ঢাকা ২৩ ভাদ্র ১৪৩১, শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যের প্রতীক কটিয়াদীর মহামায়া গাছতলা

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৪৮ পিএম
আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:২৭ পিএম
বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যের প্রতীক কটিয়াদীর মহামায়া গাছতলা
নববর্ষ উপলক্ষে কটিয়াদীতে শ্রী শ্রী মহামায়া গাছতলার মেলা। ছবি : খবরের কাগজ

বাংলা নববর্ষে ধর্ম-বর্ণ-অঞ্চলভেদে কিছু ঐতিহ্য ও গ্রামীণ সংস্কৃতি রয়েছে। সেই ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এক এলাকাসহ আশপাশের এলাকার মানুষের শ্রদ্ধা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও ভালবাসার প্রতীক হয়ে ওঠে। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলা সদরের শ্রী শ্রী মহামায়া গাছতলা বেদিটি, উপজেলার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের মূর্ত প্রতীক হয়ে দাড়িয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। 

বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বেদিটিকে প্রতিবছরই নতুন সাজে সাজানো হয়। পহেলা বৈশাখের দিন (পঞ্জিকা মতে) সকাল থেকেই এটি হাজারো ভক্ত, পূণ্যার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মনের ইচ্ছা পূরণ ও শ্রী শ্রী মা মহামায়া দেবীর কৃপা লাভের আশায় এখানে বিভিন্ন প্রাণী (পাঁঠা, কবুতর) উৎসর্গ করে থাকেন। 

এ মেলা উপলক্ষে এলাকার অনেকেই  আত্মীয়স্বজনকে আমন্ত্রণ জানায়। বাড়িতে বাড়িতে বানানো হয় খই, মুড়কি, নারকেল ও দুধের নাড়ু । নানা ধর্ম-বর্ণের স্থানীয়  মানুষেরা মেলা থেকে কিনে নেন বিভিন্ন জিনিস। 

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস ও বিভিন্ন গ্রন্থ মতে, মহামায়া হলো হিন্দু দর্শনে বর্ণিত পরমেশ্বরী শক্তি। ঈশ্বর এ মহাশক্তির সাহায্যেই সৃষ্টি, পালন, সংহার, জন্মলীলা প্রভৃতি কাজ করে থাকেন। এ মহাশক্তিকেই দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রী প্রভৃতি নামে পূজা করেন ভক্তরা। 

নাগোজীভট্ট টীকা অনুসারে, মহামায়া ‘বিসদৃশ-প্রতীতি-সাধিকা ঈশ্বরশক্তি’। তত্ত্বপ্রকাশিকা টীকা মতে, মহামায়াই হলো ‘অঘটন-ঘটন-পটীয়সী ব্রহ্মাত্মিকা শক্তি’। তিনি শিবকে স্বামীরূপে গ্রহণ করেন। তিনিই দক্ষ কন্যা সতী ও হিমালয়ের কন্যা পার্বতী রূপে জন্ম নেন। 

দেবী ভাগবত গ্রন্থে, ব্রহ্মা নারদকে মহামায়া তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। এ গ্রন্থে মহামায়া ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবতী নামে বর্ণিত। শ্রী শ্রী চণ্ডীতে রাজা সুরথ মেধা ঋষির কাছে মহামায়া তত্ত্বব্যাখ্যা জানতে চাইলে, সমগ্র চণ্ডীপুস্তকটির কাহিনির অবতারণা করা হয়। এ গ্রন্থে মোট আটবার মহামায়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বৈষ্ণবেরা মহামায়াকে ভগবান বিষ্ণুর বহিরঙ্গা বলেন।

মহামায়া গাছতলার এ পূজা ও পাঠাবলীর প্রচলন ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে লিখিতভাবে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য না জানা গেলেও এলাকার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও লেখক রতন ঘোষ বলেন, ‘তান্ত্রিক সাধক গগন চন্দ্র মোদকের পূর্ব পুরুষেরা সর্বপ্রথম এই পূজার প্রচলন করেন। পরবর্তীতে এ পূজার মূল তত্ত্বাবধান করেন মৃত নরেন্দ্র চন্দ্র বণিক, মৃত রাম দয়াল ঘোষ, মৃত হীরা লাল সাহা প্রমুখ। বর্তমানে স্থানীয়ভাবে এলাকার নবীন-প্রবীণেরা এ পূজা আয়োজন ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছেন। প্রায় চারশো বছরেরও বেশি সময় ধরে এ পূজা উদযাপন হচ্ছে।’

