কবি কবিতায় চারপাশের পৃথিবী, মানুষ আর মানুষের ভালোবাসা শৈল্পিকভাবে উৎকীর্ণ করেন। কবিতা তার প্রধান আশ্রয়স্থল। কবিতার ভেলায় তার যাত্রা অনন্তের উদ্দেশে। প্রকৃতি, নারী, নদী, শস্য খামার, জলমগ্ন পদ্ম, আকাশের তারা, পাখী, চারপাশের জলতরঙ্গ তার মধ্যে ঘূর্ণি তৈরি করে। অভিজ্ঞতা ও জীবন থেকে কবি তুলে আনেন কবিতার উপাদান। বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি মহাদেব সাহা বর্ষা, শরৎ ও বসন্তে তার চেনা জগৎ সংসার থেকে পরিভ্রমণ শুরু করেছেন। মানুষ তার কাছে রহস্যময় হয়ে ধরা দিয়েছে। বোধি, মনন ও চেতনার অন্তর্লোকে সমান্তরাল জীবনাচরণ সত্য ও সুন্দরের কাছে তাকে পৌঁছে দিয়েছে। চার দশক মহাদেব বাঁচা-মরা, স্বপ্ন ও দ্রোহের আগুনে নিজেকে পুড়িয়ে খাঁটি করেছেন।
তার কবিতায় সহজ নিরাভরণ সরলতা ও বাণীর প্রাবল্য সহজবোধ্য করে তুলেছে। অঙ্কের জ্যামিতিক মারপ্যাচ ও ব্যাকরণে দুর্বোধ্য নয় বলে এই সব পঙ্ক্তিমালা আপন হয়ে ওঠে পাঠকের কাছে। মহাদেব সাহার কবিতায় লালিত্য, সজীবতা ও তারুণ্য দীপ্ত হয়ে উঠেছে। আমরা যারা প্রতিদিন সংগ্রামে, আনন্দে, প্রেমে-অপ্রেমে মহাদেবের কবিতার কাছ থেকে পথচলার শক্তি পাই তারা মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত। সমাজ পরিবর্তনে মধ্যবিত্ত বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে। মানুষ ভেতরে অভিমান, দ্রোহ আর প্রেম পুষে রাখে। তৃষ্ণার অগ্নিতে ভিজে বহুদূর হেঁটে যায়।
মহাদেব সাহা রচিত কবিতার প্রবণতা, বক্তব্য শিল্পবোধ খুব সহজভাবে উন্মোচন করা সহজ নয়। গ্রাম, শহর, প্রকৃতি, প্রেম, নারী, নিঃসঙ্গ কাতরতা, উল্লাস, হাহাকার কবিতার মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। মানবিক আর্দ্রতায় আলোড়িত। আমার এই কথা তো বলার ছিল। বলা হয়নি। খুব সহজে, যত্নে, আদরে মমতার ভেতর থেকে ওঠে আসা শব্দমালা কবির সহোদর, আত্মজ, মানস প্রতিমা। এই গৃহ এই সন্ন্যাস (১৯৭২) থেকে শুরু করে এক এক করে বহু কাব্যগ্রন্থ, গল্পগন্থ, গদ্যগ্রন্থ মহাদেব রচনা করেছেন।
স্বতন্ত্র সত্তা বক্তব্য ও নির্মিতি প্রত্যেকের রয়েছে। পরিপার্শ্ব, জীবন-বাস্তবতার সম্মিলন ঘটে যাওয়া কবিতা সরস ও স্বাদু। মহাদেবের কবিতার প্রধান আকর্ষণ মানুষ ও মানুষের মনোজগৎ। এই মানুষের ভেতর থাকে অন্য মানুষ। বিষণ্ন মানুষ, একাকী মানুষ, ক্রোধী মানুষ, প্রেমিক মানুষ ভেঙে দেয় সমাজ-পরাবাস্তবতার দেয়াল। উদ্বাস্তু মানুষ, অন্তর্মুখী মানুষ কেবল নোঙর ফেলে জীবনের বাকে বাকে। উন্মুল উদ্বাস্তু মানুষ ক্রোধে, বিপ্লবে ফুসে ওঠে। প্রেমের কবি মানুষের কাছে আরাধ্য হয়ে উঠেছে। তার চোখে ব্যাকুলতা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা প্রকট।
