এ পর্যন্ত এমন কোনো স্থাপনার কথা শুনেছেন, যা পৃথিবী-বিখ্যাত কিন্তু তার কারিগর কে, তা কেউ জানে না? আজ আপনাদের তেমনই একটা স্থাপনার গল্প শোনাব।স্থাপনাটি বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি। বলছিলাম, ইতালির পশ্চিমের ছোট্ট শহর ‘পিসা’র হেলানো টাওয়ারের কথা। আজ থেকে প্রায় ১ হাজার বছর আগের কথা।
ব্যবসাবাণিজ্যে সমৃদ্ধ হতে শুরু করেছে পিসা শহরটি। নগরবাসী অনুভব করল, শহরে একটা ক্যাথিড্রাল থাকা প্রয়োজন। না হলে আশপাশের অন্যান্য শহরের তুলনায় তারা কোথাও না কোথাও পিছিয়ে থাকবে। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পর নগরবাসী একটি ক্যাথিড্রাল তৈরি করে ফেলল। ১০৬৩ থেকে ১০৯২, ক্যাথিড্রালটি তৈরি করতে সময় লাগল পাক্কা ২৯ বছর। পাহাড় থেকে আনা বিখ্যাত সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে বানানো ক্যাথিড্রালটি অনিন্দ্য সুন্দর হয়ে ধরা দিল। ২৯ বছরের সাধনা যেন সার্থক হলো।
ক্যাথিড্রাল তৈরির পর কেটে গেল ৫০ বছর। কিন্তু ততদিনেও তেরি হয়নি ক্যাথিড্রালের ঘণ্টা বাজানোর জন্য কোনো ঘণ্টা টাওয়ার। ১১৭৩ সাল। টাওয়ারের নকশা তৈরি করা হয়ে গেল। ঘণ্টা টাওয়ারের নির্মাণকাজের প্রয়োজনে ডোনা বার্তা নামের এক ধনী নারী অনেকগুলো রুপার মুদ্রা দান করলেন। তার দেওয়া অর্থ দিয়ে যতগুলো পাথর কেনা সম্ভব হলো, তা দিয়েই ঘণ্টা টাওয়ারের কাজ শুরু করা হলো। সেই অপর্যাপ্ত পাথর দিয়ে পুরো ফাউন্ডেশনটি মাত্র ৩ মিটার গভীর করা সম্ভব হলো। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা, অথচ কারও মাথাতেই এল না এই মস্ত বড় টাওয়ারটি মাত্র ৩ মিটার গভীরতা নিয়ে কীভাবে ঠিকঠাক দাঁড়িয়ে থাকবে। ভুলের শুরুটা তখন থেকেই। আর সেই ভুলের মাশুল টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছে আজও। যদিও একসময় এই ভুলই শাপে বর হয়েছে। এই ভুলের জন্যই টাওয়ারটি বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্য়ের একটি হতে পেরেছিল!
ফাউন্ডেশনের পর টাওয়ারের কাজ চলতে থাকল। তিনতলা পর্যন্ত কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর দেখা গেল, টাওয়ারটি আর ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। একপাশে হেলে পড়ছে। তার পর টাওয়ারের কাজ বন্ধ হয়ে গেল। লজ্জায় ঘণ্টা টাওয়ারের কনস্ট্রাকশনের সঙ্গে জড়িত সবাই প্রোজেক্ট থেকে নিজেদের নাম সরিয়ে নিল। নকশা আর হিসাবের কাগজপত্র সব নষ্ট করে দেওয়া হলো। কেউ যেন কখনো আর জানতে না পারে, এই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার এমন ভুলভাল কাজ কারা করেছিল।
পরবর্তী ১০০ বছর কাজ বন্ধ থাকল। টাওয়ারটি ওরকমভাবেই রয়ে গেল। ততদিনে পিসা শহরের ওপর দিয়ে বয়ে গেল নানান যুদ্ধবিগ্রহ। ১০০ বছর পর পরিস্থিতি মোটামুটি স্থিতিশীল হলে নগর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিল, টাওয়ারের কাজ এবার ঠিকঠাক মতো শেষ করা হোক। স্থপতি জিওভান্নি ডি সিমিওনিকে দেওয়া হলো এর গুরুভার। কিন্তু ভুল যেন পিছু ছাড়ছিল না। টাওয়ারের হেলে যাওয়া যেন বোঝা না যায়, তাই তিনি প্রতি তলার একপাশ আরেক পাশ থেকে উঁচু করে নির্মাণ করতে লাগলেন। এবং আরও বেশি ঘনত্বের মার্বেল পাথর ব্যবহার করলেন। ফলে, পাথরের ভারে এবং উচ্চতার অসামঞ্জস্যতায় টাওয়ার আরও হেলে পড়ল। স্বাভাবিকভাবে এবারও কাজ বন্ধ হয়ে গেল।
তার পর কেটে গেল আরও ৫০ বছর। আবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করা হলো। সাত তলা পর্যন্ত কাজ সম্পন্ন করে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো ঘণ্টা। ১৩৭২ সালে ঘণ্টা টাওয়ারটি তার কাঙ্ক্ষিত ঘণ্টর ছোঁয়া পেল।
গল্প এখানেই শেষ নয়। টাওয়ারটির কপালে দুর্ভোগের অন্ত নেই। ১৮৩৮ সালে আলেসান্দ্রো ডেল্লা নামের একজন স্থপতি টাওয়ারের ফাউন্ডেশন কিছুটা খুঁড়ে বের করে প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে যান। এতে পুরো টাওয়ারটি অনেকখানি হেলে যায়। তিনি তখনই ফাউন্ডেশনটি আবার মাটি সিমেন্ট দিয়ে ভরাট করে ফেলেন। নিরাপত্তার কথা ভেবে ১৯৯০ সালে এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার পর শুরু হয় সংস্কারের কাজ। কাজ শেষে ২০০১ সালে তা পুনরায় দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয় এবং স্থপতিরা নিশ্চয়তা দেন যে, আগামী ১০০ বছর এটি নিরাপদ থাকবে।
বিখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও ১৫৯০ সালে এই টাওয়ারে বস্তুর ভরের ওপর পৃথিবীর ত্বরণের পরীক্ষাটি চালান। যার মাধ্যমে তিনি ২ হাজার বছর আগে দেওয়া অ্যারিস্টটলের থিওরি প্রমাণ করেন।
পিসা শহরটি ছোট হলেও শুধুমাত্র এই আশ্চর্যজনক টাওয়ারটি দেখতে প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক আসেন এ শহরে। বলা বাহুল্য, এ টাওয়ারের জন্যই পৃথিবীসুদ্ধ মানুষ ইতালির ছোট্ট পিসা শহরটিকে চেনে।
কী অদ্ভুত না! যারা এই টাওয়ারের নকশা ও নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তারা যদি জানতেন একদিন তাদের ভুলভাল কাজই টাওয়ারটিকে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত করবে, তাহলে তারা লজ্জায় নিজেদের গুটিয়ে নিতেন না বরং সগৌরবে লিখে রাখতেন টাওয়ারের ইতিহাস-সংবলিত কোনো সাইন বোর্ডে বা বইয়ের পাতায়। সময়ের অতল স্রোতে তারা হারিয়ে গেলেন নীরবে। তাদের কাজ রয়ে গেল কালের সাক্ষী হয়ে।
কলি