ঢাকা ১২ মাঘ ১৪৩১, রোববার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫
English
রোববার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ মাঘ ১৪৩১

মন্ত্রীর অসুখ

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৫৫ পিএম
আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৫৫ পিএম
মন্ত্রীর অসুখ
অলংকরণ : নিয়াজ চৌধুরী তুলি

দক্ষিণ এশিয়ার কোনো একটা দেশের (ভারত নয়) স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কয়েকদিন ধরে বুক ব্যথা করছে।
তিনি ঠিকমতো অফিস করতে পারছেন না। অফিসে বসেই তিনি কোঁত কোঁত শব্দ করেন! বুকব্যথায় যে কেউ কোঁত কোঁত শব্দ করতে পারে, এটা কারও জানা ছিল না। তবে শব্দটা সব সময় হয় না, মাঝে মাঝে হয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার ব্যক্তিগত ডাক্তারকে ডেকে পাঠালেন। ডাক্তার এসে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেন, এক বস্তা ফাইল বানালেন, কোনো রোগ বের করতে পারলেন না।
মন্ত্রী বলে কথা! 
দেশের সব বড়ো বড়ো ডাক্তারের সমন্বয়ে বোর্ড মিটিং বসেছে। কী করে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কোঁত কোঁত শব্দ বন্ধ করা যায়! 
বোর্ডপ্রধান স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বললেন, স্যার, আপনার উচিত ইমিডিয়েট বিদেশে চলে যাওয়া। আপনার হার্ট বোধহয় নষ্ট হয়ে গেছে! 
স্বাস্থ্যমন্ত্রী রেগে গিয়ে বললেন, কী বলছেন এসব? আমি এখনো আমার বউকে ভালোবাসি। হার্ট নষ্ট হলে বউকে ভালোবাসতে পারতাম? ভালোবাসা যে হার্টে থাকে, এইটা আপনারা জানেন না? কোন চুলের ডাক্তার হইছেন? তাছাড়া আমাদের দেশের চিকিৎসাসেবা তো আন্তর্জাতিক মানের। পিরোজপুর থেকেও আমাদের চিকিৎসাসেবা উন্নত। আমি এই দেশের একজন মহান নেতা। আমি কেন বিদেশে যাব?
স্বাস্থ্যসচিব মন্ত্রীর কানে কানে বললেন, স্যার, ওটা পিরোজপুর হবে না, সিঙ্গাপুর হবে। পিরোজপুর তো স্যার বাংলাদেশের একটা জেলার নাম!
স্বাস্থ্যমন্ত্রী চিৎকার করে বললেন, পিরোজপুর হোক আর সিঙ্গাপুর হোক, আমি বিদেশে চিকিৎসা করাব না। আমি দেশপ্রেমিক নেতা। মরলে দেশের মাটিতেই মরব। কী করতে হবে বলেন!
স্বাস্থ্যসচিব বললেন, স্যার, বুকের এক্স-রে করা লাগবে। কিন্তু আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলোর বেশির ভাগ এক্স-রে মেশিন তো নষ্ট! 
এক্স-রে মেশিন খালি নষ্ট হয় কেন? কী করেন আপনারা? 
সরকারি হাসপাতালের এক্স-রে মেশিন নষ্ট হলেই ডাক্তারদের লাভ। তারা তখন বাইরে রোগী পাঠিয়ে ভালো টু-পাইস কামাতে পারে। এটা তো আর মন্ত্রীকে বলা যায় না, তাই তিনি বললেন, স্যার, আমরা আসলে মেইড ইন চায়না নামের যে মেশিনগুলো কিনি, ওগুলো মেইড ইন জিঞ্জিরা। আসমানে এবং জমিনে এমন কোনো জিনিস পয়দা হয়নি, যার নকল বাংলাদেশের জিঞ্জিরায় পাওয়া যায় না। ব্যাটারা ওপরে চায়না লিখে ভিতরে জিঞ্জিরার রদ্দি মাল গছিয়ে দেয়। 
স্বাস্থ্যমন্ত্রী ধমকের সুরে বললেন, যেভাবে হোক, এক্স-রে মেশিন ঠিক করেন। আমি সরকারি হাসপাতালেই চিকিৎসা করাব। প্রয়োজন হলে বাংলাদেশের ধোলাই খাল থেকে পার্টস নিয়ে আসেন। শুনেছি ওখানে পুরাতন ভালো ভালো পার্টস পাওয়া যায়। ইমিডিয়েট এক্স-রে করানোর ব্যবস্থা করেন। যদি ধোলাই খালে না পান, তবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ‘জবাই দেন’-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শুনছি এবারের নির্বাচনে উনি জয়লাভ করেছেন! 
স্যার, ঠিকই শুনেছেন, তবে উনার নাম জবাই দেন নয়, জো বাইডেন!
ওই হলো আর কি! তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করেন। ও মাই গড! এতো আধুনিক দেশ আমাদের, আমাদের দেশ ‘শিঙাড়াপুর’ থেকেও উন্নত, অথচ এক্স-রে মেশিন নেই! এইটা একটা কথা! আজই সবার চাকরি নট করব…
সব ডাক্তার মন্ত্রীর এক্স-রে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করল। দেশের সব চিকিৎসাসেবা এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ রইল। মন্ত্রীর চিকিৎসা বলে কথা!
এক সপ্তাহ পর আবার বোর্ড মিটিং বসেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বললেন, খবর কী? এক্স-রে মেশিন কি ঠিক হয়েছে? 
স্বাস্থ্যসচিব বললেন, আমরা এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিক-নির্দেশনা চেয়েছি। ফাইল চালাচালি হচ্ছে স্যার। মাসখানেকের মধ্যে সমাধান এসে যাবে। 
স্বাস্থ্যমন্ত্রী কোঁত করে শব্দ করে বললেন, এক মাসের মধ্যে মেশিনের সমাধান আসবে? ততদিন কি আমি বাঁচব বলে মনে হয়? 
বোর্ডপ্রধান বললেন, আমাদের কিছুই করার নেই, স্যার। এটাই এই দেশের সিস্টেম। আমরা দোয়া-দুরুদ পড়ছি স্যার, আপনিও পড়ুন। আপনার পরিচিত কোনো পীর-ফকির থাকলে পানি পড়া এনেও খেতে পারেন। কোনো মাদ্রাসায় গিয়ে কোরআন মজিদ খতম করাতেও পারেন।
অনেক দেন-দরবার করে এক্স-রে মেশিন ঠিক করা হয়েছে। মন্ত্রীর বুক এক্স-রে করা হয়েছে।
আবার বোর্ড মিটিং বসেছে। বোর্ডপ্রধান বললেন, একটা সমস্যা ধরা পড়েছে, স্যার।
মন্ত্রী অবাক হয়ে বললেন, কেন? কী হয়েছে? 
তেমন কিছু না, স্যার। আপনার এক্স-রে রিপোর্টে তেলাপোকা পাওয়া গেছে। আপনার বুকে তেলাপোকা দৌড়াদৌড়ি করছে, এ জন্যই আপনার মুখ দিয়ে কোঁত কোঁত শব্দ হয়।
অসম্ভব! মন্ত্রী চিৎকার করে বললেন। আমার বুকে তেলাপোকা থাকতে পারে না। তেলাপোকা দেখলেই আমার বউ অজ্ঞান হয়ে যায়। আমার বুকে তেলাপোকা থাকলে বউ অজ্ঞান হয় না কেন?
সত্যি বলছি স্যার। আপনার বুকে তেলাপোকা দৌড়াদৌড়ি করছে। টিকটিক টিকটিক আওয়াজ করে।
