দিনটা ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট, বিকেল। এক ক্রান্তিকাল। বিয়োগান্তক অধ্যায়ের এক হৃদয়বিদারক লগ্নের সূচনাকাল। এই ক্রান্তি কেবলমাত্র বাঙালি সমাজের নয়। গোটা মানবজাতির গ্রহণকালের সূচনা। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের এক শহরতলি। সেদিনের নিরিখে এক মফস্বলের দিকে পা বাড়ানো জনপদ। সেখানে সতু, বিজু এই বন্ধুদের তরজায় উঠে আসছে বাঙালি জীবনের বিয়োগান্তক সেই দেশভাগের সময়কাল ঘিরে ধারাবাহিক আলাপের জের।
দুই বন্ধুই বেদনার্ত হৃদয়ে সমকাল ঘিরে আলোচনা করছে। সেই আলোচনায় বিজুর ভাষ্যে উঠে আসছে ব্রিটিশ কীভাবে হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীকে অনেকটা বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল তার বর্ণনা। আবার একই সঙ্গে উঠে আসছে মুসলমানদের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় আত্মনিবেদিত কমিউনিস্টদের ভূমিকার কথা।
বিজুর কথোপকথনের মধ্যে উঠে আসা তারকা চরিত্রটি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। দীর্ঘ প্রায় এক বছর ধরে যেভাবে উগ্র সাম্প্রদায়িক, রাজনৈতিক হিন্দুরা কলকাতা এবং তার আশপাশের অঞ্চলের মুসলমানদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে আসছে তার পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানদের যথাসম্ভব নিরাপত্তা দেওয়ার প্রচেষ্টা চালায় কমিউনিস্টরা। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলজুড়ে তখন হিন্দু মহাসভা, রামরাজ্য পরিষদ ইত্যাদি হিন্দু সম্প্রদায়িক সংগঠনগুলো রাম চট্টোপাধ্যায়, অক্ষয় ভট্টাচার্য প্রমুখ উগ্র হিন্দু সমাজবিরোধীদের দ্বারা মুসলমানদের ওপর তাণ্ডব চালাচ্ছে। এই ঘটনাক্রম সমরেশের চোখে দেখা। এই সময়কালে সমরেশ আতপুর, নৈহাটি যেসব অঞ্চলে বাস করতেন বা তার রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রমের যে ক্ষেত্র ছিল, সেই অঞ্চলগুলোতে। ভাটপাড়ার অক্ষয় গুন্ডা এবং তার সাগরেদরা কীভাবে চটকলের শ্রমিক বিহারী মুসলমানদের ওপর ভয়াবহ অত্যাচার চালিয়েছিল সমরেশ নিজে ছিলেন তার সাক্ষী।
কমিউনিস্টদের তখন সহনাগরিক মুসলমানদের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য যে প্রচেষ্টা, তাকে সাধারণ হিন্দুরা আদৌ ভালো চোখে দেখেনি। তাই এই খণ্ডিতা উপন্যাসে বিজুর জবানিতে যখন আমরা উঠে আসতে দেখি- ‘তারকদাদের সঙ্গে লিগিদের মাখামাখি একটু বেশি আছে।’ (খণ্ডিতা: পৃ. ১৭) তখনই বুঝতে পারা যায় মানবতার স্বার্থে, সংখ্যালঘুর স্বার্থে কমিউনিস্টদের যে ধারাবাহিক লড়াই, তা কীভাবে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কাছে অপছন্দের বিষয় হয়ে উঠছিল। সহনাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তায় ’৪৬-’৪৭-এর ওই ক্রান্তিকালে কমিউনিস্টদের ভূমিকা এভাবে বাংলা সাহিত্যে ফুটিয়ে তোলা- সমরেশ বসু ছাড়া খুব বেশি কথাসাহিত্যিকের কলমে কিন্তু আমরা দেখতে পাই না।
রাজনৈতিক হিন্দু মানুষদের ঘিরে যেভাবে সতুর জীবনে এককালের ভুল ধারণা, অর্থাৎ একটা সময় রাজনৈতিক হিন্দুদের প্রচারের বশবর্তী হয়ে সে মনে করেছিল, আজাদ, স্টার অব ইন্ডিয়া, মর্নিং নিউজসহ মুসলিম লীগপন্থি খবরের কাগজগুলো কলকাতাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি চালিয়ে যাচ্ছে, সেই সতুরই দেশ ভাগের আগের সন্ধ্যার অনুভূতি ছিল- ‘হক (ফজলুল হক) সাহেবকে আমি কমিউনাল বলতে রাজি নই।... হক সাহেব একজন খাঁটি বাঙালী নেতা। তিনি মুসলমান হতে পারেন, কিন্তু অনেক হিন্দু বাঙালী নেতার চেয়েও উনি বড় নেতা।’ (পৃ. ১৮, বানান অপরিবর্তিত)
খণ্ডিতা উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সতু সমরেশ নিজে। মাটির টানে ফিরে যাওয়ার এক অন্তর্সলিলা কাকুতি যেটি ব্যক্তি সমরেশের মধ্যে সব সময় প্রতিবিম্বিত হতো। ঠিক সেই আদলেই এই সতু চরিত্রটিকে সমরেশ নির্মাণ করেছিলেন। সতু এই উপন্যাসে বলছে, ‘‘ওদিকে খবর নোয়াখালীতে সৈন্যরা মেয়েদের ওপর অত্যাচার করেছে। বাঙালী মুসলমান ম্যাজিস্ট্রেট সেই অভিযোগ করেছিলেন বলে, তাঁকে বদলি করে দিয়েছেন। হক নিজে ছুটে গেছিলেন নোয়াখালীতে। নোয়াখালী স্টেশনেই তাঁকে মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছিল, যতোসব ছোট-বড় অফিসারদের। সকলের এক কথা, ‘স্যার, আপনার যাওয়া হবে না।...’
