
পর্ব- ১৮
কোনো এক বিখ্যাত কবি নাকি বলেছিলেন, এপ্রিল হলো সবচেয়ে নিষ্ঠুর মাস। আর রিয়াজুল্লার কাছে সপ্তাহের নিষ্ঠুরতম দিন হলো রোববার। বিদেশে এ দিনটি সাপ্তাহিক বন্ধ, কিন্তু বাংলাদেশে সপ্তাহ শুরু এ দিনে। তাই রোববার সপ্তাহ শুরু হলেও শরীর সাড়া দেয় না। ক্লান্তি জাকিয়ে বসে মনে। নেতা-কর্মীরাও আসে না খুব একটা। তবে দুই সপ্তাহ ধরে তার ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে একজনের কল্যাণে। তার নাম অধরা। বাস্তবেও সে অধরা, অন্তত এখন পর্যন্ত।
রিয়াজুল্লার ক্লান্তিক্ষণগুলো অধরা ভালো লাগায় ভরিয়ে দিচ্ছে চ্যাটের মাধ্যমে। বাইরের পৃথিবীতে মহান নেতার বিশাল ভারে নূব্জ রিয়াজুল্লা অধরার কাছে নিতান্তই একজন সুখে-দুঃখে ভরা সাধারণ ব্যক্তি। অধরার সঙ্গে তার জীবন, কথা, উপকথা একান্তই ব্যক্তিগত। সেখানে রাজনীতি নেই, সমাজনীতি নেই, নেই অর্থনীতি অথবা নাগরিক জীবনের যন্ত্রণা।
ইদানীং রিয়াজুল্লা ভাবছে, একদিন অন্তর্জালের দেয়াল ছিন্ন করে অধরা নামের মেয়েটি ধরা দেবে তার করকমলে, এসে বসবে ছোঁয়াছুঁয়ির দূরত্বে, শিয়রে ছড়াবে চুলের গন্ধ।
অধরার সঙ্গে প্রথম দিনের কথা সারাক্ষণ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে রিয়াজুল্লার কানে,
-হ্যালো।
-কে বলছেন?
-আমি অধরা। আপনি?
উত্তর দিতে গিয়ে থেমে গিয়েছিল রিয়াজুল্লা। পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ সে। তাই নিজের নাম বলল না।
বলল-
-আমি কে তা তো আপনি জানেন।
-আশ্চর্য আমি আপনার নাম জানব কী করে?
-আপনিই তো হ্যালো বললেন।
-চ্যাট বক্সে আপনার আইডি দেখে নক করলাম। আইডি নম্বর বিডি ০০৭। নাম তো লেখা নেই!
এইবার রিয়াজুল্লা বিপদ দেখে, ভাবে নাম বলবে। শেষে বহু চিন্তা করে বলে,
-আমার নাম জুল্লা।
কিন্তু নাম লেখার আগেই কম্পিউটারের স্ক্রিন কালো হয়ে যায়। সরকারের পরিবর্তে লোড শেডিংকে কষে গালি দিতে ইচ্ছে হয়। হঠাৎ তার মনে হয় সরকার লোড শেডিং করে মানুষে মানুষে যোগাযোগে বাধা দিচ্ছে। এটি এক ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন। পাঁড় রাজনীতিক রিয়াজুল্লা। সে এটিকে নতুন প্রজন্মকে পার্টিতে টানার অস্ত্র হিসেবে বেছে নেয়।
তবে ব্যক্তিগত চ্যাটের মধ্যে তার স্বভাবগত রাজনীতি চলে আসায় লজ্জা পায় রিয়াজুল্লা।
আবার ‘অধরা’র কথা ভেবে হৃদয়ের ভেতরে মোচড় দিয়ে ওঠে। মেয়েটির নাম সে জানল, কিন্তু তার নামটি মেয়েটি জানল না। আচ্ছা সে কে অথবা কোথায় তার বাড়ি! দেখতেই বা কেমন সে! সে কি তার মা আর বন্ধুদের প্রাণপন চাওয়া পাত্রীর একটি স্বার্থক জবাব হতে পারবে- ইত্যাকার হাজারো প্রশ্নে রিয়াজুল্লার মাথার ভেতর জট পাকিয়ে যায়।
অস্থিরতা কয়েকদিন কয়েক মাসের মতো ভারী মনে হয়। তবু রুটিন করে অফিসে আসে সে। রাজনীতি করে। কিন্তু মন পড়ে থাকে ‘অধরা’ নামের অধরা মেয়েটির কাছে। আর কোনোদিন তার সঙ্গে কথা হবে কি!
