ঢাকা ৫ মাঘ ১৪৩১, রোববার, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫

দাও সে প্রেমের দান

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:১২ পিএম
দাও সে প্রেমের দান
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

শীতকাল, ঘুম থেকে জেগে ওঠে রমা। শব্দহীন চুপচাপ ঘর থেকে বেরোয়। মা জেগে গেলে যাত্রা হবে না, বাধা আসবে। মাকে ফাঁকি দিতে ভোররাতেই রওনা। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে চারটে। এখনই সঠিক সময়- ঘড়ি দেখে হিসাব করে রমা। মায়ের জন্য ভীষণ কষ্ট হতে থাকে। অনেক রাত অব্দি ঘুম আসেনি। অন্তরের কষ্ট বুকে চেপে রাখতে হয়েছে। রমেন্দ্র কুমার দাস ওরফে রমা তার নাম। বয়স একুশ ছুঁইছুঁই। এলোমেলো লম্বা চুল। গায়ের রং ফর্সা হলেও এই কদিনে তামাটে বর্ণ ধরেছে। 

শরণার্থী ক্যাম্পের তিন দিনের অভিজ্ঞতায় বৃদ্ধা মাকে ওখানে রেখে আসা ছাড়া উপায় ছিল না ওর। এটা অবশ্য পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা। 

এক সময় সংসার বলতে ছিল রমা, নববিবাহিত স্ত্রী কবরী আর তার মা। বাবাকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছে। কবরীকে ধরে নিয়ে গেছে পাকবাহিনী। গায়ে দিয়েছে আগুন। নারী-পুরুষ-বউ-ঝি-শিশু-কিশোর সবাই পালিয়েছে। এসব ঘটনার পরদিনই সুনামগঞ্জের ভাঙ্গাডহর থেকে পূর্বপুরুষের ভিটে ছেড়ে ভারতের মেঘালয়ের পাদদেশে এসে থামতে হয়েছে ওর। 

পুরো ছয়দিন রাস্তায় কেটেছে, নৌকা, পায়ে হাঁটা পথ আর মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ। মায়ের ঠিকানা এখন  মৈলাম ক্যাম্প। তাকে তো ট্রেনিংয়ে যেতেই হচ্ছে। কিন্তু বউ? বউ যে তার আত্মা। বউকে ভুলে যাওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা করার পরও বারবার মুখখানি উঁকি মারছে চোখে। মায়াময় সেই দুটো ছলছল চোখ। মেয়েদের পোড়াপ্রাণে স্বামী শাসক হলেও তার এখন যেন উল্টোটা হচ্ছে। এই মুহূর্তে রমার মনে হয় জীবন ও যৌবনরাজ্যে কবরীর স্থান অতি উচ্চে।   
  
ঝুপড়ি শিবিরে কনকনে রাত পেরিয়ে যখন ভোরের আলো ফোটে, তখনই রওনা দেওয়ার কথা ছিল তার। শীতবস্ত্রের বদলে আগুনই এখানে শীত নিবারণের একমাত্র ভরসা। দু-চারজনের থাকলেও, অধিকাংশ শরণার্থীর ঘরেই নেই শীত ঠেকানোর ব্যবস্থা। তাই দিনের বেলায় কুড়িয়ে আনা লাকড়ির পরিত্যক্ত অংশ জ্বালিয়ে কোনোরকমে শীত থেকে বাঁচার উপায় খোঁজার চেষ্টা অসহায় মানুষগুলোর। রমার বস্ত্র বলতে পরনের একখানি লুঙ্গি আর গায়ে হাফহাতা শার্ট। প্রচণ্ড শীত, শরীর কাঁপছে; তবু ট্রেনিংয়ে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়ায় লম্বা সড়কের কিনারে। 

হঠাৎ অচেনা একটি লোক এসে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কি রমা?’ মাথাসমেত  হাঁটুঅব্দি লম্বাকোট পরা মানুষ।  
লোকটির দিকে চোখ বুলিয়ে ‘হাঁ’ শব্দটি মুখে উচ্চারণ না করেও আস্তে মাথা নেড়ে বুঝাল, সঠিক। 
রমা আবারও তাকাল চেহারার দিকে। 
রং ফর্সা, গোল মুখ। সত্তরোর্ধ্ব লোকটি কাপড়ের পুঁটলি দিয়ে বলল, ‘এগুলো তোমার।’
গায়ের চাদর আর গরমকাপড় পেয়ে প্রাণ ফিলে পেল শীতবস্ত্রহীন রমা। 

খুশি হলো। হাঁ-না প্রশ্ন করল না রমা। কথা বলতেই কি ভুলে গিয়েছিল? নিজেকেই জিজ্ঞেস করে- লোকটি কে? কিছুক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকল লোকটির দিকে। নীরবে চলে যাচ্ছে কোটপরা কুঁজো লোকটি। 

সুধারাম বলেছিল- শীতবস্ত্র পাবে। তোমাকে দিয়ে যাবে একজন। তবে কী এ-ই লোক? রমা রাস্তা ধরে সামনের দিকে হেঁটে হেঁটে সুধারামের অপেক্ষা করে। সে-ই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে লক্ষ্যে।    

এই মুহূর্তে চলতি পথেও রমাকে ভাবায় ওর স্ত্রী কবরী।  মন উচাটন করে, কখনো দুচোখে পানি ভরে ওঠে। বিয়ের কয়েকদিন পরই যেন আরও সুন্দর হয়ে উঠেছিল। অধিক উজ্জ্বল হয়েছিল গাত্রবর্ণ। টানাটানা চোখ দুটো যেন আরও পরিষ্কার, আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। পরনে সাদা-নীল ফুলে আঁকা লালপেড়ে শাড়ি পরার পর চোখ সরাতে ইচ্ছে করত না রমার। সম্ভবত সৌন্দর্য এমন একটি জিনিস যা হাতে ধরা যায় না। এমনকি এখনো কনে দেখার মুহূর্তটি কোনোভাবেই চোখ থেকে সরতে চায় না। 

কবরীদের বাড়ি ছিল অতি সুন্দর। চারদিকেই কী সবুজ। সে কি ভোলা যায়!  আম, জাম, কাঁঠাল তো আছেই, এর বাইরে নাম না-জানা অসংখ্য গাছগাছালি। কী স্নিগ্ধ। চোখ জুড়িয়ে  যেত  সেই গ্রামের দৃশ্য। বাড়িতে  পৌঁছবার মুহূর্তে  রমা দেখল-  ছোট সরু রাস্তা। মাঝে মাঝে কচুরিপানাভর্তি খাল। ছোট ছোট পানাপুকুর, সরু সরু গ্রাম্য রাস্তা। 

এর পর পাত্রী দেখার বড় রকমের আয়োজন বাড়িময়। টিনের ছাউনি, কাঠের বাড়িঘর, ফুল, লতাপাতা আঁকা দরজা। বৈঠক ঘরের জানালায় নারীদের উৎসাহী, উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত মুখ। পাত্রী দেখা ও আপ্যায়নের আয়োজন করা হয়েছে ওখানেই।  
সারবাঁধা চেয়ার, জলচৌকি আর বেঞ্চ পাতা ঘরে। নেচে নেচে উঠছে সেসব দৃশ্য। 