সেম ব্যাপার ঘটেছিল মেদিনীপুরে। মেদিনীপুরে বিয়াল্লিশে পুলিশের অত্যাচারের সংবাদ পেয়ে তিনি ছুটে গেছিলেন। একইভাবে তাঁকে ফেরত পাঠানো হয়। মেদিনীপুরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তিনি বিচক্ষণ বলে জোর করে ঢোকেন নি। ঢুকলে কি হতো? অপমানিত হতেন। কাগজে ফলাও করে তা ছাপা হতো। কিন্তু কংগ্রেস কি তাঁর পাশে এসে দাঁড়াতো? তাঁকে হিরো করতো? করতো না। অপমান বুকে পুষেই তাঁকে ফিরতে হয়েছিল।’’ (পৃ. ১৯)
নোয়াখালী দাঙ্গা আর মুসলমান সমাজকে এক করে দেখার চল বাঙালি হিন্দু সমাজের একটা বড় অংশে আজও রয়েছে। আজও পশ্চিমবঙ্গে, মুসলমান সমাজকে নোয়াখালী দাঙ্গার নানা অপবাদ বয়ে বেড়াতে হয়। অথচ নোয়াখালী দাঙ্গা সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ মিলিটারি যে সব থেকে পাশবিক ভূমিকা পালন করেছিল, সে কথা কিন্তু এপার বাংলায় সুরঞ্জন দাশের মতো ঐতিহাসিক আর সমরেশ বসুর মতো কথাসাহিত্যিক ছাড়া একমাত্র উচ্চারণ করেছিলেন মনীষী অন্নদাশঙ্কর রায়।
আজ পর্যন্ত দেশভাগ ঘিরে এপার বাংলায় যত ধরনের ইতিবাচক বা নেতিবাচক সাহিত্য রচিত হয়েছে, তার একটিতেও সমরেশ বসুর মতো সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে নোয়াখালী দাঙ্গায় ব্রিটিশ মিলিটারির ভূমিকার কথা লেখার সাহস কারও হয়নি। খণ্ডিতা এই উপন্যাসে তেতাল্লিশের রাজনৈতিক বন্দিদের ছেচল্লিশে সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক মুক্তিদানের কথা প্রশংসিতভাবে উল্লেখ করেছেন সমরেশ। উল্লেখ করেছেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার অধিকার বন্দিদের মুক্তিতে সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকার কথা। এর পরই তিনি উচ্চারণ করেছেন সেই অমোঘ সত্য, যা আজ পর্যন্ত নিজেদের প্রথাগত কমিউনিস্ট বলে দাবি করা একজন কথাসাহিত্যিকও লিখতে পারেননি। সমরেশ লিখছেন- ‘সেই সুবাদেই সুরাবর্দীর সঙ্গে কমিউনিস্টদের একটা আঁতাত। সুরাবর্দী প্রগতিশীল মনের মানুষ। যামিনী রায়ের ছবির একজন ভক্ত আর পৃষ্ঠপোষক।’ (পৃ. ২০)
এ প্রসঙ্গে এই নিবন্ধকারের মনে পড়ে যাচ্ছে, ’৪৬-এর দাঙ্গার কালের এক স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে উপমহাদেশের বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসু বলেছিলেন; দাঙ্গা নিরসনে সোমনাথ লাহিড়ীর সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের পার্ক সার্কাসের বাড়িতে জ্যোতিবাবু যান। সোহরাওয়ার্দী তাঁদের সরাসরি নিজের শয়নক্ষে নিয়ে আসেন। বলেন, আমার বসবার ঘরে শ্যামাপ্রসাদ বসে আছে। ওই-ই তো দাঙ্গা লাগিয়েছে। আর আপনারা তো চান দাঙ্গা থামাতে। আপনারা আমার অতিথি। আপনাদের সঙ্গে আমি আমার শয়ন কক্ষে বসেই আলোচনা করব।