ঢাকা ২৬ কার্তিক ১৪৩১, সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪

মায়াদ্বীপ

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:০৬ পিএম
আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৩১ পিএম
মায়াদ্বীপ
অলংকরণ : মেহেদী হাসান
ফাবিহা ডিসকভারিতে ওয়াইল্ডলাইফ-বিষয়ক একটি প্রোগ্রাম দেখছিল, চ্যানেলে বিজ্ঞাপন বিরতি আসতে টিভিটা মিউট করে সে হেঁশেলে এলো। উদ্দেশ্য, কাজের মেয়েটার রান্নার খোঁজ করা। ডালিয়া নিবিষ্টমনে আনাজ কুটছে। এখন নিদাঘকাল যেহেতু, উনুনের আঁচে মেয়েটার থুতনি, নাক আর কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমেছে। গরম থেকে কতকটা স্বস্তি পেতে ডালিয়া শাড়ির আঁচলটা নামিয়ে রেখেছে কোলের উপর।
 
গৃহকর্ত্রীর উপস্থিতি টের পেতে ডালিয়া একবার মুখ তুলে তাকাল; মুখে মোনালিসার হাসি ফোটাল; তারপর বলল, খালা, কালকের ঝিঙের সালুনটা কী করব? ফাবিহা জবাবে বলল, ওগুলো তুই নিয়ে যাস। ডালিয়া আবার বলল, রুইমাছ রইয়া গেছে দুই-পিচ, ওইদুটা? ফাবিহা বলল, ও-দুটোও তুই নিয়ে যাস। ডালিয়াকে দেখে মনে হলো, ফাবিহার এমন জবাব তার অপ্রত্যাশিত ছিল না। তবু তার মুখে কৃতার্থভাব ফুটল। পরে পুনরায় তরকারি কুটায় মন দিল সে।
 
ফাবিহা ফিরে আসতে গিয়ে দৈবাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। অনিচ্ছাতেও তার আঁখিযুগল একবার ডালিয়ার কম্পমান সুগোল বুকজোড়া টেনে নিল। পাকা তালের মতো রসে টইটুম্বুর বুক এ মেয়ের! শাড়ির পর্দা সরে যেতে ডালিয়ার পীনোদ্ধত স্তনদুটো যেন ছিনাল নারীর মতো ঢলোঢলো মেজাজে হাসছে। ফাবিহা নিশ্চিত, এমন নিটোল বুক সে তার জন্মে খুব বেশি দেখেনি! তদুপরি ডালিয়ার স্বাস্থ্যখানাও মোহনীয়। ফাবিহার সহসা মনে হলো, ডালিয়ার শরীরকে যদি সুরাপাত্র ভাবা যায়, ডালিয়ার বুকজোড়া নির্ঘাত তার বরফকুচি।
 
ফাবিহা পলকের জন্য ভাবল, ডালিয়াকে বুকের উপর আঁচল টেনে নিতে বলে। পরে মনে পড়ল, বাসায় এখন তারা দুজন বই আর কেউ নেই। অবশ্য এও সত্যি যে, পুরুষগুলো জাহান্নামে যাক, ফাবিহার নিজেরই এখন প্রবল ইচ্ছে হচ্ছে, ডালিয়ার ওই দুরন্ত বুকদুটোয় একবার হাত রাখে। ফাবিহা মনে মনে বলল, কোনো মেয়ের এতটা সুন্দর বুক হওয়া ভালো নয়; ডালিয়ার মতো মেয়েদের তো নয়ইÑসে তো আর সিনেমার নায়িকা হতে যাচ্ছে না।
ফাবিহা আজ আবারও ভাবল, সজীবের যদি আরেকটু বেশি সময় বাসায় কাটানোর জো থাকত, সে বোধহয় ডালিয়াকে এভাবে বাসার কাজে রাখতে ভরসা করত না। এমনটা মনে আসতে মনখারাপও হলো; কিন্তু সে নিরুপায়-নিরালম্ব। কারণ সে দেখেছে, পুরুষমাত্রই নারীদেহ তাকে টানে, আর সে নারী যদি পর-নারী হয় তো কথাই নেই। পেঁচারা নাকি একগামী হয়, এবং জোড়ার প্রতি আমৃত্যু বিশ্বস্ত থাকে। ইস, পুরুষ জাতটারও যদি এ মতি হতো! আচ্ছা, ঘরের নারীরা যে তাদের নিয়ে অনুক্ষণ সংশয়ে ভোগে, পুরুষেরা এ নিয়ে কী ভাবে? না, সজীবকে এ নিয়ে কখনো প্রশ্ন করা হয়নি ফাবিহার।
 
