ডেঙ্গু জ্বরকে শুধু ভাইরাল জ্বর ভেবে উপেক্ষা করা ঠিক না। ডেঙ্গু জ্বর ও ভাইরাল জ্বর দুটি একে অপরের থেকে আলাদা এবং ডেঙ্গু তুলনামূলকভাবে ভয়ংকর। প্রাথমিক লক্ষণগুলো একই হওয়ার কারণে রোগী ঠিক কী রোগে ভুগছেন, তা প্রথম অবস্থায় বোঝা কঠিন হতে পারে। আমেরিকার স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট ক্লেভারল্যান্ড ক্লিনিক অবলম্বনে লিখেছেন ফখরুল ইসলাম
প্রথমে আমাদের জানা প্রয়োজন, এডিস মশা কামড়ালেই মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় কি না। চিকিৎসকরা কিন্তু ঠিক তেমনটা বলছেন না। বরং তারা বলছেন, পরিবেশে উপস্থিত কোনো ভাইরাস যদি কোনো এডিস মশার মধ্যে সংক্রমিত হয়, শুধু তখনই ওই মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
স্ত্রী এডিস মশা ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে। সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে সুস্থ ব্যক্তিতে এরা এই ভাইরাস ছড়াতে থাকে। ডেঙ্গু জ্বরের কারণে প্রচণ্ড জ্বরের মতো উপসর্গ দেখা দেয়। ডেঙ্গু ভাইরাস সাধারণত চার প্রকার। তবে যারা আগে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের পরবর্তী সময়ে এ রোগ আবার দেখা দিলে প্রাণঘাতী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ বা উপসর্গগুলো কী কী?
তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার কামড়েই যে কারও ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্বর। যা ১০২ থেকে ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। থাকতে পারে মাথাব্যথা। এ ছাড়া বমি, চোখের পেছনে ব্যথা, চামড়ায় লালচে দাগ (র্যাশ), শরীরে শীতলতা অনুভব করা, ক্ষুধা কমে যাওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, স্বাদের পরিবর্তন, হৃৎস্পন্দনের হার ও রক্তচাপ কমে যাওয়া এবং পেশিতে ও গাঁটে ব্যথার অনুভূতি হতে পারে।
ডেঙ্গু রোগের ধরন
চিকিৎসকদের মতে, সাধারণত দুই ধরনের ডেঙ্গু জ্বর হয়- ক্ল্যাসিকাল এবং হেমোরেজিক। ক্ল্যাসিকালে জ্বর সাধারণত দুই থেকে সাত দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। বিপদ ঘটে হেমোরেজিকের ক্ষেত্রে। এই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তির অবস্থা পাঁচ থেকে সাত দিন পর মারাত্মক সংকটাপন্ন হতে পারে।
হেমোরেজিকের ক্ষেত্রে রোগীর রক্তপাত হয়, রক্তে অণুচক্রিকার মাত্রা কমে যায় এবং রক্তের প্লাজমা কমে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার দেখা দেয় ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। এতে রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে হ্রাস পায়। কিছু সময় আক্রান্ত ব্যক্তির মুখ, দাঁতের মাড়ি এবং নাক থেকে রক্তপাত ঘটে। মলের সঙ্গেও মাঝে মাঝে রক্ত বের হতে পারে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত নারীর ক্ষেত্রে পিরিয়ডের সময়ও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়। এমনকি কারও কারও রক্তের প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকা কমে গিয়ে শরীরের চামড়ার নিচে ইন্টারনাল ব্লিডিং হয়। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে যখন রোগীর হাত-পা দ্রুত ঠাণ্ডা হওয়া শুরু করে এবং রক্তচাপ কমে যায়। আক্রান্ত ব্যক্তি এ সময় মাত্রাতিরিক্ত ঘামতে শুরু করে। এতে তার মধ্যে এক ধরনের ছটফটানিও শুরু হয়। কেউ কেউ বমি করে বা তাদের বমি বমি ভাব হয়। এ সময় কোনো কোনো রোগীর হোয়াইট ব্লাড সেল স্বল্পতা, ইলেক্ট্রোলাইটের অসমতা, লিভারে সমস্যা এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের মতো ঘটনা ঘটে। এতে তাদের শকে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। দুঃখজনক হলো, এর ফলে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে পদক্ষেপ ও সতর্কতা
যেহেতু এডিস মশা দিনে কামড়ায়, তাই দিনের বেলায় ঘুমাতে গেলে ঘরে মশারি অথবা কয়েল ব্যবহার করতে হবে। ঘরের আনাচে-কানাচে অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গায় মশার ওষুধ স্প্রে করতে হবে। সুরক্ষিত থাকতে দিনে যথাসম্ভব লম্বা পোশাক পরাই ভালো।