কটিয়াদী পাইলট বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক নিরঞ্জণ বণিক বলেন, ‘আগে এখানে কাঁঠালি বট ছিল। তবে বর্তমানেরটি অশ্বথ বট। পহেলা বৈশাখের পূজা ছাড়াও অমাবস্যা-পূর্ণিমা তিথিতে এখানে প্রদীপ প্রজ্বালন করা হয়া। বিধি অনুযায়ী, নিয়মিত পূজার পাশাপাশি কার্তিক মাসে মা মহামায়ার বেদীতে জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজনও করা হয়। এ ছাড়া দীপাবলীতে কালীপূজা এবং চৈত্র সংক্রান্তিতে হরগৌরি ও শীতলা মায়ের পূজা করা হয়। এ বছরও তিন শতাধিক পাঠা বলী হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’ 

বর্তমানে দীলিপ কুমার ও শিক্ষক নিরঞ্জনসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা মহামায়া গাছতলার পূজার সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। 

এ ছাড়া এলাকার তরুণ শান্ত বণিক ও হিমেল দাস দীর্ঘদিন ধরেই শ্রী শ্রী মা মহামায়া গাছতলার নিয়মিত ত্বত্ত্বাবধান ও পরিচর্যা করে আসছেন।

নববর্ষের উৎসব ছাড়াও স্থানীয় অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নতুন বউকে ঘরে তোলার আগে প্রণাম করতে মা মহামায়ার এ বেদিতে নিয়ে যান। অনেকে ছোট শিশুদের অন্নপ্রাশনের (শিশুর মুখে প্রথম অন্ন দেওয়ার অনুষ্ঠান) আনুষ্ঠানিকতাও এই মহামায়া বেদি তলায় করে থাকেন। 

সনাতন ধর্মাবলম্বী স্থানীয় শিশু-কিশোরদের কাছেও এটি ধর্মীয় উপাসনালয় ও ঐতিহ্যের অনন্য প্রতীক হয়ে উঠেছে। 

সুমিত বণিক/পপি/অমিয়/

চুইঝালের কদর চাহিদা বাড়ছে

প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২৪, ১১:৩৪ এএম
চুইঝালের কদর চাহিদা বাড়ছে
বাগেরহাটের চুইঝালের কদর বাড়ছে ভোজনরসিকদের কাছে। ছবি: খবরের কাগজ

বাগেরহাটসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চুইঝাল ব্যাপক জনপ্রিয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দিনদিন এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা বাগেরহাট, খুলনা, নড়াইল, যশোর, সাতক্ষীরা এলাকায় জনপ্রিয় একটি মসলার নামও ‘চুইঝাল’। কয়েক টুকরো চুইঝাল মাংসের স্বাদ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে গরু ও খাসির মাংসের স্বাদ বাড়াতে এর জুড়ি নেই।

খাবারে স্বাদ বাড়ানোই শুধু নয়। ভেষজ গুণ থাকার কারণে অনেক রোগব্যাধি প্রতিরোধের কাজ করে চুইঝাল। বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে চুইঝালের।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষার্থী মো. বিল্লাল হোসেন চুইঝালের নানা উপকারী দিক নিয়ে লিখেছেন। 

চুই লতাজাতীয় গাছ। এর কাণ্ড ধূসর এবং পাতা পান পাতার মতো, দেখতে সবুজ। চুইঝাল খেতে ঝাল হলেও এর রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ঔষধি গুণ। শিকড়, কাণ্ড, পাতা, ফুলফল সবই ভেষজ গুণসম্পন্ন। মসলা হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হয়। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় হাঁস ও গরুর মাংস রান্নায়। রান্নায় চুইঝালের কাণ্ড ব্যবহার করা হয়।

চুইঝালে দশমিক ৭ শতাংশ সুগন্ধি তেল থাকে। এ ছাড়া রয়েছে আইসোফ্লাভোন, অ্যালকালয়েড, পিপালারিটিন, পোপিরন, পোলার্টিন, মিউসিলেজ, গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, সিজামিন, পিপলাস্টেরল ইত্যাদি। চুই এর শিকড়ে রয়েছে ১৩.১৫ শতাংশ পিপারিন।

খাবারের রুচি বাড়ানো ও ক্ষুধামান্দ্য দূর করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে এটি। প্রচুর পরিমাণ আইসোফ্লাভোন ও অ্যালকালয়েড নামক ফাইটোক্যামিকাল রয়েছে যা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং ক্যানসার প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে এটি হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। দূর করে পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহ। তাছাড়া গ্যাস্ট্রিক ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

