ঢাকা ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

কবি আল মাহমুদের বর্ণাঢ্য সাহিত্য জীবন

প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৪, ০৮:১২ পিএম
আপডেট: ১০ জুলাই ২০২৪, ০৮:১৯ পিএম
কবি আল মাহমুদের বর্ণাঢ্য সাহিত্য জীবন
অলংকরণ : নাজমুল মাসুম

‘বধূ বরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহা মাতৃকূল 
গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল, কবুল’  (সোনালি কাবিন)

১১ জুলাই বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি আল মাহমুদের ৮৮তম জন্মদিন। তার পুরো নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তবে আল মাহমুদ নামেই তিনি অধিক পরিচিত। আল মাহমুদ একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে সক্রিয় থেকে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক্ভঙ্গিতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন প্রবাসী সরকারের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত সরকারবিরোধী সংবাদপত্র ‘দৈনিক গণকণ্ঠ (১৯৭২-১৯৭৪) পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

১৯৫০-এর দশকে যে কয়েকজন লেখক বাংলা ভাষা আন্দোলন, জাতীয়তাবাদ, রাজনীতি, অর্থনৈতিক নিপীড়ন এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন তাদের মধ্যে মাহমুদ একজন। লোক লোকান্তর (১৯৬৩), কালের কলস (১৯৬৬), সোনালী কাবিন (১৯৭৩), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। কবি আল মাহমুদ তার অনবদ্য গল্প ও উপন্যাসের জন্যও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মীর আবদুর রব ও মাতা রওশন আরা মীর। তার দাদার নাম আব্দুল ওহাব মোল্লা। যিনি হবিগঞ্জ জেলায় জমিদার ছিলেন। কুমিল্লার দাউদকান্দি সাধনা হাইস্কুল এবং পরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে পড়ালেখা করেন। মূলত এই সময় থেকেই তার লেখালেখির শুরু। আল মাহমুদ বেড়ে উঠেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি মধ্যযুগীয় প্রণয়োপাখ্যান, বৈষ্ণব পদাবলি, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল প্রমুখের সাহিত্য পাঠ করে ঢাকায় আসার পর কাব্য সাধনা শুরু করেন এবং ষাটের দশকেই স্বীকৃতি ও পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেন।

সংবাদপত্রে লেখালেখির সূত্র ধরে ১৯৫৪ সালে আল মাহমুদ ঢাকা আগমন করেন। সমকালীন বাংলা সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকার মধ্যে কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী সম্পাদিত ও নাজমুল হক প্রকাশিত সাপ্তাহিক কাফেলা পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে সাংবাদিকতা জগতে পদচারণা শুরু করেন। ১৯৫৫ সাল কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী ‘কাফেলা’ পত্রিকার চাকরি ছেড়ে দিলে তিনি সেখানে সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। দৈনিক ইত্তেফাকে মফস্বল বার্তা সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেন আল মাহমুদ।

১৯৭১ সালে তিনি ভারত গমন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। যুদ্ধের পর দৈনিক গণকণ্ঠ নামক পত্রিকায় প্রতিষ্ঠা-সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। সম্পাদক থাকাকালীন সরকারের বিরুদ্ধে লেখার কারণে এক বছরের জন্য কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়।

২০০৯ সালে বরিশাল সফরকালে তরুণ লেখকদের সঙ্গে কবি আল মাহমুদের এ ছবিটি তুলেছেন সাংবাদিক আযাদ আলাউদ্দীন 

 

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি গল্প লেখার দিকে মনোযোগী হন। ১৯৭৫ সালে তার প্রথম ছোট গল্প ‘পানকৌড়ির রক্ত’ প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক পদে নিয়োগ দেন। দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের পর তিনি পরিচালক হন। পরিচালক হিসেবে ১৯৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

১৯৫৪ সাল অর্থাৎ ১৮ বছর বয়স থেকে তার কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকা এবং কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, ময়ূখ ও কৃত্তিবাস ও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে তার নাম পরিচিত হয়ে ওঠে এবং তাকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়। কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর (১৯৬৩) সর্বপ্রথম তাকে স্বনামধন্য কবিদের সারিতে জায়গা করে দেয়। এরপর কালের কলস (১৯৬৬), সোনালি কাবিন (১৯৭৩), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৭৬) কাব্যগ্রন্থগুলো তাকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৯৩ সালে বের হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘কবি ও কোলাহল’।

তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার নগরকেন্দ্রিক প্রেক্ষাপটে ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে তার কবিতায় অবলম্বন করেন। নারী ও প্রেমের বিষয়টি তার কবিতায় ব্যাপকভাবে এসেছে। উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী হিসেবে নারীর যৌনতা, আকাঙ্ক্ষা ও ভোগের লালসাকে তিনি শিল্পের অংশ হিসেবেই দেখিয়েছেন। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় লোকজ শব্দের প্রয়োগ তার অনন্য কীর্তি।

১৯৬৮ সালে ‘লোক লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তার সবচেয়ে সাড়া জাগানো সাহিত্যকর্ম ‘সোনালি কাবিন’। ১৯৭০-এর দশকের শেষার্ধে তার কবিতায় বিশ্বস্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস উৎকীর্ণ হতে থাকে; এর জন্য তিনি প্রগতিশীলদের সমালোচনার মুখোমুখি হন। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘কবি ও কোলাহল’। 

উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: লোক লোকান্তর (১৯৬৩), কালের কলস (১৯৬৬), সোনালী কাবিন (১৯৭৩), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৭৬), আরব্য রজনীর রাজহাঁস, বখতিয়ারের ঘোড়া, অদৃশ্যবাদীদের রান্নাবান্না, Selected Poems- Al Mahmud (১৯৮১), দিনযাপন, দ্বিতীয় ভাঙ্গন, একটি পাখি লেজ ঝোলা, পাখির কাছে ফুলের কাছে, আল মাহমুদের গল্প, গল্পসমগ্র, প্রেমের গল্প, যেভাবে বেড়ে উঠি (আত্মজীবনী), কিশোর সমগ্র, কবির আত্মবিশ্বাস, কবিতাসমগ্র, কবিতাসমগ্র-২, পানকৌড়ির রক্ত (গল্পগ্রন্থ), সৌরভের কাছে পরাজিত, গন্ধ বণিক, ময়ূরীর মুখ, না কোন শূন্যতা মানি না, নদীর ভেতরের নদী, প্রেম ও ভালোবাসার কবিতা, প্রেম প্রকৃতির দ্রোহ আর প্রার্থনা কবিতা, প্রেমের কবিতা সমগ্র, উপমহাদেশ, বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ, কবিতার জন্য সাত সমুদ্র, উপন্যাস সমগ্র-১, উপন্যাস সমগ্র-২, উপন্যাস সমগ্র-৩, তোমার গন্ধে ফুল ফুটেছে (২০১৫) ছায়ায় ঢাকা মায়ার পাহাড় (রূপকথা), ত্রিশেরা, উড়াল কাব্য। কবি আল মাহমুদের একমাত্র মহাকাব্য ‘এ গল্পের শেষ নেই শুরুও ছিল না’। বইটি প্রকাশ করেছে সরলরেখা প্রকাশনা সংস্থা। 

আল মাহমুদ ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দা নাদিরা বেগমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে। এর মধ্যে এক ছেলে কয়েক মাস আগে মারা গেছেন। 

২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ৮২ বছর বয়সে ঢাকার ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কবি আল মাহমুদ মৃত্যুবরণ করেন। তিনি নিউমোনিয়াসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। 

পুরস্কার ও সম্মাননাস্বরূপ পেয়েছেন- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৮), জয় বাংলা পুরস্কার (১৯৭২), হুমায়ূন কবীর স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭২), জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭২), কাজী মোতাহার হোসেন সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৬), কবি জসীম উদ্দীন পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৬), নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯০), ভানুসিংহ সম্মাননা পদক (২০০৪), লালন পুরস্কার (২০১১), বাসাসপ কাব্যরত্ন (২০১৭) প্রভৃতি।

যুদ্ধ ও শান্তির দ্বৈরথ

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৫৯ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:০১ পিএম
যুদ্ধ ও শান্তির দ্বৈরথ

