![গোপনীয়](uploads/2024/12/12/goponiyo illustration 3 fainal, foyez towhidul islam-1734004263.jpg)
পর্ব-১৪
এরকম একটি অংশ একেবারে সামনে বসা সুন্দরীদের, আরও বলা ভালো, এক বিশেষ সুন্দরীর ওপর বিশেষ নজর রাখছিল। তারা জীবনে অনেক সৌন্দর্যরের সন্দর্শন পেয়েছে, কিন্তু এমন জগৎ ভোলানো সুন্দর কে কবে দেখেছে! মানুষ এমনও সুন্দর হয়!
বিরামপুরের ইতিহাসে যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত ছাত্র একযোগে একজনের প্রেমে ‘পড়িতেছিল’, তখন ভরা বক্তৃতার আসরে নেতার বক্তব্য হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। ছাত্ররা দেখল, নেতার উত্থিত তর্জনী তাদের দিকে তাক করে আছে।
তার পর তাদের আর কিছুই মনে নেই। হঠাৎ থেমে যাওয়া বক্তব্যের পর চারদিকের গুঞ্জরণের মাঝে কখন নিজেরা হারিয়ে গেল, হারিয়ে গেল সেই সুন্দরের প্রতিমা টেরই পেল না কেউ।
এদিকে মঞ্চের পেছনে গ্রিনরুমে তখন নেতাকে নিয়ে আসা হয়েছে। এখানে রিয়াজুল্লার মা বসে আছেন। আরও আছেন নেতার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জরুল্লা। পার্টির ডাক্তার নেতাকে পরীক্ষা করে বলেছেন, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু মায়ের প্রশ্ন, সব ঠিক থাকলে ছেলের জবান বন্ধ কেন! ডাক্তার সাহেব এ প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না।
ইজি চেয়ারে ছেলের হাত ধরে মা বসে আছেন। ওপরে একটি প্রাচীনকালের ফ্যান ঘুরে চলেছে। নামে গ্রিনরুম হলেও গোলাপি আলোতে আচ্ছন্ন ছোট্ট ঘরটি। সেখানে বাইরের ভেঙে যাওয়া সভার ভেসে আসা শব্দ ছাড়া জগতের বাকি সব কিছু স্তব্ধ হয়ে গেছে।
জরুল্লাকে মা বলছেন-
-কতবার তোমাদের বললাম, আমার ছেলের একটি বউ চাই। না, তোমরা তাকে নেতা বানাতে চাও, নিজেরা সংসারী হয়েছ কিন্তু আমার ছেলেকে নেতা বানাতে চাও। এখন এই অবস্থায় ওর কিছু হলে, ওর ভিটেয় বাতি জ্বালাবে কে, বলো!
জরুল্লা কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সে গুরুকে গুরুর মতোই মানে, মানে গুরুমাতাকেও। আবার গুরু তথা রিয়াজ্জুল্লা তার বন্ধুও বটে। তাই নিজের প্রচেষ্টায় বেশ কয়েকবার পাত্রী দর্শন তথা বিয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করেছে। এখনো হাল ছাড়েনি; কিন্তু গুরু যে অন্য কিছুর ভক্ত, তার চাই শহরের সেরা মেয়েটি এবং তা বিয়ে ছাড়াই! তার সেই ভক্তি গুরুর সহকারী আলিমুল্লা পূরণ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, সেকথা কি গুরুমাতাকে বলা যায়!
জরুল্লার চিন্তার সূত্র ছিন্ন হয় মায়ের কথায়-
-আজকের মিটিংয়েও তো কত ভালো, চোখজুড়ানো মেয়ে দেখলাম। এদের মধ্য থেকে একটি মেয়েও কি আমার ছেলের জন্য পাওয়া যায় না; না কি তোমরা ইচ্ছে করে তাকে আইবুড়ো রাখতে চাও!
