ঢাকা ১৯ আশ্বিন ১৪৩১, শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪

হেলাল হাফিজ এর''এক জীবনের জন্মজখম'' কবিতাসমগ্র বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র সুর

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৫০ পিএম
আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:৫১ পিএম
হেলাল হাফিজ এর''এক জীবনের জন্মজখম'' কবিতাসমগ্র বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র সুর
অলংকরণ : মেহেদী হাসান

কবি হেলাল হাফিজ ‘লৌহ অভিমানী’ কবি। তার অধিকাংশ কবিতাই একটা বিশেষ লক্ষ্য অভিসারী। কবির ২০১৯ সালে প্রকাশিত কবিতা সমগ্র ‘এক জীবনের জন্মজখম’ গ্রন্থে সন্নিবেশিত ৯০টি কবিতা পাঠ করে মনে হলো, এ এক বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র কাব্যসুর। প্রেম-বিরহের বিরল গরল আখ্যান। 

এক জীবনের জন্মজখম-বিরহের মহাকাব্য। ইতিহাসের উজ্জ্বল প্রেমিকের এক দহন জর্জরিত বিরহনামা। প্রেম বিপর্যয়ের অমৃত দলিল।

জন্মদাগ যেভাবে মানবশিশু সারা জীবন বয়ে বেড়ায়। কবির জন্মজখম প্রাণপ্রেয়সীকে সারা জীবন না পাওয়ার বেদনা বয়ে বেড়ানো। বোহেমিয়ান বা বাউণ্ডুলে (মানস জগতে ভবঘুরে) জীবনযাপন। প্রচলিত নিয়মের তোয়াক্কা না করে কবি চিরকুমার ব্রতে জীবন পার করলেন। যেমনি বাংলাদেশে প্রয়াত কবি জাহিদুল হক। মানবতাবাদী মার্কিন জাতীয় কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান ছিলেন চিরকুমার। হুইটম্যান ছিলেন প্রথাবিরোধী। তবে মানবতাবাদী অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শাসক কর্তৃক নির্যাতিত। নজরুলকে হুইটম্যানের অনুকারী মনে করা হয়।

এবার কবির কবিতা রাজ্যে প্রবেশ লাভের চেষ্টা করি। প্রথমেই সুবিখ্যাত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ থেকে 
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় 
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। 

ইচ্ছে ছিল শিরোনামে কবিতায় প্রেমের পরাজয় নাকি বিপর্যয়? যখন কবি উচ্চারণ করেন-
ইচ্ছে ছিলো রাজা হবো/
তোমাকে সম্রাজী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,/
আজ দেখি রাজ্য আছে /
রাজা আছে / ইচ্ছে আছে, / শুধু তুমি অন্য ঘরে। 
কবির জীবনের জন্মজখম এখানেই।

প্রতিমা কবিতায় প্রথম পঙ্‌ক্তি-
প্রেমের প্রতিমা তুমি, প্রণয়ের তীর্থ আমার। 
শেষ পঙ্‌ক্তি-
তুমি জানো, পাড়া-প্রতিবেশী জানে পাইনি তোমাকে / অথচ রয়েছো তুমি এই কবি সন্ন্যাসীর ভোগে আর ত্যাগে।
প্রেয়সীকে তীর্থ বানিয়ে কবির যে বিরহ সাধনা। তাই কি ভোগের সন্ন্যাস?

অন্যরকম সংসার কবিতায় বলা হলো, রানাকে নিয়ে অন্যরকম সংসারে গোলাপ বাগান তৈরি করে হারিয়ে যাবো। আমরা দুজন ফুরিয়ে যাবো। এরপর সরাসরি উদ্ধৃতি-

তুমি আমি থাকবো তখন / অনেক দূরে অন্ধকারে, অন্যরকম সংসারেতে।
এক আশ্চর্য নস্টালজিয়া, অত্যাশ্চর্য বিরহ কল্পনা।

আমার সব আয়োজন-কবিতায় চিত্রকল্প-
আমার আরেকটি দুঃখ একেকটি দেশলাই কাঠির মতন,/ অবয়ব সাজিয়েছে ভয়ংকর সুন্দরের কালো কালো অগ্নিতিলকে,/ পাঁজরের নাম করে ওসব সংগোপনে / সাজিয়ে রেখেছি আমি সেফটি-ম্যাচের মতো বুকে।

হিরণবালা কবিতায়-
নারী- খেলার অভিজ্ঞতার প্রথম এবং পবিত্র ঋণ / তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখে সত্যি কি আর শোধ হয়েছে?