চেয়ার টেনে বসতে বসতে প্রতিবেশী ষাটোর্ধ্ব বয়সী ছালাম মাতবর বললেন, ‘দিনের অবস্থা ভালো নয়। আকাশে মেঘ জমেছে। যা করবার তাড়াতাড়ি।’ 
রমার চেনাজানা বন্ধুবান্ধব এসেছে। বিবাহের প্রথম পর্ব এটি। জীবনের এই অধ্যায়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ছেলের পাত্রী দেখতে এসেছেন রমার বাবা। তিনিও সায় দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, আকাশে কয়দিন থেকে যেন মেঘ বাসা বেঁধেছে।’

পাত্রীপক্ষের অভিভাবকমণ্ডলীর একজন বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘আজ্ঞে, আপনারা যদি দয়া করেন তাহলেই মঙ্গল। যেভাবে বলবেন সেভাবেই হবে। আমাদের সবকিছু  তৈরি।’

ঝাঁকবাঁধা শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী ঠেলে ফাঁকা করা হলো ঘরে ঢোকার জায়গা। এর পর লালশাড়ি পরিয়ে বউ বউ ধরনের সাজগোজ করে পাত্রীকে সামনে আনা হলো।

‘নাম।’
‘কবরী।’
পাত্রীর গড়ন দেখেই তৃপ্তির হাসি খেলল প্রধানসঙ্গী ছালাম মুরুব্বির মুখে। 
‘দাঁড়াতে হবে, আমাদের দাঁড়িয়ে দেখাতে হবে।’
কবরী দাঁড়াল। ছালাম মাতব্বর বললেন, ‘হাঁটাচলা দেখি।’ 
কবরী ঘরেই দুটি চক্কর দিয়ে হাঁটল।
ছালাম মুরুব্বির মন্তব্য, ‘দারুণ ফিগার। এবার বসো।’
কবরী বসল। 

বরপক্ষের একজন বলল, ‘উঁহু, মুখচোখের গড়ন দেখতে হবে। কপাল-মুখ এত ঢাকাঢাকি কেন?’
অভিভাবকমণ্ডলীর দিকে তাকাল কবরী। আড়াল থেকে কেউ হাঁ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। কবরী কপাল-মুখ খুলে দেখাল।
‘দাঁত দেখাও?’  বরপক্ষের কেউ একজনের কণ্ঠ। 

‘খুব সুন্দর। অবশ্য মেয়ের বয়স কম।’ দাড়ি হাতাতে হাতাতে ছালাম মুরুব্বির মন্তব্য।
কনের অভিভাবকমণ্ডলীর মধ্যে থেকে প্যান্ট পরা এক  প্রৌঢ়  উচ্চারণ করলেন, ‘সতেরো। কলেজে ভর্তি হইছিল।’

সড়কের কিনারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে অতীতে ডুবে গিয়েছিল রমা। 

বিরাটাকৃতির পাথরটির পাশেই দাঁড়ানো সে। জায়গাটি অচেনা। শনাক্ত করার একমাত্র উপায় পাথর আর কিছু কিছু পাহাড়ি গাছ। এখানেই আসার কথা মুক্তিযোদ্ধা সুধারামের। কিছু একটা ভেবে স্বগতোক্তির মতো রমা উচ্চারণ করল, এখানেই অপেক্ষা করব। 

ভোরের আলো ফুটে এখন দিন শুরু হতে যাচ্ছে। দেখা গেল, এক যুবতীর কোলে দুই বছরের শিশু। পাশে আরেকটি পাঁচ বছর বয়সের কন্যাশিশু, প্রস্রাব করছে রাস্তার ওপাশে, পিঠছেঁড়া জামা। কোলের শিশুটি সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, চোখ-মুখ দেখেই অনুমান করা যায়। সড়কের পাশে বসে অপেক্ষা সুধারামের। কয়েক মিনিট পর রমা আবারও হাতঘড়ি দেখে, সাড়ে ছ’টা। 

সুধারাম এল আচমকা। যাতে শীত স্পর্শ না করতে পারে, পোশাক সেভাবেই পরা তার। ত্রিশ বছরের তরুণ। মাথা-গলায়  হলুদ-লাল রঙের মাফলার দিয়ে প্যাঁচানো। মুক্তিযুদ্ধে নাম-ঠিকানা লেখানোর সব রাস্তাঘাট মুখস্থ।  এসেই তাড়া দিয়ে বলল, ‘চল, বেলা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের তো ৭টায় পৌঁছাতে হবে।  মৈলাম ক্যাম্পেই বাইজা গেল সাড়ে ৬টা।’ 

রমা বলল, ‘আমি যথাসময় এসেছি। কখন থেকেই অপেক্ষায় আছি!’ 

‘দেরি হয়ে গেল, মায়ের জন্যি। তাকে কোনোভাবেই বোঝাতে পারি না। আমি ফিরে আসব বিশ্বাস নেই তার। বুঝলে রমা, মা তো? নরম মন, মায়ায় ভরা।  নারীরা মায়ের জাতি।’

‘হু’। শব্দ করে উত্তর দেয় রমা। হাঁটা শুরু করার একটু পর রমা জানতে চাইল, ‘আমরা কই যাব পয়লা’। 
‘হাঁটো জোরে জোরে, এখন কোনো কথা না।’

রমা উত্তর করে না। হাঁটতেই থাকে। রাস্তা শেষ হয় না। নববিবাহিতা স্ত্রীর মুখটি আবার ভেসে ওঠে। দুই সপ্তাহ কেটেছিল কবরীর সুখ-সংসার। এর মধ্যেই কত কী। পিঠে হাত রেখে শ্বশুর বলেছিলেন, ‘বাবা, হগ্গল বাপের কাছেই তার কন্যা ভালো, উত্তম। তবে আমি বেশি কিছু বলব না, খালি বলব, তুমি ঠকবা না। যদি কখনো-সখনো আমার কবরী ভুল করেই ফেলে, ক্ষমার চোখে দ্যাখবা। মাইয়া আমার মিশুক, সহজ-সরল, হাসি-খুশির।’
রমা মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, ‘কষ্ট দেব না।’ 

শ্বশুর বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ বাজছে বইলা কাজটা তাড়াহুড়ো করে করছি। কওন তো যায় না।’
রমা মাথা ঝাঁকিয়েছিল হাঁ ভঙ্গিতে। 

‘আমার আচানক মেয়ের দিকে খারাপ মাইনষের চোখ পড়েছে।’ 
রমার জবাব ছিল, ‘আপনি ভাববেন না, ওরে সুখে রাখব। কমতি হবে না।’
‘বাবা-রে ভাবতে চাই না কিন্তু মনটা ভাবে, কান্দে। এই আর কী। তুমি আমার ভরসা।’