এক সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। বকুলঝরা পুলিশ ফাঁড়ি লুটের ঘটনায় তার দুজন কর্মীকে ফাঁসি দিয়েছে সরকার। তার প্রতিবাদ সভা শেষে মিছিল করতে করতে অফিসে ফিরেছে রিয়াজুল্লা।
একটু জিরিয়ে বেরোবে বাড়ির উদ্দেশে। এসময় আকাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি এল। আর বৃষ্টির সঙ্গে এল প্রায় ভুলতে বসা ‘অধরা’র ডাক-
-হ্যালো কেমন আছেন!
-আপনি?
-হ্যাঁ আমি।
-এতদিন কোথায় ছিলেন?
-তেঁতুল ঝরা গ্রামে। চেনেন ওই গ্রাম?
-না।
একদিন আসুন। আপনাকে নিয়ে যাব। তবে সংগীতের যেমন প্রহর থাকে, ওই গ্রামে যাওয়ারও নির্দিষ্ট সময় আছে। ওখানে পৌঁছাতে হয় হব হব সন্ধ্যায় যখন দিনের আলো নরম হয়ে আসে আর বৈরাগীর পাহাড়ের আড়ালে তিনি রঙের খেলা সাজান। তার পর সন্ধ্যা সোনার মতো হলে বোয়ালভাসা নদীর তীরে বসতে হয় পাশাপাশি-ললাট লিখন থাকলে দেখা যায় দিন-রাত্রির সেই মিলন খেলা। তা শুধু অনুভবই করা যায়, মুখের কথায় বা হাতের লেখায় বলা যায় না কোনোদিন।
-বাহ্, আপনি কি কবিতা লেখেন নাকি?
-নাহ, আমিই কবিতা। আপনি কী করেন?
-আমি বলি।
-মানে?
-মানে আমি বক্তা। ‘বক্তৃতা আমার পেশা, নেশা, বক্তৃতা আমার প্রতিশোধ গ্রহণের হিরণ্ময় হাতিয়ার।’
-আমি বলতে চাচ্ছি, আপনার পেশা কী, মানে আপনি কী করেন।
-বললাম তো আমি বক্তৃতা দিই।
রিয়াজুল্লা আরেকটু হলে বলেই ফেলত, সে রাজনীতি করে। কিন্তু দীর্ঘদিনের রাজনীতিই তাকে বাঁচিয়ে দিল। সে বলল-
-আমি প্রতিবাদ করি। আর আমি মানুষকে আশাবাদী করি।
-আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
-না বোঝার কী আছে। আপনি একবার চারদিকে তাকিয়ে দেখুন, দেশের আকাশে স্বাধীনতাবিরোধী শুকুনিদের ডানার উল্লাস, জমিনে লুটেরা আর সন্ত্রাসীদের মুখের ব্যাদান। এ অবস্থায় একজন সুস্থ মনের মানুষ, যার মধ্যে ন্যূনতম দেশপ্রেম আছে প্রতিবাদী না হয়ে পারে না; আমিও পারিনি।
-আপনি রাজনীতিকের মতো কথা বলছেন।
রিয়াজুল্লা খেয়াল করল আবার তার পরিচয় ফাঁস হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কিন্তু সে তো চ্যাট শুরু করেছিল রাজনীতির বাইরে তার একটি একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের অন্বেষায়; যেখানে পৃথিবী থেকে দূরে কোনো এক নিরালায় একটি গৃহকোণ থাকবে, গৃহের দুয়ারে মৃদুল প্রদীপ জ্বেলে কেউ একজন দিনের শেষে অস্থির অপেক্ষা করবে; তার পর দিনের ক্লান্তিকর দুনিয়াদারি শেষে বাড়ির রাস্তায় এসে পৌঁছালে অপেক্ষার সে মানুষটি মৃদু অনুযোগ তুলে বলবে, ‘ফিরতে অ্যাতো দেরি হলো ক্যান?’
