ঢাকা ১২ মাঘ ১৪৩১, রোববার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫
English
রোববার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ মাঘ ১৪৩১

পাহাড়ে সবুজের হাতছানি

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:০৯ পিএম
আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:১৭ পিএম
পাহাড়ে সবুজের হাতছানি
মেঘচূড়া হিল রিট্রিট

শুভ্র মেঘের ভেলা উড়ে যায় আপন গতিতে। কখনো আবার কালো মেঘরাশি জমাট বেঁধে রয় ওই দূর আকাশে। দৃষ্টিরসীমায় ধরা পাহাড়ের ঢেউ। ঝিরঝির বাতাসের আলিঙ্গন। অপার্থিব সৌন্দর্যের সূর্যোদয়ের নান্দনিক দৃশ্য দেখার ফাঁকে, আকস্মিক মেঘের আবরণে শরীর ঢেকে যাওয়া। এমনই সব প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম দৃশ্যগুলোর সাক্ষী হয়ে এলাম, ভূমি থেকে প্রায় ১০০০ থেকে ১২০০ ফিট উপরে সবুজ পাহাড়ের বুকে গড়া মেঘচূড়া হিল রিট্রিটের জুমঘরে বসে।

২৭ নভেম্বর রাতে দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের বন্ধুরা ছুটলাম বান্দরবানের আলীকদম। রাত পেরিয়ে ভোরের আলোয় আঁকাবাঁকা সড়ক ধরে গাড়ি চলছে। দূরের পাহাড়গুলো তখনো অস্পষ্ট। তবে গাছের ঝোপঝাড়ের ফাঁক গলে গভীর গিরিখাদ ঠিকই চোখে পড়ে। বান্দরবান হাজারবার গেলেও, পথের সৌন্দর্যে যে কাউকেই বারংবার মজতেই হবে। বাস যেতে যেতে পৌঁছায় আলীকদমের আবাসিক এলাকায়। নাশতা সেরে মোটরবাইকে চড়ি। মারায়নতং পাহাড়ের পথ ধরে বাইক ছুটে চলে। পাহাড়ি পথে মোটরবাইকের পিলিয়ন হতে পারাটা আরও বিশেষ আনন্দের। আর সেটা যদি হয় ভাড়ায় খাটা মোটরবাইক তাহলে তো ষোলোকলা পূর্ণ। এই পথটা সাজেক কিংবা সিন্দুকছড়ির মতো নয় যে তেলতেলে পিচ করা সড়ক। সরুপথে ইট সুরকির সলিং।

কোথাও-বা তা সরে যাচ্ছে, তাই ইটগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিংবা স্তূপ হয়ে রয়েছে। তার মধ্যে আবার ডানে-বামে খাদ। চালকের নেক্সট প্যাসেঞ্জার ধরার তাড়াহুড়া। এহেন পরিস্থিতিতে বাইকে উঠছে। ভালোয় ভালোয় নামিয়ে দিল প্রায় ১২০০ ফিট ওপরে। এরকম ১২০০ আর ২৪০০ ফিট তার চেয়েও বেশি, ট্র্যাকিং করাটা আমাদের জন্য মামুলি। ঘরের সামনে রিকশা পেলে দশ কদমও হাঁটতে ইচ্ছে করে না। ব্যাপারটা সেরকমই ঘটেছে। বাইক মিলে যাওয়ায় ট্র্যাকিং করতে ইচ্ছে করেনি। মোটরবাইকার নামিয়ে দিয়ে শাঁ করে চলে গেল। মনে হলো সে যেন মাওয়া রোডে টান মারল। আমরা এগোতে থাকি। জুমঘর পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রায় ২০০ ফিট নিচের দিকে নামতে হবে। শুরু হলো হাইকিং। চোখে ধরা পড়ল মাতামুহুরী নদী। ওপর থেকে নদীকে চিকন সুতার মতো লাগল। জুমঘরটা দৃষ্টির সীমায়। হুট করেই সাদা মেঘের দল ঘরটাকে ঘিরে ফেলল। দ্রুত কিছু ছবি তুলে নিই। প্রকৃতি যা কিছু করে, তা তার আপন খেয়ালেই করে থাকে। পরেরবার আবার নাও করতে পারে। তাই মিস করতে রাজি না।

ওদিকে আমাদের অপেক্ষায় থাকা ভ্রমণযোদ্ধা মাসুমের ফোন। তাকে আশ্বস্ত করি আমরা ঠিকানামতো প্রায় এসেই পড়ছি। সত্যি সত্যিই এসে পড়ছি। আমার প্রিয় পাঠক সজিব গাজী বাবু অভ্যর্থনা জানাল। চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছি যে, মুহূর্তেই সারা রাতের বাস জার্নির ক্লান্তি উবে গেছে। তাঁবুতে ব্যাগ রেখেই প্রকৃতির সৌন্দর্যের পিছু নিই। ভ্রমণবন্ধুরা উল্লাসে মাতে। বেলা গড়ায়। ইচ্ছে হলো মাতামুহুরী নদীতে জলকেলিতে মাতামাতি করব সবাই। যেমন কথা তেমন কাজ। প্রায় ১০০০ ফিট নেমে বাঘের ঝিরি হয়ে তবেই পৌঁছানো যাবে মাতামুহুরীতে। দে-ছুট প্রস্তুত। নামতে শুরু করলাম সবাই। নামতে নামতে মনে হলো এই পথে ট্র্যাকিং না করলে ভ্রমণের অনেক কিছুই অপূর্ণ থেকে যেত।

বেশ কিছুক্ষণ হাইকিং-ট্র্যাকিং করার পরে বিশাল সেগুন বাগানের দেখা পাই। পুরোনো সব সেগুন গাছ। সে এক অন্যরকম ভালো লাগা। সেগুনের ছায়া ঘেরা পথে হাঁটতে হাঁটতে বাঘের ঝিরি পার হয়ে নদীর দেখা পাই। আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ অগ্রহায়ণ মাসে তার কোমর পানি থাকে। বর্ষার প্রমত্তা পাহাড়ি মাতামুহুরী অগ্রহায়ণে নিষ্প্রাণ। এর বুকজুড়ে এখন ধুমছে চলছে চাষাবাদ। কোমর পানিতেই নেমে যাই। আহ কী শান্তি। জাতের মাইয়া কালা আর নদীর পানি ঘোলাও ভালা। বুড়া-বুড়িদের কথা একেবারে ফেলনা নয়। চলল অনেকটা সময় সুখ স্থান। যাই আবারও উঠতে হবে প্রায় হাজার ফিট। মাল্টা, কমলা ও আমবাগানের পাশ দিয়ে, নিচ দিয়ে হাইকিং করে যাচ্ছি। যেতে যেতে এবার ট্র্যাকিং করার পালা। ১১৮ কেজির দেহটা নিয়া পাহাড় চূড়ায় উঠা খানিকটা চ্যালেঞ্জিং। তবে মনের জোর থাকলে সেটা মামুলি ব্যাপার। বরাবরের মতো এবারো ভ্রমণসঙ্গীদের সহযোগিতা ও মনের জোরে উতরে গেলাম। ক্যাম্পিং সাইটে ফিরেই দেখি রতনের গুছিয়ে রাখা রান্নার আয়োজন দিয়ে, মান্নান ও আনিস দুপুরে খাবারে রাজহাঁস ভুনা ও আঠাল খিচুড়ি করে রেখেছে। খেয়েদেয়ে তাঁবুতে খানিকটা সময় বিশ্রাম নিয়েই চলে যাই সবচেয়ে উঁচুতে থাকা জুমঘরে। খুনসুটি হয় মেঘের সঙ্গে। আড্ডা জমে ঝিরঝিরে বাতাসের সঙ্গে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা।