মন্ত্রী অসহায় গলায় বললেন, ওরে আল্লাহ রে! তেলাপোকা টিকটিক আওয়াজ করে? ব্যাটা গাধার গাধা! 
সচিব বললেন, স্যার অন্য দেশের তেলাপোকা টিকটিক আওয়াজ করে না, আপনার বুকে কেন করছে বুঝতে পারছি না। এই নিয়ে গবেষণা চালাতে হবে। তবে এই গবেষণার ফল পেতে কয়েক দশক লেগে যেতে পারে। এই তেলাপোকা আপনার হার্ট খেয়ে ফেলছে। তেলাপোকা মেরে ফেললেই আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। সমস্যা হচ্ছে, এই তেলাপোকা কীভাবে মারতে হয়, আমরা জানি না। আমরা মনে করছি, কোনো পীর-ফকিরের পানি পড়া খেলেই কাজ হয়ে যাবে। আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই রোগের চিকিৎসার কথা জানা নেই স্যার। রোগটা একেবারে নতুন! এমন জটিল রোগের কথা পৃথিবীর মানুষ আগে কখনো শোনেনি। 
তেলাপোকার কথা শুনে মন্ত্রী অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ চোখেমুখে পানি দেওয়ার পর তার জ্ঞান ফিরল। তিনি আকুল গলায় বললেন, আমার কি বাঁচার কোনো আশা নেই? 
স্বাস্থ্যসচিব কাচুমাচু মুখে বললেন, এই তেলাপোকা রোগের চিকিৎসা এখনো বের হয়নি স্যার। তবে চিন্তা করবেন না, বিজ্ঞানীরা একদিন ঠিকই এর চিকিৎসা বের করে ফেলবে, তবে ততদিন আপনি বেঁচে থাকবেন কিনা তা বুঝতে পারছি না! 
স্বাস্থ্যমন্ত্রী অসহায় ভঙ্গিতে চিৎকার করে বললেন, আমাদের চিকিৎসাসেবা আন্তর্জাতিক মানের। যেভাবেই হোক একটা বুদ্ধি বের করেন। নইলে সবার চাকরি নট!
মন্ত্রীর ব্যক্তিগত ডাক্তার মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললেন, একটা চিকিৎসা আছে স্যার, এটা প্রয়োগ করলে নিশ্চিত তেলাপোকা মারা পড়বে! 
মন্ত্রী চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বললেন, এতক্ষণ বলেননি কেন? কোন ঘোড়ার আন্ডা ভাজছিলেন? এক্ষুনি চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। এই চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে একটা ফিচার লিখে আন্তর্জাতিক জার্নালে পাঠিয়ে দেন। বিশ্ববাসীর উপকার হোক। পদ্ধতিটা কী?
কিছু না স্যার, আপনাকে বিষ খেতে হবে। বিষ খেলে আমি নিশ্চিত তেলাপোকা মারা পড়বে, তবে আপনি বেঁচে থাকবেন কিনা তা বুঝতে পারছি না! 
মন্ত্রী আবার ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেন। কিছুক্ষণ কোঁত কোঁত শব্দ করলেন। কোঁত কোঁত করতে করতেই বললেন, আমাদের চিকিৎসাসেবা আন্তর্জাতিক মানের হলেও আমাদের দেশের বিষ আন্তর্জাতিক মানের না। বাজারের বেশির ভাগ বিষ নকল। আমি নাও মরতে পারি। ছাত্রজীবনে একবার আমার প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আমি বিষ খেয়েছিলাম। মরিনি। বিষ খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
স্বাস্থ্যের ডিজি বললেন, সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি লাগবে, স্যার। যেহেতু আপনি মন্ত্রী পরিষদে আছেন, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া আপনার বিষ খাওয়া উচিত হবে না। 
মন্ত্রী বললেন, আপনাদের কারও বিষ খাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে? আমি সারা জীবন করে এসেছি আলু-পটোলের ব্যবসা, বিষ খাওয়ার ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা কম। তার পরও একবার খেয়ে দেখেছি। আপনারা খেয়েছেন? আছে কারও অভিজ্ঞতা?
লজ্জিত মুখে সবাই স্বীকার করল, এর আগে বিষ খাওয়ার অভিজ্ঞতা কারও নেই। তবে অভিজ্ঞতার দরকার ছিল! 
এক সপ্তাহ পর মন্ত্রী পরিষদের মিটিং বসেছে। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিষয়টা জানানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই উপমহাদেশের সেরা হার্ট বিশেষজ্ঞ হচ্ছেন ভারতের দেবী শেঠি। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত। 
প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে এক শ এক সদস্যবিশিষ্ট কমিটির দল ভারত গেল দেবী শেঠির পরামর্শ নিতে!
সব শুনে দেবী শেঠি বললেন, আমি নিজ চোখে রোগী দেখতে চাই।
বিশেষ বিমানে করে সেই দেশে দেবী শেঠিকে উড়িয়ে নেওয়া হলো। 
দেবী শেঠি এসে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাগজপত্র সব দেখলেন, এক্স-রে রিপোর্ট দেখে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তার পর স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, মাননীয় মন্ত্রী, আপনার দেশ কাগজে-কলমে সিঙ্গাপুর থেকে উন্নত হলেও বাস্তবে বাঙ্গিপুর থেকেও পিছিয়ে আছে। 
দেবী শেঠির কথা শুনে মন্ত্রী মুখ কালো করে ফেললেন। তার কথাটা পছন্দ হয়নি। কিন্তু কী আর করা! ব্যাটা তার তেলাপোকার চিকিৎসা করতে এসেছে বলে কিছু বলা গেল না। নইলে তিনি দেখিয়ে দিতেন, তারা দেশকে কোথায় নিয়ে গেছেন। 
দেবী শেঠি মন্ত্রীর মনোভাব বুঝেও পাত্তা না দিয়ে বললেন, আসলে আপনার কিছুই হয়নি। আপনার বুকের ব্যথাটা হচ্ছে গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা। কয়েকদিন গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে। আর, আপনার বুকে তেলাপোকা দৌড়াদৌড়ি করছে না, এক্স-রে করার সময় ওটা এক্স-রে মেশিনের ওপর দৌড়াদৌড়ি করেছিল!
স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার দেশের ডাক্তারদের ডেকে বললেন, আমি না হয় আলু-পটোলের ব্যবসায়ী। আপনারা? আপনাদের সবার চাকরি নট করা হলো।
ডাক্তার সাহেবরা মন্ত্রীর কথায় গ্রাহ্য করে না। মুখ টিপে হাসে। তারা জানে, তারা নট হলে তার আগে মন্ত্রী নিজেই নট হয়ে যাবে। 
সচিব সাহেব মাথা চুলকায় আর ভাবে, দেবী শেঠি এইটা কী বলল? শালার এই বাঙ্গিপুরটা কই?
বাংলাদেশের বরিশাল নয় তো? ওখানে তো শুনেছি ভালো বাঙ্গি চাষ হয়।