জরুল্লা প্রথমে ভাবল এড়িয়ে যায়, পরে মনে হলো, এ প্রশ্ন তাকেই করা, কারণ তার ছেলে
অর্থাৎ নেতার জবান এখনো বন্ধ। তাই কৌশলে উত্তর দেয় সে;
-খালাম্মা চেষ্টা তো করে যাচ্ছি, আগামী মাসেও আর একজন মেয়ে দেখব, আপনিসহ থাকবেন।
খালাম্মাকে খুব উৎসাহী মনে হলো না। তিনি নিজেও অনেক মেয়ে দেখেছেন, ছেলে এই-সেই বলে এড়িয়ে যায়; ছেলের কোনো পছন্দ আছে কিনা কে জানে, নাকি তার শারীরিক সমস্যা আছে- মা হয়ে তো এসব ছেলেকে বলা যায় না, তবে বন্ধুবান্ধবদের তো জানার কথা। কিন্তু ছেলের গোপণীয়তা বন্ধুদের বলার মতো বুদ্ধিহীনা তিনি নন। তার পিতা ব্রিটিশ আমলে রামগড় থানার দফাদার ছিলেন। থানার একজন ‘ঊর্ধ্বতন’ কর্মকর্তার মেয়ে হিসেবে এতটুকু বুদ্ধি তার আছে।
ছোট্ট গ্রিনরুমের পরিবেশ হঠাৎ গুমোট হয়ে যায়। না খালাম্মা, না জরুল্লা কেউ কোনো কথা বলে না অথবা বলতে পারে না। আর যাকে নিয়ে এত কিছু সেই নেতা এখনো নির্বাক। মঞ্চকর্মীদের দেওয়া যে চায়ের কাপে এতক্ষণ ধোঁয়া উঠছিল, তা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। সবাই নিস্তব্ধ; শুধু বাইরে থেকে শ্রাবণ আকাশের মন্দ্র ডাকের মতো থেকে থেকে ডোরাকাটা পার্টির স্লোগান ভেসে আসছে- রিয়াজুল্লা ভাইয়ের কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে।
খালাম্মা হঠাৎ শঙ্কিত হন- স্নেহের হাত রাখেন ছেলের কপালে, গণ্ডে, গলায়। এসময় আলিমুল্লা ঝটিতি গ্রিনরুমে প্রবেশ করে। তার হাতে নেতার বক্তৃতার লাইভ ভিডিও। বলে, এ ভিডিও চালালে বোঝা যাবে, কী দেখে বা কাকে দেখে নেতার কণ্ঠ হঠাৎ নিস্পন্দ হয়ে যায়।
তার পর গলা নামিয়ে জরুল্লার কানে কানে বলে, মিছিলের জন্য পল্লি থেকে খাসা কিছু জিনিস এনেছিলাম, আমার মনে হয় তাদের কাউকে দেখে নেতার জবান বন্ধ হয়ে গেছিল, যদি সেরকম হয় ধরে নাও নেতার অসুখের টোটকা আমার হাতে।
জরুল্লা- কী বলতে চাও?
আলিমুল্লা- বলতে চাইছি, সে যেই হোক, তাকে নেতার জন্য আমি জোগার করতে পারব; যাকে মিটিংয়ে আনতে পেরেছি, তাকে নেতার খাসরুমে আনাও আমার জন্য কিছুই না।
জরুল্লা- তোমার কথার আগামাথা কিছুই বুঝছি না, ভিডিও চালাও।
নৈঃশব্দের নীরবতার মধ্যে ভিডিও চালু হলো। এখন নেতার বক্তব্য শোনা যাচ্ছে, মাঝে মাঝে ডোরাকাটা পার্টির উত্তুঙ্গ স্লোগানে গ্রিনরুমের নীরবতা ভেঙে চৌচির হচ্ছে। কিন্তু চারটি প্রাণীর নীরবতার দেয়ালে ভিডিওর কথামালা দ্বিগুণে ত্রিগুণে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে কেবল- তাদের নিমগ্রতায় তা কোনো চির ধরাতে পারছে না।
এখন ভিডিও দর্শকদের ওপর জুম করে আসছে। স্পষ্ট হচ্ছে আলিমুল্লার নিয়ে আসা সেই বিশেষ মুখগুলো। একসময় তা এসে স্থির হলো একটি বিশেষ মুখের ওপর। আর তখনি খালাম্মা এবং বিস্ময়কর হলেও সত্য, জবান বন্ধ হয়ে যাওয়া নেতা দুজনই হঠাৎ আঙুল তুলে ভিডিওর দিকে তাক করলেন আর একযোগে বললেন- এই সে!