আরাফাত, সৌরভ ও তুহিনের বারবিকিউ প্রস্তুতি। চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের হতাশা। সব মিলিয়ে মজাদার বিফ বারবিকিউ। আকাশে ততক্ষণে তারার মেলা। জ্বল জ্বল করে আলো ছড়াচ্ছে নাম না জানা নানান তারা। একটা সময় সবাই ঘুমের বাড়ি পাড়ি জমাই। ঘুম ভাঙে সুবহে সাদিকের সময়। ফজর পড়েই পুব আকাশের পানে তাকিয়ে সূর্যোদয়ের অপেক্ষায়। একেবারে শুরু থেকেই সূর্যোদয় দেখার অনুভূতি ও এর সৌন্দর্য লিখে বর্ণনা করা অসম্ভব। শুধু এতটুকুই বলা যায়, যারা এই জনমে এখনো খালি চোখে সূর্যোদয় দেখেননি তারা এই ভুবনে জম্মানোটাই অনর্থক। কথাটা বেশ শক্ত হয়ে গেল তাই না। আদতে মোটেও তা শক্ত নয়। দেখেই আসুন না একবার দেশের যেকোনো পাহাড় চূড়ায় বসে। তখনই অনুভব করা যাবে, বেঁচে থাকার মানে কী। 

কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সরাসরি আলীকদম বাস সার্ভিস রয়েছে। 

কোথায় থাকবেন
লামাবাজার ও আলীকদমে হোটেল, কটেজসহ পাহাড় চূড়ায় বেশ কিছু রিসোর্ট, জুমঘর ও ক্যাম্পিং সাইট রয়েছে। যারা রোমাঞ্চকর পরিবেশ পছন্দ করেন তারা জুমঘর কিংবা তাঁবুতে থাকতে পারেন। নিরাপত্তাসহ খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে।

কলি

যেতে যেতে বানিয়াচং

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬:২৫ পিএম
আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬:২৮ পিএম
যেতে যেতে বানিয়াচং
ছবি: লেখক

প্রথমে জানতাম বাংলাদেশ। পরে শুনলাম দক্ষিণ এশিয়া। এর পর মাত্র কিছুদিন আগেই জানা যায়, সারা পৃথিবীর মধ্যে বানিয়াচং হলো সবচেয়ে বড় গ্রাম। বলছি সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার অন্তর্গত বানিয়াচং গ্রামের কথা। এত বড় গ্রাম বাংলাদেশে, আর সেখানে যাব না ঘুরতে, তা কী করে হয়! অধিক সদস্য সংখ্যার ভয়ে চুপেচাপে দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের সাত ভ্রমণবন্ধু এক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মাইক্রো করে ছুটলাম। যেতে যেতে শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভা কার্যালয়ে ব্রেক।

রাত তখন প্রায় দেড়টা। আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন পৌর নির্বাহী অফিসার কাজী কামাল মনির ভাই। উনি আরেক পাগলু ট্রাভেলার। আমাদেরকে পেয়ে পাগলামির পারদ তার তুঙ্গে। এ যেন  হরেকরকম পাগল দিয়া মিলাইছিল মেলা! গভীর রাতেই আমাদেরকে নিয়ে বের হয়ে গেলেন। মনে মনে ভাবি, আমি আর কি পাগল! তার চেয়ে বড় পাগলের পাল্লায় পইড়া রাতের ঘুম হারাম। হা হা হা। প্রথমে নিয়ে গেলেন বিরামচরের সাহেববাড়ির পুকুরে। সারি সারি সুপারি গাছের ফাঁক গলে অর্ধচন্দ্রের আলোতেও পুকুরের চারপাশটা বেশ আলোকিত ছিল। চাঁদ-তারা- এসব নক্ষত্রের আসল সৌন্দর্য অন্ধকারেই বেশ বোঝা যায়।

এর পর নিয়ে গেলেন জমিদার গিরিশ চন্দ্র বিশ্বাসের বাড়িতে। চমৎকার স্থাপত্য। দারুণ সব নকশা। তবে দীর্ঘদিন অযত্ন-অবহেলায় পরিত্যক্ত হয়ে উঠেছিল। এর পর ইউএনও মিনহাজুল সাহেবের তৎপরতায় জমিদারবাড়িটি সংস্কার করা হয়। যা বর্তমানে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাড়ির সামনে শান বাঁধানো পুকুরটাও বেশ দৃষ্টিনন্দন। পুকুরঘাটেও চলল একচোট আড্ডা। ওদিকে বানিয়াচংয়ের তরুণরা আমাদের অপেক্ষায় প্রায় নির্ঘুম। তাই আড্ডার ছেদ টেনে পৌর কার্যালয়ের ফ্লোরে বেডিং বিছিয়ে কিছুটা সময়ের জন্য সবাই চিতপটাং।

মরিচপোড়া ঘুম দিয়েই সাতসকালে সবাই রেডি। নাশতা সারতেই মাইক্রো চলল। যেতে যেতে বানিয়াচং সড়কে উঠতেই মায়াবী প্রকৃতির  দুই চোখে ধরা দিল। বড় বাজার পৌঁছার আগ পর্যন্ত বারংবার থামতে হলো। আসলে প্রকৃতি আমাদেরকে থামতে বাধ্য করেছে। চোখের সামনে ফুটন্ত লাল শাপলার বিল, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠসহ আরও কত কী! এ রকম সব মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে দেখতেই বড় বাজার পৌঁছে যাই। সেখানে অপেক্ষমাণ স্থানীয় যুবক দিহানের সঙ্গে যৎসামান্য হাই-হ্যালো করেই ছুটলাম হান্নির হাওরে। যেতে যেতে পথে দেখা মিলল শুকিয়ে যাওয়া বিল ঝিল ডোবা নালা থেকে মাছ মারার দৃশ্য। হায়রে মাছ! মাছ আর মাছ। কত পদের যে মাছ! শহুরে বাজারগুলোতে এখন না আসা বিলুপ্তপ্রায় বিভিন্ন জাতের মাছেরও দেখা পেলাম। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গাড়ি হান্নির হাওরে পৌঁছে যায়। দৃষ্টির সীমা ছাড়িয়ে যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি। মাঝে মধ্যে দু-একটা গ্রাম মাথা উঁচু করে একপায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাতটা এখানেই কাটাব। তাই যার যার দায়িত্ব অনুযায়ী কেউ তাঁবু গাড়তে লাগল, কেউবা বাজার-সদাই লেখার লিস্ট করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।