চুইঝাল স্নায়বিক উত্তেজনা ও মানসিক অস্থিরতা প্রশমন করে। মানবশরীরের বিভিন্ন ধরনের ব্যথা দূর করে শরীর সতেজ রাখতে সহায়তা করে। এটি ঘুমের ওষুধও বটে! শারীরিক দুর্বলতা কাটাতে সাহায্য করে। প্রসূতি মায়েদের শরীরের ব্যথা কমাতে চুইঝাল কাজ করে ম্যাজিকের মতো। চুইঝাল বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকজনিত রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

বাগেরহাট সদরসহ জেলার বিভিন্ন বড় হাটে চুইঝালের ছোট-বড় স্থায়ী-অস্থায়ী দোকান রয়েছে। চাহিদা বাড়ছে দিন দিন। সেই সঙ্গে বাড়ছে দামও। ভোজনরসিক মানুষের কাছে চুইঝালের কদর আগের তুলনায় বাড়ছে।

চুইঝাল বিক্রেতা কুদ্দুস শেখ বলেন, চাহিদা দিন-দিন বাড়ছে। ঈদসহ বিভিন্ন বিশেষ দিনে চাহিদা বাড়ে সবচেয়ে বেশি। আগে যে চুই ৬০০ টাকা কেজিতে বাড়ি থেকে পাইকারি দরে কিনতাম, এখন সেই চুই কিনতে হচ্ছে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায়। তবে মূল চুইঝালের দাম আরও বেশি।

আরেক বিক্রেতা আব্দুস সোবাহান বলেন, হঠাৎ চুইঝালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। স্থানীয় জাতের যে চুইঝাল আগে প্রতি মণ ২ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হতো, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। মোটা ও মূল চুইয়ের দাম সবচেয়ে বেশি। আমার কাছে ৫০০ থেকে ১২০০ টাকা কেজির চুইঝাল রয়েছে।

চুইঝাল কিনতে আসা মারুফ হাওলাদার বলেন, চুইঝাল ছাড়া মাংসের তেমন স্বাদই পাই না। মাংস কিনলেই চুইঝাল কিনে নিই। ঢাকায় আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও পাঠাতে হয়। আগের চেয়ে দামও বেড়েছে।

বাগেরহাট শহরের সবজি বাজারে দেড় যুগের বেশি সময় ধরে শুধু চুইঝাল বিক্রি করছেন জামান শেখ। প্রতিদিন সকালে দোকান নিয়ে বসেন তিনি, থাকেন বাজার শেষ না হওয়া পর্যন্ত। তিনি বলেন, আগে চুইঝালের চাহিদা তেমন ছিল না। বেচা-বিক্রিও কম ছিল না। তবে দিন দিন চাহিদা বাড়ছে, প্রতিদিন বিক্রিও ভালো হচ্ছে। চুইঝাল বিক্রি করে দুই ছেলে ও এক মেয়েকে লেখাপড়াসহ সংসারের সব খরচ চালান বলে জানান তিনি।

বাগেরহাট শহরের বাইরে ও জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে অনেক দোকান ঘুরে দেখা যায়, চুইঝালের চিকন ডাল কেজি ৪৫০-৫০০ টাকা, একটু মোটা ডাল ৬০০-৬৫০ টাকা, বড় ডাল ১১০০-১২০০ টাকা, গাছ-কাণ্ড ১২০০-১৪০০ টাকা।

সিলেটের ‘আসাম বাড়ি’

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৪, ১০:০৮ এএম
সিলেটের ‘আসাম বাড়ি’
শত বছরের পুরোনো আসাম প্যাটার্নের চুন-সুরকির তৈরি দোতলা বাড়িতে এখনো বসবাস করছেন রফিকুল হক ও তার পরিবার। সিলেট নগরীর তাঁতিপাড়া এলাকা থেকে তোলা। ছবি: মামুন হোসেন

‘চাঁদনী ঘাটের সিঁড়ি/ আলী আমজদের ঘড়ি/ বঙ্কু বাবুর দাড়ি/ জিতু মিয়ার বাড়ি’। সিলেটের বহুল প্রচলিত প্রবাদ। ‘জিতু মিয়ার বাড়ি’ হিসেবে যেটির উল্লেখ করা হয়েছে, সেই বাড়িটি চুন-সুরকি দিয়ে আসাম প্যাটার্নে নির্মিত। প্রাচীনকাল থেকেই সিলেটিদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির যেমন স্বতন্ত্র ঐতিহ্য আছে, তেমনি বাড়ি নির্মাণেও ছিল নিজস্ব স্থাপত্যশৈলী। নিজস্ব এই নির্মাণশৈলী আসাম প্যাটার্ন বা ‘আসাম ঐতিহ্য’ নামে পরিচিত। এমন স্থাপত্যশৈলীর কারণে সিলেটের আদি ঐতিহ্যের সঙ্গে জুড়ে আছে জিতু মিয়ার বাড়িও। 