গ্রন্থপরিচয়

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০৭ পিএম
আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০৮ পিএম
গ্রন্থপরিচয়
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

জীবনানন্দ ও তাঁর পরিজন
আপেল মাহমুদ (সম্পাদক)
শ্রেণি: সাহিত্য কাগজ
প্রকাশনী: উয়ারী বটেশ্বর, ঢাকা
প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০২৪
পৃষ্ঠা: ৩৬৮; মূল্য: ৬০০ টাকা
সাগর জলে লাখ লাখ ঝিনুক পাওয়া যায়। কিন্তু সব ঝিনুকে মুক্তো থাকে না। খুঁজে মুক্তো বের করতে হয়। তেমনি জীবনানন্দ দাশের বাক্সবন্দি কবিতা, গল্প-উপন্যাস-ডায়েরি জনসমাজে আনার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন কিছু লেখক-গবেষক। তারা জীবনানন্দের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অসীম প্রতিভাকে প্রস্ফুটনের কাজ করেছিলেন। জীবনানন্দ গবেষণাকে তারা তপস্যা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এদের মধ্যে ডা. ভূমেন্দ্র গুহ, দেবীপ্রাসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, আবদুল মান্নান সৈয়দ, ক্লিনটন বি সিলি, প্রভাতকুমার দাস, সমরেন্দ্র দাশগুপ্ত, গৌতম মিত্র, ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, আমীন আল রশীদ ও মাসউদ আহমদ হলেন অন্যতম। 