জাগতিক জটিল জাল ছিন্ন করে মহাদেবের এই এগিয়ে যাওয়া স্মৃতি, আনন্দ-বেদনায় গ্রথিত হয়েছে। নিরন্তর ভাঙাগড়া ও দায়ভার কাঁধে নিয়ে তিনি সুন্দরের দিকে তাকিয়েছেন। তার হাতে গোলাপ ফুটে ওঠে। মানুষ প্রতিদিন একটু একটু করে স্বজন হয়ে কল্যাণে ও প্রেমে কাছাকাছি হয়ে পথ চলছে। মানুষের ভেতরের সুপ্ত এক বোহেমিয়ান স্বভাব, একাকী হয়ে যাওয়ার সহজাত প্রবৃত্তি মহাদেব গভীর মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেছেন।
মানব এসেছি কাছে, চাই বিষ অমরতা, কী সুন্দর অন্ধ, তোমার পায়ের শব্দ-কাব্যগ্রন্থে মহাদেব সাহা ক্রমাগত জীবন ও মানুষের জয়গানে মুখর। ঘর সংসার আর চেনাজগৎ তার কাছে অচেনা, বিবর্ণ ও ধূসর হয়ে ওঠে না। কবি মাত্রই জানে অভিজ্ঞতা, বাস্তবের টানাপড়েন তাকে ঋদ্ধ ও শক্তিময় করে তোলে।
মহাদেব আত্মপ্রত্যয়ী:
হয়তো আমারই জন্যে চার দিক আলো করে ফুটে আছে এতো শীতের গোলাপ
এতো বাগান মোহিত করা গন্ধরাজ,
কিন্তু আমি আত্মমগ্ন, সেদিকে পড়ে না চোখ
কেবল নিজের মধ্যে ঘুরি ফিরি দিগভ্রান্ত পথিকের মতো
শুধু অন্তর্ভ্রমণ, ঘুরপাক অন্বেষণ
পর্যটকের মতো খুঁজি নিজের ভিতর-অন্তর্চক্ষু মেলে
কেবল দেখতে চাই অদ্যাখ্যা নন্দন কানন
কেবল দেখতে চাই জীবনে না দ্যাখা সেই পারিজাত, স্বর্গের পাখি
আমি তাই আমার ভেতর তন্ন তন্ন খুঁজি আকাশ নক্ষত্র, মেঘ প্রকৃতির শিল্পকলা
আজন্ম তাকিয়ে আছি
যদি একটু দেখতে পাই সেই আলো, সেই অন্ধকার
বাইরে ফুটছে ফুল, ভিতরে কি ফুটবে কখনো?
(বাইরে ফুটেছে ফুল; অক্ষরে বোনা স্বপ্ন)
বাংলা কবিতায় মহাদেব সাহা গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় কবি। তার কবিতায় আত্মজৈবনিক বিষয়, আর্থসামাজিক অবস্থা, মানুষ ও মানুষের আর্তি প্রকাশিত হয়েছে। কবিতার শক্তি আবেগ। এই আবেগ মহাদেব তার কবিতার পরতে পরতে রাঙিয়ে দিয়েছেন। ফেসবুক, ইন্টারনেট, ডিসএন্টেনার যুগে, সেলফোন, ক্ষুদে বার্তা অর্থহীন হয়ে যায় তার কবিতার মাধুর্যে। চিঠি লিখতে আমরা ভুলে গেছি। দেখা-সাক্ষাৎ, কথাবার্তার মধ্যেও আড়াল। বন্দি মানুষেরা নস্টালজিক হয়ে যায়। চিঠি আর কেউ লেখে না। চিঠি কিংবা ডাক বিভাগের বিকল্প কিছু তৈরি হয়নি মনের ভাবপ্রকাশের জন্য। শাশ্বত এক জীবনের কাছে আমরা সমর্পিত। মহাদেব উচ্চারণ করেন-
করুণা করেও হলে চিঠি দিও,
খামে ভরে তুলে দিও
আঙুলের মিহিন সেলাই
ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও
একটুকু সামান্য দাবী চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষেরের পাড় বোনা একখানি চিঠি।