ফাবিহা তার একাদশ-পড়–য়া ছেলে পলক বাসায় থাকলেও ডালিয়াকে নিয়ে তটস্থ থাকেÑডালিয়াকে বি¯্রস্তবসন হতে দেখলেই কৌশলে সতর্ক করে। এমন অবস্থায় ডালিয়া এক-একবার বলে ওঠে, খালা, গরম লাইগতাছে কিন্তু। বাসায় পুরুষ তো কেউ নাই। ডালিয়া কেন জানি সতেরোর পলককে এখনো পুরুষজ্ঞান করে না। ফাবিহার এক-একদিন ইচ্ছে হয়, ডালিয়ার এ ভুল ভাঙিয়ে দেয়। আবার পরক্ষণে ভয়ও হয়, প্রত্যুত্তরে মেয়েটা কী-না-কী জবাব করে! 
ফাবিহার এ বাসায় আজ ঠিক একবছর পূর্ণ হয়েছে। সে হিসেবে ডালিয়ারও এ বাসায় একবছর পূর্ণ হলো আজ। ফাবিহা ভেবেছিল, ডালিয়াকে সে আজকের জন্য কাজ থেকে রেহাই দেবে, আর পুরো সময়টায় সে ডালিয়ার সঙ্গে বসে গল্প করবে। এ কমাসে এটুকু ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার মেয়েটার হয়েছে বইকি। একটা মেয়ে যে কি-না একটা বছর ধরে তার বাসায় কাজ করছে, ফাবিহা তার সম্পর্কে সে-রকম কিছুই জানে না, কে বিশ্বাস করবে!
 
এমনটা ভেবে ডালিয়া আজ কাজে আসতে ফাবিহা ডালিয়াকে বলেছিল, শোন, তোর আজ কোনো কাজ করতে হবে না। আয়, এখানটায় বস! আজ কেবল তোর গল্প শুনব। ডালিয়া তখনি চোখ কপালে তুলে বলেছিল, খালা, আমার কি কুনু দোষ হইছে? নয়, কাম করতে মানা করেন ক্যান! ফাবিহা কোনোভাবেই তার ব্যাপারটা ডালিয়াকে বুঝাতে পারল না। ডালিয়ার ওই এককথা, তার মতো গরিব মানুষের কোনো গল্প থাকে না।
ফাবিহার মনে আছে, এ বাসার কেয়ারটেকারই তাকে ডালিয়ার খোঁজ দিয়েছিল; বলেছিল, আপা, আপনে যেমন মাইয়া চাইতাছেন, এই মাইয়াটা তেমনই। সাফসুফ মাইয়া। কামেও তাড়াহুড়া করে না। একটাই দোষ, কথা একটু বেশি কয়।
 
কেয়ারটেকার পুরোপুরি না হলেও অনেকখানি সত্য বলেছে। ডালিয়া যথার্থই গোছালো-পরিচ্ছন্ন মেয়ে। অন্যের ঘরের কাজকেও সে নিজের ঘরের কাজের মতো করেই মনপ্রাণ ঢেলে সামলায়। এখনকার কাজের মেয়েদের বেলায় যা প্রায় বিরল গুণ। ডালিয়ার বাচাল-স্বভাব সেভাবে চোখে পড়েনি ফাবিহার। বরং ডালিয়ার অন্য একটা স্বভাব ফাবিহাকে খানিকটা অস্বস্তি দেয়, মেয়েটা শরীর-সচেতন নয়। অথচ মেয়েদের শরীর-সচেতন না হলে চলে না। সে তো আর এমন নারী নয় যে, যার শরীর জরাগ্রস্ত, আর বুক হয়ে পড়েছে কিশমিশের মতো চিমসে। কে জানে, ডালিয়া হয়তো এমন ভাবে, মাইনষের ত আর খায়া-দায়া কাম নাই যে আমার মতন একটা গরিব মাইয়ার শইল দেখতে পেছন লইব। বিশ্বাস নেই ডালিয়াকে; এমনটা ভাবলেও ভাবতে পারে। ডালিয়ার বোধহয় জানা নেই, যে মানুষের শরীর দরকার, তার শরীরই দরকার; সে শরীর ধনীর না নির্ধনের, সে শরীর কৃষ্ণ না ধবল, সে শরীর ঘরের না পরেরÑএসবের ভাবনা তাকে ভাবায় না।
আচ্ছা, ডালিয়ার কত বয়স হবে? খুবজোর বাইশ-তেইশ। বিশ-একুশও হতে পারে। ফাবিহা একবার জিজ্ঞেস করেছিল। ডালিয়া অনুমতিভাবেই বলেছে, সত্যই মনে নাই খালা।
 