জীবনানন্দ বিষয়ক লেখালেখির কোনো অন্ত নেই। বর্তমানে তাকে ঘিরে যে গবেষণা হচ্ছে সেটাও বেশ উল্লেখযোগ্য। পেন্ডরার বাক্স থেকে অনেক চাঞ্চল্যকর পাণ্ডুলিপি বের হয়ে বই হয়ে পাঠকের টেবিলে চলে আসছে। এই অবস্থায় জীবনানন্দকে নিয়ে আরেকটি পাণ্ডুলিপির জন্ম হলো। এর বিষয়বস্তু জীবনানন্দের আত্মীয়-স্বজন, দাস পরিবার, বরিশাল ব্রাহ্মসমাজ, নদনদী, শিক্ষাদীক্ষা প্রভৃতি। প্রসঙ্গক্রমে এসেছে বরিশালের সংস্কৃতি, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, স্কুল-কলেজ, জীবনানন্দের বরিশালের জীবন, তার সহকর্মী ও সহপাঠীদের বিবরণ। এতে কবির প্রথম প্রেম মনিয়া, লাল গির্জা, অক্সফোর্ড মিশন লাইব্রেরি, ব্রজমোহন কলেজ স্কুল, সর্বানন্দ ভবন প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমেরিকান গবেষক ক্লিনটন বি সিলি দীর্ঘদিন অনুসন্ধান চালিয়ে কবি জীবনানন্দকে বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী একজন লেখক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি জীবনান্দকে ‌অনন্য হিসেবে উপাধি দিয়েছেন।... 


মেয়েটিকে বাঁচানো গেল না
ইকরাম কবীর 
শ্রেণি: গল্প সংগ্রহ
প্রকাশনী: রচয়িতা, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০২০
পৃষ্ঠা: ১০০; মূল্য: ২৫০ টাকা


খুদে গল্পের বই
ইকরাম কবীর 
শ্রেণি: গল্প সংগ্রহ
প্রকাশনী: আজব, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, সেপ্টেম্বর ২০২৪
পৃষ্ঠা: ১৫২; মূল্য: ৪০০ টাকা


গল্প একটা বোধ
গল্প একটা চেতনা
গল্প একটা অস্ত্র
গল্পের মাঝে নিজেকে পাওয়া যায়
গল্পের মাঝে মানুষদের খুঁজে পাওয়া যায়।...

পৃথিবীর কোথাও না-কোথাও কিছু না-কিছু ঘটছে। সারাক্ষণ ঘটছে। পার্থিব কিংবা অপার্থিব। বাস্তব কিংবা অবাস্তব। এর কিছু দেখা যায়, শোনা যায়। বেশির ভাগই যায় না। তবে ঘটে। ঘটেছে। শুধু তা বলা হয় না, শোনা হয় না। সেগুলো অন্তর দিয়ে দেখতে হয়, শুনতে হয়। এই না-বলা ঘটনাগুলোই এক সময় গল্প হয়ে যায়। 

মানুষের চোখের দিকে তাকালে বোঝা যায় তার ভেতরে কত গল্প জমে আছে। যেন নিঃশব্দে ঝংকারিত হাজারো সুর সংগীতায়িত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। গল্পগুলো বলার অপেক্ষায়, সুরগুলো শোনার অপেক্ষায়। সবাই গল্পগুলো বলতে পারেন না, সুরগুলো শোনাতে পারেন না। তবে তারা চায় বলতে, শোনাতে। একজন গল্পকারে নৈপুণ্য এখানেই গুরুত্বপূর্ণ। তাকে গল্পগুলো খুঁজে পেতে হয়। উৎস থেকে একটি বীজ আহরণ করে অঙ্কুরিত করাতে হয়। ডালপালা মেলে দিয়ে ফুল ফোটাতে হয়। গল্প লেখা এমনই এক যাত্রা। মনস্তাত্ত্বিক এক যাত্রা যা অন্তরের অনেক গভীর থেকে সঞ্চারিত হয়। প্রায়ই যাত্রাভঙ্গ হয়। আবার নতুন যাত্রা শুরু হয়। এই গ্রন্থে আছে- খুব সাধারণ দৈনিন্দিন প্রেমের গল্প, তেমনই জটিল চিন্তা গল্প। দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, সম্পর্ক, আধুনিকতার অগভীরতা, আধ্যাত্মিকতা- এর সবই দুই মলাটে বন্দি হয়েছে।

দেখতে চাই বইমেলার বাইরে বই বিক্রির সম্ভাবনা কতুটুকু

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৫৫ পিএম
দেখতে চাই বইমেলার বাইরে বই বিক্রির সম্ভাবনা কতুটুকু
রবীন আহসান

এবারের বইমেলায় আপনি অংশগ্রহণ করেননি কেন? 

নানা কারণে এবারের একুশের বইমেলায় আমরা অংশগ্রহণ করিনি। একটি প্রধান কারণ দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে চলছে মব শাসন! আগের সরকারের সময়ও আমরা দুবার বইমেলায় অশংগ্রহণ করিনি ইচ্ছে করে! আমরা আসলে দেখতে চেয়েছি বইমেলার বাইরে বই বিক্রির সম্ভাবনা কতুটুকু আছে! এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুবিষয়ক বই প্রকাশকদের হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে অনলাইনে, এসব কারণেও আমরা এবারের বইমেলায় অংশ নিইনি।

প্রায় প্রতিবছর আপনার অংশগ্রহণটা ব্যতিক্রমী ছিল। সেটা ধরে রাখতে অন্য কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন কি না?  