স্থানীয় ইতিহাস বলে, সিলেটের স্বনামধন্য জমিদার ছিলেন খান বাহাদুর আবু নছর মোহাম্মদ এহিয়া ওরফে জিতু মিয়া। ১৮৮৬ সালে মূল বাড়িটি নির্মাণ করেন জিতু মিয়ার বাবা মাওলানা আবু মোহাম্মদ আবদুল কাদির। ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে সিলেট ও আসামের অধিকাংশ স্থাপনার মতো এটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর ১৯১১ সালে জিতু মিয়ার বাড়িটির সামনের অংশে একটি নতুন দালান নির্মাণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে এটিই জিতু মিয়ার বাড়ি হিসেবে পরিচিতি পায়। 

সেই কালে ১ দশমিক ৩৬৫ একর ভূমিজুড়ে ঐতিহ্যবাহী এই বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছিল মুঘল আমলের মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন আসাম প্যাটার্নে। সেই স্থাপত্যশৈলীর বাড়িগুলোতে কাঠের নল-বর্গার সঙ্গে চুন-সুরকির প্রলেপ দেওয়া হতো। ঘরগুলোর দেয়াল, দরজা-জানালা থেকে শুরু করে চালাতেও ছিল নান্দনিকতার ছোঁয়া। টালি বা ঢেউটিন দিয়ে ২ থেকে ১৩টি পর্যন্ত হতো ঘরের চালা। তখন সেই নির্মাণশৈলীতে সিলেটের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা বাড়ি তৈরি করাতেন। ধীরে ধীরে এই নির্মাণশৈলী জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। 

এখনকার সিলেট মহানগরী তখন ছিল শহর। গ্রাম ও শহরের ব‍্যবধান ছিল বাড়ির চাকচিক‍্য বিচারে। বিভিন্ন উপজেলায় এখনো কিছু বাড়ি রয়েছে আসাম প্যাটার্নের। কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি ভবনও রয়েছে। অনেকেই ঐতিহ্যের নিদর্শনস্বরূপ বাড়িগুলো রেখে দিয়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি ভবনগুলো এখন সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ। 

সেমিপাকা আসাম প‍্যাটার্নের বাড়ির নির্মাণশৈলী এখনো আকর্ষণীয় বলে মনে করেন স্থপতি রাজন দাশ। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, যদিও সিলেট একসময় আসাম প্রদেশের সঙ্গে ছিল, এ জন্যই আমরা এই ধরনের বাড়িকে আসাম প্যাটার্ন বাড়ি বলি। কিন্তু সিলেট অঞ্চলের বাড়িগুলো আসাম থেকেও কিছুটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বলেই আমরা একে সিলেট প্যাটার্ন বা সিলেটি বাড়ি বলতে পারি। তৎকালীন আসামের উঁচু অঞ্চলগুলোতে এ ধরনের বাড়ি তৈরি করা হতো। কোনো কোনো বাড়ি টিলার ওপরে মাচা করেও বানানো হতো, যাতে পাহাড় বেয়ে নেমে-আসা পানি ঘরের নিচ দিয়ে চলে যায়। ইংল্যান্ডে প্রথম করোগেটেড আয়রন শিট বা সিআই শিট তৈরি হয়, যা ব্রিটিশ উপনিবেশ দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতীয় অঞ্চলে আসে, মূলত মাইনিং এরিয়াগুলোর পাশে ওয়্যার হাউসের জন্য এই সিআই শিট ব্যবহৃত হতো। ক্রমশ তা এ অঞ্চলের কুঁড়েঘরের ছাদ হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। ভিত্তি হিসাবে লোহার খুঁটি আর দেয়ালগুলোতে কাঠের ফ্রেম (যাকে আমরা ব্যাটন বলি) ও তার ভেতরে মাটি-লেপা ‘ইকরা’র বেড়ার ব্যবহার শুরু হয়। স্থাপত্যকলায় একে বাংলা ব্যাটন বাড়ি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