যুদ্ধ ও শান্তির দ্বৈরথ বেশ পুরোনো
অথচ-
মানুষ যুদ্ধ করে রাজত্ব কায়েমে।
শেষমেশ শান্তি খুঁজতে চায়
উর্বশী রমণীর দেহে, ভাঁজে ভাঁজে।

প্রতিবেশী কুচক্রী মানুষটাও
হতবাক হয়ে যায়
রাষ্ট্রীয় বঞ্চনার কাছে-
নতিস্বীকার করে নিজস্ব বেদনারা।
সমস্বরে বলে ওঠে-
আমাদের কোনো জৈবিক তাড়না নেই।

যে মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে-
যুদ্ধে যায় দলবেঁধে,
ফিরে আসে একা,
একজন ‘শহীদ’ অন্যজন ‘গাজী’
এও কি দ্বৈরথ নয়?

আমরা দূরত্বের সীমানা না টেনে
ঝাঁপিয়ে পড়ি আগামীর যুদ্ধ জয়ে
আমাদের কোনো নিয়ম নেই
আমাদের কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই।

নিঃসঙ্গ যাপন

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৫৮ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:০১ পিএম
নিঃসঙ্গ যাপন

গুমোট সময়: আকাশের উঠোনে-
সে কার বিরহী মুখ 
সমস্ত আকাশ মেঘাচ্ছন্ন 
কোথাও বুক ফাটিয়ে কাঁদছে কেউ 
ভুল পথে শুধু 
মানুষের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কোলাহল 
বাড়ছে বেঁচে থাকা মানুষের নিঃসঙ্গ যাপন,

কোথাও কি অনুবাদ হচ্ছে ভালো কিছুর 
শুধু মন্দা সময় মানুষের পায়ে পায়ে 
পথ ভেসে যায় গৃহস্থালি ভেসে যায়
কাজল জলে ভাসে যুবতী আকাশ,

ভুল পথে এগোচ্ছে সময়ের পা 
রোদ্দুরে চিল প্রতিশ্রুতি ভুলে 
উড়ে যায় অন্য বাড়ি
শুধু স্মৃতিকথার বিষণ্ন দিনগুলো 
ভাঙা কাচ টুকরোর মতো পড়ে আছে বুকের ভেতর।  

ক্লান্তি

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৫৬ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:০১ পিএম
ক্লান্তি

তপ্তরোদ মাথার ওপরে 
চিলের ডানা কাঁপছে;
শরীরের ছায়া যেন ঠিক ভূতুড়ে
ক্ষণে ক্ষণে ভয় পাই...
যার হাত, পা, মাথা আছে
যতবার লাঠিঘাত করি ঠিক ততবার
নিউটনের সূত্রের বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়
হাতের পেশিতে টান পড়ে
বিষাদের সুর কানে ভাসে
তবুও নিরুপায়...
অবশেষে শুধু ক্লান্তি অনুভব করি।

দাফন

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৫৫ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:০১ পিএম
দাফন

খুব যতনে পুষে রাখা কিছু সোনালি স্বপ্ন
বুকের গহিনেই ডুবে থাকে,
কিন্তু মাঝে মাঝে খুব করে জেগে ওঠে,
সাঁতরে সাঁতরে পাড়ে এসে মাথা উঁচু
করে দেখতে চায় ভোরের আলোক রশ্মি।
সংসারের উপবিধি কিছু নারীর স্বাবলম্বী-
হওয়ার লালিত স্বপ্নের অকাল মৃত্যু ঘটায়।
বুকের ভেতর আহত রক্তাক্ত স্বপ্নের 
আর্তনাদ কেউ কি শুনতে পায়?
ছটফট করতে করতে একসময়
খুব নীরবেই হয় রঙিন স্বপ্নের দাফন,
ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ই শুধু শুনতে পায়
এই মহা দীর্ঘশ্বাসের কাঁপন।

ঘৃণা

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৫৩ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:০০ পিএম
ঘৃণা

ভস্ম হওয়ার আগে
আরও একবার এঁকেছিলাম 
দুর্বিনীত জলের ছবি।
পায়ের ছাপে খুঁজে নিও 
একরোখা প্রাণের বিস্তার।
ঘৃণাই আমার প্রিয়াসম কোমল রাতের শেফালী।
নির্দ্বিধায় মেতে উঠি দারুণ অভিসারে।