এরই মধ্যেই রাতভর মাছ মারতে যাওয়া জেলেরা, নৌকাভর্তি মাছ নিয়ে ফিরতে শুরু করেছে। মাছের প্রাচুর্য দেখে চোখ আমাদের কপালে। নামমাত্র মূল্যে হরেক পদের মাছ কিনি। বোয়াল মাছের কেজি মাত্র ৩৫০ টাকা। সঙ্গে কাইক্কা, পুঁটি ফ্রি। মজার মজার মাছ খেতে চাইলে আর কেন দেরি! মাছ, কাঁচাবাজার ও রাত্রি নিবাসের তাঁবু টানানো শেষ।

যাই এবার লক্ষ্মী বাঁওড়। মাদ্দের বিলের গাঙ পাড়ি দিয়ে হাঁটা শুরু করি  হাওড়ের বুক চিরে। দেশি গরুর পিছু পিছু, কখনো-বা আবার মাছ ধরার ফাঁদে চোখ বুলাতে বুলাতে কোমরসমান পানি কেটে গিয়ে পৌঁছাই লক্ষ্মী বাঁওড়ের প্রান্তরে। যতই ভিতরে যেতে থাকি, ততই মুগ্ধতা ভর করতে থাকে। হিজল-কড়ই গাছের ছড়াছড়ি। গাছগুলোর আকার-আকৃতি অনেকটাই রাতারগুলের পরিবেশ লক্ষ্মী বাঁওড়ে ভর করেছে। হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে মেছো বিড়ালের পায়ের ছাপ। বর্ষায় পানি থাকে টইটুম্বর।

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ মিঠাপানির জলাবন। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে প্রায় সমান। এই বনের আয়তন সাড়ে তিন কিলোমিটার। আকার ও আয়তনে লক্ষ্মী বাঁওড় রাতারগুলের চেয়েও অনেক বড়। পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে পারলে দেশ-বিদেশের প্রচুর ভ্রমণপিপাসুর সমাগম হবে নিশ্চিত। পেটে টান পড়তেই চলে যাই অস্থায়ী নিবাস নূরপুর। মৎস্যজীবীদের বাবুর্চি আমাদের করা বাজার দিয়ে আগেভাগেই রান্নাটা সেরে রেখেছিলেন। এসেই শুধু গপাগপ ভাতের লোকমা। কাইক্কা মাছের ভুনা এতটাই জোশ ছিল যে, অন্যান্য মাছের তরকারির স্বাদ পুরাই ম্লান।

সময় কম। খেয়েদেয়েই ছুটলাম কমলা রানীর দীঘি। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে যাই দীঘির প্রান্তরে। প্রথম দেখায় ভালো না লাগলেও কাছাকাছি যাওয়ার পর বিস্মিত হই এর সৌন্দর্যে। নীলাভ পানি। আসমানের রঙ আর পানির রঙ মিলেমিশে একাকার। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দীঘি। সাগরদীঘি নামেও এর পরিচিতি রয়েছে।

 
দ্বাদশ শতাব্দীতে রাজা পদ্মনাভ প্রজাদের পানির কষ্ট লাঘবের জন্য গ্রামের মধ্যভাগ দিয়ে দীঘিটি খনন করান। কিন্তু খননের পর পানি না ওঠায় রাজা চিন্তিত হয়ে পড়েন। একদা রাতে রাজার স্ত্রী রানী কমলাবতী স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে আত্মবিসর্জন দেন বলে এই অঞ্চলে জনশ্রুতি রয়েছে। এই দীঘির পাড়ে বসে পল্লীকবি জসীম উদদীন রানী কমলাবতীর দীঘি নামক একটি কবিতা লিখেছিলেন।

সূর্য হেলে পড়েছে। যাই এবার বানিয়াচং রাজবাড়ি। বর্তমানে রাজবাড়ির উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো ইমারত অবশিষ্ট নেই। যাও একটি ঘর রয়েছে, সেটাও থাকে তালাবদ্ধ। তবে বাড়ির উঠোনটা বেশ চমৎকার। রাজা গোবিন্দ সিংহ বানিয়াচং রাজ্যের অধিপতি হওয়ার পর এই বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছিল। চারপাশ ভর করে সন্ধ্যা এলো নেমে। মাগরিব আদায় করেই ফিরলাম তাঁবুতে।

ভাটিয়ালি গানের আসর বসল নাজমুলের তত্ত্বাবধানে। কিন্তু আকাশে জ্বলজ্বল করা তারার মেলা আমাদেরকে সেদিকেই বেশি আকৃষ্ট করে।  হাওড়ের প্রান্তরে নিঝুম এক পরিবেশে গাড়া তাঁবুতে বেশ একটা ফুরফুরে ঘুম দিয়ে, সুবহে সাদিকের অপার্থিব ও নজরকাড়া সৌন্দর্যের স্মৃতি নিয়ে ঢাকার পথ ধরি। 

কীভাবে যাবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ হতে সরাসরি হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং বাস সার্ভিস রয়েছে।

থাকা-খাওয়া
সুবিধামতো স্থানে তাঁবু টানিয়ে অথবা বানিয়াচং বাজারে থাকা-খাওয়ার হোটেল রয়েছে।

কলি

কার্তাহেনাতে ফুর্তি

প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:০৮ পিএম
কার্তাহেনাতে ফুর্তি
ছবি: লেখক

কলম্বিয়াতে এবার দ্বিতীয়বারের মতো আসা। দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর উপকূলে, ক্যারিবিয়ান সাগরের তীরে জ্বলজ্বলে রত্নের মতো ছোট শহর কার্তাহেনা। এয়ারপোর্টে সময় লেগে গেল বেশ খানিক, ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়েই দেশের কথা ভাবছি। দেশে এয়ারপোর্টে নামলেই ইমিগ্রেশনটাকে একটা যন্ত্রণা বলে মনে হয়।

এখন কার্তাহেনার লম্বা ধীরগতি সম্পন্ন ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়িয়ে ঢাকার যন্ত্রণাকে আর যন্ত্রণা মনে হচ্ছে না। এয়ারপোর্টে নেমে এ ধরনের যন্ত্রণা আর অভিজ্ঞতা ভ্রমণেরই অংশ। কাজেই হা হুতাশ না করে সেটাকেও কোনো একভাবে উপভোগ করছি। ইমিগ্রেশনে যারা কাজ করেছে তাদের জেনেটিক পরীক্ষা করা হলে আমি নিশ্চিত কচ্ছপের জিন পাওয়া যাবে। পৃথিবীটাকে দেখা, অন্য প্রান্তে মানুষের জীবনটাকে একটু কাছ থেকে দেখা। 