পর্ব-০৭
জরুল্লা নেতার জবান ফিরে আসায় খুশি, কিন্তু ঘটনা কিছুই বুঝতে পারল না।
আলিমুল্লা বলল, আ রে, আঙুলি দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া নেতার ওই মেয়েটিকে আমি চিনি; ও তো ‘আমাদের’ চারু! ঘটনা তাহলে এই!!
আলিমুল্লা তার কথা রেখেছে। তিন দিনের মাথায় নেতার অফিসে চারুকে হাজির করাতে পেরেছে সে।
সভার পরদিন। আলিমুল্লা ভেবেছিল বেলাবেলি চারুপল্লিতে এসে হাজির হবে। কিন্তু তা যে ঢাকা শহর থেকে এত দূরে কে জানত। ঢাকা শহরের মাঝখানে কিন্তু চারুপল্লিতে যেতে হবে নৌকায় চড়ে- এমন আজব বাত পৃথিবীতে কে কবে শুনেছে! আলিমুল্লাও শোনেনি, তবে ও আজ শুধু শোনেইনি, নিজে এক্ষণে চড়ে বসেছে একটি নৌকায়। নৌকার মাঝি নিতান্তই বালক। তার মুখে গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে কেবল। মুখে মুচকি হাসি।
আলিমুল্লা মুখে কিছুই বলল না; কিন্তু বালক মাঝি নিজেই মুখ খুলল,
-সাহেব বুঝি প্রথমবার পল্লিতে যাচ্ছেন!
আলিমুল্লার একবার মনে হলো, বলবে মাঝির বাচ্চা তুই আমারে চিনিস? জানিস আমি হবু প্রধানমন্ত্রীর ডান হাত? আবার কী ভেবে নিজের রাগ সংবরণ করল সে।
শ্রাবণ দুপুরে মেঘভাঙা রোদ উঠেছে। জলের বুকে কয়েকটি পাতি হাঁসের সন্তরণ। লেকের অনুচ্চ ঢেউগুলো ভেঙে পড়ছে তাদের পেলব দেহের বঙ্কিম বিভঙ্গে। আলিমুল্লা কোনোদিন কবিতার ভক্ত পাঠক নয়, কিন্তু এই মুহূর্তে সে আবিষ্কার করল হাঁসগুলোর চোখ মচকা ফুলের মতো লাল।
দীর্ঘক্ষণ উত্তর না পেয়ে বালক মাঝি আবার প্রশ্ন করল-
-সাহেব কি প্রথমবার পল্লিতে যাচ্ছেন?
-এবার আলিমুল্লা মুখ খুলল-
-হ্যাঁ। এতে কি তোমার কোনো সমস্যা?
- না। পল্লিতে তো অনেক ঘাট, ভাবছিলাম পুরাণ হলে তো কোন ঘাটে নামবেন জানেন, কিন্তু নতুন হলে কোন ঘাটে নেব সেটাই সমস্যা।
এইবার আলিমুল্লা চিন্তিত হলো। কোন ঘাটে যাবে সে, কোন ঘাটে নামলেই বা চারুর দেখা হবে। চারু আর চারুপল্লির মেয়েদের নিয়ে যাওয়া স্থানীয় ছেলেটা থাকলে ভালো হতো! কিন্তু এ তো গোপন মিশন- শুধু চারুকে চাই নেতার নৈবেদ্য হিসেবে নিবেদনের জন্য; একাকী এবং গোপনে।
শ্রাবণ সূর্য রশ্মি বিকিরণে অকৃপণ। সেই কিরণধারা জলের বুকে বিম্বিত হচ্ছে চারদিকে, নৌকার পাশজুড়ে কয়েকটি জলময়ূরী উড়ছে। তাদের পাখায় পাখায় রবির রশ্মি এক অজানিত মায়া ‘বুলাইয়া’ দিয়াছে।
কিন্তু ভাবালুতার সময় নয় এটি। আলিমুল্লা ভালো করেই জানে মাঝিকে বলতে হবে, ‘কোন ঘাটে ভিড়বে তাহার তরণী’। কিন্তু কোন সে ঘাট!
