরজার পাল্লার ও-পাশে বলে এটির আলো সরাসরি ছাদে আসছিল না। চোখ সরু করে পুরো ফোকাসে মেলেও সে চিনতে পারল না। হয়তো নতুন এসেছে। গার্মেন্টসে নতুন চাকরিতে ঢুকে অনেক মেয়ে কাজের চাপে দিশেহারা হয়ে কাঁদে অবশ্য, কিন্তু কেন যেন সিরাজের এ কান্নাকে সে ধরনের কান্না মনে হচ্ছিল না। তবে কি...!

ভাবনাটা আরেকটু সামনে বাড়ার আগেই ত্রস্তব্যস্ত হয়ে আরেকজন মেয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ছাদে পা রেখে প্রথমে এদিক-সেদিক নজর বুলিয়ে কী একটা খুঁজল; তার পর জোর কদমে পা চালিয়ে ট্যাংকের দিকে ছুটে এল। বোধ করি ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ কানে যেতেই। এসেই কাঁদতে থাকা মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল:

‘কী রে পিরু! তুই এনে এম্বায় কাঁনতাছস ক্যা?’

গলার স্বর শুনেই চিনে ফেলেছিল সিরাজ। রোকেয়া। অ্যামব্রয়ডারি বিভাগের সিনিয়র অপারেটর। সিরাজেরও সিনিয়র। অনুমান করে নিয়েছিল, এই রোকেয়া আপাই নতুন এই মেয়েকে এনেছেন। পিরু নামের কাঁদতে থাকা মেয়ে এবার রোকেয়াকে জড়িয়ে ধরে শরীর কাঁপিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। রোকেয়া তাকে বুকে চেপে ধরে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করেছিল:

‘এহন আমারে ক ছেন, তোর কী অইছে? তোরে না সুপারভাইজার স্যার আইস্যা বসের রুমে নিয়া গেল? আমারে কইয়া গেল, তোরে বলে কী একখান কা গেলাম যেম বুঝাইয়া দিব মালিক। আমি তো আরও খুশি অইয়া গেলাম যে, যাক, তোর ওপরে মালিকের সুনজর পড়ছে!’
‘আমার সব্বোনাশ অইছে রোকেয়া বু! আমারে...’

আর কোনো কথা বলতে পারল না পিরু নামের এই মেয়ে। হাউমাউ করে কেঁদে রোকেয়াকে আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরেছিল। যা বোঝার বুঝে গিয়েছিল রোকেয়া। দূরে দাঁড়িয়ে সিরাজও বুঝেছিল। তবে ওদের বুঝতে দেয়নি। রোকেয়াও কেঁদে উঠেছিল এবং এর পরপরই নিজেদের অবস্থান বুঝতে পেরে সতর্ক হয়ে উঠেছিল। যে কেউ এখন ছাদে উঠে আসতে পারে। এদিক সেদিক তাকিয়ে নিজের ওড়না দিয়ে পিরুর মুখ চেপে ধরে তাকে শান্ত করার চেষ্টায় ফিসফিসিয়ে বলেছিল-

‘খবরদার! এই কথা য্যান্ কেউ কুনুদিন জানবার না পারে! আমি দেহি কী করবার পারি। আমাগো তো বুইন পুড়া কপাল! মাইনষের নাত্থি-গুঁতা খাইয়া আর বেইজ্জতি অইয়াই আমাগো বাঁইচ্যা থাহুন লাগে। এহন যুদি আমি কিছু কইবার যাই তাইলে তোর তো চাকরি যাইবই, আমারও চাকরি চইল্যা যাইব। বুইন রে, প্যাটের জ্বালা অইতাছে বড় জ্বালা। আমার খালা, তোর মা যে মরুন্যা ব্যারামে পড়ছে, হ্যারে বাঁচাইয়া রাখবার চাইলে তোর তো চাকরি করুনই লাগব। তোরে কি কমু বোইন, আমার নিজেরও কইলাম কম বেইজ্জতি অইতে অয় নাই! এই বেবাক কিছু সইবার পারছি বইল্যাই না চাকরিতে আমার ইট্টু উন্নতি অইছে! তয় তোরে আর আমি বেইজ্জতি অইবার দিমু না...’

