শুভ্র মেঘের ভেলা উড়ে যায় আপন গতিতে। কখনো আবার কালো মেঘরাশি জমাট বেঁধে রয় ওই দূর আকাশে। দৃষ্টিরসীমায় ধরা পাহাড়ের ঢেউ। ঝিরঝির বাতাসের আলিঙ্গন। অপার্থিব সৌন্দর্যের সূর্যোদয়ের নান্দনিক দৃশ্য দেখার ফাঁকে, আকস্মিক মেঘের আবরণে শরীর ঢেকে যাওয়া। এমনই সব প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম দৃশ্যগুলোর সাক্ষী হয়ে এলাম, ভূমি থেকে প্রায় ১০০০ থেকে ১২০০ ফিট উপরে সবুজ পাহাড়ের বুকে গড়া মেঘচূড়া হিল রিট্রিটের জুমঘরে বসে।
২৭ নভেম্বর রাতে দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের বন্ধুরা ছুটলাম বান্দরবানের আলীকদম। রাত পেরিয়ে ভোরের আলোয় আঁকাবাঁকা সড়ক ধরে গাড়ি চলছে। দূরের পাহাড়গুলো তখনো অস্পষ্ট। তবে গাছের ঝোপঝাড়ের ফাঁক গলে গভীর গিরিখাদ ঠিকই চোখে পড়ে। বান্দরবান হাজারবার গেলেও, পথের সৌন্দর্যে যে কাউকেই বারংবার মজতেই হবে। বাস যেতে যেতে পৌঁছায় আলীকদমের আবাসিক এলাকায়। নাশতা সেরে মোটরবাইকে চড়ি। মারায়নতং পাহাড়ের পথ ধরে বাইক ছুটে চলে। পাহাড়ি পথে মোটরবাইকের পিলিয়ন হতে পারাটা আরও বিশেষ আনন্দের। আর সেটা যদি হয় ভাড়ায় খাটা মোটরবাইক তাহলে তো ষোলোকলা পূর্ণ। এই পথটা সাজেক কিংবা সিন্দুকছড়ির মতো নয় যে তেলতেলে পিচ করা সড়ক। সরুপথে ইট সুরকির সলিং।
কোথাও-বা তা সরে যাচ্ছে, তাই ইটগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিংবা স্তূপ হয়ে রয়েছে। তার মধ্যে আবার ডানে-বামে খাদ। চালকের নেক্সট প্যাসেঞ্জার ধরার তাড়াহুড়া। এহেন পরিস্থিতিতে বাইকে উঠছে। ভালোয় ভালোয় নামিয়ে দিল প্রায় ১২০০ ফিট ওপরে। এরকম ১২০০ আর ২৪০০ ফিট তার চেয়েও বেশি, ট্র্যাকিং করাটা আমাদের জন্য মামুলি। ঘরের সামনে রিকশা পেলে দশ কদমও হাঁটতে ইচ্ছে করে না। ব্যাপারটা সেরকমই ঘটেছে। বাইক মিলে যাওয়ায় ট্র্যাকিং করতে ইচ্ছে করেনি। মোটরবাইকার নামিয়ে দিয়ে শাঁ করে চলে গেল। মনে হলো সে যেন মাওয়া রোডে টান মারল। আমরা এগোতে থাকি। জুমঘর পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রায় ২০০ ফিট নিচের দিকে নামতে হবে। শুরু হলো হাইকিং। চোখে ধরা পড়ল মাতামুহুরী নদী। ওপর থেকে নদীকে চিকন সুতার মতো লাগল। জুমঘরটা দৃষ্টির সীমায়। হুট করেই সাদা মেঘের দল ঘরটাকে ঘিরে ফেলল। দ্রুত কিছু ছবি তুলে নিই। প্রকৃতি যা কিছু করে, তা তার আপন খেয়ালেই করে থাকে। পরেরবার আবার নাও করতে পারে। তাই মিস করতে রাজি না।
ওদিকে আমাদের অপেক্ষায় থাকা ভ্রমণযোদ্ধা মাসুমের ফোন। তাকে আশ্বস্ত করি আমরা ঠিকানামতো প্রায় এসেই পড়ছি। সত্যি সত্যিই এসে পড়ছি। আমার প্রিয় পাঠক সজিব গাজী বাবু অভ্যর্থনা জানাল। চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছি যে, মুহূর্তেই সারা রাতের বাস জার্নির ক্লান্তি উবে গেছে। তাঁবুতে ব্যাগ রেখেই প্রকৃতির সৌন্দর্যের পিছু নিই। ভ্রমণবন্ধুরা উল্লাসে মাতে। বেলা গড়ায়। ইচ্ছে হলো মাতামুহুরী নদীতে জলকেলিতে মাতামাতি করব সবাই। যেমন কথা তেমন কাজ। প্রায় ১০০০ ফিট নেমে বাঘের ঝিরি হয়ে তবেই পৌঁছানো যাবে মাতামুহুরীতে। দে-ছুট প্রস্তুত। নামতে শুরু করলাম সবাই। নামতে নামতে মনে হলো এই পথে ট্র্যাকিং না করলে ভ্রমণের অনেক কিছুই অপূর্ণ থেকে যেত।