এভাবে ‘পরানের পাখি’, ‘আমার কী এসে যাবে’, কবিতায় কবির সংগোপন নিবেদন আর ভয়াবহ অভিমানগুলো কার প্রতি?
অহংকার কবিতায় এসে কবি অভিমান ভুলে ব্যর্থতা জয়ে প্রাণপ্রিয়াকেই বিজয়মালা পরিয়ে যাচ্ছেন। কে কবির এ মানসপ্রিয়া?

দু পঙ্‌ক্তির কবিতা ‘কোমল কংক্রিট’-
জলের আগুনে পুড়ে হয়েছি কমল,/ কী দিয়ে মুছবে বলো আগুনের জল।
এটা প্রেমসিক্ত কবির চূড়ান্ত অভিব্যক্তি। এ সান্ত্বনা অন্বেষণ কবির জন্মজখম। 
‘লাবণ্যের লতা’ কবিতায় এক প্রচ্ছন্ন মায়াজাল প্রসৃষ্ট হয়েছে উপমায়- চিত্রকল্পে-

ভালোবাসাবাসিহীন এই দিন সব নয়- শেষ নয়/ আরো দিন আছে, / ততো বেশি দূরে নয়/ বারান্দার মতো ঠিক দরোজার কাছে। 
ভিন্ন মেজাজের একটি কবিতা ‘ভূমিহীন কৃষকের গান’। চিরকুমার কবি যেন যৌবনের সার্থকতা নিয়ে শঙ্কিত:

একদিন দিন চলে যাবে মৌসুম ফুরাবে,/ জরা আর খরায় পীড়িত খাঁ খাঁ/ অকর্ষিত ওলো জমি/ কেঁদে - কেটে কৃষক পাবে না।
কবুতর নামের কবিতা পাঠককে পড়ে স্বাদ নিতে অনুরোধ জানাবো। কবির জীবনদর্শন প্রিয়তমাকে নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করার গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন কবুতরের কাঁধে। যেমনি কালিদাস তার প্রিয়ার কাছে বার্তা পৌঁছাবার দায়িত্ব দিয়েছিলেন মেঘকে।

‘নেত্রকোনা’ কবিতায় রয়েছে নির্মল কাব্য ভাবাবেগ। এতে মরণকে অদ্ভুত বলে জীবনের প্রতি গভীর মমত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ক্যামোফ্লাজ ছদ্মবেশ ধারণ বা লুকিয়ে যাওয়ার সূত্র। গোপনীয়তা রক্ষার্থে মানুষের মনে বিভ্রান্তি তৈরি করা। অস্ত্র লুকিয়ে প্রতিপক্ষের কাছে স্বাভাবিক সাজার এ কৌশল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। কবি উক্ত কবিতায় বলতে চান, জীবন মরণকে ক্যামোফ্লাজের মতো (ছদ্মবেশের মতো) আড়াল করে রাখে। প্রিয় জন্মস্থান নেত্রকোনাকে আদরের বোনের সঙ্গে তুলনা করে স্মৃতিতে আত্মস্থ করেছেন কবি।

অভিমান ভুলে প্রাণপ্রিয়ার সঙ্গে মিলিত হওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষার চিত্রল পঙ্‌ক্তিগুচ্ছ ‘তুমি ডাক দিলে’। তাছাড়া, হিজলতলীর সুখ, রাখাল, ব্যবধান, কে, অমীমাংসিত সন্ধি, ক্যাকটাস, হৃদয়ের ঋণ, প্রস্থান, ডাকাত প্রভৃতি কবিতা পাঠক নন্দিত বহুল পঠিত কবিতা। বিরহ ও অভিসার আকাঙ্ক্ষার হৃদয়গ্রাহী কবিতা।

