
গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা- যা কিছুই তিনি লিখেছেন, দেশভাগের ক্ষত, দীর্ঘশ্বাস, হাহাকার ও অশ্রু চুঁইয়ে বেরিয়েছে। গল্পকার হিসেবে তার খ্যাতি ও কীর্তি বিস্ময়কর। ছোটগল্পকে সঙ্গী করে কথাসাহিত্যে তার অভিযাত্রা, বিস্তার ও প্রসিদ্ধি। গল্প অনেকেই লেখেন, লেখালেখির শুরুতে গল্প দিয়ে আরম্ভ করে ক্রমশ উপন্যাসের দিকে ঝুঁকে পড়েন।…
‘ঘরে ফেরা সোজা নয়’ তার একটি গ্রন্থের নাম। তিনি নিজেও আর ঘরে ফিরতে পারলেন না! ঘর থেকে হাসপাতালে গেলেন, কিন্তু কিছুতেই ঘরে ফেরা হলো না তার। সোজা তো নয়ই, কিছুতেই নয়! কবিতার বইয়ের নামটি জীবনের সঙ্গে সত্য করে দিলেন তিনি। কবিরা তো সৃজন-ঈশ্বর, তাই তারা আগে ভাগেই অনেক কিছু বলে দেন। বলে দিতে পারেন। তিনি যেন কোথায় গেলেন, আর দেখা যাবে না তার ঘরে, মঞ্চে, পর্দায়, পথে; আর খাবেন না ‘তবক দেওয়া পান’। রবীন্দ্রনাথের মতো ৮০ বছরের সমান বয়সী হয়ে অনন্তলোকের দিকে যাত্রা করলেন তিনি, তিনি সমকালীন বাংলা কবিতার খ্যাতিমান কবি, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, অনুবাদক, জীবনী লেখক, ভ্রমণ লেখক, ভারী কণ্ঠের বক্তা, আবৃত্তি শিল্পী, দেশসেরা উপস্থাপক, মুক্তিযোদ্ধা, বাংলা একাডেমির ফেলো, সাবেক পরিচালক, সদাহাস্যোজ্জ্বল, রসিক, বাংলাদেশের অসাধারণ প্রকৃতি ও ঐতিহ্য-রঙের এক দীর্ঘ সাক্ষীসুতো আসাদ চৌধুরী। নদী মেখলা বরিশালে জন্ম নেওয়া কবি, শেষনিঃশ্বাস ফেললেন তার দ্বৈত নাগরিকের দেশ কানাডার অশোয়া শহরের লেক রিজ হাসপাতালে। মরণব্যাধি রোগ ব্লাড-ক্যানসার কেড়ে নিল তাকে। রোগকেও দোষ দিয়ে লাভ নেই, তার জীবন এখানেই শেষ হবে হয়তো লেখা ছিল। জীবনের বাতি সবারই নিভে যাবে এক এক করে কিন্তু কিছু কিছু মানুষের চিরতরে চলে যাওয়া অনেকেরই মন ভীষণ খারাপ করে দেয়! আমিও বিষণ্ন, বিমর্ষ, বিস্মিত, বিপন্ন বোধ করছি, কারণ কবি তো বটেই, তার চেয়ে বেশি বড় আমাদের প্রজন্মের অভিভাবক, আরও খুলে বললে, স্নেহদড়ি লাগিয়ে রাখা যেন একজন সিনিয়র ফ্রেন্ড অর্থাৎ একসঙ্গে দীর্ঘ পথ চলা বন্ধু। এই বন্ধুবৎসল কবি ও অভিভাবকের সঙ্গে শেষ দেখাটি হলো না, যদিও শেষ দেখা বলে কিছু নেই। কিন্তু প্রথমবারের মতো কানাডায় গিয়ে, ঠিক এক মাস আগে তার শেষ অবস্থানের খুব কাছের মহাসড়ক দিয়ে অর্থাৎ টরন্টো থেকে মন্ট্রিয়েল দুবার যাতায়াত করেও দেখা করতে পারিনি সময়ের অভাবে। এমনকি সর্বশেষ বাংলাদেশ থেকে যখন অসুস্থ হয়ে কানাডায় ফিরে যান, তার কয়েকদিন আগেই আমাকে সেল ফোনে কল করেছিলেন। আমি সময়ের অভাবে ধরতে পারিনি? হায়রে সময়! পরে যখন তাকে ফোন করব, তখন তিনি হাসপাতাল থেকেই চলে গেছেন স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের কাছে। টরন্টোয় অনুষ্ঠিত আমার অগ্রজ কবি ও সাংবাদিক সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের বড় মেয়ে অনাদি নিমগ্নের বিয়েতে এসেছিলেন তার বড় ছেলে আসিফ ও মেয়ে শাওলি, তাদের সঙ্গে দেখা হলো, কথা হলো, তার খোঁজখবর নিলাম। ওরা বলল, একদিন এসে বাবাকে দেখে যান। কিন্তু যাওয়া হলো কই? সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখে কানাডা থেকে উড়াল দিলাম বাংলাদেশে আর ঠিক এক মাস পর ৫ অক্টোবর তার সুদূরের দেশে ফিরে যাওয়ার খবর পেলাম... মনটা বৃষ্টির জলে যেন ভিজে গেল অথবা তুষের আগুনের মতো ভিতরটা পুড়তে থাকল...