সিরাজ আর ওদের কোনো কথা শুনতে পেল না। পিরুকে কিছুটা শান্ত করে টেনে তুলে ছাদের দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করেছিল রোকেয়া। সিঁড়ির গোড়ায় আলোতে যাওয়ার পর সিরাজ পিরুর চেহারা দেখতে পেয়েছিল। শ্যামলা। তবে দেখতে বেশ!

ব্যাপারটাকে নিজের ভেতর চেপে রেখে এর পর থেকে পিরুর ওপর নজর রাখছিল সিরাজ। নিছক কৌতূহলের বশেই। এমনিতে কারও কোনো ব্যাপারে কখনো কোনো আগ্রহ জাগে না তার। নিজের কাজ নিয়ে থাকে। নিজের মতো চলে। নিজের সমস্যায় এমন নাকানি-চুবানি খেতে থাকে যে, অন্য কারও বা অন্য কিছুর কথা ভাববারও ফুরসত থাকে না। লেখাপড়া শেষ করতে পারার আগেই আয়-রোজগারের উপায় খুঁজে নিতে হয়েছিল তাকে। বাবা ছিলেন পদ্মাপারের এক প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। বছর পাঁচেক আগে মা মারা যাওয়ার পর থেকেই সংসারে ভাটার টান শুরু হয়েছিল। বাবা দিন দিন জাগতিক সব কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছিলেন। মাঝে মাঝেই তবলিগের চিল্লায় চলে যেতেন। তখন সংসারের কোনো খোঁজই রাখতেন না। বড় বোনের অবশ্য বিয়ে হয়েছিল মা মারা যাওয়ার আগেই। তিন ভাইবোনের ভেতর সে বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান। লেখাপড়ায় খুব একটা ভালো ছিল না। কোনোরকমে এসএসসি পাস করার পর শহরে গিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। একটা মেসে থাকত আর টিউশনি করে চলত। ছোট বোনটা বেশ মেধাবী। ক্লাসে ফার্স্ট হতো। কিন্তু সে এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারার আগেই চিল্লা থেকে জটিল রোগ বাঁধিয়ে ফিরে এসে বিছানায় পড়েছিল বাবা। অগত্যা সিরাজ পড়াশোনা ফেলে চলে এসেছিল সংসারের হাল ধরতে। বাবার কোনো জমানো অর্থ ছিল না। বাড়ির পাশে ছোট্ট এক প্লট জমি ছিল। সেটি বিক্রি করে বাবার চিকিৎসা করাতে ঢাকায় নিয়ে এসেছিল। কিন্তু চিকিৎসা শুরু হওয়ার আগেই তিনি মারা যান। বেদিশা হয়ে পড়েছিল সিরাজ। হাতে যে টাকা-পয়সা ছিল তা খরচ করে বাধ্য হয়ে ছোট বোনকে বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তার ছোট বোনকে শ্বশুরবাড়ির অনেক অত্যাচার সইতে হচ্ছিল। সিরাজ দু-চোখে অন্ধকার দেখে গ্রামের পরিচিত একজনের হাত ধরে ঢাকায় এসে গার্মেন্টসে স্টিকার ম্যান হিসেবে এই চাকরিটা নিয়েছিল। ছোট বোনকে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার থেকে রক্ষায় প্রায়ই তাকে টাকা পাঠাতে হচ্ছিল। গার্মেন্টসে এই চাকরিটা ছাড়াও টোঙা বানিয়ে বিক্রি করে এবং এটা-সেটা করে তাকে টাকা জোগার করতে হচ্ছিল। অবশেষে অত্যাচার সইতে না পেরে মাস ছয়েক আগে তার ছোট বোন আত্মহত্যা করেছে।

