ঢাকা ২৩ আশ্বিন ১৪৩১, মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৪

শ্রী হারাচ্ছে জ্যোতি বসুর পৈতৃক বাড়ি

প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:২৬ এএম
শ্রী হারাচ্ছে জ্যোতি বসুর পৈতৃক বাড়ি
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বারদীর চৌধুরীপাড়া গ্রামে জ্যোতি বসুর জীর্ণ পৈতৃক বাড়ি। ছবি: খবরের কাগজ

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসুর পৈতৃক বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বারদীর চৌধুরীপাড়া গ্রামে। অযত্ন-অবহেলায় আদি দোতলা ভবনটি জীর্ণ হয়ে পড়েছে। এটি সংরক্ষণ ও সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

জ্যোতি বসুর স্মৃতিবিজড়িত এ বাড়িকে ২০১০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে বলে ঘোষণা দেন। পরে ৩ কোটি ৮৩ লাখ ৬৬ হাজার টাকা ব্যয়ে সংস্কার করা হয়। ২০২০ সালে সাবেক বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেন বাড়িটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। তবে বাড়িটিতে যে আদি পাকা ভবন রয়েছে, সেটি অবহেলা-অযত্নে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেখানে রয়েছে লাইব্রেরি। তবে পাঠক নেই। পর্যটকও আসেন না বললেই চলে। 

এই পর্যটন কেন্দ্রে তিনজন কর্মকর্তা আছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, জ্যোতি বসুর স্মৃতিবিজড়িত দোতলা আদি ভবনটি সৌন্দর্য হারাচ্ছে। সরকারের উচিত বাড়িটির দেখভাল করা। বাড়িটি টিকে থাকলে, জ্যোতি বসুর নাম রয়ে যাবে। 

তারা আরও বলেন, অনেকে বহু দূর থেকে বাড়িটি দেখতে আসেন। এই নিদর্শনটি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। কিন্তু বাড়িটি যথাযথ পরিচর্যার অভাবে রংচটে যাচ্ছে। 

এলাকাবাসী মনে করেন, জেলা পরিষদ বিভাগের হস্তক্ষেপে হয়তো বাড়িটি তার হারানো গৌরব ফিরে পেতে পারে। এর রক্ষণাবেক্ষণের ফলে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে তৎকালীন ইতিহাস। তেমনি পর্যটকদের আনাগোনা বাড়লে, ওই গ্রামের অর্থনীতির চাকাও সচল হবে। 

জ্যোতি বসু কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা করেন। পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৩৫ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর লন্ডন থেকে বার এট ল পাস করেন। ১৯৪০ সালে তিনি কলকাতা ফিরে আসেন এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪৬ সালে তিনি অবিভক্ত বাংলা প্রদেশের প্রাদেশিক আইনসভায় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯ সালে জ্যোতি বসু যুক্তফ্রন্ট সরকারের উপমুখ্যন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মাকর্সবাদী) বা সিপিআই (এম)-এর সদস্য হিসেবে ১৯৭৭ সালের ২১ জুন থেকে ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত একটানা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার নাম বিবেচিত হলেও, তিনি পার্টির সিদ্ধান্তে সেই পদ প্রত্যাখ্যান করেন।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে জ্যোতি বসু ১৯৮৭ সালের ২০ জানুয়ারি এবং ১৯৯৭ সালের ১১ নভেম্বর স্ত্রী বাসন্তি ঘোষ ওরফে কমলা বসু ও তার ছেলে চন্দন বসুকে সঙ্গে নিয়ে বারদীতে তার পৈতৃক বাড়িটি দেখতে আসেন। পরে ১৯৯৭ সালে জ্যোতি বসু আবার বারদীতে আসেন। সে সময় ভারত থেকে জ্যোতি বসুর সঙ্গে আসেন পশ্চিমবঙ্গের উপমুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসুর বড় ভাই ডা. সুরেন্দ্র কিরণ বসু ও বোন সুধা বসু।

সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা রহমান জানান, ‘আমরা বইয়ে জ্যোতি বসুর ইতিহাস পড়েছি। এ উপজেলায় নতুন যোগ দিয়েছি। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন এখনো দাপ্তরিকভাবে কোনো কার্যক্রম শুরু করেনি। এখানে জনবল নিয়োগ দিতে হবে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে বাড়িটি কীভাবে সংস্কার করে আদিরূপ ফিরিয়ে আনা যায়, সেজন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।’ 

