
কলম্বিয়াতে এবার দ্বিতীয়বারের মতো আসা। দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর উপকূলে, ক্যারিবিয়ান সাগরের তীরে জ্বলজ্বলে রত্নের মতো ছোট শহর কার্তাহেনা। এয়ারপোর্টে সময় লেগে গেল বেশ খানিক, ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়েই দেশের কথা ভাবছি। দেশে এয়ারপোর্টে নামলেই ইমিগ্রেশনটাকে একটা যন্ত্রণা বলে মনে হয়।
এখন কার্তাহেনার লম্বা ধীরগতি সম্পন্ন ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়িয়ে ঢাকার যন্ত্রণাকে আর যন্ত্রণা মনে হচ্ছে না। এয়ারপোর্টে নেমে এ ধরনের যন্ত্রণা আর অভিজ্ঞতা ভ্রমণেরই অংশ। কাজেই হা হুতাশ না করে সেটাকেও কোনো একভাবে উপভোগ করছি। ইমিগ্রেশনে যারা কাজ করেছে তাদের জেনেটিক পরীক্ষা করা হলে আমি নিশ্চিত কচ্ছপের জিন পাওয়া যাবে। পৃথিবীটাকে দেখা, অন্য প্রান্তে মানুষের জীবনটাকে একটু কাছ থেকে দেখা।
জীবনে কখনো জন্মবার্ষিকী পালন করা হয়নি, এই প্রথম ফুর্তি করতে ইচ্ছা হচ্ছে। শারমিন, আমার এয়ার ফোর্স ওয়ান (ফার্স্ট প্রায়োরিটি), সেও চাচ্ছে ইচ্ছামতো ফুর্তি করি। আর ফুর্তি হবে বলেই কার্তাহেনাতে আসা। বলতে গেলে কার্তাহেনা দক্ষিণ আমেরিকার ব্যাংকক।
এখন বছরের প্রায় শেষ সময়, বড়দিন সামনে, শহর আলোকিত, আনন্দের শ্রেষ্ঠ সময় এখনই। প্রায় সপ্তাহখানেকের জন্য এসেছি আমরা, খাবদাব, হাঁটব, মানুষ দেখব, শহরের আলো এসে পড়বে গায়ে– এই তো ভ্রমণ। আমার পঞ্চাশে যুক্ত হলো কার্তাহেনার নাম, অস্বীকার করা ঠিক হবে না, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একগাদা ফুর্তি। এখন থেকেই ঠিক করে ফেললাম, বাকিটা জীবন ফুর্তি করেই কাটিয়ে দেব। কী আছে দুনিয়ায়! এখানে ‘ফুর্তি’ শব্দটার অর্থ একটু পরিষ্কার করে বলি, নয়তো অনেকেই ভাববে ফুর্তি মানেই লাফালাফি, ফালাফালি, পার্টি, হিহি-হাহা টাইপ কাজকর্ম। আমি এখানে ফুর্তি বলতে যা বলি তা হলো অনেকটা এরকম, ভালো থাকা, দুশ্চিন্তার বাইরে চলে যাওয়া, সবকিছুতেই অংশ নেওয়া, কিন্তু গা না মাখানো। কোনো কষ্ট যাতে ছুঁয়ে যেতে না পারে। চারপাশে হচ্ছে, যা হওয়ার, হোক, আমার ভেতর থাকবে ফুর্তিতে।
কলম্বিয়ার কার্তাহেনা প্রাণবন্ত শহর ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য এক স্বপ্নের গন্তব্য। এসে দেখে যাও ঔপনিবেশিক ইতিহাসের গল্প, প্রাণচঞ্চল জীবন, এবং নীল সমুদ্রের নিরন্তর ডাক।
কার্তাহেনা পুরোনো শহর, সে যেন সময়কে ধরে রেখেছে। শহরের রঙিন বাড়ি, সংকীর্ণ পথ এবং প্রাচীন প্রাসাদগুলো স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক শাসনের এক নিখুঁত চিত্র। পুরোনো শহরের চত্বরে বসে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে দেখা যায় ব্যস্ত জীবন পাশ কেটে যায় পলকে।
রাতের কার্তাহেনা আলোতে ছোঁয়া, অলিগলি, হাঁটা পথ, মানুষের সমাগম। রাস্তাগুলোতে ফুটে ওঠে জীবনের উচ্ছ্বাস। গেটসেমানি এলাকায় দেয়ালচিত্রের (স্ট্রিট আর্ট) মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বোঝা যায়, শিল্প এখানে জীবনেরই আরেকটি ভাষা।
শহরের আধুনিক দিক দেখতে চাইলে যেতে হবে বোকা গ্রান্ডে। এখানে ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের ধারে সারি সারি আধুনিক হোটেল আর রেস্টুরেন্ট। দিনভর সৈকতে রোদ পোহানোর পর সন্ধ্যায় অভিজাত রেস্টুরেন্টগুলোতে সি-ফুডের সঙ্গে স্থানীয় মিউজিকের তালে তালে নাচের আমেজে মেতে উঠে শহর।
পৃথিবীর যেকোনো ভূখণ্ডেই তার বড় সম্পদ সেখানকার মানুষগুলো। কার্তাহেনাতেও তাই, এখানেও মানুষ দরিদ্র অনেক, আছে অভাব-অনটন, তবু মুখে হাসি। আর প্রাণখোলা হাসি বারবার মনে করিয়ে দেয়, ভ্রমণ শুধু স্থান নয়, এ এক মানুষকে জানার গল্প।
কার্তাহেনা শুধু একটি শহর নয়, এটি ইতিহাস, প্রকৃতি, সংস্কৃতি এবং জীবনের এক মেলবন্ধন। কার্তাহেনার ইতিহাস আছে, মানুষ, শিল্প, সংস্কৃতি আছে, আছে আরও বহু কিছু। আমার ক্ষুদ্র সময় এখানে মনে করিয়ে দেয় আমি অর্ধশত বছরে পা ফেলেছি কার্তাহেনাতে। হাতে সময় নেই আর, আরও অনেকটা পথ যেতে হবে, হয়তো যাব, হয়তো থেমে যাবে সব। ঘটুক যা ঘটার। আমার আছে শুধু ‘আজ’, এই নিয়েই থাকব আমি। অতীত ছুঁয়ে দেখার নয়, ভবিষ্যৎ কারও কখনো আসেনি। আমরা যা কিছু, সব এখনই। কাজেই ঘরে বসে থেকে কী লাভ? চল ফুর্তি করি, এর চেয়ে ভালো কিছু নিজেকে উপহার দেওয়া প্রায় অসম্ভব।
কলি