তৃষ্ণা নামক কবিতা কবির চির একাকিত্বের প্রতিধ্বনি। 
চতুষ্পদী, একপদী কবিতাগুলোও তাৎপর্যপূর্ণ।
যেমন-
তুমি আমার নিঃসঙ্গতার সতীন হয়েছো!
(সতীন)
বাসনা নামে ত্রিপদী কবিতায় কবির নিজ সৃষ্টি নিয়ে আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে-
আগামী, তোমার হাতে / আমার কবিতা যেন/ থাকে দুধে-ভাতে।

বলা হয়, হেলাল হাফিজ অল্প লিখেও গল্প হয়েছেন। নারীকে উপজীব্য করে প্রেম-বিরহের কবিতা লিখে বাংলার অন্যতম প্রধান কবির আসন পোক্ত করেছেন। জার্মান কবি হাইনের সঙ্গে হেলালের তুলনা খুঁজে পাওয়া যায়। হেলাল হাফিজ বলেছেন, ‘কবিতাই আমার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং প্রণয়ের একমাত্র মাধ্যম।’ ষাটের দশকের অপরাপর কবিরা হচ্ছেন- সিকদার আমিনুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, মোহাম্মদ রফিক, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, সমুদ্র গুপ্ত, হুমায়ুন আজাদ ও আবুল হাসান। হেলাল হাফিজকে বলা হয় - বিশ্বাসে সমাজতন্ত্রী, শেষ গন্তব্যে মানবতাবাদী। 

হেলাল হাফিজের জন্ম ৭ অক্টোবর ১৯৪৮ নেত্রকোনায়। তিনি সাংবাদিক ও সাহিত্য সম্পাদক। তার প্রথম কবিতা সংকলন ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়। এর পুনর্মুদ্রণ হয় ৩৩ বারেরও বেশি। ২৬ বছর পর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’ ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়। 

দুঃখবাদকে আত্মস্থ করে বিরহের জপমালা জপেছেন কবি। একাকিত্বের সাধনায় শিল্পসাধনায় উত্তরণের এক অত্যাশ্চর্য সাধক হেলাল হাফিজ। দুঃখবাদী কবি যতীন্দ্র নাথ সেনগুপ্ত (১৮৮৭-১৯৫৪) প্রমুখের সঙ্গে জড়িয়ে যতই-না এ কবির তুলনা খোঁজা হোক। হেলাল হাফিজ নিজেই নিজের তুলনা। স্বতোৎসারিত ঝর্ণার মতো নিখুঁত। জীবনযাপনে এবং কাব্য চর্চায় উভয় ক্ষেত্রে তিনি একান্ত নিজস্ব বৃত্তভিত্তিক।

সেই আদিম শকুন

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৩৪ পিএম
আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৩৪ পিএম
সেই আদিম শকুন

পৃথিবীর উত্তরে দক্ষিণে 
পূবে পশ্চিমে আজ শুধু শকুনের উল্লাস 
রাত্রির বুকে কলঙ্ক- অস্থির প্রবাহ,
অন্ধ-বধির সময়
সভ্যতা খেয়েছে দূষিত জীবাণু!

কোথাও আজ- কেউ কি ভালো আছো?

নক্ষত্রের বুক সেই আদিম শকুন! 
খামছে ধরেছে মধ্যবিত্তের হাত পা 
শান্তির ঘুম অবুঝ স্বপ্ন 
ঝাঁঝরা ধূলিতে পড়ে আছে ঝলসানো চাঁদ 
পোড়া হাড়গোড় 
ক্ষতবিক্ষত কত নিষ্পাপ মুখ!

প্রয়োজনে প্রিয়জন

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৩৩ পিএম
আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৩৩ পিএম
প্রয়োজনে প্রিয়জন

পূজো শেষে ফুলগুলো অপাঙক্তেয় হয়
প্রয়োজন ফুরালে কিছু প্রিয়জনের মতো।
রান্নার সুগন্ধে স্বাদে পরিপূর্ণ তৃপ্তির পরে;
মুল্যবান উপকরণকেও উচ্ছিষ্ট মনে হয়।