ঐতিহ্যবাহী হাট: ঘিওরের ডিঙি নৌকার কদর

প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৫২ এএম
ঐতিহ্যবাহী হাট: ঘিওরের ডিঙি নৌকার কদর
নৌকার হাটে চলছে বেচাকেনা। গত সপ্তাহে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলা সদরের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে। ছবি: খবরের কাগজ

হাটটি ২০০ বছরের পুরোনো। এর বিস্তৃতি ছিল প্রায় ৩ কিলোমিটার। শুরু থেকে গরু, পাট ও ধান বিক্রির জন্য সারা দেশে পরিচিত ছিল। কালের বিবর্তনে এটি ক্রমশ ছোট হয়ে বাজারে পরিণত হয়েছে। এখন এই হাটটিকে অনেকে নৌকার হাট নামে চেনেন। বলছিলাম মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ডিঙি নৌকার হাটের কথা।

পদ্মা, যমুনা, ধলেশ্বরী ও ইছামতী নদীবেষ্টিত মানিকগঞ্জ জেলা। বর্ষা এলেই এ এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। ফলে মানুষের চলাচলের একমাত্র বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয় ডিঙি নৌকা। আর মানিকগঞ্জসহ আশপাশের জেলাগুলোর ডিঙি ও কোশা নৌকার জোগান দিয়ে আসছে ঐতিহ্যবাহী ঘিওরের এ হাটটি।

বর্ষা মৌসুমে প্রতি বুধবার উপজেলা সদরের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে বসে এ নৌকার হাট। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে নৌকা বেচাকেনা। আকার ও মানভেদে প্রতিটি নৌকা ৩ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। মানিকগঞ্জ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী ঢাকার সাভার, ধামরাই, টাঙ্গাইল ও রাজবাড়ী থেকেও আসেন ক্রেতা ও বিক্রেতারা। 

অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক মোহাম্মদ সিরাজ খান বলেন, ‘ব্রিটিশ শাসনামলে আঠারো শতকের প্রথম দিকে ধলেশ্বরী ও ইছামতী নদী তীরের এই ঘিওর হাটটি গরু, পাট ও ধান বিক্রির জন্য বিখ্যাত ছিল। এখনো প্রতি বুধবারে এখানে হাট বসে। কালের বিবর্তনে এই হাটটির ঐতিহ্য থাকলেও আগের মতো আর জৌলুস নেই। বর্ষা মৌসুমে এখানে প্রতিবছর নৌকার হাট বসে। অনেক জেলা উপজেলা থেকে নৌকার ব্যাপারী ও ক্রেতারা আসেন।’ 

বৃদ্ধ রহমত আলী বলেন, ‘এই ঘিওর হাটের ঐতিহ্য সারা দেশেই রয়েছে। আশপাশে এমন বড় নৌকার হাট না থাকায় অনেক নৌকা ওঠে এখানে। প্রতি মৌসুমে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার নৌকা বিক্রি হয়। একটা সময় এই হাটটি ৪০-৪৫ লাখ টাকা সরকারি ডাক হলেও বর্তমানে তা ১০-১২ লাখ টাকায় ডাক নেন ইজারাদার। হাটের অব্যবস্থাপনার জন্যই এমন দশা হয়েছে। এতে করে একদিকে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অপরদিকে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। আমরা চাই ঘিওরে হাটটির ঐতিহ্য আবার ফিরে আসুক।’

এই হাটে নৌকা বিক্রি করতে আসা ব্যবসায়ী রমিজ উদ্দিন বলেন, ‘এই হাটে ১৬ বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে বিভিন্ন আকার ও মানের নৌকা বিক্রি করে থাকি। এ বছরের জুন মাসে প্রথম নৌকার হাট বসেছে। হাট কবে শেষ হবে তা নির্ভর করে নদীতে পানি থাকার ওপর।’

নৌকার কারিগর সুবল সরকার প্রায় এক যুগ ধরে নৌকা বানোনোর সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, ‘এ হাটে আম, জাম, ঝিকা, ডুমরা, মেহগনি, কড়ই, চাম্বুল কাঠের নৌকা পাওয়া গেলেও চাম্বুল ও কড়ই কাঠের নৌকার চাহিদা অনেক বেশি। কিন্তু অধিকাংশ ক্রেতাই ছোট ও মাঝারি আকারের নৌকা কিনে থাকেন।’ 