বইমেলায় আমরা শ্রাবণ প্রকাশনীতে গত কয়েক বছর একটা খোলা জানালা বানাতাম ‘শ্রাবণের জানালা’। এটা একটা কবিতার মতো বিষয় ছিল! হাজার হাজার মানুষ এই জানালায় ছবি তুলত। এটা মিস করব এবার। মিস করব লেখক-বন্ধু-পাঠকদের ২৮ দিনের আড্ডা! এসবের পরও আমরা অনলাইনে একুশে বইমেলা আয়োজন করেছি মাসব্যাপী! আমাদের ফেব্রুয়ারিবিডি.কম নামে নতুন ওয়েবসাইট থেকে এই মেলার কাজ চলবে।

ফেব্রুয়ারিবিডি.কম-এর মাসব্যাপী অনলাইন বইমেলার আয়োজন করতে যাচ্ছেন। এই ধরনের ব্যতিক্রমী চিন্তা কীভাবে এল? 

২০২১ সালেও আমরা বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলায় অংশ নিইনি। সে বছর আমরা অনলাইন বইমেলার আয়োজন করেছিলাম মাসব্যাপী। ফেব্রুয়ারিবিডি.কম শুধু শ্রাবণ প্রকাশনীর বই বিক্রি করবে না। এ বছর অনলাইন বইমেলায় আমরা প্রগতিশীল লেখক প্রকাশকদের বল বই বিক্রির আয়োজন করছি অনলাইনে।

অনলাইন বইমেলার সুবিধা এবং অসুবিধা কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন? 

অনলাইন বইমেলার বড় সমস্যা হচ্ছে, পাঠক একটি বই ধরে দেখতে পারে না। নতুন বইয়ের গন্ধটা শুকতে পারে না আর বইমেলায় যেভাবে আড্ডা দিতে দিতে চা খেতে খেতে একটা বই কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে কিনতে পারে, এখানে তা পারে না। এ ছাড়া বইমেলার কমিশনেই পাঠক ঘরে বসে আরামে বই কিনতে পারে।

ফেব্রুয়ারিবিডি.কম-এর ওয়েবসাইট আপনি কীভাবে সাজিয়েছেন, যাতে পাঠক উপকৃত হবেন। 

ফেব্রুয়ারিবিডি.কম ওয়েবসাইটটি আমরা মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও প্রগতিশীল বই দিয়ে সাজাচ্ছি; যাতে মুক্তমনা পাঠক তাদের প্রিয় বই সহজেই কিনতে পারে। বই কেনা নয়, শুধু এখানে বই আলোচনা, বই সংবাদ-লেখক সংবাদ থাকবে। আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে বই নিয়ে থাকবে লাইভ অনুষ্ঠান। থাকবে কবিতাসন্ধ্যা আবৃত্তি, গান ও আড্ডা।

অনলাইন বইমেলা কতটুকু জনপ্রিয়তা পাবে বলে আপনি মনে  করেন। ভবিষ্যতে অনলাইন বইমেলা পাঠকদের কাছে পৌঁছাতে আপনার পরিকল্পনা কী?

অনলাইন বইমেলা এখন থেকে চালু হলে অল্প সময়ের মধ্যে এটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন গাড়ি ভাড়া দিয়ে জ্যামে বসে না থেকে তাদের প্রিয় বইটি ঘরে বসে সংগ্রহ করতে চাইবে। এখন তো দুনিয়া ডিজিটাল, মানুষজন ঘরে বসেই কেনাকাটা করছে। ফলে বইকে বইয়ের বিষয় যদি আমরা অনলাইলে জনপ্রিয় করতে পারি, তবে পাঠক বেশি বেশি বই অনলাইন বইমেলা থেকে কিনবে। এখন কিন্তু সারা বছর বই অনলাইনেই বেশি বিক্রি হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো কাগজের বই কিনবে না তার প্রস্তুতি চলছে। ফলে আমরা ডিজিটাল বই প্রকাশের দিকেও এগোব। 

ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।

সাক্ষাৎকার: সানজিদুল ইসলাম সকাল

রবীন আহসান 
শ্রাবণ প্রকাশনী, ঢাকা

নু

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৫২ পিএম
নু
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

নাইট ডিউটি চলছিল। শেষরাতের একটু আগে আগে চোখ দুটি ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছিল। দুবার চোখে পানি ছিটিয়েও ঘুম তাড়াতে না পেরে সিরাজ অগত্যা বাইরের দিকের বাড়তি সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠেছিল একটি সিগারেট ধরাতে। এই বাড়তি সিঁড়িটা মোটামুটি ফাঁকাই থাকে। নেহাত দরকার না হলে এটি কেউ বড় একটা ব্যবহার করতে যায় না। ছাদে উঠে প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে চেপে ধরে দেয়াশলাই বের করতেই থেমে যেতে হয়েছিল তাকে। একটি শব্দ তার হাত দুটিকে থামিয়ে দিয়েছিল। খাড়া করে দিয়েছিল কান দুটিকে।

কান্নার শব্দটা আসছিল পানির ট্যাংকের উল্টোপাশ থেকে। ফুঁপিয়ে কান্না। ভীষণ ভড়কে গিয়েছিল সে। মনের ভেতর জেগে উঠেছিল বেপরোয়া কৌতূহল। ট্যাংকের যে পাশে ছিল সেখান থেকে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেয়েছিল মাথাটাকে সামনে বাড়িয়ে। কান দুটো খাড়া হয়ে গিয়েছিল। দেয়ালঘেঁষে আলগোছে এগিয়ে গিয়ে নিজেকে পুরোপুরি লুকিয়ে রেখে মাথাটাকে মিনিটের কাঁটা বানিয়ে ধীরে ধীরে সামনে বাড়িয়ে ট্যাংকের ও-পাশটাতে নজর বুলিয়েই সে দেখতে পেয়েছিল এক মেয়ে মুখে ওড়না চেপে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