রমা এদিনই ভালো করে তাকিয়ে দেখেছিল শ্বশুরকে। বয়স পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন। চোখে পুরু চশমা। ভরা বর্ষাকাল। বিদায়বেলা, নৌকায় দাঁড়িয়ে দুজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিল। চোখে দুজনেরই অনিশ্চয়তার ছায়া। নৌকা ছাড়ার আগ মুহূর্তে  অর্থাৎ বিদায়কালে রমা শ্বশুরকে শেষ কথা বলেছিল, ‘এত চিন্তা করবেন না। আমি আছি না?’ 
সুধারামের কাশির শব্দে রমা সম্বিৎ ফিরে পেল।
‘ঘন কুয়াশা পড়ছেরে রমা।’ 
সুধার এমন কণ্ঠে হাঁ-না মন্তব্য না করে রমা জানতে চাইল, ‘আর কত দূর?’ 
‘আইসা পড়ছি, ওই তো দেখা যায়।’ আশ্বস্ত করে সুধা। 

রমা সামনে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না, বুঝলও না। ডানে-বায়ে  শুধু শরণার্থী শিবিরের লম্বা সারিসারি ঘর চোখের সামনে।  
রমা জানতে চাইল, ‘এটা কত নম্বর ক্যাম্প?’
হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দেয় সুধারাম, ‘পাঁচ নম্বর।’ 

প্রচণ্ড শীত। রমার মনে পড়ে, এক কাপড়ে মাকে নিয়ে গ্রাম ছেড়েছিল সে। গরম কাপড় তো দূরের কথা, কোনো কিছুই মাকে দিয়ে আসতে পারেনি। বাড়ি থেকে প্রাণ নিয়ে আসাটাও ছিল দুরূহ। তিন দিন অনাহারে কেটেছে। ছিল, প্রতিমুহূর্তে যমদূতের আতঙ্ক।

সুধাকে অনুসরণ করতে করতে বিরক্ত হয় রমা। তবু প্রকাশ করে না ক্ষোভ, কষ্ট- দুঃখ। কেউ বলে দেয়,  ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে এসবের কোনোটিই নয়।  

নতুন রাস্তার অদূরে ত্রিপলের ছাউনিঘেরা ত্রাণকেন্দ্রের পাশে ধানি জমিতে নতুন করে ঘর তৈরি করতে দেখা যাচ্ছে চারজন নানাবয়সী পুরুষকে। শুধু ঘরের ছাউনি দিতে পেরেছে তারা। দাঁড়িয়ে-বসে থাকা নারী-শিশুরা শীতে কাঁপছে। বাঁশের বেড়া ও দুটি ত্রিপল মাটিতে পড়ে আছে। বোঝা যায়  খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান সবকিছুই অনিশ্চিত। 

রমা জানতে চায়, ‘সুধাদা ওরাও মনে হয় রাইতে আসছে। তাই না?’
‘হু, খুব কষ্টে আছে বাইচ্চারা?’ মুখ ঘুরিয়ে শরাণার্থীদের ওপর চোখ বুলিয়ে নেয় সুধা। 
‘আর কত দূর?’
‘অত অস্থির হইলে চলব?’ বিরক্ত কণ্ঠে সুধারামের জিজ্ঞাসা।
‘শীতে পা হিম হয়ে আছে!’ 

কয়েক মিনিটের মাথায় সুধা থেমে গেল। শরণার্থী শিবিরের মাঝখানে একটি ছোট্ট চায়ের দোকানের পাশে বেঞ্চ। বসে পড়ল সুধারাম। পাশের খালি জায়গাটি দেখিয়ে বলল, ‘বসো রমা। চা খাই আমরা, লোকটি এখানে আসবে।’ 

দোকানটি শরণার্থীদের মধ্য থেকেই কেউ বানিয়ে দিয়েছে এটি। চা-অলার আলাপে ধারণা পায় রমা।
চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে রমা বলল, ‘মুক্তিযুদ্ধে যাব, মুক্তিযুদ্ধ করব, মিলিটারিদের শক্তি শ্যাষ হবে, আর এইটাও সত্য- আমরা স্বাধীন হব একদিন।’
‘এর পর আমার কবরীরে কি পাব, সুধাদা?’

মাঝারি কণ্ঠে সুধা বলল, ‘রমা, তুমি কবরীরে নিয়া ভাবতেছ এখনো? কত কবরী  প্রাণ দিয়েছে, মান দিয়েছে, শরীর দিয়েছে পাকিস্তানি মিলিটারিরে- এর সংখ্যা জানো? জানবা না কোনো দিন?’ সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ওপরের দিকে ধোঁয়া ছেড়ে সুধা বলল, ‘বিড়াল ইঁদুর ধরে খেলায়, কখনো নিজেই খেলে, আমাদের মা-বৈইনরে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি মিলিটারিরা ইঁদুর খেলা শুরু করছে,  বুঝলা?’ 

রমা বুঝতে পারে আগ্রহ ও ভীতি মিশে আছে কথাগুলোয়। সুধার চোখের দিকে তাকিয়ে রমা সন্দেহমাখা প্রশ্ন করল, ‘আমরা পারব, দাদা?’ 
‘শহরে ছিলাম, আমি তো ছাত্ররাজনীতি করেছি, মিটিং-মিছিল কম করি নাই। বহু বই পড়েছি, পৃথিবীর স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস জেনেছি। কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ভিন্ন? কোনো যুদ্ধের লগে মিল নাই।’ ভেঙে ভেঙে কথাগুলো বলে সুধারাম। 

‘আমরা পারব তো?’ রমা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আবারও প্রশ্নের জবাব জানতে চায়। উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না সুধারাম। 
রমা চোখ ঘুরিয়ে দেখে বহু শরণার্থী খোলা আকাশের নিচে। চা-অলা বলল, ‘ঘরে ছাউনি দিতে পারে নাই ওরা। চাটাই নাই, দড়ি নাই, আলপিন নাই।’
সকাল সাড়ে ৭টা হলেও রোদের দেখা নেই। সাদা কাপড় পরা এক বৃদ্ধা চা-দোকানির কাছে এসে জানতে চাইল, ‘পানি বসাইছ?’
সুধারাম একটু দূরে গিয়ে আরেকটি সিগারেট জ্বালাল। মাথা উঁচিয়ে আছে দূরের দিকে। কাউকে যেন সে খুঁজছে।

‘দেখা যায়?’ 
পেছন দিকে না তাকিয়ে সুধা ‘না’ ইঙ্গিতে হাত নাড়ল। 
রমা আগ্রহ নিয়ে শুনছিল চায়ের দোকানি আর বৃদ্ধার কথা। এবার নিজেই কথা শুরু করে বৃদ্ধার সঙ্গে। ‘আপনারা কবে আসছেন এইখানে?’
বৃদ্ধা বললেন, ‘বাইশ দিন হইল। কোনো গরম কাপড় নেই, একটা ঝুপড়িঘরে পরিবারের এগারো নারী ও শিশু নিয়া গাদাগাদি করে থাকছি। লগে পুরুষ মানুষ নাই একটাও। এইখানে, আসবার পথে তাদের ধরে নিয়ে গেছে পাঞ্জাবি মিলিটারিরা। রেজাকারেরা ঘরবাড়ি জ্বালাইয়া দিছে। ওগোরে আমি বাংলাদেশি জানোয়ার বলি।’