দৌলতপুর উপজেলার কলিয়া গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আগের নৌকাটা নষ্ট হওয়ায় ঘিওর হাটে এসেছি। নৌকার দাম তুলনামূলকভাবে আগের চেয়ে বেশি। আমি চাম্বুল কাঠের ৭ হাতের একটা নৌকা কিনেছি সাড়ে ৫ হাজার টাকা দিয়ে।’

নৌকার ব্যাপারী রহমত আলী বলেন, ‘নৌকা তৈরির কাঠ, পেরেক ও মিস্ত্রিখরচ বাড়ায় আমরা দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছি। দাম বাড়ায় অনেক ক্রেতা না কিনেই চলে যান। এতে করে আমাদের ব্যবসায় লোকসান হয়। কার্তিক মাস পর্যন্ত বেচাকেনা চলবে।’

নৌকা কেনার পর হাট থেকে অন্যত্র নেওয়ার জন্য ভ্যান ও ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই হাটে নৌকা পরিবহন করার জন্য অর্ধশতাধিক ঘোড়ার গাড়ি ও ভ্যান চালক রয়েছেন। ঘিওর নৌকা হাটের ইজারাদার আলমগীর হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী ঘিওর নৌকার হাটে মানিকগঞ্জ জেলাসহ আশপাশের শতাধিক ব্যবসায়ী ও নৌকা তৈরির কারিগররা আসেন। এ হাটের স্থায়িত্ব নির্ভর করে নদীনালা ও খালবিলে পানি কতদিন থাকে তার ওপর। প্রতি বুধবার এ হাটে গড়ে এক থেকে দেড় শ নৌকা বিক্রি হয়, যা টাকার অঙ্কে প্রায় ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা।’

ঘিওর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ঘিওর হাট জেলার অন্যতম বড় হাট হিসেবে পরিচিত। শুনেছি ব্রিটিশ আমলেও এই হাটটি বেশ জমজমাট ছিল। উপজেলায় মোট ৭টি হাট-বাজার রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ টাকায় ইজারা দেওয়া হয় এই ঘিওর হাটটিকে।’

কলকাতায় আর চলবে না ট্রাম

প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৪৫ এএম
কলকাতায় আর চলবে না ট্রাম
অবসান হতে যাচ্ছে দেড়শ বছরের ঐতিহ্যের। কলকাতায় আর চলবে না ট্রাম। ছবি: খবরের কাগজ

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় বেড়াতে যাওয়া পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ ছিল ট্রাম। ভারতের একমাত্র কলকাতা শহরেই ছিল ট্রাম পরিষেবা। কলকাতায় গেছেন আর ট্রামে চড়েননি- এমনটা খুব কম পর্যটকের ক্ষেত্রে ঘটেছে। কলকাতার ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ সেই ট্রাম আর আর চলবে না। দেড় শ বছর ধরে বহু মানুষের যাত্রাপথের বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়ে থেকে, দেশ-বিদেশের প্রশংসা কুড়িয়ে অবশেষে বিদায় নিচ্ছে বাহনটি। 

সম্প্রতি শহরে ট্রাম পরিষেবা চালু রাখার দাবিতে ‘ক্যালকাটা ট্রাম ইউজার্স অ্যাসোসিয়েশনের’ তরফে হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা করা হয়েছিল। তাতেই সরকারের ট্রাম-নীতি জানতে চেয়েছিলেন আদালত। নবান্ন সূত্রের খবর, প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনার পরে, শেষমেশ শহর থেকে ট্রাম তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বালিগঞ্জ-ধর্মতলা ও শ্যামবাজার-ধর্মতলা রুটে শেষ যে দুটি ট্রাম চলত, তাও বন্ধ করে দিচ্ছে রাজ্য সরকার।

তাহলে আগামী প্রজন্ম কী আর চোখেও দেখতে পাবে না এই যান? তা যাতে না হয়, সে জন্য ধর্মতলা থেকে ময়দান পর্যন্ত লুপ লাইনে ট্রামের জয় রাইডের ব্যবস্থা থাকবে বলে জানা গেছে। দেশ-বিদেশের পর্যটকরা উপভোগ করতে পারবেন ট্রামযাত্রা। সেটি বাদে শহরের বাকি সব ট্রামলাইনও এবার তুলে ফেলা হবে।