কিন্তু তার রাজনৈতিক সত্তা তার ব্যক্তি সত্তার ওপর এমনভাবে আছর করে আছে তা আগে কোনোদিন জানতে পারেনি সে। এখন, এই তুমুল মুহূর্তে সে উপলব্ধির সন্ধান পেয়ে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না সে। এদিকে তার জবাব না পেয়ে স্ক্রিনের মেয়েটি বারবার বলে চলেছে
-কী হলো? কথা বলছেন না যে!
-হ্যালো?
-হ্যালো... যখন খেয়াল হলো, রিয়াজুল্লা ভাবল, কিছু লেখে, সে লিখল-
-সরি, ফোন এসেছিল।
কিন্তু স্ক্রিনে ভেসে উঠল অধরা চ্যাটবক্স ত্যাগ করেছেন। আর তখনই রিয়াজুল্লার মনে হলো, এবারও তার নামটি বলা হলো না।
পর্ব-১০
শানবাঁধানো পুকুরঘাটে চেয়ার পেতে বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। জরুল্লার কাজে খুশি হলেন মা। রিয়াজুল্লা এসেছে ঠিকই, কিন্তু তার মন যেন অন্য কোথাও!
দুই হবু বেয়াই বেয়াইনের সঙ্গে মায়ের পরিচয় হলো। ভদ্রলোক স্থানীয় কলেজের বাংলার অধ্যাপক। রিয়াজুল্লার মায়ের সঙ্গে মিল হওয়ায় দুই পক্ষই খুশি। দুই অধ্যাপক সাহিত্য নিয়ে ইতং বিতং কিছুক্ষণ আলাপ করলেন। একজন বিষ্ণুদের কবিতার দুর্বোধ্যতা নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই রেগে গেলেন। দুই উল্লা এসবের মর্মার্থ কিছুই বুঝতে না পেরে থম মেরে বসে
থাকল।
এসময় চা-নাশতা পরিবেশন হওয়ায় বাঁচোয়া।
হরেক রকমের বৈকালিক নাশতায় ভরে উঠল শানবাঁধানো পুকুরপাড়। টেবিলে টেবিলে ঘিয়ে প্রজ্বলিত প্রদীপ শিখা। বোঝা গেল, বাবা বাংলার অধ্যাপক হলেও, কনের মা সাংসারিক বিষয়ে সাংঘাতিক সচেতন। মেয়ের কনে-দেখা বলে কথা!
রিয়াজুল্লার মায়ের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এসবে পটে যাওয়ার পাত্রী আমি নই; তা ছাড়া আমি নিশ্চিত এসব নাশতার অর্ধেকও মেয়েটি বানায়নি।
কিন্তু মেয়ের মা পাক্কা গৃহিণী। হবু বেয়াইনের মনোভাব বুঝে তিনি আগেই বলে ফেললেন,
-মিথ্যা বলব না, এসব নাশতার অধিকাংশ বাইরের, তবে গুরুত্বপূর্ণ আইটেমগুলো আমার মেয়েই বানিয়েছে। মা আমার সাক্ষাৎ গৃহলক্ষ্মী।
মনে মনে গজরান রিয়াজুল্লার মা, এ যে দেখছি ঘসেটি বেগম; তার মেয়ে কেমন হয় আল্লা মালুম।
কিন্তু মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বললেন,
-বাহ্, খুবই ভালো। তা আপনার গৃহলক্ষ্মী মেয়েটিকে তো দেখতে পাচ্ছি না। গৃহশাস্ত্র সম্পর্কে তার সঙ্গে একটু আলাপ করতাম।
মেয়ের মা আহত হোন মনে, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারেন না। তবে এসময় সন্ধ্যার পরিবেশ আলো করে মেয়েটি হাজির হলে সবাই নড়েচড়ে বসে। রিয়াজুল্লার মায়ের গলা দিয়ে অকপট স্বীকারোক্তি বের হয়ে আসে,
-বাহ্, আমাদের মা তো দেখি আসলেই গৃহলক্ষ্মী!