জীবনে কখনো জন্মবার্ষিকী পালন করা হয়নি, এই প্রথম ফুর্তি করতে ইচ্ছা হচ্ছে। শারমিন, আমার এয়ার ফোর্স ওয়ান (ফার্স্ট প্রায়োরিটি), সেও চাচ্ছে ইচ্ছামতো ফুর্তি করি। আর ফুর্তি হবে বলেই কার্তাহেনাতে আসা। বলতে গেলে কার্তাহেনা দক্ষিণ আমেরিকার ব্যাংকক।

এখন বছরের প্রায় শেষ সময়, বড়দিন সামনে, শহর আলোকিত, আনন্দের শ্রেষ্ঠ সময় এখনই। প্রায় সপ্তাহখানেকের জন্য এসেছি আমরা, খাবদাব, হাঁটব, মানুষ দেখব, শহরের আলো এসে পড়বে গায়ে– এই তো ভ্রমণ। আমার পঞ্চাশে যুক্ত হলো কার্তাহেনার নাম, অস্বীকার করা ঠিক হবে না, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একগাদা ফুর্তি। এখন থেকেই ঠিক করে ফেললাম, বাকিটা জীবন ফুর্তি করেই কাটিয়ে দেব। কী আছে দুনিয়ায়! এখানে ‘ফুর্তি’ শব্দটার অর্থ একটু পরিষ্কার করে বলি, নয়তো অনেকেই ভাববে ফুর্তি মানেই লাফালাফি, ফালাফালি, পার্টি, হিহি-হাহা টাইপ কাজকর্ম। আমি এখানে ফুর্তি বলতে যা বলি তা হলো অনেকটা এরকম, ভালো থাকা, দুশ্চিন্তার বাইরে চলে যাওয়া, সবকিছুতেই অংশ নেওয়া, কিন্তু গা না মাখানো। কোনো কষ্ট যাতে ছুঁয়ে যেতে না পারে। চারপাশে হচ্ছে, যা হওয়ার, হোক, আমার ভেতর থাকবে ফুর্তিতে।

কলম্বিয়ার কার্তাহেনা প্রাণবন্ত শহর ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য এক স্বপ্নের গন্তব্য। এসে দেখে যাও ঔপনিবেশিক ইতিহাসের গল্প, প্রাণচঞ্চল জীবন, এবং নীল সমুদ্রের নিরন্তর ডাক।

কার্তাহেনা পুরোনো শহর, সে যেন সময়কে ধরে রেখেছে। শহরের রঙিন বাড়ি, সংকীর্ণ পথ এবং প্রাচীন প্রাসাদগুলো স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক শাসনের এক নিখুঁত চিত্র। পুরোনো শহরের চত্বরে বসে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে দেখা যায় ব্যস্ত জীবন পাশ কেটে যায় পলকে।

রাতের কার্তাহেনা আলোতে ছোঁয়া, অলিগলি, হাঁটা পথ, মানুষের সমাগম। রাস্তাগুলোতে ফুটে ওঠে জীবনের উচ্ছ্বাস। গেটসেমানি এলাকায় দেয়ালচিত্রের (স্ট্রিট আর্ট) মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বোঝা যায়, শিল্প এখানে জীবনেরই আরেকটি ভাষা।

শহরের আধুনিক দিক দেখতে চাইলে যেতে হবে বোকা গ্রান্ডে। এখানে ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের ধারে সারি সারি আধুনিক হোটেল আর রেস্টুরেন্ট। দিনভর সৈকতে রোদ পোহানোর পর সন্ধ্যায় অভিজাত রেস্টুরেন্টগুলোতে সি-ফুডের সঙ্গে স্থানীয় মিউজিকের তালে তালে নাচের আমেজে মেতে উঠে শহর।

পৃথিবীর যেকোনো ভূখণ্ডেই তার বড় সম্পদ সেখানকার মানুষগুলো। কার্তাহেনাতেও তাই, এখানেও মানুষ দরিদ্র অনেক, আছে অভাব-অনটন, তবু মুখে হাসি। আর প্রাণখোলা হাসি বারবার মনে করিয়ে দেয়, ভ্রমণ শুধু স্থান নয়, এ এক মানুষকে জানার গল্প।

কার্তাহেনা শুধু একটি শহর নয়, এটি ইতিহাস, প্রকৃতি, সংস্কৃতি এবং জীবনের এক মেলবন্ধন। কার্তাহেনার ইতিহাস আছে, মানুষ, শিল্প, সংস্কৃতি আছে, আছে আরও বহু কিছু। আমার ক্ষুদ্র সময় এখানে মনে করিয়ে দেয় আমি অর্ধশত বছরে পা ফেলেছি কার্তাহেনাতে। হাতে সময় নেই আর, আরও অনেকটা পথ যেতে হবে, হয়তো যাব, হয়তো থেমে যাবে সব। ঘটুক যা ঘটার। আমার আছে শুধু ‘আজ’, এই নিয়েই থাকব আমি। অতীত ছুঁয়ে দেখার নয়, ভবিষ্যৎ কারও কখনো আসেনি। আমরা যা কিছু, সব এখনই। কাজেই ঘরে বসে থেকে কী লাভ? চল ফুর্তি করি, এর চেয়ে ভালো কিছু নিজেকে উপহার দেওয়া প্রায় অসম্ভব।

 কলি 

প্রকৃতির মায়ায় মারমেইড বিচ রিসোর্ট

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫২ পিএম
প্রকৃতির মায়ায় মারমেইড বিচ রিসোর্ট
ছবি: মারমেইড বিচ রিসোর্ট

কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত, যেখানে সোনালি বালু আর নীল আকাশ মেলে ধরেছে এক অপূর্ব দৃশ্য, সেখানে এমন এক রিসোর্ট রয়েছে, যা আপনাকে এনে দেবে সম্পূর্ণ অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা। শরতের সোনালি রোদের আলিঙ্গনে যখন আমি প্রথম রিসোর্টে প্রবেশ করি, মনে হচ্ছিল যেন একটি পুরনো বইয়ের পাতায় পা রেখেছি। মৃদু-মন্দ সাগরের হাওয়া, সোনালি আভায় ভেসে থাকা বালুকাবেলা, আর চারপাশে অগণিত গাছপালা- এই দৃশ্য যেন কিছুটা কবিতার মতো, যেখানে সময় থেমে গেছে।