কলকাতায় প্রায়ই অভিযোগ ওঠে, ট্রামলাইনের জন্য দুর্ঘটনা ঘটার। শহরটিতে জনসংখ্যার তুলনায় রাস্তা অনেক কম। ফলে এমনিতেই যান নিয়ন্ত্রণ একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তার মধ্যে রাস্তার ওপর ট্রামলাইন যেন আরও সমস্যা বাড়ায়। তাই সব দিক ভেবেই এই সিদ্ধান্ত।

এই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের পরিবহনমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী বলেছেন, ‘আদালত এই নিয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত জানতে চেয়েছিল। আমরা বলেছি, ময়দান-ধর্মতলা ছাড়া বাকি কোনো রুটে ট্রাম চলবে না। লাইনও তুলে ফেলব। রাস্তা বাড়েনি। যান বেড়েছে। তাই যানজট হচ্ছে। এভাবে ট্রাম চালানো অসম্ভব।’ 

অবশ্য বহু আগেই ট্রামের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাজ্য সরকার। সময় যত এগিয়েছে বিকল্প যানও রাস্তায় নেমেছে। ফলে আগের মতো যাত্রী না হওয়ায় এক প্রকার যাত্রীশূন্যতায় ভুগছিল শহরের এই ঐতিহ্যবাহী পরিবহনটি। কাজেই সব রকম চিন্তা মাথায় রেখেই শহরের রাজপথ থেকে চিরতরে ট্রাম তুলে দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত।

কলকাতায় ১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রথমবার ঘোড়ায় টানা ট্রাম চালানো হয়। শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়া ঘাট পর্যন্ত ওই ট্রাম চলে। পরে ‘কলকাতা ট্রামওয়ে কোম্পানি লিমিটেড’ গঠন করা হয়। এ কোম্পানির নিবন্ধন ছিল লন্ডনে। পরে ১৯০২ সালে কলকাতায় প্রথমবার চালু করা হয় বৈদ্যুতিক ট্রাম। কলকাতা শহরে ২৭-২৮টি রুটে ট্রাম চলত। ১৫ বছর আগেও ১২ রুটে সচল ছিল ট্রাম। শেষমেশ দুটি রুটে চলত।

ঐতিহ্যবাহী ট্রামের ১৫০ বছর পূর্তি উৎসব হয় ২০২৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। দিবসটি উপলক্ষে কলকাতা ট্রাম কোম্পানি বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করে। পুরোনো আটটি ট্রাম নতুন করে সাজিয়ে পথে নামানো হয়।

ওই দিন দাবি ওঠে, কলকাতার ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য ট্রাম চালু রাখতে হবে। কিন্তু সব দাবি উপেক্ষা করে বন্ধ করা হচ্ছে ট্রাম পরিষেবা।

নান্দনিক স্থাপনা চিনি মসজিদ

প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৩ এএম
নান্দনিক স্থাপনা চিনি মসজিদ
নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের ইসলামবাগের চিনি মসজিদ মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন। ছবি: খবরের কাগজ

নীলফামারীর সৈয়দপুরে কয়েকটি প্রাচীন স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম চিনি মসজিদ। এটি মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন। নীলফামারী জেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে সৈয়দপুর শহরের ইসলামবাগে এই মসজিদ অবস্থিত। 

এলাকাবাসী ও মসজিদ কমিটির লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৮৬৩ সালে হাজি বাকের আলী ও হাজি মুকু ইসলামবাগে ছন ও বাঁশ ব্যবহার করে মসজিদটি নির্মাণ করেন। শঙ্কু নামের এক ব্যক্তি দৈনিক ১০ আনা মজুরিতে নির্মাণকাজ শুরু করেন। এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে তাকে সাহায্য করেন। সে সময় মসজিদটি নির্মাণে ব্যয় হয় ৯ হাজার ৯৯৯ রুপি। 

