বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমন করতে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ডের (ম্যাস কিলিং) বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি মামলায় ঢাকার সিএমএম আদালতের এক বিচারকের খাসকামরায় বসে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় তিনি জবানবন্দি দেন।
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার জন্য গত মাসে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে ম্যাস কিলিংয়ের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পুলিশের প্রতি নির্দেশ ছিল বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। তার আগ্রহের ভিত্তিতে অত্যন্ত গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে জবানবন্দির বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটররা।
ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনা মোতাবেক আজ সকালে কঠোর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে কারাগার থেকে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইনের খাসকামরায় হাজির করা হয়। সেখানে তিনি লিখিতভাবে তার বক্তব্য তুলে ধরেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় কোনো আসামির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম। একইভাবে জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘটিত গণহত্যা মামলায় প্রথমবারের মতো কোনো সরকারি কর্মকর্তা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেন।
সূত্র জানিয়েছে, বিচারকের খাসকামরায় সাবেক এই আইজিপি ছিলেন আড়াই ঘণ্টা। এ সময় তাকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে একাধিকবার সময় দেওয়া হয়। কারণ এই ধরনের জবানবন্দি মামলার বিচারের ক্ষেত্রে তার বিপক্ষেও যেতে পারে। পরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি জবানবন্দি দেন। তিনি তার জবানবন্দিতে শুধু নির্দেশদাতাদের দায় ও নির্বিচারে হত্যার ঘটনার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, নাকি এসব হত্যায় নিজের দায়ও স্বীকার করেছেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করছেন এবং সংশ্লিষ্ট মামলার আনুষ্ঠানিক বিচারের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিষয়টি গোপন রাখা হবে বলেও জানা গেছে।
একাধিক মামলায় গত ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার উত্তরা থেকে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসব মামলায় তাকে কয়েক দফায় রিমান্ডে নেওয়া হয়।
এদিকে জুলাই-আগস্টে দেশব্যাপী গণহত্যার ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে গত ১৪ ও ২৯ আগস্ট দুটি অভিযোগ দাখিল করা হয়। এ দুটি অভিযোগে আসামির তালিকায় শেখ হাসিনাসহ মোট ৬১ জনের নাম উল্লেখ রয়েছে। একটিতে ৯ জন, অন্যটিতে ৫২ জনের নাম রয়েছে। এতে সাবেক প্রভাবশালী অনেক মন্ত্রী-এমপি ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ বেশ কিছু শীর্ষস্থানীয় সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৭ অক্টোবর শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জন এবং ২৭ অক্টোবর একাধিক মামলায় ১৭ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। তাদের আগামী ১৮ ও ২০ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আসামিদের অনেকেই আত্মগোপনে এবং পালিয়ে বিদেশ গেছেন। তবে অন্যান্য মামলায় চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ কারাবন্দি থাকা আসামিদের গণহত্যার মামলায় ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার দেখানো (শ্যোন অ্যারেস্ট) হয়েছে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ। সে সময় মামলার তদন্ত ও বিচারকাজে ব্যাপক তৎপরতা দেখা যায়। এ নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনাও হয়। বিচারকাজ ত্বরান্বিত করতে ২০১২ সালের ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুটিকে একীভূত করে আবার একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। এ সময়ের মধ্যে বেশ কিছু আলোচিত মামলার রায় ঘোষণা এবং কয়েকটি রায় কার্যকর করা হয়। গত ১৪ বছরে ৫৫টি মামলার রায় দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এসব মামলায় ১৪৯ জনকে দণ্ড দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে ছয়জনের। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা পাঁচজন এবং একজন বিএনপির নেতা। ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজে স্থবিরতা তৈরি হয় গত বছরেই। সর্বশেষ চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি শেরপুরের নকলার তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। সেই সময়ে ট্রাইব্যুনালে ৩০টি মামলার বিচার চলছিল। এরপর আর কোনো মামলার বিচারকাজ পরিচালনা হয়নি। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের কিছুদিন আগে ও পরে ট্রাইব্যুনালের তিন বিচারকের মধ্যে একজন অবসরে যান। আরেকজনকে হাইকোর্টে ফিরিয়ে আনা হয়। অপরজন ২৭ আগস্ট বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ-পিআরএল ভোগরত) এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া আবেদন করে অব্যাহতি নিলে বিচারকাজ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়। ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর ট্রাইব্যুনাল, ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হলে নতুন করে বিচারকাজ শুরু হয়। গত তিন মাসে ৬০টিরও বেশি অভিযোগ দায়ের হয়েছে বলে জানা গেছে।