এসময় আলিমুল্লার সাহায্যে এগিয়ে এল সেই বালক মাঝি।
-চলুন, আমরা প্রথম ঘাট থেকেই শুরু করি। প্রতি ঘাটের ধারে ওই অংশের সব মেয়েকে দেখতে পাবেন; তার পর যে ঘাটে বলবেন, নামিয়ে দেব।
আলিমুল্লা অনেক্ষণ কথা বলল না অথবা বলতে পারল না।
ব্যাপার তাহলে এই! শহরের বা বিদেশের রেড লাইট এরিয়ার মতো মেয়েরা দাঁড়িয়ে থাকবে সাজুগুজু করে আর খদ্দের পছন্দ করবে! কী আর করা!
প্রথম ঘাটে নৌকা ভেড়াল মাঝি।
শূন্য ঘাটে শূন্য তরণী। কোথাও কেউ নেই। শানবাঁধানো বিরানা ঘাটের নিচে আলিমুল্লা। একটি নিঃসঙ্গ গাঙচিল উড়ে গেল কোথায়। দূরে-বহু দূরে ঢাকা শহরের নাগরিক আয়োজন।
এসময় আচমকা লিলুয়া বাতাসের মতো কেউ একজন ঘাটে এল, এসে বসল আলতো পায়ে। তার নূপুরের নিক্কনে বাঙ্ময় হলো নদীতীর। তীরে স্নানরত একটি পানকৌড়ি উড়াল দিল দক্ষিণে।
সেদিকে পল্লির বাগানে অশোক গাছে বহু দিন পরে ‘খয়েরী রঙের ফুল ধরিয়াছে’।
আলিমুল্লা একবার খইরঙা অশোক গাছের দিকে তাকাল।
কিন্তু মুহূর্তেই তার দৃষ্টি কেড়ে নিল ঘাটে বসা রমণী। লাল রঙের দোপট্টা পড়েছে সে। কিন্তু ছোট্ট দোপাট্টা তার ভরা যৌবন গোপন করতে হিমসিম খাচ্ছে বারবার। তার চোখে কামনার আমন্ত্রণ প্রত্যক্ষ করল আলিমুল্লা। কিন্তু যখন আলিমুল্লার চোখ মেয়েটির চোখের গহনে ডুবুডুবু, সে খেয়ালই করল না কখন ঘাটে তার পাশে একের পর এক অনেকে এসে বসেছে। তাদের মুখে মদিরা, চোখে মাদকতার কাজল লেপ্টে আছে। কিন্তু আলিমুল্লা বহু খুঁজেও কাঙ্ক্ষিত মুখটি খুঁজে পেল না। কোথায় চারু!
দ্বিতীয় ঘাট গাঙের ভেতর অনেক দূরে ঢুকে পড়েছে। এখানে প্রাচীন বৃক্ষতলে ছায়া করে আছে। আর সে ছায়া আলো করে বসেছিল কয়েকজন। তারা গাইছিল হাল আমলের একটি জনপ্রিয় গান-
অসময়ে বাঁশী বাজায় কে রে
কাঙ্খের কলসী টলমল টলমল করে।
একজন প্রথম কলি ভাজে তো সবাই সমস্বরে শেষের কলি ফুটিয়ে তোলে-
আমি জলকে আসি যমুনার পাড়
দেখা হলো সেই সে কালার
ছলকে উঠে ভরা কলসী অঙ্গ ভেজায় রে।
চলবে...