এমন অল্প বয়সেই ডালিয়া কিন্তু বিবাহিত একজন; বছর-দুয়েক বয়সের তার একটা বাচ্চাও রয়েছে। অবশ্য কাজে বেরোতে ডালিয়া কখনো বাচ্চাকে সঙ্গে নেয় না বলে আজতক ডালিয়ার বাচ্চাকে একনজর দেখা হয়নি ফাবিহার। ডালিয়ার স্পষ্ট কথা, ছোড বাচ্চা নিয়া কাম করণ যায় না।
এটা মিথ্যে নয় যে, ডালিয়ার শরীর এক-একবার ফাবিহার মনেও ঈর্ষা জাগায়। ফাবিহা জানে, তাদের দুজনকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দিলে কেউ ডালিয়াকে ফেলে তার দিকে ফিরে তাকাবে না। কী করে ডালিয়া এমন সুন্দর শরীর সুন্দর বুক তৈরি করল, কে জানে! অথচ মেয়েটা শরীর নিয়ে কতই-না অসচেতন। তুলনায় ফাবিহা তার শরীরকে আজন্ম ভালোবাসা দিয়ে এসেছে; যতেœ রেখেছে, আরামে-আদরে রেখেছেÑসে তুলনায় তার শরীর সাড়া দিয়েছে সামান্য। কিছু কিছু ব্যাপারে প্রকৃতির ভাব বুঝা মুশকিল। নয় ডালিয়ার এই অযতেœর শরীর কেন এমন মায়াকাড়া আর নয়নভোলানো হবে!
ফাবিহাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডালিয়া আরেকবার মুখে তুলে বলল, খালা, কিছু কি কইবেন?
ফাবিহা চট করে কথা খুঁজে না পেয়ে বলে উঠল, ভাবছি যে তোর কাছ থেকে রান্নাটা একটু-আধটু শিখে নেবো। শেখাবি নাকি?
ডালিয়া গালভর্তি হেসে বলল, খালায় যে কী কন না-কন!
এখন খোশগল্প আরম্ভ করলে ডালিয়ার কাজে ব্যাঘাত হবে ভেবে ফাবিহা টিভিরুমে ফিরে এলো।
 
দুই.
ডালিয়া কাজ শেষে যখন বেরিয়ে যাবে ফাবিহা ডেকে বলল, ডালিয়া, তোর কি তাড়া আছে?
কন যে কী করতে হইব।
কোনো কাজ নয়। আজ তোর সাথে একটু গল্প করতে ইচ্ছে করছে।
ধক করে উঠল ফাবিহার ভেতরটায়। বুকের অন্দরে সাইরেন বাজছে শুনতে পেল। ইতস্তত মুখ করে ডালিয়া কোনোরকমে বলল, বসতে কন যদি বসবার পারি। তয় কইলাম, আমার কিন্তু কোনো গল্প নাই।
ফাবিহা আলটপকা হেসে উঠে বলল, তোর কোনো গল্প নেই, এ কী রকম কথা! যে মানুষ বলে তার কোনো গল্প নেই, ওই মানুষটারই আসলে বলবার গল্প থাকে বেশি। অল্পের জন্য থেমে পুনশ্চ বলল, মনে হচ্ছে কিছুর তাড়া আছে তোর। ঠিক আছে, এখন যা তবে তুই। অন্যদিন করব তোর সাথে গল্প।
 
তিন.
ডালিয়া রাস্তায় নেমে এসে একবার পেছন ফিরে তাকাল। না, ফাবিহার টিকিটি নেই জানালা কিংবা ব্যালকনিতে। এতক্ষণে যেন দম ফেলল ডালিয়া। ফাবিহার আচরণ তাকে আজ ভালোরকম ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। মানুষটা কেন আজ বারবার করে তার গল্প শুনতে চাইছিল, কে জানে! মানুষটা কি তার সম্পর্কে কোথাও থেকে কিছু জানতে পেরেছে? অজানা আশঙ্কায় ডালিয়ার হাত-পা জমে আসতে চাইছে।
হ্যাঁ, ডালিয়ার ভেতর ঢের গল্প জমা আছে। কিন্তু কেবল ডালিয়া জানে, এ এমন গল্প, যা কাউকে শোনাবার মতো নয়।
 