শব্দটি রমার পছন্দ হলো। ‘বাংলাদেশি জানোয়ার?’
‘রেডিও দেই নাই। লুকাইয়া রাখছিলাম। পোলাডা মুক্তিযুদ্ধে গেছে।’ 

শুধু বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনো আশ্বাস দিতে পারে না রমা। কী করা যায় এখন? কী-ই বা ক্ষমতা। চোখ যায় অদূরে, মেডিকেল ক্যাম্পের দিকে। চিকিৎসা নিতে এসেছেন কয়েকজন নারী। দু-একজনের কোলে ফুটফুটে শিশু। তাদের নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছেন তারা। দুই মাসের একটি ছেলেশিশুর অস্বাভাবিক কান্না। চিৎকারের সঙ্গে মায়ের কোল থেকে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করছে। রমা অনুমান করতে পারে বাচ্চাটি অসুস্থ। মায়া জাগে। এগিয়ে যায় রমা। 

‘কী হয়েছে বাচ্চার?’

কাঁচাবয়সী এক নারী কয়েক পলক তাকান রমার দিকে। এর পর অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে জবাব দেন, ‘পাকসেনারা স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে। স্বামীর কোনো খবর জানা নাই। বাপ নাই বাচ্চাদের। বাচ্চারা সবাই অসুস্থ। কলেজে লেকচারার ছিলাম। এখন এতিমের মতো আমি।’

কোলের শিশুটি কেঁদে ওঠে। হাতে বিস্কুট জাতীয় খাবার তুলে দেন মা। নারী আবার কথা শুরু করেন, ‘কোলের বাচ্চাটা ঠাণ্ডা, জ্বর আর কাশিতে ভুগছে, চিকিৎসা নিতে আসছি। মেডিকেল ক্যাম্পে ডাক্তার নেই, আছে খালি নার্স।’ কথা শেষ করে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নারী অন্যদিকে মুখ ফেরান।

শিশুদের কান্নাকাটি আর হইচইয়ের শব্দ পাশের মেডিকেল ক্যাম্পে। হঠাৎ রমার চোখ থেমে গেল মেডিকেল ক্যাম্পের প্রবেশপথের দিকে। একটি মেয়েমুখ তার দিকে চেয়ে আছে, বিস্ময়ে ভরা চোখ। অসুস্থ হলেও হঠাৎ যেন দেহের সব শক্তি নিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা ওর। রমা এগিয়ে যায় মেয়েটির দিকে। চোখজোড়া  যেন পরিচিত। যে চোখজোড়া দেখে রমা আকর্ষিত হয়েছিল। তবে কী কবরীর চোখ? একদার প্রিয় স্ত্রী কবরী এখানে এলো কীভাবে? ওর এমন দশা কেন? অসংখ্য প্রশ্ন, জবাব নেই। আরও কাছাকাছি হয় রমা। চিনতে ভুল হয় না।

‘তুমি কি কবরী, না?’

রমার এ প্রশ্নের জবাব নেই নারী মুখটিতে। মায়াময় মুখচোখে অব্যক্ত যন্ত্রণা। মনে হয় এ যেন শতজনমের পরিচিত কেউ। 
রোগীর ওপর চোখ রেখে মধ্যবয়স্কা নার্স জবাব দেন, ‘পাকিস্তানি মিলিটারা এ নারীর ওপর এতটাই অত্যাচার করেছে যে, কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।’ 

‘মানে?’ 

‘মানে, লিখতে পারে, বলতে পারে না। লিখে জানাল ওর নাম কবরী। বাড়ি বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের দিরাই।
রমাকে খুঁজতে খুঁজতে সুধারাম মেডিকেল ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসে।  চোখাচোখি হতেই রমাকে তাড়া দিয়ে সুধারাম বলে, ‘সময় হয়ে গেছে। আমাদের লোক এসে গেছে, আসো তুমি।’

‘কোথায়?’ রমার জিজ্ঞাসা।
‘কেন? যুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধে।’
‘আমার কবরীকে রেখে? স্ত্রীকে রেখে?’ রমার প্রশ্ন।

কোনোদিকেই  ভ্রুক্ষেপ নেই সুধারামের। একমাত্র জবাব তার,  ‘হাজার হাজার, লাখ লাখ কবরীকে বাঁচাতে হবে, দেশকে রক্ষা করতে হবে। মাটিকে রক্ষা করতে হবে। এটা আমাদের দায়িত্ব, রমা!’

‘না, আমি যাব না, সুধাদা।’

উচ্চকণ্ঠে সুধারামের জবাব, ‘ছাবালের মতো কথা বলবা না। দেরি করা যাবে না।’ রমার প্রাণে বেজে ওঠে রবীন্দ্র সংগীতের সেই দুটি চরণ- নেব সকল বিশ্ব দাও সে প্রবল প্রাণ, করব আমায় নিঃস্ব দাও সে প্রেমের দান’।

মনি হায়দারের ‘কিংবদন্তির ভাগীরথী’ উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়া

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:১৪ পিএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:১৬ পিএম
মনি হায়দারের ‘কিংবদন্তির ভাগীরথী’ উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়া
কিংবদন্তির ভাগীরথী

শিরোনামে যাকে কথাসাহিত্যিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছি, তিনি এ বিষয়ে, মানে কথাসাহিত্যে আর পাঁচজনের মতো নন, বরং বেশ ব্যতিক্রমী এক মেধা। বিগত চার দশকে তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত সৃষ্টিশীল প্রকাশসহ, গল্প, উপন্যাস ও শিশুসাহিত্যে একের পর এক যে অবদান রেখে চলেছেন। 

ভাষার অধিকার নিয়ে জাতির আন্দোলনে যেমন নারী তার সব সুখ বিসর্জন দিয়ে দৃঢ় অবস্থান নেয়, তেমনি দেশমাতৃকাকে শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করতে গিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ১৯৭১ সালে নারীর ওপর নির্যাতন, শেষে চরম আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো নারীদের এক অসামান্য উদাহরণ হয়ে থাকবে কথাসাহিত্যিক মনি হায়দারের কলমের আঁচড়ে ফুটে ওঠা আরেক নারী চরিত্র, ভাগীরথী। কিংবদন্তির ভাগীরথী সত্যি ঘটনা অবলম্বনে সৃষ্ট উপন্যাস। 