তবে পরক্ষণেই তিনি নিজেকে সংযত করে নেন। এ মেয়েকে আগে তিনি সব উপায়ে পরীক্ষা নেবেন; তার পর মন্তব্য করা যাবে।
একটু দূরে বসে রিয়াজুল্লা বন্ধুর সঙ্গে সন্ধ্যা হওয়া দেখছিল।
বন্ধু বলল, দেখ, ভালো করে দেখ।
রিয়াজুল্লা- দেখেছি। ও ঘর হতে বের হওয়ার সময়ই দেখে ফেলেছি।
-কী দেখলে?
-উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি, ওজন ৪৫ কেজি, কালো চুল কোমর ছাপিয়ে নেমেছে।
-আর কিছু দেখলে?
- আর দেখলাম কথা বলা দুটি চোখ, দুটি চঞ্চল পা, আর তনুমধ্যা শরীরে কালীদাসের উপন্যাসের রমণীদের মতো কদলী উরু।
-বাহ্, তুমি কি কবি নাকি রাজনীতিক?
-আমি রাজনীতিক বলেই মানুষকে দেখার, চেনার এই চোখ আছে। পরীক্ষণের ব্যাপারটা মা-কে করতে দাও, চলো আমরা দূর থেকে দেখি।
এদিকে মায়ের নির্দেশে মেয়ে হবু শাশুড়িকে কদমবুচি করে নাশতা পরিবেশন শুরু করেছে। পরীক্ষার হলে কঠোর পরীক্ষকের মতো রিয়াজুল্লার মা মেয়েটির প্রতিটি নড়ন চড়ন, তার কথা, এমনকি বারে বারে মাথা থেকে নেমে আসা মখমলের ওড়নাটি পর্যন্ত তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন। এক সময় তিনি বলেই ফেললেন-
-তা বেয়াইন আপনি আপনার মেয়েকে শাস্ত্রে বর্ণিত চার রমণীর কোনটিতে ফেলবেন।
-মাফ করবেন, আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।
-না বোঝার কী আছে, আপনি কি শাস্ত্রে বর্ণীত হস্তিনী, সিংহিনী, শংখিনী, পদ্মিনী এ চার প্রকার মেয়ের ব্যাপারে জানেন না?
-বেয়াইন আমি মেয়েকে শিখিয়েছি শালীনতা, লেহাজ, আর ঘরকন্না। আপনার বেয়াই শিখিয়েছেন তাহজিব আর তমুদ্দুন। কিন্তু এরকম শাস্ত্রবর্ণিত রমণীভেদ আমার জানা নেই।
-ঠিক আছে। আমিই দেখছি। ক্লান্ত দিবাকর মলিনমুখে অস্তাচলে বসেছেন। তার শেষ রশ্মিটুকু পৃথিবীর পাতায় পাতায় অনিঃশেষ মায়ায় লেপ্টে আছে। তারই এক টুকুরো কিরণ পৃথিবীর বুকে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি মেয়েটির শাড়ির আঁচলে ‘লুটাইয়া পড়িতেছিল’।
রিয়াজুল্লার মা মেয়েকে কাছে ডাকলেন।
-জি মা!
-সুরা ফাতেহা একটু পড়ে শোনাও মা।
-আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।........ওয়ালাদ্ব্যোল্লিন।
-আমিন। ভালো, তবে কোরআন পড়ার সময় বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম পড়ে শুরু করতে হয়। এটি কোরআনের আদব। বেয়াইনকে বলছি, যারা পদ্মিনী তারা শুধু জীবনাচারে নয়, ধর্মাচারেও আদব মেনে চলে।
মা বা মেয়ে কেউ কিছু বলে না। নিস্তব্ধতা গ্রাস করছে চারদিক। দিনান্তের ম্লান আলো দিয়ে দিগন্তের পাহাড়গুলোর চূড়ায় রঙের খেলা সাজিয়েছেন তিনি। সেই আলোর খেলা মেয়েটির অলক চিকুরে লেগে মোহনীয় হয়ে উঠেছে। বোধ করি, তা দেখেই পিতা বলে উঠলেন-
আচ্ছা বেয়াইন, আগে কিছু মুখে দেন। তার পর কথা বলুন।
কিন্তু যার উদ্দেশে এ কথা বলা সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি একদৃষ্টে মেয়ের মাথার দিকে তাকিয়েছিলেন। বললেন,
-মা, তোমার চুলের কবরী খুলে দাও তো দেখি।
চলবে…