১৯২০ সালে হাজি হাফিজ আবদুল করিমের উদ্যোগে ৩৯ ফুট বাই ৪০ ফুট আয়তনের মসজিদটির প্রথম অংশ পাকা করা হয়। তিনি নিজেই নকশা এঁকেছিলেন। পরে ১৯৬৫ সালে মসজিদের দক্ষিণ দিকে ২৫ বাই ৪০ ফুট আয়তনের দ্বিতীয় অংশ পাকা করা হয়। সম্প্রতি এটি আরও সম্প্রসারিত করা হয়েছে। বগুড়ার একটি গ্লাস ফ্যাক্টরি ১৯৬৫ সালে চিনি মসজিদের জন্য প্রায় ২৫ টন চীনা মাটির পাথর দান করে। এগুলো দিয়ে মোড়ানো হয় মসজিদের মিনারসহ বড় তিনটি গম্বুজ। মসজিদটির মূল অংশের বর্ণ অনেকটা লালচে হলেও, একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, পরবর্তী সময়ে নির্মাণ করা অংশ অনেকটা সাদা। ১৯৮০-এর দশকে মসজিদের শেষ অংশ পাকা করা হয়। কারুকার্যের জন্য কলকাতা থেকে মর্মর পাথর ও চীনামাটির নকশা করা থালা আনা হয়। মসজিদের অধিকাংশ কারুকাজ চীনামাটির। কারিগরও কলকাতা থেকে আনা হয়েছিল। সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে দেয়ালে চীনামাটির থালা ও কাচের টুকরা বসানো হয়। এ পদ্ধতিকে ‘চিনি করা’ বা ‘চিনি দানার’ কাজ বলা হয়। ধারণা করা হয়, এখান থেকেই এর নামকরণ হয় ‘চিনি মসজিদ’। 

মসজিদটি নির্মাণে মুঘল আমলের স্থাপত্যশৈলী অনুসরণ করা হয়েছে। মসজিদের দেয়ালে ফুলদানি, ফুলের তোড়া, গোলাপ ফুল, একটি বৃন্তে একটি ফুল, চাঁদ-তারাসহ নানা কারুকাজ করা হয়েছে। মসজিদটি নির্মাণে প্রচুর মার্বেল পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। এতে ২৭টি বড় মিনার, ৩২টি ছোট মিনার ও তিনটি বড় গম্বুজ রয়েছে। দোতলা মসজিদে প্রবেশ পথের পাশে আজান দেওয়ার জন্য মিম্বার রয়েছে। মসজিদে ২৪২টি শঙ্কর মর্মর পাথর আছে। মসজিদের বারান্দা সাদা মোজাইক করা। মসজিদের সম্পূর্ণ অবয়ব রঙিন পাথরে মোড়ানো। মসজিদে প্রবেশের জন্য উত্তরে ও দক্ষিণে একটি করে প্রধান দরজা আছে। দোতলায় একটি ভবনসহ একটি মেহমানখানা আছে। সেখানে পর্যটকদের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে।

বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে মুঘল শাসক ও অন্যান্য মুসলিম নবাবের হাতে নির্মিত অনেক মসজিদ কালের সাক্ষী হয়ে আছে। কিন্তু এটিই একমাত্র মসজিদ যা এলাকাবাসী ও সর্বসাধারণের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় নির্মিত হয়ে ইতিহাসের অংশ হয়েছে।

চিনি মসজিদ কমিটির সভাপতি হিটলার চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, দৃষ্টিনন্দন চিনি মসজিদ নির্মাণের পেছনে বহু মানুষের শ্রম-ঘাম রয়েছে। অনেকেই স্বেচ্ছাশ্রমে মসজিদের নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছিলেন। মুসল্লির সংখ্যা বাড়তে থাকলে পরিসর বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। পরে মূল নকশা ও কারুকাজের সঙ্গে মিল রেখে মসজিদটি আরও ২৫ ফুট সম্প্রসারিত করা হয়।

সৈয়দপুর পৌরসভার কাউন্সিলর আনোয়ারুল ইসলাম মানিক নিয়মিত এই মসজিদে নামাজ আদায় করেন। তিনি বলেন, ‘এই মসজিদ আমাদের গর্বের স্থাপনা। ১৬০ বছর পরে এসেও তা ঠিক কতটা জীবন্ত! মসজিদটির দিকে একবার তাকালে মন জুড়িয়ে যায়। মসজিদটি টিকে থাকুক যুগ যুগ ধরে।’

চুইঝালের কদর চাহিদা বাড়ছে

প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২৪, ১১:৩৪ এএম
চুইঝালের কদর চাহিদা বাড়ছে
বাগেরহাটের চুইঝালের কদর বাড়ছে ভোজনরসিকদের কাছে। ছবি: খবরের কাগজ

বাগেরহাটসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চুইঝাল ব্যাপক জনপ্রিয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দিনদিন এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা বাগেরহাট, খুলনা, নড়াইল, যশোর, সাতক্ষীরা এলাকায় জনপ্রিয় একটি মসলার নামও ‘চুইঝাল’। কয়েক টুকরো চুইঝাল মাংসের স্বাদ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে গরু ও খাসির মাংসের স্বাদ বাড়াতে এর জুড়ি নেই।