মারমেইড বিচ রিসোর্ট, যা মেরিন ড্রাইভ রোডের পাশে পেঁচার দ্বীপের কোনে অবস্থিত, কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্যই নয়, এখানে আসলে এক অনন্য প্রশান্তির ছোঁয়া পাওয়া যায়। শরতের সোনালি রোদ আর মৃদু বাতাসের মাঝে সেখানে দুই রাত কাটিয়ে, মনে হয়েছে সময় যেন থমকে গেছে, আর প্রকৃতি আপনাকে তার আদর-মাখানো গান শুনিয়েছে।
রিসোর্টের কটেজগুলো যেন নিজেই একেকটি ছোট্ট পৃথিবী। বাঁশ আর পুনর্ব্যবহৃত কাঠ দিয়ে তৈরি, কটেজগুলো আধুনিক সুবিধার পাশাপাশি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক নিখুঁত মেলবন্ধন। গাছের ছায়ায় ঘেরা আমার কটেজটি যেন এক পুরনো গল্পের অংশ, যার প্রতিটি কোনে লুকিয়ে ছিল কিছু অজানা রহস্য। খোদাই করা কাঠের দরজা, স্থানীয়ভাবে তৈরি সজ্জা, আর সোনালি আলোয় স্নিগ্ধ লণ্ঠন- সবকিছু যেন আহ্বান জানাচ্ছিল- ‘আর একটু থাকুন, এখানে আরও কিছু মধুর স্মৃতি তৈরি করুন।’

প্রকৃতির সিম্ফনি, পাখির গান আর সমুদ্রের দূরবর্তী আওয়াজ- এখানে সকালের শুরুটা যেন একদম আলাদা। প্রথম সকালে, ঢেউয়ের ছন্দের মাঝে চোখ মেলে দেখলাম সমুদ্রের অপরূপ দৃশ্য। কফির কাপ হাতে, বারান্দায় বসে আমি শুধু তাকিয়ে ছিলাম। শান্ত, মৃদু বাতাস আর সমুদ্রের লবণাক্ত গন্ধে মন যেন আরও বেশি প্রকৃতির সান্নিধ্যে চলে যাচ্ছিল। এক মুহূর্তে, সময় যেন থেমে গিয়েছিল।

কিন্তু মারমেইড বিচ রিসোর্ট শুধুই নিঃসঙ্গতার স্থান নয়। এখানে সক্রিয়তার খোঁজে থাকা মানুষের জন্যও অনেক কিছু আছে। কায়াকিং, সাইকেল রাইডিং, অথবা সৈকতের ধারে পায়ের তলায় বালির অনুভূতি- সবকিছুই অপেক্ষা করছে আপনাকে অভ্যর্থনা জানাতে। এক বিকেলে, আমি সাইকেল নিয়ে রিসোর্টের চারপাশে ঘুরতে বের হই, আর হঠাৎ অনুভব করি, যেন দিগন্তের সীমাহীনতা আমাকে এক নতুন জীবন দেখাচ্ছে। বাতাসের টানে মাথার চুল উড়ছে, আর সমুদ্রের ধারে এই অসীম দৃশ্য মনে হয় যেন কোনো শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা ছবি।

 

রিসোর্টের রেস্তোরাঁর খাবার ছিল এক চমৎকার রন্ধনশিল্পের উদাহরণ। স্থানীয় উপাদান দিয়ে তৈরি প্রতিটি পদ যেন এক নান্দনিক রচনা। এক সন্ধ্যায়, আমি গ্রিলড পমফ্রেট খেয়েছিলাম- এটির ধোঁয়ামাখা গন্ধ, আর ট্যাঞ্জি আম সালসার সঙ্গে তার সমন্বয় ছিল এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। পরের রাতে নারকেল থেকে তৈরি একটি ডিজার্ট খেয়েছিলাম, যা মনে করিয়ে দিয়েছিল- যত সহজই হোক না কেন, আন্তরিকতা দিয়ে প্রস্তুত করা যেকোনো খাবার অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে।

মারমেইড বিচের সন্ধ্যাগুলো যেন এক বিশেষ মায়ায় রঙিন। প্রথম রাতে, সৈকতে লাইভ মিউজিক ছিল, আর আগুনের নরম আলো ছড়ানো ছিল সুরে সুরে। গিটারিস্টের বাজানো সুর যেন তরঙ্গের ধ্বনির সঙ্গে মিলে এক অভূতপূর্ব সংগীত রচনা করছিল। দ্বিতীয় রাতে, পূর্ণিমার আলোতে সৈকতের ধারে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছিল, এ যেন এক অপার্থিব অভিজ্ঞতা। আমার পায়ের তলায় শীতল বালি সমুদ্রের অপরূপ আলোয় চমকাচ্ছিল।

মারমেইড বিচ রিসোর্টের একটি অতিরিক্ত সৌন্দর্য রয়েছে, যা সাধারণত এমন রিসোর্টগুলোর মাঝে দেখা যায় না- এটি পরিবেশবান্ধব একটি রিসোর্ট, যা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে। রিসোর্টের স্থাপত্য নকশা থেকে শুরু করে তার কার্যক্রম পর্যন্ত- সবকিছুতে পরিবেশের সঙ্গে খাপখাইয়ে চলার ছাপ। সৌরশক্তি ব্যবহার করে আলোকসজ্জা, বৃক্ষরোপণ প্রকল্প, আর ইকো-ফ্রেন্ডলি কাঠামো- সবকিছুই রিসোর্টটির পরিবেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে। বিশেষ করে, পেঁচার দ্বীপের সবুজে ঘেরা প্রকৃতি, যা রিসোর্টের একেবারে কাছেই অবস্থিত, তা যেন প্রাণী ও গাছপালার একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে।

আরেকটি দিক যা আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে, তা হলো রিসোর্টের স্থানীয় সম্প্রদায়ের প্রতি দায়বদ্ধতা। অনেক কর্মী এখানকার আশপাশের গ্রাম থেকে আসে এবং রিসোর্টটি স্থানীয় কৃষক ও কারিগরদের সহযোগিতা করে, যা এ ধরনের পর্যটন ব্যবসায় খুবই বিরল। রিসোর্টের সাবান, যা স্থানীয় সমবায় থেকে তৈরি, অথবা আমার সালাদের সবজি, যা মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি খামার থেকে সংগ্রহ করা- এসব প্রমাণ করে যে পর্যটন শুধু আনন্দের জন্য নয়, বরং দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করলে এর মাধ্যমে ব্যবসার পাশাপাশি স্থানীয় ভূমি ও সংস্কৃতিকেও সহযোগিতা করা সম্ভব।

রিসোর্টের শেষ সকালে, যখন আমি সৈকতে বসে সূর্যোদয় দেখছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল, যেন এই স্থানে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তই এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। এটি শুধু একটি থাকার স্থান নয়, বরং এ এক নতুন জীবন যাপনের পদ্ধতি- প্রকৃতির সঙ্গে, নিজের সঙ্গে, আর জীবনের সরল আনন্দের সঙ্গে মেলবন্ধনের জায়গা।

 কলি

বরেন্দ্রভূমিতে একদিন

প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৫৮ পিএম
আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৫৮ পিএম
বরেন্দ্রভূমিতে একদিন
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। ছবি: সংগৃহীত

বরেন্দ্রভূমি আমার কাছে বুকের ভেতর জেগে থাকা একটা জায়গার নাম। এ ভূমির পরতে পরতে মায়ার বিস্তার। এই মায়াপুরে কাটানো দুদিনের গল্প বলব আজ। প্রতিবারই কাকতালীয়ভাবে শীত মৌসুমে রাজশাহী যাওয়া হয় আমার। অন্য মৌসুমে এই জেলা দেখতে কেমন, তা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়নি। এবারেও রাতের ট্রেনে করে চলে গেলাম রাজশাহী; পৌঁছালাম শীতের নরম ভোরে। তখন সুয্যিমামা তার সোনালি আলো ছড়াতে শুরু করেছে। সেই আলো এসে পড়েছে রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের গায়ে। কী যে অপূর্ব সেই সোনামাখা দৃশ্য!