১৮৯৭ সালের ঐতিহাসিক ভূমিকম্পের পর আসাম ও সিলেট অঞ্চলে ইট ও চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত দালান বাড়িগুলোর প্রায় সব কটি ভেঙে পড়েছিল। এ তথ্য উল্লেখ করে স্থপতি রাজন দাশ আরও বলেন, কোনোটিরই ছাদ অক্ষত ছিল না। বলা হয় তৎকালে প্রায় ৫০০ বাড়ি ধসে পড়েছিল। পরবর্তী সময়ে ভূমিকম্পের কথা মাথায় রেখে ছাদ হিসেবে চুন-সুরকির বদলে টিনের বাড়ির প্রচলন হয়। এগুলো বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে। যেমন, ইংরেজি বর্ণ ই, এইচ, ইউ, সি কিংবা এল আকৃতির টিনের ছাদবিশিষ্ট বাড়ি। 

কালের পরিক্রমায় নির্মাণ প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে সিলেট অঞ্চলে যেসব বাড়ি অবশিষ্ট আছে, সেগুলোও ভগ্নদশাগ্রস্ত। যেসব আসাম প্যাটার্ন বা সিলেট প্যাটার্ন বাড়ি স্থাপত্যকলার দৃষ্টিতে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছিল, তার অনেকই ধ্বংস হয়ে গেছে। সিলেটে এ রকম একটি স্থাপত্য ছিল সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের আবু সিনা ছাত্রাবাস। সেটি ভেঙে বহুতল ভবন করা হয়েছে।

এ ছাড়াও ‌ শহিদ ডা. শামসুদ্দিন ছাত্রাবাস, এমসি কলেজের সুকান্ত ছাত্রাবাস ও বাংলা বিভাগের ভবনগুলো সেই সময়ের স্থাপত্যের সৌন্দর্যের স্মৃতি এখনো বহন করছে। 

স্থপতি রাজন দাশ বলেন, আমার জানামতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী ব্রিটিশ পিরিয়ডের স্থাপত্য-আঙ্গিক নিয়ে গবেষণা করছেন। তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, ওই সময়ের স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যগুলোকে চিহ্নিত করা এবং ড্রইংয়ের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা। যাতে পরবর্তী প্রজন্মের স্থাপত্য শিক্ষার্থীদের এই বিষয়ে জানানো যায়। আমি মনে করি, এই ধরনের বাড়িগুলো আমাদের এই অঞ্চলের স্থাপত্য-ঐতিহ্যের তথা ইতিহাসের অংশ। যেগুলো এখনো দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোকে ঐতিহ্য ঘোষণা করে সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা অতি জরুরি।

কালের সাক্ষী ৪১৫ বছরের আতিয়া মসজিদ

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২৪, ১১:৪৩ এএম
কালের সাক্ষী ৪১৫ বছরের আতিয়া মসজিদ
৪১৫ বছর আগের মুসলিম স্থাপত্যকর্ম টাঙ্গাইলের আতিয়া মসজিদ ১৯৭৮ সালে ১০ টাকার নোটের প্রচ্ছদে প্রথম ঠাঁই পেয়েছিল। ছবি: খবরের কাগজ

বাংলাদেশে সুলতানি এবং মোগল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত যেসব স্থাপত্য রয়েছে, তার মধ্যে টাঙ্গাইলে অবস্থিত আতিয়া মসজিদ অন্যতম। এই মুসলিম স্থাপত্যকর্মটি প্রায় ৪১৫ বছর আগেকার। মসজিদটির নান্দনিক কারুকাজ এখনো কৌতূহলী দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। 

মসজিদটি দেখতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগ্রহী দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন। সব মিলিয়ে আতিয়া মসজিদ যুগসন্ধিলগ্নের স্থাপত্য ও নিদর্শনরূপে পরিচিত। কিন্তু কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাচ্ছে শিল্পকর্মগুলো। এর সঠিক সংরক্ষণ ও যথাযথ পরিচর্যার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। 

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, টাঙ্গাইল শহরের দক্ষিণ পশ্চিমে আট কিলোমিটার দূরে ঐতিহাসিক আতিয়া মসজিদটির অবস্থান। ১৯৭৮ সালে ১০ টাকার নোটের প্রচ্ছদে আতিয়া মসজিদটি প্রথম ঠাঁই পেয়েছিল। এরপর ১৯৮২ সালে পরিবর্তিত ১০ টাকার নোটের প্রচ্ছদেও আবার স্থান পায়। এতে দেশবাসীর কাছে সহজেই মসজিদটি পরিচিতি লাভ করে। তবে আজকাল দশ টাকার পুরোনো নোটটি তেমন দেখা যায় না।