ভীষণ খটকা লেগেছিল সিরাজের। ভালো করে তাকিয়েছিল। আবছা আলো। চেনা যাচ্ছিল না। সিঁড়ির সামনে একটি বাল্ব জ্বলছিল যদিও, কিন্তু দরজার পাল্লার ও-পাশে বলে এটির আলো সরাসরি ছাদে আসছিল না। চোখ সরু করে পুরো ফোকাসে মেলেও সে চিনতে পারল না। হয়তো নতুন এসেছে। গার্মেন্টসে নতুন চাকরিতে ঢুকে অনেক মেয়ে কাজের চাপে দিশেহারা হয়ে কাঁদে অবশ্য, কিন্তু কেন যেন সিরাজের এ কান্নাকে সে ধরনের কান্না মনে হচ্ছিল না। তবে কি...!

ভাবনাটা আরেকটু সামনে বাড়ার আগেই ত্রস্তব্যস্ত হয়ে আরেকজন মেয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ছাদে পা রেখে প্রথমে এদিক-সেদিক নজর বুলিয়ে কী একটা খুঁজল; তার পর জোর কদমে পা চালিয়ে ট্যাংকের দিকে ছুটে এল। বোধ করি ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ কানে যেতেই। এসেই কাঁদতে থাকা মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল:

‘কী রে পিরু! তুই এনে এম্বায় কাঁনতাছস ক্যা?’

গলার স্বর শুনেই চিনে ফেলেছিল সিরাজ। রোকেয়া। অ্যামব্রয়ডারি বিভাগের সিনিয়র অপারেটর। সিরাজেরও সিনিয়র। অনুমান করে নিয়েছিল, এই রোকেয়া আপাই নতুন এই মেয়েকে এনেছেন। পিরু নামের কাঁদতে থাকা মেয়ে এবার রোকেয়াকে জড়িয়ে ধরে শরীর কাঁপিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। রোকেয়া তাকে বুকে চেপে ধরে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করেছিল:

‘এহন আমারে ক ছেন, তোর কী অইছে? তোরে না সুপারভাইজার স্যার আইস্যা বসের রুমে নিয়া গেল? আমারে কইয়া গেল, তোরে বলে কী একখান কা গেলাম যেম বুঝাইয়া দিব মালিক। আমি তো আরও খুশি অইয়া গেলাম যে, যাক, তোর ওপরে মালিকের সুনজর পড়ছে!’
‘আমার সব্বোনাশ অইছে রোকেয়া বু! আমারে...’

আর কোনো কথা বলতে পারল না পিরু নামের এই মেয়ে। হাউমাউ করে কেঁদে রোকেয়াকে আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরেছিল। যা বোঝার বুঝে গিয়েছিল রোকেয়া। দূরে দাঁড়িয়ে সিরাজও বুঝেছিল। তবে ওদের বুঝতে দেয়নি। রোকেয়াও কেঁদে উঠেছিল এবং এর পরপরই নিজেদের অবস্থান বুঝতে পেরে সতর্ক হয়ে উঠেছিল। যে কেউ এখন ছাদে উঠে আসতে পারে। এদিক সেদিক তাকিয়ে নিজের ওড়না দিয়ে পিরুর মুখ চেপে ধরে তাকে শান্ত করার চেষ্টায় ফিসফিসিয়ে বলেছিল-

‘খবরদার! এই কথা য্যান্ কেউ কুনুদিন জানবার না পারে! আমি দেহি কী করবার পারি। আমাগো তো বুইন পুড়া কপাল! মাইনষের নাত্থি-গুঁতা খাইয়া আর বেইজ্জতি অইয়াই আমাগো বাঁইচ্যা থাহুন লাগে। এহন যুদি আমি কিছু কইবার যাই তাইলে তোর তো চাকরি যাইবই, আমারও চাকরি চইল্যা যাইব। বুইন রে, প্যাটের জ্বালা অইতাছে বড় জ্বালা। আমার খালা, তোর মা যে মরুন্যা ব্যারামে পড়ছে, হ্যারে বাঁচাইয়া রাখবার চাইলে তোর তো চাকরি করুনই লাগব। তোরে কি কমু বোইন, আমার নিজেরও কইলাম কম বেইজ্জতি অইতে অয় নাই! এই বেবাক কিছু সইবার পারছি বইল্যাই না চাকরিতে আমার ইট্টু উন্নতি অইছে! তয় তোরে আর আমি বেইজ্জতি অইবার দিমু না...’

সিরাজ আর ওদের কোনো কথা শুনতে পেল না। পিরুকে কিছুটা শান্ত করে টেনে তুলে ছাদের দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করেছিল রোকেয়া। সিঁড়ির গোড়ায় আলোতে যাওয়ার পর সিরাজ পিরুর চেহারা দেখতে পেয়েছিল। শ্যামলা। তবে দেখতে বেশ!