আত্মীয়ের বাসায় উঠে সকালের নাশতা সেরে বিশ্রাম নিলাম কিছুক্ষণ। তার পর রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঘুরতে। প্রথমে গেলাম সদরে অবস্থিত বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে।

প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহের জন্য এ জাদুঘরটি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম। শুধু তাই নয়, এটিই বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর। এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় নাটোরের দিঘাপাতিয়া রাজপরিবারের জমিদার শরৎ কুমার রায়, আইনজীবী অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রামপ্রসাদ চন্দ্রের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে তারা বাংলার ঐতিহ্য ও নিদর্শন সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি গঠন করেন। ওই বছরে তারা রাজশাহীর বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান চালিয়ে ৩২টি দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন সংগ্রহ করেন।

এই নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করার জন্য শরৎ কুমার রায়ের দান করা জমিতে জাদুঘরটির নিজস্ব ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। নির্মাণ শেষ হয় ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে। একই বছরের ১৩ নভেম্বর বাংলার তৎকালীন গভর্নর কারমাইকেল জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন। মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ছাড়াও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি এই জাদুঘরটি পরিদর্শন করেছেন। জাদুঘরটিতে অনেক পুরোনো দিনের নিদর্শন রয়েছে। মহেঞ্জোদারো সভ্যতা থেকে সংগৃহীত প্রত্নতত্ত, পাথরের মূর্তি, খ্রিষ্টীয় একাদশ শতকে নির্মিত বুদ্ধমূর্তি, গঙ্গামূর্তিসহ অসংখ্য মূর্তি এই জাদুঘরের অমূল্য সংগ্রহের অন্তর্ভুক্ত। মোগল আমলের রৌপ্য মুদ্রা, গুপ্তসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের গোলাকার স্বর্ণমুদ্রা, সম্রাট শাহজাহানের গোলাকার রৌপ্য মুদ্রাও রয়েছে সংগ্রহে। এখানে প্রায় ৫,০০০ পুঁথি রয়েছে, যার মধ্যে ৩,৬৪৬টি সংস্কৃত আর বাকিগুলো বাংলায় রচিত।

কালো পাথরের মূর্তি

জাদুঘর দেখা শেষ করে গেলাম টি-বাঁধে। পেয়ারা মাখা খেয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর চলে গেলাম রুয়েটে। রুয়েট আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পাশাপাশি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাজ্জাদের লেবুচুরের বেশ সুনাম রয়েছে। তাই রুয়েট থেকে গেলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেবুচুর খেতে এবং তা খেয়ে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা আর বধ্যভূমি দেখে মন খুব ভার হয়ে গেল। সংগ্রহশালা দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে উঠেছিল জলে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল প্রায়। প্রথম দিনের ঘোরাঘুরি এভাবেই শেষ হলো।

দ্বিতীয় দিনের ভ্রমণটা ছিল সবচেয়ে স্মরণীয়। আমার ইচ্ছে ছিল, রাজশাহীর কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে গরুর গাড়িতে চড়ব। হারিকেন জ্বালিয়ে ঝুলিয়ে দিব সেই গাড়িতে। আর সরিষাখেতের পাশে বসে মাটির সানকিতে করে খিচুড়ি খাব। আমার ইচ্ছে পূরণ করতে কিছু মাটির সানকি কেনা হলো। খুঁজে খুঁজে গরুর গাড়ি না পেয়ে মহিষের গাড়ি জোগাড় করা হলো। একটা হারিকেনের বন্দোবস্তও করা হলো। শুধু তাই নয়, আমার জন্য ভাপা পিঠাও বানানো হলো। আর খিচুড়ির সঙ্গে মুরগির মাংস, বেগুন ভাজা, ডিম ভাজা এসবের আয়োজন করা হলো। আমি ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম আমার ইচ্ছে পূরণে কাছের মানুষগুলোর এই কর্মযজ্ঞ দেখে।

প্রাইভেট কারে প্রথমে রাজশাহীর পবা উপজেলার এক গ্রামে গেলাম। খুব প্রত্যন্ত না হলেও খাঁটি গ্রাম বলা যায় অবশ্যই। গ্রামের নাম ভুগরইল। প্রথমে সরিষাখেতের পাশে বসে খিচুড়ি খেলাম আয়েশ করে। তখন বিকেল বেলা। এরপর ঠিক করে রাখা মহিষের গাড়িতে উঠে বসলাম। ফসলের মাঠের আলপথ ধরে যাচ্ছিলাম আর মুগ্ধচিত্তে অনুভব ঘনিয়ে এলে হারিকেন জ্বালানো হলো। সূর্য ডুবে গেল, অন্ধকার গাঢ় হতে লাগল। সবুজ ফসলের মাঠে ছন্নছাড়া অন্ধকার খেলা করতে শুরু করল রাত নামাবে বলে। জীবনে এত অভূতপূর্ব মুহূর্ত বারবার আসে না।

এক আকাশ স্বপ্ন পূরণের উচ্ছ্বলতা নিয়ে ফিরে এলাম রাজশাহী শহরে। সিঅ্যান্ডবি মোড়ে এক লেখকের সঙ্গে দেখা করে শিক কাবাবের বার্গার খেলাম আর কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে এবারের রাজশাহী ভ্রমণের সমাপ্তি টানলাম।

