বাংলা নববর্ষে ধর্ম-বর্ণ-অঞ্চলভেদে কিছু ঐতিহ্য ও গ্রামীণ সংস্কৃতি রয়েছে। সেই ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এক এলাকাসহ আশপাশের এলাকার মানুষের শ্রদ্ধা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও ভালবাসার প্রতীক হয়ে ওঠে। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলা সদরের শ্রী শ্রী মহামায়া গাছতলা বেদিটি, উপজেলার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের মূর্ত প্রতীক হয়ে দাড়িয়ে আছে যুগ যুগ ধরে।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বেদিটিকে প্রতিবছরই নতুন সাজে সাজানো হয়। পহেলা বৈশাখের দিন (পঞ্জিকা মতে) সকাল থেকেই এটি হাজারো ভক্ত, পূণ্যার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মনের ইচ্ছা পূরণ ও শ্রী শ্রী মা মহামায়া দেবীর কৃপা লাভের আশায় এখানে বিভিন্ন প্রাণী (পাঁঠা, কবুতর) উৎসর্গ করে থাকেন।
এ মেলা উপলক্ষে এলাকার অনেকেই আত্মীয়স্বজনকে আমন্ত্রণ জানায়। বাড়িতে বাড়িতে বানানো হয় খই, মুড়কি, নারকেল ও দুধের নাড়ু । নানা ধর্ম-বর্ণের স্থানীয় মানুষেরা মেলা থেকে কিনে নেন বিভিন্ন জিনিস।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস ও বিভিন্ন গ্রন্থ মতে, মহামায়া হলো হিন্দু দর্শনে বর্ণিত পরমেশ্বরী শক্তি। ঈশ্বর এ মহাশক্তির সাহায্যেই সৃষ্টি, পালন, সংহার, জন্মলীলা প্রভৃতি কাজ করে থাকেন। এ মহাশক্তিকেই দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রী প্রভৃতি নামে পূজা করেন ভক্তরা।
নাগোজীভট্ট টীকা অনুসারে, মহামায়া ‘বিসদৃশ-প্রতীতি-সাধিকা ঈশ্বরশক্তি’। তত্ত্বপ্রকাশিকা টীকা মতে, মহামায়াই হলো ‘অঘটন-ঘটন-পটীয়সী ব্রহ্মাত্মিকা শক্তি’। তিনি শিবকে স্বামীরূপে গ্রহণ করেন। তিনিই দক্ষ কন্যা সতী ও হিমালয়ের কন্যা পার্বতী রূপে জন্ম নেন।
দেবী ভাগবত গ্রন্থে, ব্রহ্মা নারদকে মহামায়া তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। এ গ্রন্থে মহামায়া ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবতী নামে বর্ণিত। শ্রী শ্রী চণ্ডীতে রাজা সুরথ মেধা ঋষির কাছে মহামায়া তত্ত্বব্যাখ্যা জানতে চাইলে, সমগ্র চণ্ডীপুস্তকটির কাহিনির অবতারণা করা হয়। এ গ্রন্থে মোট আটবার মহামায়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বৈষ্ণবেরা মহামায়াকে ভগবান বিষ্ণুর বহিরঙ্গা বলেন।
মহামায়া গাছতলার এ পূজা ও পাঠাবলীর প্রচলন ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে লিখিতভাবে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য না জানা গেলেও এলাকার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও লেখক রতন ঘোষ বলেন, ‘তান্ত্রিক সাধক গগন চন্দ্র মোদকের পূর্ব পুরুষেরা সর্বপ্রথম এই পূজার প্রচলন করেন। পরবর্তীতে এ পূজার মূল তত্ত্বাবধান করেন মৃত নরেন্দ্র চন্দ্র বণিক, মৃত রাম দয়াল ঘোষ, মৃত হীরা লাল সাহা প্রমুখ। বর্তমানে স্থানীয়ভাবে এলাকার নবীন-প্রবীণেরা এ পূজা আয়োজন ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছেন। প্রায় চারশো বছরেরও বেশি সময় ধরে এ পূজা উদযাপন হচ্ছে।’
কটিয়াদী পাইলট বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক নিরঞ্জণ বণিক বলেন, ‘আগে এখানে কাঁঠালি বট ছিল। তবে বর্তমানেরটি অশ্বথ বট। পহেলা বৈশাখের পূজা ছাড়াও অমাবস্যা-পূর্ণিমা তিথিতে এখানে প্রদীপ প্রজ্বালন করা হয়া। বিধি অনুযায়ী, নিয়মিত পূজার পাশাপাশি কার্তিক মাসে মা মহামায়ার বেদীতে জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজনও করা হয়। এ ছাড়া দীপাবলীতে কালীপূজা এবং চৈত্র সংক্রান্তিতে হরগৌরি ও শীতলা মায়ের পূজা করা হয়। এ বছরও তিন শতাধিক পাঠা বলী হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’
বর্তমানে দীলিপ কুমার ও শিক্ষক নিরঞ্জনসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা মহামায়া গাছতলার পূজার সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছেন।
এ ছাড়া এলাকার তরুণ শান্ত বণিক ও হিমেল দাস দীর্ঘদিন ধরেই শ্রী শ্রী মা মহামায়া গাছতলার নিয়মিত ত্বত্ত্বাবধান ও পরিচর্যা করে আসছেন।
নববর্ষের উৎসব ছাড়াও স্থানীয় অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নতুন বউকে ঘরে তোলার আগে প্রণাম করতে মা মহামায়ার এ বেদিতে নিয়ে যান। অনেকে ছোট শিশুদের অন্নপ্রাশনের (শিশুর মুখে প্রথম অন্ন দেওয়ার অনুষ্ঠান) আনুষ্ঠানিকতাও এই মহামায়া বেদি তলায় করে থাকেন।
সনাতন ধর্মাবলম্বী স্থানীয় শিশু-কিশোরদের কাছেও এটি ধর্মীয় উপাসনালয় ও ঐতিহ্যের অনন্য প্রতীক হয়ে উঠেছে।
সুমিত বণিক/পপি/অমিয়/