ব্যাপারটাকে নিজের ভেতর চেপে রেখে এর পর থেকে পিরুর ওপর নজর রাখছিল সিরাজ। নিছক কৌতূহলের বশেই। এমনিতে কারও কোনো ব্যাপারে কখনো কোনো আগ্রহ জাগে না তার। নিজের কাজ নিয়ে থাকে। নিজের মতো চলে। নিজের সমস্যায় এমন নাকানি-চুবানি খেতে থাকে যে, অন্য কারও বা অন্য কিছুর কথা ভাববারও ফুরসত থাকে না। লেখাপড়া শেষ করতে পারার আগেই আয়-রোজগারের উপায় খুঁজে নিতে হয়েছিল তাকে। বাবা ছিলেন পদ্মাপারের এক প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। বছর পাঁচেক আগে মা মারা যাওয়ার পর থেকেই সংসারে ভাটার টান শুরু হয়েছিল। বাবা দিন দিন জাগতিক সব কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছিলেন। মাঝে মাঝেই তবলিগের চিল্লায় চলে যেতেন। তখন সংসারের কোনো খোঁজই রাখতেন না। বড় বোনের অবশ্য বিয়ে হয়েছিল মা মারা যাওয়ার আগেই। তিন ভাইবোনের ভেতর সে বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান। লেখাপড়ায় খুব একটা ভালো ছিল না। কোনোরকমে এসএসসি পাস করার পর শহরে গিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। একটা মেসে থাকত আর টিউশনি করে চলত। ছোট বোনটা বেশ মেধাবী। ক্লাসে ফার্স্ট হতো। কিন্তু সে এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারার আগেই চিল্লা থেকে জটিল রোগ বাঁধিয়ে ফিরে এসে বিছানায় পড়েছিল বাবা। অগত্যা সিরাজ পড়াশোনা ফেলে চলে এসেছিল সংসারের হাল ধরতে। বাবার কোনো জমানো অর্থ ছিল না। বাড়ির পাশে ছোট্ট এক প্লট জমি ছিল। সেটি বিক্রি করে বাবার চিকিৎসা করাতে ঢাকায় নিয়ে এসেছিল। কিন্তু চিকিৎসা শুরু হওয়ার আগেই তিনি মারা যান। বেদিশা হয়ে পড়েছিল সিরাজ। হাতে যে টাকা-পয়সা ছিল তা খরচ করে বাধ্য হয়ে ছোট বোনকে বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তার ছোট বোনকে শ্বশুরবাড়ির অনেক অত্যাচার সইতে হচ্ছিল। সিরাজ দু-চোখে অন্ধকার দেখে গ্রামের পরিচিত একজনের হাত ধরে ঢাকায় এসে গার্মেন্টসে স্টিকার ম্যান হিসেবে এই চাকরিটা নিয়েছিল। ছোট বোনকে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার থেকে রক্ষায় প্রায়ই তাকে টাকা পাঠাতে হচ্ছিল। গার্মেন্টসে এই চাকরিটা ছাড়াও টোঙা বানিয়ে বিক্রি করে এবং এটা-সেটা করে তাকে টাকা জোগার করতে হচ্ছিল। অবশেষে অত্যাচার সইতে না পেরে মাস ছয়েক আগে তার ছোট বোন আত্মহত্যা করেছে।

টিফিনের সময় গার্মেন্টসে খুব হুড়োহুড়ি লেগে যায়। সবাই আগে গিয়ে ছাদে বসে সারা দিনের একমাত্র খাবার একটু আরাম করে খেতে চায়। একদিন সিঁড়ি দিয়ে নিজের নিজের টিফিন বক্স নিয়ে দৌড়ে ওঠার সময় একজনের হাতের গুঁতো লেগে পিরুর টিফিন বক্সটি ছিটকে পড়ে গেল একেবারে নিচে। পড়েই ভেতরের খাবারগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেল। সেদিনের পর থেকেই সিরাজ পিরুকে চোখে চোখে রাখছিল। নিজের বোন অত্যাচার সইতে না পেরে নিজেই নিজেকে শেষ করে দিয়েছে। এখন পিরু নামের এই মেয়ে এখানে গোপনে যে অত্যাচার সইছে তাতে অজান্তেই তার ওপর সিরাজের বোন-ভালোবাসা জেগে উঠছিল দিনে দিনে। সে পিরুর এই অবস্থা দেখে এগিয়ে এল এবং পিরুর হাতে নিজের টিফিন বক্সটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘তুমি এই টিফিন বক্সটা নিয়া ছাদের এক কোনায় যাইয়া বসো। আমি তুমার টিফিন বক্স নিয়া আসতেছি।’

পিরু থতমত খেয়ে গেলেও যখন দেখল অচেনা এই লোকটি দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে তার টিফিন বক্সটা কুড়িয়ে আনতে, সে তখন ধীরে ধীরে তার টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে ছাদের এক কোনায় গিয়ে বসে পড়ল। সিরাজ ফিরে এসে তাকে ওভাবে তার টিফিন বক্স নিয়ে বসে থাকতে দেখে একটু রাগের সঙ্গেই বলল, এবং এমনভাবে বলল যেন সে তার কত কালের চেনা! যেন নিজের বোন।
‘কী রে পিরু! এহনও ওইডা হাতে নিয়া বইস্যা আছস! খাইবার পারতাছস না? তোর টিফিন তো সব পইড়্যা গেছে!’
‘বাহ! আমি আপনের টিফিন খামু ক্যা? আপনেরে তো আমি চিনিই না!’
‘চিনুন লাগব না। তোরে তো আমি চিনি।’