রাজশাহীতে আরও যা যা দেখার আছে
রাজশাহী সদরে আছে জিয়া শিশুপার্ক, পদ্মা গার্ডেন, মুক্তমঞ্চ, শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী পার্ক বা সেন্ট্রাল পার্ক। পবা উপজেলায় আছে শাহ্ মখদুম বিমানবন্দর, গরু-মহিষের বাজার, হস্তশিল্পপল্লী। পুঠিয়া উপজেলায় আছে পুঠিয়া রাজবাড়ি, রাজবাড়িসংলগ্ন একাধিক মন্দির, দোল মন্দির, হাওয়াখানা। মোহনপুর উপজেলায় আছে পানের বরজ। তানোর উপজেলায় আছে চোলকুরের জমিদারবাড়ি, কিশোর মোহন চৌধুরী জমিদারবাড়ির শত বছরের শিবমন্দির, সাঁওতালপল্লী, গরু-মহিষের গাড়ি, কামার-কুমারপল্লী, বাঁশের হস্তশিল্পপল্লী, নাইস গার্ডেন পার্ক। চারঘাট উপজেলায় আছে সারদা ক্যাডেট কলেজ, সারদা পুলিশ একাডেমি, হাজার বছরের পুরোনো বৃক্ষ, সরদহ রেলওয়ে স্টেশন, তাঁতপল্লী, নীলকুঠি, খয়ের প্রস্তুতকরণ এলাকা। গোদাগাড়ি উপজেলায় আছে বরেন্দ্র পার্ক, সাফিনা পার্ক, সরমংলা ইকোপার্ক, মৃৎপল্লী, সাঁওতালপল্লী, গরু-মহিষের গাড়ি, ধানসিঁড়ি খেত। বাগমারা উপজেলায় আছে হাজার দুয়ারী জমিদারবাড়ি (বীরকুৎসা নামেও পরিচিত), তাহেরপুর রাজবাড়ি, গোয়ালকান্দি জমিদারবাড়ি। বাঘা উপজেলায় আছে বাঘা শাহী মসজিদ ও তৎসংলগ্ন বাঘা দীঘি, উৎসব পার্ক, বাঘা জাদুঘর, বাঘা দরগাহ শরিফ ইত্যাদি।

কীভাবে যাবেন
ঢাকার কল্যাণপুর থেকে বাসে যেতে পারেন। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে যেতে পারেন। বিমানেও যেতে পারবেন রয়েছে এই সুন্দর শহরে।

কী খাবেন
কালাভুনা, সিঅ্যান্ডবি মোড়ের গরম মিষ্টি, বট পরোটা, বীরেন রেস্তোরাঁর কলিজা সিঙ্গারা, খাসির মাংসের চপ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাজ্জাদের লেবুচুর, টি-বাঁধের পেয়ারা ও আচার মাখা, শিক কাবাবের বার্গার, নবরূপা আর মৌচাকের মিষ্টি এবং আম।

কোথায় থাকবেন
রাজশাহী শহরেই থাকার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট হোটেল রয়েছে।

 কলি 

থামেলের দিনরাত্রি

প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৪১ পিএম
আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৪২ পিএম
থামেলের দিনরাত্রি
থামেল বাজার কাঠমান্ডু। ছবি: সংগৃহীত

ঘড়ির কাঁটায় বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টা বেজে ১৫ মিনিট আর নেপাল সময় দুপুর ১টা, আমরা আছি নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সকালবেলা বাংলাদেশ বিমানের বিজি ৭০৭ চেপে হিমালয়কন্যার কাছে এসেছি। আসার অবশ্য কারণও আছে। আমারা এসেছি নেপাল-বাংলাদেশ ইয়ুথ কনক্লেভের অনুষ্ঠানে।

নেপাল এয়ারপোর্টে আমাদের নেপালের ঐতিহ্যবাহী টুপি আর উত্তরীয় দিয়ে বরণ করেন অনুষ্ঠানের প্রধান সমন্বয়ক অভিনব দাদা। আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে আরও অনেকেই উড়াল দিয়ে এসেছেন এই আয়োজনে অংশ নিতে। আমরা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হলাম। মোবাইলের সিম কিনলাম এয়ারপোর্ট থেকেই। আনুষঙ্গিক সব কাজ শেষ করে এবার আমরা চেপে বসলাম চার চাকার বাহনে। সূর্যদেবের উষ্ণ অভ্যর্থনা আমাদের বেশ ভালোই লাগছিল। আমরা আসার আগে ভেবেছিলাম খুব ঠাণ্ডা পরে হয়তো নেপালে তবে এতটা ঠাণ্ডা অনুভূত হলো না। আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের হোটেল পানে। চলতি পথে আমাদের দেশের মতো রাস্তায় যানজটের দেখা পেলাম।

ধীরগতিতে চলছিল আমাদের চার চাকার বাহন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা চলে এলাম থামেলের প্রান্তে। থামেল জায়গাটি আমাদের শাঁখারীবাজার বা লক্ষ্মীবাজারের মতোই। বলা যায় যেকোনো পুরোনো জেলা শহরের বড় বাজার এলাকাটি যেমন, তেমনই। কিন্তু অনেক কালারফুল। পথে পর্যটকে ঠাসা। দেখে মনে হলো অধিকাংশই পশ্চিমা। ছোট ছোট দোকানঘর। হরেক রকম পসরা সাজানো। আমি এক দৃষ্টিতে গাড়ির বাইরে তাকিয়েছিলাম। অনুভব করছিলাম থামেল শহরের স্পন্দন। বেশির ভাগ হস্তশিল্পের জিনিস।

পিতলের, তামা, পাথর, মাটি, শোলা, কাঠ বিভিন্ন সহজলভ্য উপাদানে তৈরি এসব। হাতের নিখুঁত কারুকাজ, রঙের ছটা, তুলির আঁচড়, ঢালাইয়ের পেটা কাজ প্রভৃতি বিভিন্নভাবে শিল্প সৃষ্টি হয়েছে। অভিনব দা ঘোষণা দিলেন আমরা হোটেলের কাছে চলে এসেছি। এখন গাড়ি থেকে নেমে পদব্রজে যেতে হবে সামান্য একটু পথ। আমরা গাড়ি থেকে নেমে গলির পথে এগিয়ে চললাম। গলির ভেতরে ছোট ছোট দোকান যার বেশির ভাগই নারীরা পরিচালনা করছেন। আমরা প্রবেশ করলাম সাতকার হোটেল অ্যান্ড স্পা’তে। প্রবেশের পর আমাদের ওয়েলকাম ড্রিংকস পরিবেশন করা হলো। মনে হলো আসল তরমুজের স্বাদ। এরপর আমাদের প্রত্যেকের রুমের চাবি বুঝিয়ে দেওয়া হলো।

পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবকিছুই পাবেন থামেলে।

আমরা অস্থায়ী ডেরায় প্রবেশ করলাম। বেশ ছিমছাম গোছানো। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে বের হলাম দুপুরের পেটপূজার জন্য, যদিও নেপাল সময় তখন বিকেল ৫টা। আমরা চলে এলাম নেপালি এক খাবার হোটেলে। যার যেমন পছন্দ তেমনি এক:এক মেন্যু অর্ডার করলেন। আমরা নিলাম নেপালি ভেজ থালি। অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের খাবার পরিবেশন করা হলো। এক থালাতেই সব অল্প অল্প করে সাজানো। শাঁক, আলু ভর্তা, ডাল, বরবটি আলু দিয়ে তরকারি, বাদামের তরকারি, আচার, দই। তার ওপর খাঁটি ঘি দিয়ে গেলেন খাবার পরিবেশনকারী। পেটে চলছিল রাম-রাবণের যুদ্ধ, সেই সকাল বেলায় দানাপানি পড়েছিল। তাই আর ভদ্রতা না করে খাওয়া শুরু করলাম। 