খাবারে স্বাদ বাড়ানোই শুধু নয়। ভেষজ গুণ থাকার কারণে অনেক রোগব্যাধি প্রতিরোধের কাজ করে চুইঝাল। বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে চুইঝালের।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষার্থী মো. বিল্লাল হোসেন চুইঝালের নানা উপকারী দিক নিয়ে লিখেছেন। 

চুই লতাজাতীয় গাছ। এর কাণ্ড ধূসর এবং পাতা পান পাতার মতো, দেখতে সবুজ। চুইঝাল খেতে ঝাল হলেও এর রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ঔষধি গুণ। শিকড়, কাণ্ড, পাতা, ফুলফল সবই ভেষজ গুণসম্পন্ন। মসলা হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হয়। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় হাঁস ও গরুর মাংস রান্নায়। রান্নায় চুইঝালের কাণ্ড ব্যবহার করা হয়।

চুইঝালে দশমিক ৭ শতাংশ সুগন্ধি তেল থাকে। এ ছাড়া রয়েছে আইসোফ্লাভোন, অ্যালকালয়েড, পিপালারিটিন, পোপিরন, পোলার্টিন, মিউসিলেজ, গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, সিজামিন, পিপলাস্টেরল ইত্যাদি। চুই এর শিকড়ে রয়েছে ১৩.১৫ শতাংশ পিপারিন।

খাবারের রুচি বাড়ানো ও ক্ষুধামান্দ্য দূর করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে এটি। প্রচুর পরিমাণ আইসোফ্লাভোন ও অ্যালকালয়েড নামক ফাইটোক্যামিকাল রয়েছে যা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং ক্যানসার প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে এটি হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। দূর করে পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহ। তাছাড়া গ্যাস্ট্রিক ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

চুইঝাল স্নায়বিক উত্তেজনা ও মানসিক অস্থিরতা প্রশমন করে। মানবশরীরের বিভিন্ন ধরনের ব্যথা দূর করে শরীর সতেজ রাখতে সহায়তা করে। এটি ঘুমের ওষুধও বটে! শারীরিক দুর্বলতা কাটাতে সাহায্য করে। প্রসূতি মায়েদের শরীরের ব্যথা কমাতে চুইঝাল কাজ করে ম্যাজিকের মতো। চুইঝাল বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকজনিত রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

বাগেরহাট সদরসহ জেলার বিভিন্ন বড় হাটে চুইঝালের ছোট-বড় স্থায়ী-অস্থায়ী দোকান রয়েছে। চাহিদা বাড়ছে দিন দিন। সেই সঙ্গে বাড়ছে দামও। ভোজনরসিক মানুষের কাছে চুইঝালের কদর আগের তুলনায় বাড়ছে।

চুইঝাল বিক্রেতা কুদ্দুস শেখ বলেন, চাহিদা দিন-দিন বাড়ছে। ঈদসহ বিভিন্ন বিশেষ দিনে চাহিদা বাড়ে সবচেয়ে বেশি। আগে যে চুই ৬০০ টাকা কেজিতে বাড়ি থেকে পাইকারি দরে কিনতাম, এখন সেই চুই কিনতে হচ্ছে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায়। তবে মূল চুইঝালের দাম আরও বেশি।

আরেক বিক্রেতা আব্দুস সোবাহান বলেন, হঠাৎ চুইঝালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। স্থানীয় জাতের যে চুইঝাল আগে প্রতি মণ ২ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হতো, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। মোটা ও মূল চুইয়ের দাম সবচেয়ে বেশি। আমার কাছে ৫০০ থেকে ১২০০ টাকা কেজির চুইঝাল রয়েছে।

চুইঝাল কিনতে আসা মারুফ হাওলাদার বলেন, চুইঝাল ছাড়া মাংসের তেমন স্বাদই পাই না। মাংস কিনলেই চুইঝাল কিনে নিই। ঢাকায় আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও পাঠাতে হয়। আগের চেয়ে দামও বেড়েছে।

বাগেরহাট শহরের সবজি বাজারে দেড় যুগের বেশি সময় ধরে শুধু চুইঝাল বিক্রি করছেন জামান শেখ। প্রতিদিন সকালে দোকান নিয়ে বসেন তিনি, থাকেন বাজার শেষ না হওয়া পর্যন্ত। তিনি বলেন, আগে চুইঝালের চাহিদা তেমন ছিল না। বেচা-বিক্রিও কম ছিল না। তবে দিন দিন চাহিদা বাড়ছে, প্রতিদিন বিক্রিও ভালো হচ্ছে। চুইঝাল বিক্রি করে দুই ছেলে ও এক মেয়েকে লেখাপড়াসহ সংসারের সব খরচ চালান বলে জানান তিনি।