কবি আসাদ চৌধুরী তার বর্ণাঢ্য কর্মের জন্য ৮০ বছর বয়সেও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা পুরস্কার পাননি, তাতে কী। মরণোত্তর হয়তো পাবেন? পেয়েছেন তো একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ দেশের অসংখ্য সেরা সেরা পুরস্কার ও পদক। তবে ইতিহাসের অপরিহার্য গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ ও জাতির পিতার জীবনীগ্রন্থ ‘সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থদ্বয়ের অসাধারণ পরিশ্রম ও মননের জন্য জীবিতাবস্থায় স্বাধীনতা পুরস্কারটি পেলে তৃপ্তি পেতেন একথা বলা যায়। আসলে প্রকৃত লেখকরা কোনো প্রাপ্তির আশায় সৃজনে থাকেন না, কিংবা বলা যায় তাদের আকাঙ্ক্ষা কম। সেই আসাদ চৌধুরীও নির্লোভ। তার মুখ দেখলে কখনো মনে হয়নি তার এটি পেতেই হবে। কিন্তু তিনি লিখে গেছেন নিরন্তর। তার ১৮টি কবিতার বইসহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৪১টি। কয়েকটি বইয়ের নাম দেখুন কী সুন্দর- ‘তবক দেওয়া পান (১৯৭৫)’, ‘বিত্ত নাই বেসাত নাই (১৯৭৬)’, ‘প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড় (১৯৭৬)’, ‘জলের মধ্যে লেখাজোখা (১৯৮২)’, ‘যে পারে পারুক (১৯৮৩)’, ‘মধ্য মাঠ থেকে (১৯৮৪)’, ‘মেঘের জুলুম পাখির জুলুম (১৯৮৫)’, ‘দুঃখীরা গল্প করে (১৯৮৭)’, ‘নদীও বিবস্ত্র হয় (১৯৯২)’, ‘বাতাস যেমন পরিচিত (১৯৯৮)’, ‘বৃন্তির সংবাদে আমি কেউ নই (১৯৯৮)’, ‘কিছু ফল আমি নিভিয়ে দিয়েছি (২০০৩)’, ‘ঘরে ফেরা সোজা নয় (২০০৬)’। এই শেষ কাব্যগ্রন্থটির নাম দিয়েই লেখা শুরু করেছিলাম, দেখুন তার কাব্যগ্রন্থের নামগুলো যেমন সুন্দর, তেমনি তার কবিতা অসংখ্য পাঠককে সুন্দরের শীর্ষে নিয়ে যায়। তার লেখা একটি প্রেমের কবিতা দিয়েই শেষ করি: আপনারা শুধু কবি আসাদ চৌধুরীর এই ক’টা কবিতা পড়েন, দেখুন কতটা আপনাকে নাড়াবে? ‘রিপোর্ট ৭১’, ‘শহীদদের প্রতি’, ‘প্রথম কবি তুমি প্রথম বিদ্রোহী, ‘বারবারা বিডরালকে’, ‘সত্যি ফেরারি’। শেষ করি তার একটি কবিতার চরণ দিয়ে:
‘কোন ঘাসে ছিল
দুঃখ তোমার
কোনে ঘাসে ছিল
প্রেম
কোথায় ছিলেন
রূপালি জ্যোৎস্না
ঢের সূর্যের হেম
কখনো নদীতে
সোনালি গীতিকে
একথা বলেছিলেম’।
বাকেরগঞ্জের ঘাস, নদী, গীতি, ঢাকার প্রেম আর অসোয়ার জ্যোৎস্না গায়ে মেখেই কবি আসাদ চৌধুরী হারিয়ে গেলেন সুদূরের কোন নদীতে কিংবা ঘাসের বিছানায়। আর হবে না দেখা, কথা। বুকে হাহাকার লাগছে আসাদ ভাই, বিদায়।