এডিস মশা সাধারণত পরিষ্কার পানিতে বংশবিস্তার করে। এ কারণে অফিস, ঘর এবং এর আশপাশে যেন পানি না জমে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কোথাও পানি জমা থাকলে ২-৩ দিন পরপর তা পরিবর্তন করতে হবে। অনেক সময় ফুলের টবে, এসি বা ফ্রিজের ট্রেতে জমা পানিতে মশা ডিম দিতে পারে। তাই ডেঙ্গুর মৌসুমে এসব স্থান পরিষ্কার রাখতে হবে।
ডেঙ্গু হলেই আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কিছু বিপৎসংকেত জানা থাকলে সতর্ক হতে সুবিধা হবে। অস্বাভাবিক দুর্বলতা, অসংলগ্ন কথা বলা, অনবরত বমি, পেটে তীব্র ব্যথা, গায়ে লাল ছোপ ছোপ দাগ, শ্বাসকষ্ট, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তপাত, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া অথবা রোগীর মুখ, নাক, দাঁতের মাড়ি, পায়ুপথে রক্তক্ষরণ, পিরিয়ডের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, রক্তবমি হলে দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
কারা বেশি ঝুঁকিতে থাকে
ডেঙ্গুতে সাধারণত বেশি ঝুঁকিতে থাকেন ১ বছরের কম এবং ৬৫ বছরের ওপরে যাদের বয়স, তারা। এ ছাড়া অন্তঃসত্বা, যাদের ওজন বেশি, যারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন, যাদের উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা আছে, যারা হার্টের সমস্যায় আক্রান্ত কিংবা যাদের নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হয়, তাদের ডেঙ্গু সংক্রমণের শুরু থেকেই হাসপাতালে থাকার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা।
এ ছাড়া ডেঙ্গু থেকে সতর্ক থাকতে এ সময় জ্বরে আক্রান্ত হলেই প্রথমে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। প্রাথমিক অবস্থাতেই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চললে জটিলতা এড়ানো সম্ভব। সাধারণত জ্বরের শুরুতেই প্রথম পাঁচ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু NS1 টেস্ট করার কথা পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। এর সঙ্গে আরও থাকে CBC, SGPT, SGOT টেস্ট করার পরামর্শ।
ডেঙ্গু হলে করণীয়
যেকোনো রোগের উপসর্গ দেখা দিলেই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। ডাক্তারের নির্দেশনা ছাড়া ওষুধ গ্রহণ করলে অথবা নিজে থেকে কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে অনেক সময় মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়। নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বাসায় প্রাথমিক পরিচর্যা ও চিকিৎসা শুরু করা ভালো।
যেহেতু ডেঙ্গু রোগীরা অধিকাংশ সময়ই ক্লান্ত থাকেন, তাদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। লক্ষণ দেখা দেওয়ার ৭ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত কোনো ভারী কাজ অথবা মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম করা যাবে না। তবে তাই বলে শুধু শুয়ে-বসে থাকাটাও ঠিক নয়। স্বাভাবিক হাঁটা-চলা বা দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে যেতে হবে। এ সময় বাসার বাইরে না যাওয়াই ভালো।
ডেঙ্গু রোগীর খাবার
ডেঙ্গু রোগীকে প্রচুর পরিমাণে পানি, স্যালাইন, স্যুপ, ডাবের পানি, ফলের রস এবং দুধ জাতীয় তরল পানীয় পান করতে হবে। ডেঙ্গু জ্বর থেকে সেরে ওঠার সময়ও প্রচুর পরিমাণে তরল পান করতে হবে। এ সময় শরীর যেন পানিশূন্যতায় না ভোগে, সে জন্য আড়াই থেকে তিন লিটার পানি প্রতিদিন পান করতে হবে।
এ ছাড়া খেতে হবে প্রচুর প্রোটিন ও আয়রন-সমৃদ্ধ খাবার। মাছ, মুরগির মাংস, চর্বিহীন লাল মাংস, ডিম, দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যে প্রোটিন বেশি থাকে বলে এ সময় এসব খাবার বেশি করে খাওয়া উচিত। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এ খাবারগুলো সাহায্য করে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায় হচ্ছে সচেতনতা। এডিস মশা যেন বংশবৃদ্ধি করতে না পারে কিংবা দিনের বেলা যেন মশার কামড় এড়ানো যায়, সে বিষয়ে সচেতন থাকা গুরুত্বপূর্ণ। সচেতনতার মাধ্যমেই ডেঙ্গু জ্বরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব।
কলি