চুলের মতন কোনো চিহ্ন দিও বিস্ময় বোঝাতে যদি চাও
সমুদ্র বোঝাতে চাও, মেঘ চাও ফুল, পাখি সবুজ পাহাড়
বর্ণনা আলস্য লাগে তোমার চোখের মতো চিহ্ন কিছু দিও।
আজো তো অমল আমি চিঠি চাই পথ চেয়ে আছি
আসবেন অচেনা রাজার লোক
তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌঁছে দেবে।
খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড়ো এক লাগে তাই লিখো
করুণা করেও হলে চিঠি দিও, মিথ্যা করেও হলে বলো, ভালোবাসি
(চিঠি দিও)
মহাদেব সাহার কবিতায় প্রেম এক অনিবার্য অনুষঙ্গ। দেশ, সমাজ, সমকাল, নারী প্রণয়িনী, সর্বাঙ্গিনী তার কবিতার মূল ভূভাগজুড়ে দীপ্যমান। যে প্রেমের বাণী তার কবিতায় অন্তরঙ্গ তরঙ্গ তোলে সেখানে শুধুমাত্র কামজাগ্রত থাকে না, প্রবহমান স্নিগ্ধ সান্নিধ্য ব্যাকুলতা, হৃদয়ের অভ্যন্তরের লালিত স্বপ্ন। জাগ্রত এক বোধকে মহাদেব কবিতায় তুলে আনেন। তিনি স্বপ্নালোকের বাসিন্দা হয়েও সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত। ‘ভালোবাসি’ ‘আমি’ ও ‘তুমি’ এসব শব্দগুচ্ছ বহু ব্যবহারে উজ্জ্বল ও দ্যুতিময় হয়ে উঠেছে।
মহৎ কবির সার্থকতা এখানে। ভাষা ও প্রকরণ ব্যঞ্জনা ও বক্তব্য ভিন্নতা প্রচলিত ভাবনাকে অতিক্রম করেছে। মহাদেব একসঙ্গে প্রেমিক ও বিপ্লবী। সাদামাটা সংসারী মানুষ হয়েও কবি বিপন্ন বিষণ্নতায় আক্রান্ত। মৃদুভাষা, বিনয় ও সহজ উপস্থাপনের গুণে মহাদেবের কবিতা অন্তরঙ্গ ও প্রতিধ্বনিময়। কবিতায় আপাদমস্তক নিমগ্ন কবি জীবনের কাছ থেকেই পাঠ গ্রহণ করেন। প্রকৃতি সংলগ্ন, আবহমান বাংলার রূপ বৈচিত্র্যে মগ্ন কবি প্লাবন, শিশির, মেঘদল ও কান্নাকে সাথী করে অনেকটা পথ হেঁটে এসেছেন। জীববৈচিত্র্য, প্রকৃতি মুগ্ধতা ও মানুষের ক্রন্দন অস্ফুট হাহাকার, ব্যাকুলতা তার কবিতার প্রধান অবলম্বন।
গ্রাম থেকে শহরে আসা ছেলের জন্য মায়ের ব্যাকুলতা আর ছেলের স্মৃতি, কর্মব্যস্ততা, নাগরিক জীবনের ক্লান্তি, হতাশা মহাদেব কবিতার ক্যানভাসে ধারণ করেন। বর্ষপরিক্রমায় বোশেখ আসে। শেকড় বিচ্ছিন্ন মানুষের আর্তি, বেদনা, বোধ, ক্ষরণ কবি পর্যবেক্ষণ করেন। কবির মা পৃথিবীর সব মানুষের মা হয়ে যায়। ইট, কাঠ, কংক্রিটের জীবনে স্বপ্ন বন্দি হয়ে যায়:
মা তুমি বলেছিলে পয়লা বোশেখে
বাড়ি আসবি তুই, আমার মনে আছে-আমারও
ইচ্ছে করে পয়লা বোশেখ কাটাই বাড়িতে, প্রতি বছর মনে
করে রাখি সামনের বছর পয়লা বোশেখটা বাড়িতে কাটিয়ে
আসব, খুব সকালে উঠে দেখবো পয়লা বোশেখের সূর্যোদয়
দেখতে কেমন, কিন্তু মা সারাটা বছর কাটে ক্যালেন্ডার পাল্টে যায়
আমার জীবনে আসে না পয়লা বোশেখ