কৃতকার্য হয়ে কলম ছুঁড়ে ফেলে নির্দ্বিধায় 
বর্ষার সঙ্গী ছাতাটা অবহেলায় পড়ে থাকে। 
দুর্গন্ধ থেকে পরিত্রাণে সুগন্ধি পারফিউম;
ব্যবহার শেষে ছিটকে পড়ে ময়লার ঝুড়িতে।

প্রয়োজনে প্রিয়জন কখনো হয় না আপন
দেখেশুনে সর্বদা করো তাই জীবনযাপন।

ছেঁড়া কাগজ

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৩২ পিএম
আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৩২ পিএম
ছেঁড়া কাগজ

     ফেরারী এ মন দিবানিশি চলে
ভাঙ্গা স্বপ্ন ফেরি করে
      পিচ ঢালা শহরের মাঝে। 

ছেঁড়া কাগজ বস্তায় ভরে 
      সামান্য টাকা বিক্রি করে 
ফুটপাতের ভাঙ্গা হোটেলে
      জরাজীর্ণ চারিপাশ
মাছি ভনভন করে। 

     পেটের ক্ষুধায় বসি
অল্প টাকায় পেট ভরে খাবো বলে 
     পাশে এসে অর্ধউলঙ্গ বাচ্চাটা 
এসে হাত বাড়ায় যখন 
      তার মুখপানে চেয়ে 
পারিনা চোখের জল ধরে রাখতে। 

      নিজের মুখের খাবার দেয়
অপরিচিত বাচ্চাদের হাতে তুলে 
     খালি পেটে জল খেয়ে 
উঠে যায় হোটেল হতে 
      রাতের খাবার জোগাড় করতে 
ছেঁড়া কাগজ টোকায় পথে-পথে।

মানুষ হও

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৩০ পিএম
আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৩১ পিএম
মানুষ হও

মানুষ হও
কথা কও সদা সত্য বাণী 
বুক টা ভাসিয়ে দিও প্রেম - যমুনার ঢেউয়ে। 
গন্ধরাজের গন্ধ নিও
গোলাপের কাঁটা নয় সৌরভ দিও
পিঁপড়ার মতো  শৃঙ্খলা হও। 
মানুষ হও
মানুষ হও মানবের তরে।

নির্বাক জাতি এক প্লেট ভাতে

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:২৯ পিএম
আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:২৯ পিএম
নির্বাক জাতি এক প্লেট ভাতে

বিদঘুটে মনুষ্যত্বে আজ  চিহ্নিত অসভ্য মানবতা ;
সেরা বিদ্যাপিটে মেধাবীদের রক্তে হোলি খেলা। 
নোংরা রাজনীতির পরিপক্ব বিষাক্ত সর্প নাচ!  
এটাই মানবতা, এটাই অর্জিত মনুষ্যত্বের সুস্থ বিকাশ, 
বাহ! চমৎকার সৃজন, চমৎকার আবদ্ধ সংস্কৃতি 
বিবেকগুলো স্মৃতির যাদুঘরে টাঙ্গিয়ে রাখার মতো
ভবিষ্যৎ প্রজম্ম দেখবে উলঙ্গ মানবতার চিত্র সমুহ  ! 
হে - বাঙালী তোমরা সত্যি সত্যিই জড়বস্তু !
প্রতিযোগিতার মঞ্চে তাড়িত হৃদয়ে পোষা বিবেক। 
ওখানে পড়াতে ব্যস্ত তোমরা উপচে পরা ভীড়ে। 
বেশ কি আর বলি সবই তো উল্টো এই অদৃশ্য পথে, 
কারন মানানসই মার্জিত লেবেলে জাতি যত ঘুনেপোকো ! 
মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, বুকের বোতাম খোলা, পায়ে -
বেমানান চটি এ-সবই আজ পরিপুষ্ট ভদ্রতা আর মানবতা ! 
নির্বাক এ সভ্য জাতি, সমাজ, নির্বাক জাতি এক প্লেট ভাতে ! 
বোঝার উপায় নেই কে পশু ? কে মানুষ? কোনটা মানবতা ? 
বনের মধ্যে শুকুর না কি মানব জাতিতে মানুষ রুপি শুকুর, 
মানবতা আজ ধর্ষিত ইতিহাসে এক বিভৎস কালো ছায়া !