হাটটি ২০০ বছরের পুরোনো। এর বিস্তৃতি ছিল প্রায় ৩ কিলোমিটার। শুরু থেকে গরু, পাট ও ধান বিক্রির জন্য সারা দেশে পরিচিত ছিল। কালের বিবর্তনে এটি ক্রমশ ছোট হয়ে বাজারে পরিণত হয়েছে। এখন এই হাটটিকে অনেকে নৌকার হাট নামে চেনেন। বলছিলাম মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ডিঙি নৌকার হাটের কথা।
পদ্মা, যমুনা, ধলেশ্বরী ও ইছামতী নদীবেষ্টিত মানিকগঞ্জ জেলা। বর্ষা এলেই এ এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। ফলে মানুষের চলাচলের একমাত্র বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয় ডিঙি নৌকা। আর মানিকগঞ্জসহ আশপাশের জেলাগুলোর ডিঙি ও কোশা নৌকার জোগান দিয়ে আসছে ঐতিহ্যবাহী ঘিওরের এ হাটটি।
বর্ষা মৌসুমে প্রতি বুধবার উপজেলা সদরের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে বসে এ নৌকার হাট। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে নৌকা বেচাকেনা। আকার ও মানভেদে প্রতিটি নৌকা ৩ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। মানিকগঞ্জ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী ঢাকার সাভার, ধামরাই, টাঙ্গাইল ও রাজবাড়ী থেকেও আসেন ক্রেতা ও বিক্রেতারা।
অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক মোহাম্মদ সিরাজ খান বলেন, ‘ব্রিটিশ শাসনামলে আঠারো শতকের প্রথম দিকে ধলেশ্বরী ও ইছামতী নদী তীরের এই ঘিওর হাটটি গরু, পাট ও ধান বিক্রির জন্য বিখ্যাত ছিল। এখনো প্রতি বুধবারে এখানে হাট বসে। কালের বিবর্তনে এই হাটটির ঐতিহ্য থাকলেও আগের মতো আর জৌলুস নেই। বর্ষা মৌসুমে এখানে প্রতিবছর নৌকার হাট বসে। অনেক জেলা উপজেলা থেকে নৌকার ব্যাপারী ও ক্রেতারা আসেন।’
বৃদ্ধ রহমত আলী বলেন, ‘এই ঘিওর হাটের ঐতিহ্য সারা দেশেই রয়েছে। আশপাশে এমন বড় নৌকার হাট না থাকায় অনেক নৌকা ওঠে এখানে। প্রতি মৌসুমে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার নৌকা বিক্রি হয়। একটা সময় এই হাটটি ৪০-৪৫ লাখ টাকা সরকারি ডাক হলেও বর্তমানে তা ১০-১২ লাখ টাকায় ডাক নেন ইজারাদার। হাটের অব্যবস্থাপনার জন্যই এমন দশা হয়েছে। এতে করে একদিকে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অপরদিকে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। আমরা চাই ঘিওরে হাটটির ঐতিহ্য আবার ফিরে আসুক।’
এই হাটে নৌকা বিক্রি করতে আসা ব্যবসায়ী রমিজ উদ্দিন বলেন, ‘এই হাটে ১৬ বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে বিভিন্ন আকার ও মানের নৌকা বিক্রি করে থাকি। এ বছরের জুন মাসে প্রথম নৌকার হাট বসেছে। হাট কবে শেষ হবে তা নির্ভর করে নদীতে পানি থাকার ওপর।’
নৌকার কারিগর সুবল সরকার প্রায় এক যুগ ধরে নৌকা বানোনোর সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, ‘এ হাটে আম, জাম, ঝিকা, ডুমরা, মেহগনি, কড়ই, চাম্বুল কাঠের নৌকা পাওয়া গেলেও চাম্বুল ও কড়ই কাঠের নৌকার চাহিদা অনেক বেশি। কিন্তু অধিকাংশ ক্রেতাই ছোট ও মাঝারি আকারের নৌকা কিনে থাকেন।’
দৌলতপুর উপজেলার কলিয়া গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আগের নৌকাটা নষ্ট হওয়ায় ঘিওর হাটে এসেছি। নৌকার দাম তুলনামূলকভাবে আগের চেয়ে বেশি। আমি চাম্বুল কাঠের ৭ হাতের একটা নৌকা কিনেছি সাড়ে ৫ হাজার টাকা দিয়ে।’
নৌকার ব্যাপারী রহমত আলী বলেন, ‘নৌকা তৈরির কাঠ, পেরেক ও মিস্ত্রিখরচ বাড়ায় আমরা দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছি। দাম বাড়ায় অনেক ক্রেতা না কিনেই চলে যান। এতে করে আমাদের ব্যবসায় লোকসান হয়। কার্তিক মাস পর্যন্ত বেচাকেনা চলবে।’
নৌকা কেনার পর হাট থেকে অন্যত্র নেওয়ার জন্য ভ্যান ও ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই হাটে নৌকা পরিবহন করার জন্য অর্ধশতাধিক ঘোড়ার গাড়ি ও ভ্যান চালক রয়েছেন। ঘিওর নৌকা হাটের ইজারাদার আলমগীর হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী ঘিওর নৌকার হাটে মানিকগঞ্জ জেলাসহ আশপাশের শতাধিক ব্যবসায়ী ও নৌকা তৈরির কারিগররা আসেন। এ হাটের স্থায়িত্ব নির্ভর করে নদীনালা ও খালবিলে পানি কতদিন থাকে তার ওপর। প্রতি বুধবার এ হাটে গড়ে এক থেকে দেড় শ নৌকা বিক্রি হয়, যা টাকার অঙ্কে প্রায় ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা।’
ঘিওর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ঘিওর হাট জেলার অন্যতম বড় হাট হিসেবে পরিচিত। শুনেছি ব্রিটিশ আমলেও এই হাটটি বেশ জমজমাট ছিল। উপজেলায় মোট ৭টি হাট-বাজার রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ টাকায় ইজারা দেওয়া হয় এই ঘিওর হাটটিকে।’