
সিরিয়ার বাশার-আল-আসাদ সরকারের পতনকে যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্য এবং রাশিয়ার পরাজয় হিসেবে দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে এবার অতি সহজেই পশ্চিম এশিয়ার দেশটিতে ‘রাজত্ব’ করতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ইসরায়েল-তুরস্ক। অন্যদিকে বিপদে পড়তে পারে রাশিয়া ও তার মিত্র ইরান।
শুধু তাই নয়, আসাদ সরকারের পতনে সিরিয়া থেকে রুশ সেনাঘাঁটি সরাতে বাধ্য হবে মস্কো। এত দিন ভূমধ্যসাগরের তীরে ছিল সেগুলোর অবস্থান। কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় সিরিয়ার রুশ সেনাঘাঁটিগুলো পাত্তা দিতে বাধ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীও। দামেস্কের দখল বিদ্রোহীদের হাতে যাওয়ায় সে দিক থেকেও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল তারা।
তবে পশ্চিম এশিয়ার দেশটিতে বিদ্রোহীরা ক্ষমতায় আসায় সবচেয়ে বিপদে পড়েছে ইরান। দেশটি এত দিন সিরিয়াকে বাফার রাষ্ট্র হিসেবে ব্যবহার করছিল। সিরিয়ার ওপর দিয়েই লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর কাছে যাচ্ছিল তেহরানের অস্ত্র।
ইসরায়েলের একেবারে উত্তর দিকে লেবাননের অবস্থান। দীর্ঘ দিন ধরেই সেখানে হিজবুল্লাহ শক্তি বাড়াচ্ছে। ইরানের মদদে প্রায়ই শিয়াপন্থি এই সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসরায়েলে হামলা করছে। ইরানের অস্ত্র আসা বন্ধ হলে সেই পরিকল্পনা থেকে পিছু হটতে হবে তাদের।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের দাবি, সিরিয়ার সংকটে পোয়াবারো হতে পারে ইসরায়েল এবং তুরস্কের। দুই রাষ্ট্রের কাছেই পশ্চিম এশিয়ার এই দেশটির বেশ কিছুটা জমি হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এতে একদিকে যেমন ‘গ্রেটার ইহুদিভূমি’ তৈরির স্বপ্ন পূরণের দিকে এক কদম এগোবে তেল আবিব, অন্য দিকে তেমনই আরবে আধিপত্য বাড়বে আঙ্কারার।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা আবার দামেস্কের পতনকে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে উল্লেখ করেছেন। এর মাধ্যমে আরব দুনিয়া থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হলেন তিনি। এর ফলে আগামী দিনে পশ্চিম এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব ওয়াশিংটন যে কয়েকগুণ বাড়িয়ে নিতে পারবে, তা বলাই বাহুল্য।
সিরিয়ার আসাদকে সরাতে ২০১১ সাল থেকে চেষ্টা চালিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সমর্থন থাকায় সেটা সম্ভব হচ্ছিল না। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’-এর সূচনা করে মস্কো। আর ঠিক তখনই পশ্চিম এশিয়া থেকে রাশিয়াকে তাড়ানোর সুবর্ণসুযোগ চলে আসে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিরক্ষা কার্যালয় পেন্টাগনের পদস্থ জেনারেলরা বুঝেছিলেন অস্ত্র সরবরাহ চালু রাখলে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পক্ষে ইউক্রেন দখল খুব সহজ হবে না। এই সুযোগে ন্যাটোভুক্ত দেশ তুরস্ককে দলে টেনে আসাদবিরোধী বিদ্রোহীদের পেছন থেকে মদদ জুগিয়ে গেলে কেল্লাফতে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সমর বিশেষজ্ঞদের কথায়, আসাদ সরকারের কফিনে দ্বিতীয় পেরেকটি পুঁতেছে ইরান ও হিজবুল্লাহ। গত বছরের ৭ অক্টোবর হঠাৎ করেই ইসরায়েলে ঢুকে হত্যাযজ্ঞ চালায় তেহরানের মদদপুষ্ট ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘হামাস’। তাদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করতে সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
গত বছরের অক্টোবর থেকে হামাসের ঘাঁটি গাজায় একের পর এক হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। হামলায় হামাস কোণঠাসা হয়ে পড়েছে বুঝতে পেরে যুদ্ধে নামে হিজবুল্লাহ। লেবাননের দিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ইরান মদতপুষ্ট ওই সশস্ত্র গোষ্ঠী। ফলে হিজবুল্লাহকে দুর্বল করতে লেবাননে হামলা শুরু করে ইসরায়েল।
যুদ্ধের মধ্যেই ইসরায়েলি গুপ্তচররা বুঝে যান হিজবুল্লাহকে হাতিয়ার সরবরাহ করতে সিরিয়াকে ব্যবহার করছে ইরান। অবিলম্বে তা বন্ধ করার হুমকি দিয়ে প্রেসিডেন্ট আসাদকে সতর্ক করে তেল আবিব। কিন্তু তাতে কাজ না হওয়ায় সেখানে বিমান হানা চালায় ইসরায়েল।
ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের ঝটিকা আক্রমণে বড়সড় লোকসান হয় সিরিয়ার সরকারি সেনাবাহিনীর। তাদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রথমে দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পোকে নিশানা করে বিদ্রোহীরা। গত ৫ ডিসেম্বর তাদের হাতে পতন হয় সামরিক দিক থেকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হামার। এরপর রাজধানী দামেস্কে ঢুকে পড়ে বিদ্রোহী সেনার দল।
অন্যদিকে ২০১১ সালে সিরিয়ায় গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনের বিরুদ্ধে আসাদ সরকার কঠোর দমন নীতি গ্রহণ করে। তখন শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধ এবং এর ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক লড়াইয়ে তুরস্ক সিরিয়ার বিরোধী বাহিনীকে সমর্থন দিয়ে আসছে। চলতি বছর তুরস্ক বাশার আল আসাদকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানায়। তবে সিরিয়ায় তুরস্কের সেনা উপস্থিতির কারণে আসাদ আঙ্কারার সঙ্গে বসতে অস্বীকৃতি জানান।
এই পরিস্থিতিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)-কে আলেপ্পো ও হোমস শহরে সফল হামলা চালানোর অঘোষিত সমর্থন দেন। সূত্র: সিএনএন, আনাদোলু, আনন্দবাজার।