রাতের অন্ধকারে রাজাকার সুলতান মাহমুদের সহায়তায় পাকিস্তানি পিশাচ সৈন্যরা পিরোজপুর শহরের বাড়িঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় বিভিন্ন বয়সী মেয়েদের। বিশেষ করে সনাতন ধর্মের নারীদের কী এক অজানা বিকৃত চিন্তায় বেশি করে টার্গেট করা হয়। ভাগীরথী তেমনি এক অল্প বয়েসী, পাঁচ বছর বয়সের এক পুত্রসন্তান, লালশ্যামের মা। ঘনশ্যাম তার স্বামী একজন মুচি। ক্যাপ্টেন আলী মোহাম্মদ হাত বাড়ায় ভাগীরথীর দিকে। ভাগীরথীর চওড়া কাঁধের ওপর আলী মোহাম্মদ কঠোর হাত রাখে। ঘাড় ফিরে দেখে ভাগীরথী নিজের কাঁধটা দখল হয়ে গেছে (পৃ: ১৫, কিংবদন্তির ভাগীরথী)। এতক্ষণ নির্জীব ঘনশ্যাম দৌড়ে এসে সুলতান মাহমুদের দুই পা জড়িয়ে ধরে- সুলতান দাদা, আমার বৌরে ছাইড়া দ্যান। আপনেগো সব জোতা মুই সেলাই কইরা দিমু। আপনেগো সব জোতা কালি কইরা দিমু। আমার বৌরে ছাইড়া দ্যান (পৃ: ১৫-১৬, কিংবদন্তির ভাগীরথী)। কিন্তু রাজাকার সুলতান মাহমুদ আর পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন তো একথা শোনার মানুষ নয়। পিরোজপুরের পাকিস্তানি ক্যাম্পে মেজর ইসকান্দার হায়াৎ খানের যৌন লালসার শিকার আরও অগুনিত নারীর পরিণতি হয় ভাগীরথীরও পরিণতি। 

একদিন সুযোগ আসে। ক্যাপ্টেন দিলদার হোসেন বেগের হৃদয় গলিয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছেলেকে দেখার জন্য বাড়ি যাওয়ার অনুমতি পেয়ে যায় ভাগীরথী। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয় না। বরং স্বামী ও প্রতিবেশীরা তাকে ধর্মের দোহাই দিয়ে ফিরিয়ে দেয়। ভাগীরথী আবিষ্কার করে, সে আর কোনোদিন তার পুরনো স্বাভাবিক সংসারে ফিরে যেতে পারবে না।

ক্যাম্পের দুঃসহ জীবনে ফিরে যাওয়ার পথে দেখা হয়ে যায় একদল মুক্তিসেনার সঙ্গে। তাদের সমবেদনা ভাগীরথীকে অনুপ্রেরণা জোগায় দেশের মুক্তির জন্য পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে তথ্য সরবরাহ করার কাজে। নিজের জীবনের সব ঝুঁকি নিয়ে ভাগীরথী যে তথ্য দেয়, মুক্তিসেনারা তাতে কয়েকটি সফল অপারেশন করতে পারে। এতে পাকিস্তান আর্মির ক্যাপ্টেন দিলদার হোসেন বেগসহ পঞ্চাশজন সৈন্য নিহত হয় মুক্তিবাহিনীর হাতে। 

উপন্যাস কিংবদন্তির ভাগীরথী জাদুকরী কথাসাহিত্যিক, অথবা বলা যায় কথাসাহিত্যের জাদুকর রঙের তুলিতে নয়, শব্দচিত্র দিয়ে নির্মাণ করেছেন। বইটি প্রকাশ করেছে বেহুলাবাংলা। বাজারে চলছে বইটির চতুর্থ মুদ্রণ। 

লেখক: ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক, কথাশিল্পী, কবি, অনুবাদক 

মানসম্মত পাণ্ডুলিপির সংকট কাটাতে এখনই কিছু করতে হবে

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০৭ পিএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০৮ পিএম
মানসম্মত পাণ্ডুলিপির সংকট কাটাতে এখনই কিছু করতে হবে
মাজহারুল ইসলাম

কেমন হতে পারে এবারের মেলা? 

এবারের বইমেলা ভালো হবে। পাঠক বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে প্রতিদিন মেলায় আসবেন। পছন্দের লেখকের বই কিনবেন- এমনটাই প্রত্যাশা। এই মেলার জন্য সারা বছর তারা অপেক্ষায় থাকেন। সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করবেন। প্রিয় লেখকদের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করবেন, সেলফি তুলবেন। সর্বোপরি পাঠক-লেখক-প্রকাশক সবার অংশগ্রহণে একটি বইবান্ধব মেলা হবে। 

এবারের বইমেলায় আপনার প্রকাশনী থেকে কয়টি বই প্রকাশ করছেন? 
এবার অন্যপ্রকাশ থেকে প্রায় অর্ধ শত বই প্রকাশিত হবে। 

উল্লেখযোগ্য বই কী কী? 

উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে আল মাহমুদের ‘নির্বাচিত ১০০ কবিতা’, ‘সেরা পাঁচ উপন্যাস’, ড. মোহাম্মদ হাননানের ইতিহাসগ্রন্থ ‘ভাষার সংগ্রাম ১৯১৭-১৯৯৯ [হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষার সংগ্রামের ঐতিহাসিক আলেখ্য], এম আবুল কাসেমের ব্যতিক্রমী গবেষণাগ্রন্থ ‘চা-অর্থনীতি’, এম আবদুল আলীমের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘ভাষা আন্দোলনে নিম্নবর্গ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’। এ ছাড়া ফরিদুর রেজা সাগরের জনপ্রিয় ছোটকাকু সিরিজের ৪০টি বইয়ের সংকলন ‘ছোটকাকু চল্লিশ’। ৮০০ পৃষ্ঠার এই বইটি নিছকই একটি সংকলন নয়, এর আকারে যেমন অভিনবত্ব থাকবে, তেমনি প্রোডাকশনটি হবে ভিন্নমাত্রার। সব মিলে একটা সংগ্রহে রাখার মতো প্রকাশনা হবে এটি।

মেলাপ্রাঙ্গণ বা অবয়ব নিয়ে আপনার কোনো বক্তব্য আছে কি? 

মেলাপ্রাঙ্গণ হবে এমন, যেন ক্রেতা-পাঠক স্বচ্ছন্দ বোধ করেন, সহজে চলাফেরা করতে পারেন। মেলার স্টল ও প্যাভিলিয়নগুলোর বিন্যাস এমনভাবে করতে হবে যেন তা পাঠক ও প্রকাশকবান্ধব হয়। কেউ যেন কোনো সমস্যা বোধ না করেন। ধুলার সমস্যা দীর্ঘদিনের, একই সঙ্গে আলোর স্বল্পতা। আশা করি, এই বিষয় দুটি গুরুত্বের সঙ্গে মেলা পরিচালনা কমিটি সমাধানের চেষ্টা করবে। 

মানসম্মত পাণ্ডুলিপির অভাব বোধ করছেন কি? 

মানসম্মত পাণ্ডুলিপির অভাব নতুন কিছু নয়। এই সংকট আগে যেমন ছিল, এখনো আছে। দুঃখজনক সত্য হলো, ন্যূনতম মানহীন কিছু পাণ্ডুলিপিও বই আকারে বেরিয়ে যাচ্ছে। এটা আসলে সামগ্রিক দুর্বলতারই অংশ। অনেক ক্ষেত্রে  আমরা এগিয়েছি, এটা যেমন সত্য, তেমনি নতুন লেখক সৃষ্টিতে কিংবা মানসম্মত পাণ্ডুলিপির সংকট কাটাতে আমাদের এখনো অনেক কিছু করা বাকি। সাহিত্যের চর্চা, এর পঠনপাঠন বাড়ানো গেলে, সংস্কৃতিমনস্কতার উন্নতি হলে এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলে আমি মনে করি।

মেলায় কী ধরনের বই বেশি বেচা হয়? 