খাবার নয়, যেন অমৃত খাচ্ছি। নেপালিদের অথেনটিক খাবারের রেস্টুরেন্ট এটি। নেপালিরা ফ্রেশ রান্না করে, বাসি খাবার রাখে না, উচ্ছিষ্ট খায় না একদমই। বেঁচে যাওয়া খাবার ডিশে থেকে গেলে বা হাতের স্পর্শ ছাড়া বেড়ে নেওয়া হলে তা-ও উচ্ছিষ্ট বলে ধরে নেন। এজন্য খাবার আসতে সবখানেই সময় লাগে একটু বেশি। একদল পরিকল্পনা করল নাগরকোট যাবে, কেউ যাবে আবার চন্দ্রা গিরি হিল। পেটপূজা শেষ করে আমরা বের হয়ে পড়লাম থামেলের পথে প্রান্তরে। সূর্যদেব তখন অস্তাচলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সন্ধ্যা ক্রম আসন্ন। পাহাড়ের উপত্যকার শহর। রাত নামে দ্রুত, শহর ঘুমিয়ে পড়ে আগে আগে। যখন জেগে ওঠে অন্যরকম আরেকটি শহর। আমরা পদব্রজে এগিয়ে চলছি। থামেলের পথে প্রান্তরে বিভিন্ন ধরনের দোকানের দেখা পাওয়া যায়।

কেউ ঠাণ্ডার কাপড় বিক্রি করছেন, কেউবা পিতলের সামগ্রী, কেউ আবার হিমালয় ট্র্যাকিং করার সামগ্রী আবার কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের চা। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবকিছুই পাবেন এই থামেলে। আমরা একটি দোকানে প্রবেশ করলাম। দোকানে গৃহসজ্জার সামগ্রী বিক্রি হয়, সবই পিতলের। কিছু নিকেল করা। আমাদের দেশের এলিফ্যান্ট রোডের পিতলের দোকানগুলোর মতোই। অসাধারণ কারুকাজ দেখলেই কিনতে মনে চাইছিল। পরে ভাবলাম আরেকটু দেখি অন্য দোকান আরও ভালো কিছু পাব হয়তো। আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম পরের দোকানের দিকে।

এবার একটি মেডিটেশন বোল দেখে চোখ আটকে গেল। মেডিটেশন বোলের শব্দ আপনাকে নিয়ে যাবে এক অন্য ভুবনে। দামাদামি করে কিনে নিলাম। রাতের গভীরতা বাড়ছে পাহাড়ের উপত্যকার শহরে। রাতের গভীরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে থামেলের চিত্র পরিবর্তিত হতে লাগল। তখন সে এক অন্য থামেল। বিদেশিদের আনাগোনা বাড়ছে।

পাব ও নাইট ক্লাব খুলে গেছে। ক্লাবগুলোর বাইরে মানুষের ভিড়। মিউজিকের উত্তাল তরঙ্গে যে কাউকেই ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। থামেল শহরের পুরোনো অংশ। ঘরবাড়ি অধিকাংশই পুরোনো। আমাদের জমিদার বাড়িগুলোর মতো। ভবনগুলোর প্রধান দরজা কাঠের, নকশা করা। মনে হয় একেকটি রাজবাড়ির প্রবেশদ্বার। এরই রেপ্লিকা স্বর্গের দরজা নামে এখানকার দোকানে বিক্রি হয়। স্থানে স্থানে সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের রঙিন কাগজ বা পলিমার দড়িতে টাঙানো।

কোনো কোনোখানে এর সঙ্গে মরিচবাতি দেওয়া। ছবি বিক্রির দোকানের সামনে গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম। বেশির ভাগ ছবিই হিমালয়, হিমালয়ের পাদদেশে জনজীবন, বুদ্ধদেব ও বুদ্ধচক্রের। হিমালয়ে সূর্যোদয়, পাহাড়ে চমরি গাইয়ের দল, পাহাড়ি পরিশ্রমী মানুষের ঋজু চেহারা, তাদের জীবিকার সুকঠিন সংগ্রামের ছবি…। এই শহরে পর্যটকের অভাব নেই। বিশেষ করে থামেলে তো বিদেশিই বেশি। সেই বিদেশি পর্যটকের মধ্যে তরুণী, বৃদ্ধা, সুন্দরী, অসুন্দরী সব রকম নারীই আছেন। পোশাকও তাদের বিচিত্র রকম। 

কীভাবে যাবেন
বাংলাদেশ থেকে নেপালে বিমানযোগে যাওয়া যায়। যাওয়া-আসার টিকিট নিয়ে ১৮ থেকে ২২ হাজার টাকার মতো খরচ পড়বে। আগে টিকিট কাটতে পারলে ১৭ হাজার টাকার মতো হতে পারে। বাই রোডে নেপাল যেতে হলে খরচ কমে যাবে অনেকটা। সেক্ষেত্রে ভারতের ট্রানজিট ভিসা নিতে হবে যেখানে পোর্টের নাম দিতে হবে চ্যাংরাবান্ধা বা রানীগঞ্জ। এখানে বা বিমানে কোনোটাতেই নেপালের ইমিগ্রেশনে কোনো ভিসা ফি’র দরকার নেই যদিনা আপনি একই বছরে দুবার ভ্রমণ করতে চান। এসআর পরিবহন সরাসরি বাই রোডে নেপালের বাসের সেবা দিচ্ছে। চাইলে ভেঙে ভেঙে ভারতের বর্ডার পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে নেপালের কাঁকড়ভিটা পর্যন্ত যেতে পারেন। এতে খরচ পড়বে প্রায় ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকার মতো।

কোথায় থাকবেন
থাকতে হলে থামেলের চেয়ে উপযুক্ত স্থান আর দ্বিতীয়টি নেই। কারণ, পুরো থামেলের গলি-ঘুপচিতে অসংখ্য হোটেল/ব্যাকপ্যাকার হোস্টেল রয়েছে। ১০০০ থেকে ১৮০০ রুপির মধ্যে ভালো ডাবল রুমের বাজেট হোটেল এখানে পাওয়া সম্ভব। ৪০০ রুপিতে সিঙ্গেল রুমের হোটেলও এখানে আছে। বাজেট আরেকটু বেশি যেমন ৩০০০ রুপি বা তার বেশি হলে ডিলাক্স রুমের খাবারসহ অনেক ভালো হোটেল পাওয়া যায়। তবে থামেলের হোটেল এবং তাদের দরদাম ও চেহারা এত বেশি বৈচিত্র্যময় যে, আগে থেকে বুকিং না দিয়ে বরং হেঁটে ঘুরে কয়েকটি হোটেল ঘুরে যাচাই-বাছাই করলে সস্তায় ভালো হোটেল পাওয়া সম্ভব।

 কলি