টিফিনের সময় গার্মেন্টসে খুব হুড়োহুড়ি লেগে যায়। সবাই আগে গিয়ে ছাদে বসে সারা দিনের একমাত্র খাবার একটু আরাম করে খেতে চায়। একদিন সিঁড়ি দিয়ে নিজের নিজের টিফিন বক্স নিয়ে দৌড়ে ওঠার সময় একজনের হাতের গুঁতো লেগে পিরুর টিফিন বক্সটি ছিটকে পড়ে গেল একেবারে নিচে। পড়েই ভেতরের খাবারগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেল। সেদিনের পর থেকেই সিরাজ পিরুকে চোখে চোখে রাখছিল। নিজের বোন অত্যাচার সইতে না পেরে নিজেই নিজেকে শেষ করে দিয়েছে। এখন পিরু নামের এই মেয়ে এখানে গোপনে যে অত্যাচার সইছে তাতে অজান্তেই তার ওপর সিরাজের বোন-ভালোবাসা জেগে উঠছিল দিনে দিনে। সে পিরুর এই অবস্থা দেখে এগিয়ে এল এবং পিরুর হাতে নিজের টিফিন বক্সটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘তুমি এই টিফিন বক্সটা নিয়া ছাদের এক কোনায় যাইয়া বসো। আমি তুমার টিফিন বক্স নিয়া আসতেছি।’

পিরু থতমত খেয়ে গেলেও যখন দেখল অচেনা এই লোকটি দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে তার টিফিন বক্সটা কুড়িয়ে আনতে, সে তখন ধীরে ধীরে তার টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে ছাদের এক কোনায় গিয়ে বসে পড়ল। সিরাজ ফিরে এসে তাকে ওভাবে তার টিফিন বক্স নিয়ে বসে থাকতে দেখে একটু রাগের সঙ্গেই বলল, এবং এমনভাবে বলল যেন সে তার কত কালের চেনা! যেন নিজের বোন।
‘কী রে পিরু! এহনও ওইডা হাতে নিয়া বইস্যা আছস! খাইবার পারতাছস না? তোর টিফিন তো সব পইড়্যা গেছে!’
‘বাহ! আমি আপনের টিফিন খামু ক্যা? আপনেরে তো আমি চিনিই না!’
‘চিনুন লাগব না। তোরে তো আমি চিনি।’

এরপর সিরাজ সেদিন রাতে তার সবকিছু জেনে যাওয়া, তার বোনের মর্মান্তিক কাহিনি বলে তাকে সে তার সেই বোনের মতো দেখে, সব সময় তাকে চোখে চোখে রাখে- এসব খুলে বলেছিল। সেদিন থেকেই দুজনে ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল এবং একজন আরেকজনের সব কথা পরস্পরকে খুলে বলেছিল। কিন্তু তারা সেই সুপারভাইজারের চোখ ও কানকে ফাঁকি দিতে পারেনি, যে সুপারভাইজার পিরুকে সেদিন মালিকের রুমে নিয়ে গিয়েছিল। মালিককে সব বলে সে সিরাজকে ছাঁটাই করতে চেয়েছিল, কিন্তু মালিক শুধু ছাঁটাই করাকে যথেষ্ট মনে করেনি। সে একটি চুরির ঘটনা সাজিয়ে সিরাজকে পুলিশে দিয়েছিল। এদিকে পিরুর ওপর অত্যাচারের মাত্রাও বেড়ে গিয়েছিল। সে যাতে চাকরি ছেড়ে পালাতে না পারে সে ব্যবস্থাও পাকা করে রাখা হয়েছিল। রোকেয়া শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে পেরেছে, আর কিছু করতে পারেনি।

ছয় মাসের জেল হয়েছিল সিরাজের। জেলে থাকতেই সে ঠিক করেছিল, ছাড়া পেলে পিরুকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে গিয়ে সংসার পাতবে। পদ্মাপারে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। এক চিলতে যে বসতভিটে ছিল তা পদ্মায় ভেঙে নিয়েছে। তার ইচ্ছে চট্টগ্রামের ইপিজেডে গিয়ে কোনো গার্মেন্টসে কাজ জুটিয়ে নেবে। কিছু একটা করতে পারবে সে আত্মবিশ্বাস তার আছে। তার পর কয়েক বছর টাকা জমিয়ে কোনো গ্রামে গিয়ে জমি লিজ নিয়ে চাষবাস করবে আর একটি গরুর খামার করবে। শুনেছে ঠিকমতো করতে পারলে নাকি তাতে খুব লাভ!