বাগেরহাট শহরের বাইরে ও জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে অনেক দোকান ঘুরে দেখা যায়, চুইঝালের চিকন ডাল কেজি ৪৫০-৫০০ টাকা, একটু মোটা ডাল ৬০০-৬৫০ টাকা, বড় ডাল ১১০০-১২০০ টাকা, গাছ-কাণ্ড ১২০০-১৪০০ টাকা।

সিলেটের ‘আসাম বাড়ি’

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৪, ১০:০৮ এএম
সিলেটের ‘আসাম বাড়ি’
শত বছরের পুরোনো আসাম প্যাটার্নের চুন-সুরকির তৈরি দোতলা বাড়িতে এখনো বসবাস করছেন রফিকুল হক ও তার পরিবার। সিলেট নগরীর তাঁতিপাড়া এলাকা থেকে তোলা। ছবি: মামুন হোসেন

‘চাঁদনী ঘাটের সিঁড়ি/ আলী আমজদের ঘড়ি/ বঙ্কু বাবুর দাড়ি/ জিতু মিয়ার বাড়ি’। সিলেটের বহুল প্রচলিত প্রবাদ। ‘জিতু মিয়ার বাড়ি’ হিসেবে যেটির উল্লেখ করা হয়েছে, সেই বাড়িটি চুন-সুরকি দিয়ে আসাম প্যাটার্নে নির্মিত। প্রাচীনকাল থেকেই সিলেটিদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির যেমন স্বতন্ত্র ঐতিহ্য আছে, তেমনি বাড়ি নির্মাণেও ছিল নিজস্ব স্থাপত্যশৈলী। নিজস্ব এই নির্মাণশৈলী আসাম প্যাটার্ন বা ‘আসাম ঐতিহ্য’ নামে পরিচিত। এমন স্থাপত্যশৈলীর কারণে সিলেটের আদি ঐতিহ্যের সঙ্গে জুড়ে আছে জিতু মিয়ার বাড়িও। 

স্থানীয় ইতিহাস বলে, সিলেটের স্বনামধন্য জমিদার ছিলেন খান বাহাদুর আবু নছর মোহাম্মদ এহিয়া ওরফে জিতু মিয়া। ১৮৮৬ সালে মূল বাড়িটি নির্মাণ করেন জিতু মিয়ার বাবা মাওলানা আবু মোহাম্মদ আবদুল কাদির। ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে সিলেট ও আসামের অধিকাংশ স্থাপনার মতো এটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর ১৯১১ সালে জিতু মিয়ার বাড়িটির সামনের অংশে একটি নতুন দালান নির্মাণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে এটিই জিতু মিয়ার বাড়ি হিসেবে পরিচিতি পায়। 

সেই কালে ১ দশমিক ৩৬৫ একর ভূমিজুড়ে ঐতিহ্যবাহী এই বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছিল মুঘল আমলের মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন আসাম প্যাটার্নে। সেই স্থাপত্যশৈলীর বাড়িগুলোতে কাঠের নল-বর্গার সঙ্গে চুন-সুরকির প্রলেপ দেওয়া হতো। ঘরগুলোর দেয়াল, দরজা-জানালা থেকে শুরু করে চালাতেও ছিল নান্দনিকতার ছোঁয়া। টালি বা ঢেউটিন দিয়ে ২ থেকে ১৩টি পর্যন্ত হতো ঘরের চালা। তখন সেই নির্মাণশৈলীতে সিলেটের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা বাড়ি তৈরি করাতেন। ধীরে ধীরে এই নির্মাণশৈলী জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। 

এখনকার সিলেট মহানগরী তখন ছিল শহর। গ্রাম ও শহরের ব‍্যবধান ছিল বাড়ির চাকচিক‍্য বিচারে। বিভিন্ন উপজেলায় এখনো কিছু বাড়ি রয়েছে আসাম প্যাটার্নের। কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি ভবনও রয়েছে। অনেকেই ঐতিহ্যের নিদর্শনস্বরূপ বাড়িগুলো রেখে দিয়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি ভবনগুলো এখন সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ। 