এরপর সিরাজ সেদিন রাতে তার সবকিছু জেনে যাওয়া, তার বোনের মর্মান্তিক কাহিনি বলে তাকে সে তার সেই বোনের মতো দেখে, সব সময় তাকে চোখে চোখে রাখে- এসব খুলে বলেছিল। সেদিন থেকেই দুজনে ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল এবং একজন আরেকজনের সব কথা পরস্পরকে খুলে বলেছিল। কিন্তু তারা সেই সুপারভাইজারের চোখ ও কানকে ফাঁকি দিতে পারেনি, যে সুপারভাইজার পিরুকে সেদিন মালিকের রুমে নিয়ে গিয়েছিল। মালিককে সব বলে সে সিরাজকে ছাঁটাই করতে চেয়েছিল, কিন্তু মালিক শুধু ছাঁটাই করাকে যথেষ্ট মনে করেনি। সে একটি চুরির ঘটনা সাজিয়ে সিরাজকে পুলিশে দিয়েছিল। এদিকে পিরুর ওপর অত্যাচারের মাত্রাও বেড়ে গিয়েছিল। সে যাতে চাকরি ছেড়ে পালাতে না পারে সে ব্যবস্থাও পাকা করে রাখা হয়েছিল। রোকেয়া শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে পেরেছে, আর কিছু করতে পারেনি।

ছয় মাসের জেল হয়েছিল সিরাজের। জেলে থাকতেই সে ঠিক করেছিল, ছাড়া পেলে পিরুকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে গিয়ে সংসার পাতবে। পদ্মাপারে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। এক চিলতে যে বসতভিটে ছিল তা পদ্মায় ভেঙে নিয়েছে। তার ইচ্ছে চট্টগ্রামের ইপিজেডে গিয়ে কোনো গার্মেন্টসে কাজ জুটিয়ে নেবে। কিছু একটা করতে পারবে সে আত্মবিশ্বাস তার আছে। তার পর কয়েক বছর টাকা জমিয়ে কোনো গ্রামে গিয়ে জমি লিজ নিয়ে চাষবাস করবে আর একটি গরুর খামার করবে। শুনেছে ঠিকমতো করতে পারলে নাকি তাতে খুব লাভ!

জেল থেকে ছাড়া পেয়েই সেদিন রাতে সে পিরুর মেসে চলে গেল। এর আগে পিরু জেলখানায় তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তারা সবকিছু পাকা করে রেখেছিল। সেদিন নাইট ডিউটি না থাকায় পিরুর মেসে গিয়ে তাকে পেয়ে গেল সিরাজ। পিরুকে সে তখনই সব গুছিয়ে নিতে বলল। পিরু এমন একটাকিছুর জন্য মনে মনে তৈরি হয়েই ছিল। গোছানোর তেমন কিছু নেই। দুই সেট সস্তা থ্রিপিস আর গামছা। ব্যাগ নিয়ে সিরাজের পিছু পিছু যেতে যেতে সে জিজ্ঞেস করল-
‘কই যাইবেন? ঠিক করছেন কিছু?’ 
‘আগে তো বাইর হই, তার পর দেখবানি। নু।’

পরগাছা প্রেম

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৬ পিএম
পরগাছা প্রেম
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

দুজনের ভুল বোঝাবুঝি মেটানোর সব কৌশলই
ভুল নামতায় পাশমার্ক না পেয়ে হাপিত্যেশ করে-
ভুল বোঝাবুঝি অবসানে সচেতন মিটারের বড্ড অভাব। 

অসময় ভেবে পেছনে ফেলে আসা দিনগুলো মিটার দেখে 
তবু দিনাতিপাত করছে...
আমাদের চাকচিক্য জীবন এখন আর অটোতে চড়ে না।
পাঁচ টাকার বাদাম আর তিন টাকার পাকা তেঁতুলের 
চোখে-মুখে সেই সতেজ হাসিটা বিক্রি করে দিয়েছি-
পুরনো বইয়ের সাথে ফেরিওয়ালার কাগজের পাল্লায়। 

সন্ধ্যাগুলো জ্যামে বসে ঘাম পুষে বড্ড ক্লান্ত।

শহরের গাছের ধুলোমাখা ডালপালায় ঝুলে থাকে 
সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো। 
একটি সচল কিংবা সচেতন মিটারের অভাবে 
নিষ্ঠুর গন্তব্য যেন এক একটি পরগাছা প্রেম।

আমাদের নির্বাণকাল

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৫ পিএম
আমাদের নির্বাণকাল
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

তারকাঁটায় হেঁটে হেঁটে একদিন ঠিক পৌঁছে গিয়েছিলাম
নিষিদ্ধ শরীরী বিদ্যায়
আমার শরীর তা জানে 
যেভাবে তোমার অতীত তা মানে

এখন এতদিন পর স্মৃতিচারণের মতো চিহ্নগুলো
গলায় ঝুলিয়ে ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য প্রদর্শন করে চলেছি

আমাকে দেখলেই তোমাদের গৃহপালিত নদী
মুখ লুকায় উত্তাল দিনের সামুদ্রিক সন্ত্রাসে 
তোমাকে দেখলেই আমাদের প্রহরারত মাঠে
অশ্বদৌড় কেঁপে ওঠে মধ্যরাতে অকুণ্ঠ উত্তাপে   

আজকাল ঊনঘুম ঊনঅন্নে রাত জেগে তীর্থ রচনা করি
পুরনো নোটবই ঘেঁটে অনাবশ্যক বাক্য কেটে
                                ভুল শুধরে নিই

আজকাল গঞ্জে বাজারে ঘুরি, নানা বরণ মানুষ ঘেঁটে
চোখে চোখে খুঁজে দেখি শরীরী সম্পর্কের ভাষা

আমাদের এই বিদ্যা ভেসে উঠেছিল 
ঢলে পাওয়া কইমাছের দিনে; আজও কেউ জানেনি তো
দুজনেই মজে আছি সেই এক চিরকালীন নির্বাণের ঋণে