জেল থেকে ছাড়া পেয়েই সেদিন রাতে সে পিরুর মেসে চলে গেল। এর আগে পিরু জেলখানায় তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তারা সবকিছু পাকা করে রেখেছিল। সেদিন নাইট ডিউটি না থাকায় পিরুর মেসে গিয়ে তাকে পেয়ে গেল সিরাজ। পিরুকে সে তখনই সব গুছিয়ে নিতে বলল। পিরু এমন একটাকিছুর জন্য মনে মনে তৈরি হয়েই ছিল। গোছানোর তেমন কিছু নেই। দুই সেট সস্তা থ্রিপিস আর গামছা। ব্যাগ নিয়ে সিরাজের পিছু পিছু যেতে যেতে সে জিজ্ঞেস করল-
‘কই যাইবেন? ঠিক করছেন কিছু?’ 
‘আগে তো বাইর হই, তার পর দেখবানি। নু।’

পরগাছা প্রেম

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৬ পিএম
পরগাছা প্রেম
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

দুজনের ভুল বোঝাবুঝি মেটানোর সব কৌশলই
ভুল নামতায় পাশমার্ক না পেয়ে হাপিত্যেশ করে-
ভুল বোঝাবুঝি অবসানে সচেতন মিটারের বড্ড অভাব। 

অসময় ভেবে পেছনে ফেলে আসা দিনগুলো মিটার দেখে 
তবু দিনাতিপাত করছে...
আমাদের চাকচিক্য জীবন এখন আর অটোতে চড়ে না।
পাঁচ টাকার বাদাম আর তিন টাকার পাকা তেঁতুলের 
চোখে-মুখে সেই সতেজ হাসিটা বিক্রি করে দিয়েছি-
পুরনো বইয়ের সাথে ফেরিওয়ালার কাগজের পাল্লায়। 

সন্ধ্যাগুলো জ্যামে বসে ঘাম পুষে বড্ড ক্লান্ত।

শহরের গাছের ধুলোমাখা ডালপালায় ঝুলে থাকে 
সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো। 
একটি সচল কিংবা সচেতন মিটারের অভাবে 
নিষ্ঠুর গন্তব্য যেন এক একটি পরগাছা প্রেম।

আমাদের নির্বাণকাল

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৫ পিএম
আমাদের নির্বাণকাল
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

তারকাঁটায় হেঁটে হেঁটে একদিন ঠিক পৌঁছে গিয়েছিলাম
নিষিদ্ধ শরীরী বিদ্যায়
আমার শরীর তা জানে 
যেভাবে তোমার অতীত তা মানে

এখন এতদিন পর স্মৃতিচারণের মতো চিহ্নগুলো
গলায় ঝুলিয়ে ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য প্রদর্শন করে চলেছি

আমাকে দেখলেই তোমাদের গৃহপালিত নদী
মুখ লুকায় উত্তাল দিনের সামুদ্রিক সন্ত্রাসে 
তোমাকে দেখলেই আমাদের প্রহরারত মাঠে
অশ্বদৌড় কেঁপে ওঠে মধ্যরাতে অকুণ্ঠ উত্তাপে   

আজকাল ঊনঘুম ঊনঅন্নে রাত জেগে তীর্থ রচনা করি
পুরনো নোটবই ঘেঁটে অনাবশ্যক বাক্য কেটে
                                ভুল শুধরে নিই

আজকাল গঞ্জে বাজারে ঘুরি, নানা বরণ মানুষ ঘেঁটে
চোখে চোখে খুঁজে দেখি শরীরী সম্পর্কের ভাষা

আমাদের এই বিদ্যা ভেসে উঠেছিল 
ঢলে পাওয়া কইমাছের দিনে; আজও কেউ জানেনি তো
দুজনেই মজে আছি সেই এক চিরকালীন নির্বাণের ঋণে