গল্প-উপন্যাস, থ্রিলার, ভ্রমণকাহিনি। ইদানীং ননফিকশনাল বইও বেশ বেচা হচ্ছে। এ ছাড়া আত্মউন্নয়নমূলক বইয়েরও চাহিদা রয়েছে।

ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।

সাক্ষাৎকার: সানজিদুল ইসলাম সকাল

মাজহারুল ইসলাম 
প্রধান নির্বাহী, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা

ফেরার পথ নেই

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৯ পিএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৯ পিএম
ফেরার পথ নেই
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

এই শহরে আগেও অনেকবার এসেছে জারা। এখানে প্রায়ই বড় বড় আয়োজনের বিয়ে, গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের পাশাপাশি জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীর জমকালো অনুষ্ঠান থাকে। আবার দীর্ঘদিন লন্ডন, আমেরিকা, কানাডায় থাকার পর দেশে ফেরা উপলক্ষে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে গেট-টুগেদার আয়োজন করে কেউ কেউ। এবারও তেমন একটি অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে নিজের টিম নিয়ে এসেছে জারা। এ ধরনের অনুষ্ঠানে খানাপিনার সঙ্গে ডিজে পার্টি, মিউজিক্যাল নাইটের আয়োজন থাকে। বেশ কয়েক মাস আগেই শিডিউল ঠিক করা ছিল। শহর থেকে কিছুটা দূরে গোলাপগঞ্জে লন্ডন প্রবাসীর বাড়িতে জমকালো গেট-টুগেদার অনুষ্ঠান। শহরের বাইরে হলেও জায়গাটা অনেক উন্নত। এবার প্রোগ্রাম করতে এলেও ভেতরে ভেতরে অনেক অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে জারা। এক ধরনের অস্বস্তি বুকের মধ্যে চেপে বসে আছে। প্লেনে চড়ে ঢাকা থেকে সিলেট আসতে কোনো কষ্ট হয়নি। ক্লান্তির প্রশ্নই ওঠে না। তার পরও নিজেকে বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছে তার।

ঢাকায় থাকতেই জারা জেনেছে, উত্তরার ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টে ডিজে পার্টিতে মাদক আর বিষাক্ত ভেজাল মদ খেয়ে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্র ও একজন ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনা দেশজুড়ে দারুণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনার জন্য দায়ীদের আটক করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে জাতীয় সংসদে সবাই একমত হয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। শাহবাগ, টিএসসি ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মিছিল, মানববন্ধন ও প্রতিবাদী সমাবেশ হয়েছে। ফলে এ ইস্যুটি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। দেশজুড়ে মাদককারবারি, চোরাচালানি, সরবরাহকারীদের ধরতে শক্ত অভিযান চলছে। কেউ ছাড়া পাচ্ছে না। আটক করে জেলখানায় পাঠানো হচ্ছে তাদের। এর মধ্যে কয়েকটি ক্রসফায়ারের ঘটনা এসব কাজে জড়িতদের মনে রীতিমতো আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টে সে রাতের ডিজে পার্টি আয়োজনের নেপথ্যে ও প্রকাশ্যে থাকা সবার নাম পুলিশ ও সিআইডি এর মধ্যেই পেয়ে গেছে। তালিকা ধরে তাদের খোঁজ চলছে। ঢাকা ছেড়ে অন্য শহরে কিংবা গ্রামে পালিয়ে আত্মগোপনে থাকলেও তাদের খুঁজে বের করে আটক করা হচ্ছে। সেই তালিকার প্রথমদিকেই ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টে ডিজে পার্টির আয়োজক বিখ্যাত ডিজে গার্ল জারা শাহরিন খানের নামটি রয়েছে। 

প্রভাবশালী কয়েকজন হোমরাচোমরা মানুষের সঙ্গে পরিচয় ও সখ্যের কারণে সে নানাভাবে বিপদ-আপদে সাহায্য-সহযোগিতা-প্রশ্রয় পেয়ে এসেছে এতদিন। বেশ কয়েকবার কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেলেও সেই হোমরাচোমরাদের বদান্যতায় উদ্ধার পেয়েছে জারা। কিন্তু এবার ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টের ঘটনাটিতে জল ঘোলা হয়েছে অনেক। সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। তালিকা থেকে তার নামটি যেকোনোভাবে বাদ দেওয়ার অনুরোধ জানানোর পর কেউ কোনো সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দিতে পারেনি। সবাই একটাই কথা বলেছে, এ কেসটি অন্য সব কেস থেকে আলাদা। সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে চাপ রয়েছে- অভিযুক্তরা যাতে কোনোভাবে পার পেয়ে না যেতে পারে। সবাইকে কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে। যেকোনো মূল্যে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এখানে কারও জন্য তদবির, সুপারিশ করার একদম সুযোগ নেই। তেমন পরিস্থিতিতে কখন যে কী ঘটে যায়- এ নিয়ে দুশ্চিন্তা চেপে বসেছে। 

বুকের মধ্যে অনেক অস্বস্তি চেপে বসেছে। কিছুতেই সেটাকে সরাতে পারছে না। সারাক্ষণ একটা ভয়, আতঙ্কভাব তাড়া করে ফিরছে তাকে। গত কয়েক দিন ধরে এক ধরনের ট্রমার মধ্যে ছিল সে। ঘুমের ওষুধ খেয়েও দুচোখে ঘুম আসছিল না। হঠাৎ একটু তন্দ্রাভাব এলেও পরক্ষণেই তা ছুটে পালিয়ে যাচ্ছিল। এ রকম একটি অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করার সুযোগ খুঁজছিল জারা। 

আরও কয়েক মাস আগেই সিলেটে একটি প্রোগ্রামের কথাবার্তা ফাইন্যাল হয়েছিল। প্রোগ্রামটা ক্যানসেল করে দিতে পারত সে। কিন্তু একটুখানি প্রশান্তির আশায় ঢাকার বাইরে দূরে কোথাও চলে যেতে মনটা কেমন অস্থির হয়ে উঠেছিল। এ কারণেই প্লেনে চড়ে সোজা সিলেট চলে এসেছে। এখানে যাদের বাড়িতে প্রোগ্রাম, তারাই এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে তাদের নিজস্ব গাড়িতে হোটেলে এনেছে। দামি বিলাসবহুল লাক্সারি স্যুটে জারার

থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। 
নিজেকে আরও রিফ্রেশ করতে বাথটাবে হালকা গরম-ঠাণ্ডা পানিতে কিছুক্ষণ শরীরটা ডুবিয়ে রেখেছে। এতে কিছুটা কাজ হয়েছে। হালকা গরম-ঠাণ্ডা পানিতে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে শরীরটা ডুবিয়ে রাখার পর কিছুটা প্রশান্তিবোধ করায় আয়োজকদের ফোন করে গাড়ি পাঠাতে বলেছে জারা। আজ রাতে যে বাড়িতে অনুষ্ঠান হবে সেখানে গিয়ে সবকিছু দেখতে চায় সে।

ছবির মতো চমৎকার সুন্দর বিলেতি ডিজাইনের একটি বাড়ির সামনে এসে গাড়িটি থামে। এই বাড়িতেই আজ অনুষ্ঠান। দীর্ঘদিন লন্ডন, কানাডায় থাকা কয়েকটি পরিবার দেশে বেড়াতে এসেছে। দেশে এসে আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে নিয়ে একটি গেট-টুগেদারের আয়োজন করেছে। খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি গানবাজনা, ডিজে পার্টির ব্যবস্থা করেছেন তারা। 

গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির সামনে তৈরি করা স্টেজের দিকে এগোতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয় জারার। পাশাপাশি হাঁটতে থাকা একজন সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরে না ফেললে মাটিতে পড়ে একটা দুর্ঘটনা ঘটত নিশ্চিত। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সে কিছুটা অমনোযোগী হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তাই বলে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হওয়ার কথা নয়। মনের মধ্যে অজানা আশঙ্কা উঁকি দেয়। তাহলে কি এখানে তার জন্য কোনো বিপদ অপেক্ষা করছে? যার আগাম সংকেত হলো হঠাৎ এই হোঁচট খাওয়া! সাধারণভাবে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ হোঁচট খেলে অনেকেই এ ধরনের আশঙ্কা করে মনে মনে। কুসংস্কার হলেও তেমন বিপদের আশঙ্কা উড়িয়ে দিতে পারে না সে। মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। ছোটবেলা থেকে এ রকম কিছু ঘটলে কাছাকাছি মা থাকলে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেন। বলতেন, মায়ের দোয়া সঙ্গে থাকলে কোনো বালা-মুসিবত, বিপদাপদ কাছে আসতে পারবে না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। গত কদিন ধরে এক ধরনের অস্থিরতা তাড়া করে ফিরছে তাকে। এক ধরনের অনিশ্চয়তার দোলাচলে তার সময় কাটছে।

স্টেজে উঠে চারপাশে তাকাতেই জারা দেখতে পায়, বাড়ির সামনে একটি সাদা মাইক্রোবাস এসে থেমেছে। এ রকম গাড়ি তো আজ অনেক আসছে এ বাড়িতে। অতিথিরা যে যার মতো গাড়ি নিয়ে আসছেন। কিন্তু সাদা মাইক্রোবাস থেকে নামতে থাকা মানুষগুলো সাধারণ শার্টপ্যান্ট পরা হলেও তাদের কয়েক জনের গায়ে বিশেষ ধরনের জ্যাকেট দেখে ভয়ে, আশঙ্কায় তার সারা শরীরে হালকা কাঁপুনি দিয়ে ওঠে। দেখেই বোঝা যায়, এই লোকগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। গাড়ি থেকে নেমে তারা এ বাড়ির কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছে। কী বলছে- এতদূর থেকে শোনা না গেলেও এ বাড়ির মানুষজন লোকগুলোর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে স্টেজের দিকে হাতের ইশারা করছে, দেখতে পায় সে। তাদের কথোপকথনের ধরন দেখে এখানে থাকা কারও কথা আলোচনা করছে বোঝা যায়। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকগুলোর হাতে অস্ত্র দেখা যায়। তারা সবাই এদিকেই এগিয়ে আসছে দৃঢ় পদক্ষেপে। 

ব্যাপারটা এত দ্রুত এভাবে ঘটবে ভাবতে পারেনি জারা। এ রকম একটা মুহূর্ত আসবে তার জীবনে, যেখানে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ নেই। এতদিন নানা চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে এলেও আজকের মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি আগে কখনো। এ অবস্থায় যাতে পড়তে না হয়, তার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে সে।


জারাকে নিয়ে মাইক্রোবাসটা সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেছে আরও এক ঘণ্টা আগে। 
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে সেই কবে। রাস্তাজুড়ে রাতের অন্ধকার জেঁকে বসেছে। সেই অন্ধকার ভেদ করে হেডলাইটের তীব্র আলো ছড়িয়ে হাইওয়ে ধরে ছুটছে গাড়িটা। গাড়িতে তার দুপাশে দুজন শক্তসমর্থ গড়নের নারী। তাদের পরনেও প্যান্টশার্ট। দেখেই বোঝা যায়, তারাও একই বাহিনীর সদস্য। এখন কোনো নারীকে আটক করতে গেলে সেই অভিযানে নারী সদস্য রাখা হয়। এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটা নিয়ম হয়ে গেছে এখন। একসময় এমনটা ছিল না।

ঢাকার উত্তরার ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টের ঘটনায় জারা শাহরিন খানকে আটক করেছে ডিবি পুলিশ। আরও আগে থেকেই তাকে আইনের আওতায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রচেষ্টা চালানো হলেও সেটা নানাভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু সব বাধা অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত তারা সফল হয়েছে। জারাকে আটকের ব্যাপারে শুরু থেকে তৎপর ছিল পুলিশ। তবে এতদিন তার প্রতি সহানুভূতিশীল একটি প্রভাবশালী মহল নানাভাবে চেষ্টা করে গেছে, যাতে সে আটক না হয়। কিন্তু দেশজুড়ে প্রতিবাদ মিছিল, মানববন্ধন, আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতেই অনেকটা চাপে পড়ে পিছু হটে এসেছে সেই প্রভাবশালী মহলটি।

গাড়িতে জারা ছাড়াও আরও কয়েকজন যাত্রী থাকলেও তারা কেউ তেমন কথা বলছে না। এক ধরনের অসহ্যকর নিস্তব্ধতা জেঁকে বসেছে এখানে। এসি গাড়ির সব জানালা বন্ধ রয়েছে। বাইরে কোনো শব্দ আসছে না। আশপাশে ছুটে চলা অন্যান্য গাড়ি, বাস, ট্রাক ইত্যাদির হর্নের ক্ষীণ শব্দ কানে এলেও সেটা জেঁকে বসা নীরবতাকে যেন দূর করতে পারছে না।

অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা শহরে পড়াশোনা করতে এসেছিল জারা। লেখাপড়া শেষে নিজেকে যোগ্য করে তোলার পর ভালো একটি চাকরিতে ঢোকার স্বপ্ন ছিল; যা তাকে সুন্দরভাবে বাঁচার নিশ্চয়তা দেবে। সমাজে মাথা উঁচু করে সম্মান-মর্যাদা নিয়ে চলার চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি করবে। কিন্তু বাস্তবতা জারাকে সেই অবস্থা থেকে যোজন যোজন দূরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। মফস্বল শহর থেকে আসা মেধাবী, স্বপ্নবাজ, ভালো মেয়েটি মোহনা থেকে জারায় পরিণত হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটনা তাকে স্বপ্ন দেখা সেই পথ থেকে সরিয়ে ভিন্ন আরেক জগতে নিয়ে এসেছে। যেখানে স্বপ্ন নেই, আছে দুঃস্বপ্ন। ভোগ-বিলাস, আনন্দ, অর্থবিত্তের বাসনা, লোভ-লালসা ইত্যাদি কেবল মরীচিকার মতো চারদিকে ছুটে বেড়ায়, মোহজাল সৃষ্টি করে। যার পেছনে ছুটতে গিয়ে পদে পদে অবক্ষয়, বিকৃতি, বীভৎস লালসার শিকার হতে হয়, নিজের বিবেক, মূল্যবোধ, নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দিতে হয়। গত কয়েকটি বছর সেই অন্ধকার একটি জগতে বিচরণ করতে গিয়ে কুৎসিত একটি পৃথিবীকে দেখে দেখে নিজের প্রতি চরম ঘেন্না ধরে গেছে। তার অপরাধ আর পাপের বোঝা অনেক ভারী হয়ে উঠেছে। যা বইতে গিয়ে সে হাঁপিয়ে উঠছিল বারবার। 

ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টে ডিজে পার্টির আয়োজক হিসেবে তাকে আটক করা হয়েছে, কিছু কাগজপত্র দেখিয়ে ডিবির লোকগুলো বলেছে। এটা তো স্রেফ একটি কেস। এ রকম আরও বহু ঘটনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। যার প্রমাণ পুলিশ ও র‌্যাবের কাছে রয়েছে। যা এতদিন নানা উপায়ে পাথরচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। একটি কেসে ধরা পড়লে বাকিগুলো এমনিতেই আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে। এ রকম একটি পরিণতির অপেক্ষায় ছিল সে এতদিন। যদিও এ রকম কিছু তার কাম্য ছিল না। এই পৃথিবীতে কাম্য না হলেও, না চাইলেও অনেক কিছু ঘটে যায়। নানাভাবে চেষ্টা করলেও যা ঠেকানো সম্ভব হয় না। 

জারা নিজের পরিণতির কথা ভাবতে ভাবতে মনে মনে কেমন যেন দার্শনিক হয়ে ওঠে। এমন একটি পরিস্থিতিতেও তার হাসি পায় ভীষণ। মন খুলে হাসতে ইচ্ছে করে। কিন্তু গাড়িতে থাকা ডিবির নারী-পুরুষগুলো কী মনে করে, ভেবে নিজের হাসিটা চেপে রাখে। আগামীকালের দৈনিক পত্রিকায় তাকে আটক করার ছবি ও রিপোর্ট ছাপা হবে। টিভি চ্যানেলের, অনলাইন পোর্টালের ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হবে অপরাধী হিসেবে। তার পর তা টিভি পর্দায়, ইউটিউবে দেখানো হবে। আজকাল সাধারণত এমনই হয়। তার বেলাতেও তাই হবে। এ আর নতুন কী? 

রাস্তার দুপাশের বাড়িঘর, সবুজ বনবনানী, ধান খেত, নদী, খাল-বিল পেছনে ফেলে জারাকে বহনকারী সাদা মাইক্রোবাসটি তীব্র গতিতে ছুটছে গন্তব্যের দিকে। কতক্ষণে ঢাকা শহরের ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে নিরাপদে পৌঁছবে, তেমন ভাবনা মধ্যবয়সী গাড়িচালকের। পথে কোনোরকম দুর্ঘটনায় যাতে পড়তে না হয়- তাই খুবই সাবধানী হাতে স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে মানুষটা। সবদিক সতর্ক হয়েই গাড়ি চালাতে হচ্ছে তাকে। 

এতদিন ঢাকা শহরটাকে এক মায়ার শহর ভেবে এসেছে জারা। এখানে যারা পা রাখে, তারা কেমন যেন মায়ায় জড়িয়ে যায়। একসময় মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সেই মোহে জড়িয়ে পড়ে নিজের সবকিছু বিসর্জন দেয়। মায়ানগরীর সেই মোহ ধ্বংসের মুখে নিয়ে দাঁড় করানোর আগে উপলব্ধি হলেও তখন আবার শিকড়ে ফেরার তীব্র ইচ্ছে জাগে। ইচ্ছে কিংবা সাধ জাগলেও আর ফেরার উপায় বা সুযোগ থাকে না সে সময়। সেই নরকেই পুড়ে মরতে হয়। শেষ পরিণতিকে মেনে নিতে হয় বাধ্য হয়েই।

নতুন ধানের ঘ্রাণ

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৫ পিএম
নতুন ধানের ঘ্রাণ
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

ভাবনার ভিতর একমুঠু ভাত
মগ্নরাতে কৃষকের হাহাকার।

রাত্রি ডোবে কালোর গভীরে
বিঘা বিঘা জমিতে সোনালি ধান।

ক্ষুধার্ত শরীর ঘামে জবজব 
মাঠে কৃষক হৃদয়ে প্রতিবাদ। 

একজোড়া পায়ে কী অসীম শক্তি
বুকজুড়ে নতুন ধানের ঘ্রাণ। 

লাঙল কাঁধে কৃষক হাঁটে 
ধানি জমিজুড়ে ভাটিয়ালি গান।

ওহ্‌ হৃদয়

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫২ পিএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৩ পিএম
ওহ্‌ হৃদয়
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

ঝড়ের স্মৃতিতে অবাঞ্ছিত প্রাঙ্গণে
বিষাদের কফিন খুলে সঙ্গোপনে 
বিগতবেলার যে ঘ্রাণ নিচ্ছ 
তাতে বিষাক্ত কীট, বিক্ষত পরাগরেণু
ঝরে যাচ্ছে গোলাপ পাপড়ি।

আহত পাখির পালকে বিরচিত সৌধে
পরাজিত মুহূর্তরা স্তরে স্তরে,
নদীর ভালোবাসা ছেড়ে পতিত মাছ
তীব্র তৃষ্ণায়, তবু জলের দ্রাঘিমায়
সমাপ্তি টেনে আশ্রয় নেয় মধ্যাহ্নে। 
 
এতটা কার্বন অভ্যন্তরীণ প্রকোষ্ঠে
রুগ্নদিন শেষে অন্ধকারে নোঙর ফেলে
বুকের উত্তাপে পুড়ছে আত্মহনন নেশায়।


ওহ্‌ হৃদয়! কেন খরাক্রান্ত নগর ঘুরে
তৃষ্ণা পুষে রাখো বুকের করিডোরে।

দখলি দিগন্তে রক্তজবার পাণ্ডুলিপি
ক্ষরণের গোধূলি চুয়ে পড়ে পড়ন্ত সূর্যে।
অনিদ্রার নিশানা উড়িয়ে
দীর্ঘ করা রাতে যখন নক্ষত্র কাঁদে 
বেদনা আছড়ে পড়ে আঙিনাজুড়ে। 

ওহ্ হৃদয়! কেন ধূমায়িত হয়ে থাকো
অনেক শূন্যতার আকাশ হয়ে।