বেশ কিছুক্ষণ হাইকিং-ট্র্যাকিং করার পরে বিশাল সেগুন বাগানের দেখা পাই। পুরোনো সব সেগুন গাছ। সে এক অন্যরকম ভালো লাগা। সেগুনের ছায়া ঘেরা পথে হাঁটতে হাঁটতে বাঘের ঝিরি পার হয়ে নদীর দেখা পাই। আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ অগ্রহায়ণ মাসে তার কোমর পানি থাকে। বর্ষার প্রমত্তা পাহাড়ি মাতামুহুরী অগ্রহায়ণে নিষ্প্রাণ। এর বুকজুড়ে এখন ধুমছে চলছে চাষাবাদ। কোমর পানিতেই নেমে যাই। আহ কী শান্তি। জাতের মাইয়া কালা আর নদীর পানি ঘোলাও ভালা। বুড়া-বুড়িদের কথা একেবারে ফেলনা নয়। চলল অনেকটা সময় সুখ স্থান। যাই আবারও উঠতে হবে প্রায় হাজার ফিট। মাল্টা, কমলা ও আমবাগানের পাশ দিয়ে, নিচ দিয়ে হাইকিং করে যাচ্ছি। যেতে যেতে এবার ট্র্যাকিং করার পালা। ১১৮ কেজির দেহটা নিয়া পাহাড় চূড়ায় উঠা খানিকটা চ্যালেঞ্জিং। তবে মনের জোর থাকলে সেটা মামুলি ব্যাপার। বরাবরের মতো এবারো ভ্রমণসঙ্গীদের সহযোগিতা ও মনের জোরে উতরে গেলাম। ক্যাম্পিং সাইটে ফিরেই দেখি রতনের গুছিয়ে রাখা রান্নার আয়োজন দিয়ে, মান্নান ও আনিস দুপুরে খাবারে রাজহাঁস ভুনা ও আঠাল খিচুড়ি করে রেখেছে। খেয়েদেয়ে তাঁবুতে খানিকটা সময় বিশ্রাম নিয়েই চলে যাই সবচেয়ে উঁচুতে থাকা জুমঘরে। খুনসুটি হয় মেঘের সঙ্গে। আড্ডা জমে ঝিরঝিরে বাতাসের সঙ্গে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা।
আরাফাত, সৌরভ ও তুহিনের বারবিকিউ প্রস্তুতি। চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের হতাশা। সব মিলিয়ে মজাদার বিফ বারবিকিউ। আকাশে ততক্ষণে তারার মেলা। জ্বল জ্বল করে আলো ছড়াচ্ছে নাম না জানা নানান তারা। একটা সময় সবাই ঘুমের বাড়ি পাড়ি জমাই। ঘুম ভাঙে সুবহে সাদিকের সময়। ফজর পড়েই পুব আকাশের পানে তাকিয়ে সূর্যোদয়ের অপেক্ষায়। একেবারে শুরু থেকেই সূর্যোদয় দেখার অনুভূতি ও এর সৌন্দর্য লিখে বর্ণনা করা অসম্ভব। শুধু এতটুকুই বলা যায়, যারা এই জনমে এখনো খালি চোখে সূর্যোদয় দেখেননি তারা এই ভুবনে জম্মানোটাই অনর্থক। কথাটা বেশ শক্ত হয়ে গেল তাই না। আদতে মোটেও তা শক্ত নয়। দেখেই আসুন না একবার দেশের যেকোনো পাহাড় চূড়ায় বসে। তখনই অনুভব করা যাবে, বেঁচে থাকার মানে কী।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সরাসরি আলীকদম বাস সার্ভিস রয়েছে।
কোথায় থাকবেন
লামাবাজার ও আলীকদমে হোটেল, কটেজসহ পাহাড় চূড়ায় বেশ কিছু রিসোর্ট, জুমঘর ও ক্যাম্পিং সাইট রয়েছে। যারা রোমাঞ্চকর পরিবেশ পছন্দ করেন তারা জুমঘর কিংবা তাঁবুতে থাকতে পারেন। নিরাপত্তাসহ খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে।
কলি