(বৈশাকে নিজস্ব সংবাদ)
মহাদেব সাহা শেকড় বিচ্ছিন্ন মানুষকে ঐতিহ্য সন্ধানী করেছেন। শহরে বাস করে যারা ভেতরে এক হাহাকার, যন্ত্রণা, স্মৃতির টান অনুভব করেন তাদের উৎস ফেরানোর চেষ্টা তার রয়েছে। তার কবিতায় গ্রামছাড়া মানুষের অন্তর্গত বোধ প্রকাশিত। মহাদেব উচ্চারণ করেন- নিজের ঘরে নিজেই বাউল/এই বয়সে আউল বাউল/ঐ ছিলোতো ছিন্ন কাঁথা/সব হারিয়ে নিঃস্ব বাউল (এই বয়সে বিশ্ব বাউল)
মহাদেব সাহা মাটি ও মানুষের কবি। নারী, নিসর্গ, পাখী, ফুল, নদী, স্বদেশ রক্ত প্রবাহের মতো ক্রিয়াশীল তার কবিতায়। জীবন সংলগ্ন দর্শন জীবনবাদী মানুষকে উজ্জীবিত করে। দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্যে প্রতিদিন শক্তি সঞ্চয় করে সংগ্রামী মানুষ। নানা ব্যঞ্জনায় মহাদেব মানুষের মর্মপীড়া দহন ও প্রতিক্রিয়া তার কবিতার অন্তর্ভুক্ত করেন-
তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্রতম দেশের একজন কবির
মনু মিয়ার হাড়ির খবর ভুললে চলে না,
আমি তাই জোয়াল ভাঙ্গা হারু শেখের দিকে তাকিয়ে
আন্তর্জাতিক শোষনের কথাই ভাবি,
পেটের ক্ষিদে এখন বুঝি কবিতার জন্যে কি অপরিহার্য
জুই ফুলের চেয়ে কবিতার বিষয় হিসেবে আমার কাছে
তাই সাদা ভাতই অধিক জীবন্ত-আর ধুলোমাটি মানুষ;
(জুই ফুলের চেয়ে সাদা ভাত অধিক সুন্দর, ধূলোমাটির মানুষ)
মহাদেব সাহা আনন্দ বিষাদ, দুঃখ কষ্ট, বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা কবিতাবদ্ধ করেছেন। চলিষ্ণু সময় মহাকালকে স্পর্শ করে। নগর সভ্যতা, চলমান জীবনের ক্লান্তির বিপরীতে দাঁড়িয়ে তার কাছে মানুষ, তার বোধ ও প্রেম মুখ্য হয়ে যায়। মহাদেব জীবনবিমুখ নয়, তার কবিতা অন্তহীন জীববৈচিত্র্য, মানবিক গুণাবলি এবং যাপিত দিন যাপনের টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। তার সুবোধ্য কবিতা শোক সন্তাপ, আকুলতায় দীর্ণ। ব্যক্তিগত বলে কিছু থাকে না, তার কবিতা সমষ্টির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। স্বচ্ছ ও গভীর পর্যবেক্ষণ মহাদেবের কবিতাকে হৃদয়গ্রাহী করেছে। মায়াময় জগৎ সংসার আর চারপাশের পৃথিবী তার আরাধ্য-
‘ঝরা বকুলের মতো পথে পথে নিজেকে ছড়াতে পারি আমি/ ছেড়া কাগজের মতো এমনকি যত্রতত্র ফেলে দিতে পারি/এইভাবে ফেলতে ফেলতে ছড়াতে এটুকু জীবন আমি পাড়ি দিতে চাই।’
মহাদেব সাহা পরিচিত পৃথিবী ও প্রতিবেশ থেকে ‘ভালোবাসা’, ‘অহংকার’ ও ‘উত্তরাধিকার’কে বহন করে কবিতা নির্মাণ করছেন। তার কবিতা মানবসমাজে বিদ্যমান মানবিক আলোড়ন, আলো-আঁধার আর জীবনকে ‘জয়’ করার পথ দেখায়। যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে বিষাদ ছেড়ে আনন্দ লগ্ন হয়ে ওঠে মানুষ। চেনা মানুষের অন্তর্গত বোধকে আবিষ্কার করার শক্তি মহাদেব আয়ত্ত করেছেন।
