অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে সোমবার (৭ অক্টোবর)। গত বছরের এই দিনে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলি ভূখণ্ডে স্থল, আকাশ ও নৌপথে আচমকা হামলা চালিয়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি নাগরিককে হত্যা করে এবং ২৫০ জনকে বন্দি করে। বন্দিদের মধ্যে সাধারণ নাগরিক ছাড়াও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সেনাসদস্য ছিলেন। এর পর থেকে প্রতিশোধের যে উন্মত্ত প্রদর্শনী ইসরায়েলি বাহিনী শুরু করে, তা বিরামহীনভাবে চলছে এক বছর ধরে। আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘ প্রস্তাব অনুসারে নিপীড়ক ও দখলদার শক্তি হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার পরও এখন পর্যন্ত পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল। এই আগ্রাসনে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৪১ হাজার ৮৭০ জন ফিলিস্তিনি। নিহতদের মধ্যে ১৭ হাজার শিশু এবং ১১ হাজার নারী রয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় এক লাখ মানুষ।
৭ অক্টোবরের হামলাকে নিপীড়িতের প্রতিরোধ বলছে হামাস। অন্যদিকে ইসরায়েল আত্মরক্ষার অধিকারের নামে ক্লিশে যুক্তি দেখিয়ে পৈশাচিক আগ্রাসনকে যৌক্তিক প্রমাণের চেষ্টা করে আসছে। সমর্থক হিসেবে তারা পাশে পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু পশ্চিমা দেশকে।
গাজা ছাড়িয়ে যুদ্ধ গত মাসে গড়িয়েছে লেবাননেও। সেখানেও পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরু করেছে ইসরায়েল। এই যুদ্ধে সম্প্রতি জড়িয়ে পড়েছে ইরানও। তাদের মিত্র সশস্ত্র লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরাল্লাহসহ একাধিক ইরানি জেনারেলকে হত্যা, লেবানন ও গাজায় আগ্রাসনের প্রতিবাদে ইসরায়েলে সম্প্রতি নজিরবিহীন ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে তেহরান। ইতোমধ্যে এর প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তাই আরেকটি ফ্রন্টে যুদ্ধ শুরুর দ্বারপ্রান্তে মধ্যপ্রাচ্য।
কোটি কোটি টন ধ্বংসস্তূপ নিয়ে বিপাকে গাজাবাসী
ইসরায়েলি দখলদারদের ধারাবাহিক হামলায় পুরো গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। যেখানেই চোখ যায় বিধ্বস্ত কংক্রিটের ছড়াছড়ি। সেখানে ধ্বংসস্তূপের পরিমাণ ৪ কোটি ২০ লাখ টনেরও বেশি হবে।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, এসব ধ্বংসস্তূপ ২০০৮ থেকে গত বছর যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত গাজা ভূখণ্ডে সঞ্চিত আবর্জনার ১৪ গুণ এবং ২০১৬-১৭ সালে ইরাকের মসুলে হওয়া যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের পাঁচ গুণের বেশি। এসব ধ্বংসস্তূপ একসঙ্গে জড়ো করা হলে তা দিয়ে মিসরের বৃহত্তম পিরামিডটিকে (গিজার মহাপিরামিড) ১১ বার ভরে দেওয়া যাবে। আর এই ধ্বংসস্তূপের পরিমাণ প্রতিদিনই বাড়ছে। এই বিষাক্ত ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করতে প্রয়োজন প্রায় ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। তবে উপত্যকাটিকে বাস উপযোগী করতে আবর্জনাগুলো দ্রুত অপসারণ প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশে দেশে বিক্ষোভ
গাজায় ইসরায়েলের হামলা বন্ধের দাবিতে ফ্রান্সের প্যারিস থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, ইতালির রোমসহ নানা দেশে হাজারও মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। বিক্ষোভে কোথাও পুলিশ বাধা দিয়েছে, কোথাও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হয়েছে, আবার কোথাও সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে।
আল-জাজিরার খবর বলছে, গত শনিবার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপজুড়ে হাজারও মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন। লন্ডনের ডাউনিং স্ট্রিট অভিমুখে পুলিশের কড়া পাহারায় কয়েক হাজার মানুষ বিক্ষোভ মিছিল করেন। সে সময় পরিস্থিতি উত্তেজনাকর হয়ে ওঠে। এ সময় বিক্ষোভকারীরা ব্যারিকেড পার করে যেতে চাইলে পুলিশি বাধার মুখে পড়েন। লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ বলছে, সেখান থেকে কমপক্ষে ১৭ জনকে আটক করা হয়েছে।
জার্মানির সংবাদ সংস্থা ডিপিএ বলেছে, দেশটির হামবুর্গ শহরে ফিলিস্তিন ও লেবাননের সমর্থনে প্রায় ৯৫০ জন মানুষ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করেছেন। বিক্ষোভকারীদের অনেকের হাতে ফিলিস্তিন ও লেবাননের পতাকা দেখা গেছে। তারা এ সময় ‘গণহত্যা বন্ধ করুন’ বলে স্লোগান দেন।
এদিকে প্যারিসের রিপাবলিক প্লাজায় ফিলিস্তিনি ও লেবাননের নাগরিকদের প্রতি সংহতি জানিয়ে কয়েক হাজার মানুষ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। এ সময় অনেক ফিলিস্তিনির হাতে ‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’, ‘হ্যান্ডস অব লেবানন’ লেখা পোস্টার দেখা যায়। ইতালির রাজধানী রোমে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুড়েছে। শনিবার বিকেলে রোমে কয়েক হাজার মানুষ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অংশ নেন।
নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে যুদ্ধবিরতির দাবিতে ফিলিস্তিনি সমর্থকরা জড়ো হয়েছেন। তারা ‘গাজা, গাজা’ বলে স্লোগান দেন। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ছবিতে লাল রং মাখিয়ে, ফিলিস্তিনি ও লেবাননের পতাকা হাতে তারা বিক্ষোভে অংশ নেন। এ ছাড়া এশিয়া ও আফ্রিকার অসংখ্য দেশে গাজায় যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন সাধারণ মানুষ। সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, আল-জাজিরা, রয়টার্স