জাঁকজমকপূর্ণ কোনো সাজসজ্জা নেই, নেই কোনো সাইনবোর্ডও। দোকানটি রাজশাহী নগরীর বাটার মোড় এলাকায় বলে এ দোকানের জিলাপির নাম হয়ে গেছে ‘বাটার মোড়ের জিলাপি’। স্বাদে-গুণে অনন্য ও রসে ভরা মুচমুচে এই জিলাপি সুদীর্ঘ ৬৪ বছর ধরে ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। ফলে নামহীন এই দোকানে সারা বছরই ভিড় লেগে থাকে। রমজানে ইফতারের জন্য এই ভিড় কয়েক গুণ বেড়েছে। ফলে ছোট্ট দোকানটির ভেতরে গিজগিজ করে মানুষ। গরম গরম জিলাপি তোলার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে যায়। কড়াই থেকে জিলাপি তোলার ফুরসত পাচ্ছেন না কারিগররা। ক্রেতা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
জানা যায়, রাজশাহীতে এ জিলাপির দোকানের যাত্রা ১৯৬০ সালে। ব্যবসা শুরু করেন সোয়েব উদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ী। তখন থেকেই ধীরে ধীরে প্রচলিত হতে থাকে এ জিলাপি। তখন দোকানটির নাম ছিল রানীবাজার রেস্টুরেন্ট। সাইনবোর্ড নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর আর সাইনবোর্ডের দরকার পড়েনি। বাটার মোড়ের জিলাপি নামেই পরিচিতি পায় দোকানটি। তখন এই দোকানের একমাত্র কারিগর ছিলেন যামিনী সাহা। পরে যামিনী সাহার কাছ থেকে জিলাপি বানানো শেখেন তার ছেলে কালিপদ সাহা। ১৯৮০ সালে বাবার মৃত্যুর পর প্রধান কারিগর হন কালিপদ সাহা। কালিপদের হাতে তৈরি এই জিলাপি একসময় রাজশাহী শহরের মানুষের কাছে ‘কালিবাবু’ নামেও পরিচিত হয়ে ওঠে। কালিপদ সাহা মারা যান ২০১৭ সালে। এখন তার দুই শিষ্য সাফাত আলী ও শফিকুল ইসলাম জিলাপি বানাচ্ছেন।
২০০২ সালে সোয়েব উদ্দিনের মৃত্যুর পর তার চার ছেলে সোহেল, শামীম, নাইট ও এমরান আলী নাহিদ বাবার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটির হাল ধরেন। স্বাধীনতার পর রাজশাহী ছিল পদ্মা নদীবিধৌত একটি ছোট্ট শহরের নাম। সেই শহর কালের পরিবর্তনে এখন পরিণত হয়েছে মহানগরে। কিন্তু শহরের পুরোনো সেই জিলাপির ঐতিহ্য আছে আগের মতোই।
সরেজমিনে দেখা যায়, রমজানে সেই জিলাপির চাহিদা বেড়ে যায়। রোজাদারদের কাছে ইফতারে অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে ‘বাটার মোড়ের জিলাপি’। সম্পূর্ণ কেমিক্যালমুক্ত ও কোনো প্রকার রং ছাড়াই আড়াই প্যাঁচের জিলাপি তৈরি হয় বলে প্রতিদিনের ইফতারের সময় ক্রেতাদের মন টানে। ফলে ছোট্ট দোকানটিতে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা গেছে।
কথা হয় নগরের শিরোইল এলাকা থেকে জিলাপি কিনতে আসা হাসনাত আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘স্বাদ ও ঐতিহ্য মিলেমিশে আছে এই জিলাপিতে। তাই প্রতিবছরই ইফতারের জন্য জিলাপি এখান থেকেই কিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার বয়স এখন ৬০। ৩০ বছর বয়স থেকে এই জিলাপি খেয়ে আসছি। এখন ডায়াবেটিসের ভয়ে কম খাই। কিন্তু ইফতারে এই জিলাপি থাকাই লাগে। তা না হলে মনে হয় ইফতারিটা পরিপূর্ণ হলো না।’
বর্তমানে দোকানের মালিকানায় সোয়েব উদ্দিনের ছেলেরা। তাদের মধ্যে দোকানটি দেখাশোনা করেন মো. শামীম। তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দাম বাড়ানো হলেও মান ধরে রাখা হয়েছে। গত বছর রোজার সময়েও ১৮০ টাকা কেজিদরে জিলাপি বিক্রি হয়েছে। এখন প্রতি কেজির দাম ২০০ টাকা রাখা হচ্ছে। কারণ জিলাপি তৈরির সব উপাদানের দামই বেড়ে গেছে। তবে কারিগররা মান ধরে রেখে বছরের পর বছর জিলাপি তৈরি করে আসছেন। স্বাদেও কোনো হেরফের নেই। তাই সাধারণ সময়ে দোকানটিতে দিনে ৮০ থেকে ৯০ কেজি জিলাপি বিক্রি হলেও রোজায় তা বেড়ে ২০০ কেজি ছাড়িয়ে যায়।
জিলাপি তৈরির উপাদান সম্পর্কে তিনি বলেন, এতে চালের আটা, ময়দা ও মাষকলাইয়ের আটা ব্যবহার করা হয়। এ উপাদানগুলো পানিতে বিভিন্ন পরিমাণে মিশিয়ে রাখা হয় ৬-৮ ঘণ্টা। আর এর পরই তৈরি করা হয় ঐতিহ্যবাহী বাটার মোড়ের জিলাপি। তবে ভোজ্যতেল হিসেবে ব্যবহার করা হয় পামঅয়েল ও ডালডা।
কারিগর সাফাত আলী বলেন, ‘কয়েক ধরনের ময়দা আর ভালো তেল দিয়ে জিলাপি ভাজি। বছরের পর বছর একই কৌশল, একই স্বাদ।’
তিনি আরও জানান, সাধারণ সময় দিনে দুই মণ জিলাপি বিক্রি হয়, এই রোজায় বিক্রি হচ্ছে পাঁচ মণ করে। সকাল ৯টায় কাজ শুরু করি, চলে ইফতারের আগ পর্যন্ত।