
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ইংরেজি দৈনিকের উদ্দেশ্যমূলক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দুবাইয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের গোপন সম্পদ নিয়ে কয়েক মাস ধরে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করছে পত্রিকাটি। চলতি মাসের শুরুতেও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক অলাভজনক সংগঠন সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিসের (সিফোরএডিএস) তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
ডেইলি স্টারের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪৬১ জন বাংলাদেশি নাগরিকের নামে দুবাইয়ে ৯০০টিরও বেশি সম্পত্তি কেনা হয়েছে, যার মূল্য প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার। তবে তাদের ওই অনুসন্ধানের বিশ্বাসযোগ্যতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন ইন্টারন্যাশনাল পলিসি ডেইজেস্ট-এর সাংবাদিক থমাস ইব্রাহিম।
এ ধরনের প্রশ্ন ওঠার কারণও আছে। পত্রিকাটি (ডেইলি স্টার) তাদের প্রতিবেদনকে শক্তিশালী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বলে জাহির করেছে। প্রতিবেদনে ইনফোগ্রাফিকস ও প্রোফাইল ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি দেখলে মনে হতে পারে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রতিষ্ঠিত কোনো তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রচিত। কিন্তু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, সিফোরএডিএসের ২০২০ ও ২০২২ সালের প্রকাশিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। পুরোনো এই তথ্য দিয়ে পত্রিকাটি ২০২৫ সালে অনুসন্ধানের নামে কেন প্রতিবেদনটি প্রকাশ করল তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। প্রতিবেদনে সম্পদের ক্রেতা বাংলাদেশির সংখ্যার কথা বলা হয়েছে ৪৬১ জন। কিন্তু পত্রিকাটি মাত্র ১২ জনের তথ্য-উপাত্তকে সবিস্তার প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে।
প্রতিবেদন প্রকাশের সময় এবং মাত্র ১২ জনের তথ্যপ্রমাণ কেন ফলাও করে প্রকাশ করা হলো- প্রশ্ন সেখানেই। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে। অন্তর্বর্তী সরকার সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার এবং তাদের সহযোগীদের টার্গেট করে প্রচার চালাচ্ছে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পত্রিকাটিও অন্তর্বর্তী সরকারের ‘ন্যারেটিভ’ হিসেবে কাজ করছে।
প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল ‘নেইমস অ্যান্ড শেমস’। প্রতিবেদনে সাবেক ভূমিমন্ত্রী, একজন সাবেক পুলিশ ইন্সপেক্টরের স্ত্রী, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাবেক নেতা এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর নাম রয়েছে। তবে তালিকায় থাকলেও জারিফ আয়াত হোসেনের নাম প্রতিবেদন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। জারিফ আয়াত হোসেন হচ্ছেন সিমিন রহমানের ছেলে। দুবাইয়ের এক্সক্লুসিভ জুমেরা পামে তার নামে ১৫ লাখ ডলারের গোপন সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। সিমিন রহমান হলেন ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর মালিক। তার নামে বিভিন্ন ধরনের বিতর্ক রয়েছে। ছোট ভাইবোনের স্বাক্ষর জাল করে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এই আত্মসাতের ঘটনা নিয়ে শুনানির মাত্র ১০ দিন আগে তার ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যু ঘটে। এই নিয়েও বিতর্ক রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ছোট বোন তার বিরুদ্ধে ভাই হত্যার মামলা করেছেন। আওয়ামী লীগ ও অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে অর্থ আত্মসাতে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠলেও সিমিন রহমান বা তার ছেলে- কারও নাম প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।
এ ধরনের ইচ্ছাকৃত ভুল বা ভ্রান্তির অর্থ হলো বাংলাদেশের আর্থিক দুর্নীতি বন্ধে চলমান অভিযানকে খাটো করে দেখা। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর অর্থের পাচার বা মানিলন্ডারিংকে শক্ত হাতে দমনের ঘোষণা দিয়েছেন। ডেইলি স্টারের এই বেছে বেছে রিপোর্ট করা আহসান মনসুরের অর্থ পাচার প্রতিরোধ চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এ ধরনের অবস্থান অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার নিয়েও সাধারণ মানুষের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি করবে।
আর্থিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) চলমান উদ্যোগকেও সমালোচনার মুখে ফেলবে এই প্রতিবেদন। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বিএফআইইউ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সাংবাদিক এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের আর্থিক হিসাবের তথ্যাদি চেয়েছে। পত্রিকাটির এ ধরনের ‘তথাকথিত অনুসন্ধানী’ সাংবাদিকতা যখন প্রশংসা পায়, তখন সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়ে সাংবাদিকদের চুপ করিয়ে রাখেন। তাই এ ধরনের কার্যক্রম গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিপন্থি। একটি দেশের স্বাধীন গণমাধ্যমের প্রতি এ ধরনের পদক্ষেপ হুমকি তৈরি করে বৈকি।