নারী, ফুল, যোদ্ধা, দেশপ্রেমিক তার সহযাত্রী। মহাদেব সাহা আমদের চেনা জগতের রহস্যময়তা তার কবিতায় তুলে এনেছেন। তার কবিতা স্বাদু।
মহাদেব স্বাভাবিকভাবে বলেন-
যতোই ব্যথিত হও মানুষের সান্নিধ্য ছেড়ো না
মানুষের সাথে থাকো সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে
যতোই আঘাত পাও মানুষকে কিছুতে ছেড়ো না
যখন কিছুই নেই মনে রেখো
তখনো সর্বশেষ আশা মানুষ;
মানুষকে এড়িয়ে কোনো সার্থকতা নেই
যতোই আঘাত পাও, যতোই ব্যথিত হও
মানুষের সঙ্গ ছেড়ো না
মানুষের সাথে থাকো সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে
কেবল মানুষই এই মানুষের চিরদিন বাঁচার সাহস।
(মানুষের সাথে থাকো; রাজনৈতিক কবিতা)।
মহাদেব আধুনিক। তার কবিতা যন্ত্রসভ্যতার যুগেও পাঠযোগ্য। ‘সুন্দরের হাতে হাতকড়া, ‘গোলাপের বিরুদ্ধে হুলিয়া’ জেনেও তিনি পাখীদের কলতান, নিঃসঙ্গ কয়েদির যন্ত্রণায় কাতর। ‘ধূলোমাটির মানুষ’ ‘যদুবংশ ধ্বংসের আগে’ ‘কেউ ভালোবাসে না’ এমন স্বগতোক্তি করলেও মহাদেব জানেন-
যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমি আর পাখি আর ফুল
যুদ্ধের বিরুদ্ধে শিশু, পৃথিবীর সমস্ত প্রেমিক।
মহাদেব সাহা বক্তব্য, উপমা উৎপ্রেক্ষা প্রয়োগে সজীব। প্রকৃতি, স্বদেশ, দয়িতা ও আর বীর মানুষ তার কবিতায় অনায়াসে অধিকার করে আছে। জীবন ঘনিষ্ঠতা, মানবপ্রেম ও মানবতার জয়গান তার কবিতাকে শিল্প উন্নীত করেছে। হার্দিক উচ্চারণ, অন্তর্গতবোধে আদ্রিত এসব পঙ্ক্তিমালা মানবসত্তার বিবর্তন ও ইতিহাসের সাক্ষী। কোমল পেলবতায় স্নাত তার কবিতা গীতল। অস্বীকার করি না তার ব্যক্তিগত অনুভূতি সবার পৃথক আত্মসত্তা নির্মাণে স্বতশ্চল প্রভাবক হয়ে যায়।
বিষয়, শিল্প প্রকরণ ও বক্তব্যে স্বতন্ত্র ও মোহনীয় মহাদেবের কবিতা সময়ের সচল আয়নায় প্রতিবিম্বিত হয়। দৈশিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট যার কবিতার প্রয়োজনীয় উপাদান তিনি আত্মমগ্নতা থেকে বেরিয়ে বিশ্ব মানব হয়ে ওঠেন। একজন বড় কবি খুব সহজে সমকাল চিত্রিত করতে পারঙ্গম, ভবিষ্যৎ তার চোখে দীপ্যমান। যে সময় তার বেড়ে ওঠা সে সময়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ঘটে গেছে পরিবর্তন। এই পরিবর্তন তাকে আলোড়িত করেছে। আধুনিক মানুষ নগর জীবনের চাপে অসহায়। মহাদেব শেকড়ের সন্ধানে, উৎসে প্রত্যাবর্তন চিন্তায় নিমগ্ন। তার কবিতায় জন্মভূমি, জন্মঋতু ও আপন মানুষের বন্দনা নিনাত শুনতে পাই।