সেমিপাকা আসাম প‍্যাটার্নের বাড়ির নির্মাণশৈলী এখনো আকর্ষণীয় বলে মনে করেন স্থপতি রাজন দাশ। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, যদিও সিলেট একসময় আসাম প্রদেশের সঙ্গে ছিল, এ জন্যই আমরা এই ধরনের বাড়িকে আসাম প্যাটার্ন বাড়ি বলি। কিন্তু সিলেট অঞ্চলের বাড়িগুলো আসাম থেকেও কিছুটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বলেই আমরা একে সিলেট প্যাটার্ন বা সিলেটি বাড়ি বলতে পারি। তৎকালীন আসামের উঁচু অঞ্চলগুলোতে এ ধরনের বাড়ি তৈরি করা হতো। কোনো কোনো বাড়ি টিলার ওপরে মাচা করেও বানানো হতো, যাতে পাহাড় বেয়ে নেমে-আসা পানি ঘরের নিচ দিয়ে চলে যায়। ইংল্যান্ডে প্রথম করোগেটেড আয়রন শিট বা সিআই শিট তৈরি হয়, যা ব্রিটিশ উপনিবেশ দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতীয় অঞ্চলে আসে, মূলত মাইনিং এরিয়াগুলোর পাশে ওয়্যার হাউসের জন্য এই সিআই শিট ব্যবহৃত হতো। ক্রমশ তা এ অঞ্চলের কুঁড়েঘরের ছাদ হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। ভিত্তি হিসাবে লোহার খুঁটি আর দেয়ালগুলোতে কাঠের ফ্রেম (যাকে আমরা ব্যাটন বলি) ও তার ভেতরে মাটি-লেপা ‘ইকরা’র বেড়ার ব্যবহার শুরু হয়। স্থাপত্যকলায় একে বাংলা ব্যাটন বাড়ি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

১৮৯৭ সালের ঐতিহাসিক ভূমিকম্পের পর আসাম ও সিলেট অঞ্চলে ইট ও চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত দালান বাড়িগুলোর প্রায় সব কটি ভেঙে পড়েছিল। এ তথ্য উল্লেখ করে স্থপতি রাজন দাশ আরও বলেন, কোনোটিরই ছাদ অক্ষত ছিল না। বলা হয় তৎকালে প্রায় ৫০০ বাড়ি ধসে পড়েছিল। পরবর্তী সময়ে ভূমিকম্পের কথা মাথায় রেখে ছাদ হিসেবে চুন-সুরকির বদলে টিনের বাড়ির প্রচলন হয়। এগুলো বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে। যেমন, ইংরেজি বর্ণ ই, এইচ, ইউ, সি কিংবা এল আকৃতির টিনের ছাদবিশিষ্ট বাড়ি। 

কালের পরিক্রমায় নির্মাণ প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে সিলেট অঞ্চলে যেসব বাড়ি অবশিষ্ট আছে, সেগুলোও ভগ্নদশাগ্রস্ত। যেসব আসাম প্যাটার্ন বা সিলেট প্যাটার্ন বাড়ি স্থাপত্যকলার দৃষ্টিতে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছিল, তার অনেকই ধ্বংস হয়ে গেছে। সিলেটে এ রকম একটি স্থাপত্য ছিল সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের আবু সিনা ছাত্রাবাস। সেটি ভেঙে বহুতল ভবন করা হয়েছে।

এ ছাড়াও ‌ শহিদ ডা. শামসুদ্দিন ছাত্রাবাস, এমসি কলেজের সুকান্ত ছাত্রাবাস ও বাংলা বিভাগের ভবনগুলো সেই সময়ের স্থাপত্যের সৌন্দর্যের স্মৃতি এখনো বহন করছে। 

স্থপতি রাজন দাশ বলেন, আমার জানামতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী ব্রিটিশ পিরিয়ডের স্থাপত্য-আঙ্গিক নিয়ে গবেষণা করছেন। তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, ওই সময়ের স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যগুলোকে চিহ্নিত করা এবং ড্রইংয়ের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা। যাতে পরবর্তী প্রজন্মের স্থাপত্য শিক্ষার্থীদের এই বিষয়ে জানানো যায়। আমি মনে করি, এই ধরনের বাড়িগুলো আমাদের এই অঞ্চলের স্থাপত্য-ঐতিহ্যের তথা ইতিহাসের অংশ। যেগুলো এখনো দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোকে ঐতিহ্য ঘোষণা করে সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা অতি জরুরি।