ফাবিহার কাছে মিথ্যে বলে ডালিয়ার এখন কষ্ট হচ্ছে। মানুষটা তার প্রতি সমব্যথী-দরদি। তার শুভাকাক্সক্ষী একজনের সঙ্গে এভাবে কপটতা করা কি তার উচিত হলো? কিন্তু এখানটায় মিথ্যে না বলে ডালিয়ার উপায়ই-বা কী ছিল! ডালিয়া যদি তার গল্পগুলো শুনাতে যেতো, এসব গল্প সে যতই রেখেঢেকে করুক, ঝাড়পোঁছ করে যা বলা হবে তাতেও তার সর্বনাশের একশেষ হতো। চট করে তার এ বাসায় কাজটা হাতছাড়া গেলে সে নিদারুণ অসুবিধেয় পড়ে যাবে। বাঁচবার জন্য মানুষ কত কী অন্যায় কাজ করে; ডালিয়া নয় খানিকটা মিথ্যের আশ্রয় নিল। কেবল মিথ্যে করে বলল যে তার জীবনে কোনো গল্প নেই।
একদিক থেকে অবশ্য বলতে গেলে ডালিয়ার জীবনে কোনো গল্প নেইও। যেনতেন আজেবাজে কিছু ঘটনা-দুর্ঘটনাকে কি গল্প বলা যায়? ডালিয়া ভেবে দেখল, গল্পের সংজ্ঞাটা তার কাছে আদতেই পরিষ্কার নয়।
 
চার.
ডালিয়া তার জন্ম থেকে দেখে এসেছে, তাদের পরিবারটা দীনহীন, অসচ্ছল। তার বাবা সংসারের ঘানি টানতে টানতে জেরবার, পরিশ্রান্ত। সংসার নামক তরীটাকে নিয়ে কোনোভাবেই যেন কূল খুঁজে পাচ্ছিল না বাবা!
সংসারটাকে এমন মাঝ দরিয়ায় রেখে বছর-আড়াই পূর্বে বাবা হুট করে একদিন দেহ রাখল। মৃত্যুতে মানুষটা বেঁচে গেলেও ডালিয়ারা পড়ে গেল আরও গভীর পাঁকে। বাস্তবতার করাল থাবার কাছে মানুষের নিরেট শোকভাবনাও মার খেয়ে যায়। স্বামীর মৃত্যুর মাস-দুই না হতে দ্বিতীয় একটা হাতে পুনরায় নিজের কাহিল হাতটা সঁপে দিল ডালিয়ার মা। খুবসম্ভব, মানুষমাত্রই প্রাণটা আকুলিবিকুলি করে আরেকটু বেশিদিন বাঁচতে।
এর মাঝে ডালিয়া সবিস্ময়ে লক্ষ করল, মায়ের এই দ্বিতীয় মানুষটা দেখতে শক্তপোক্ত, সুঠামদেহী; বয়সেও মায়ের চেয়ে আট-দশ বছরের ছোট হবে। লোকটা কী ভেবে মায়ের মতো বেহাল দশার জীর্ণ শরীরের একজনকে বিয়েতে রাজি হলো, ভেবে থই পাচ্ছিল না ডালিয়া।
 
না, ডালিয়াকে এ প্রশ্নের উত্তর পেতে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না। ডালিয়ার হয়তো এখানে করার ছিল অনেক কিছুই, কিংবা কিছুই করার হয়তো ছিল না। মা একদিন কী করে যেন সেসব টের পেয়ে গেল। সেদিন শেষরাতের দিকে ডালিয়াকে ঘুম থেকে জাগিয়ে মা যুগপৎ অনুচ্চ ও দড়গলায় বলল, রাইত পোয়াবার আগেই যেইদিকে দুইচখ যায় বাইর হইয়া যাবি, নয় তর গলায় আমি ছুরি চালামু।
যার কিছু থাকে না, কেউ থাকে না, তারও ঠাঁই হয় কোথাও না কোথাও। ডালিয়ার ঠাঁই হলো শহরের এক বস্তিতে। কদিনেই পড়শি এক মহিলার সঙ্গে খালার সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলল। বাচ্চাদের কাছে অশরীরী কিছুর গল্প ফাঁদার মতো পাতানো খালার কাছে পেটের বাচ্চাটার ব্যাপারে আজগুবি সব গল্প করল ডালিয়া। খালা গল্পগুলো কৌতূহল নিয়ে শুনল; কোনো প্রশ্ন করল না। যথাসময়ে ডালিয়ার পেটের বাচ্চাটা জন্ম নিল। বাচ্চাকে একনজর দেখেই চমকে উঠেছিল ডালিয়া, হা খোদা, বাচ্চাটা যার আদল পেল, সে কী করে এ বাচ্চাকে লোকসম্মুখে বের করবে!
বাচ্চার মুখ দেখে ডালিয়াকে বিবশ হয়ে পড়তে দেখে পাতানো খালা উপদেশের ঢঙে বলেছিল, হতচ্ছাড়ি শোন, তোর সেই গোপন কুঠুরিগুলোয় এবার জন্মের তরে তালা ঝুলিয়ে দেয়। দেখবি অনেক হালকা হয়ে গেছিস। মনে রাখিস, এ দুনিয়াতে যত মানুষ দেখছিস, সবাই এভাবেই বেঁচে আছে।
এ মহিলা মাঝেমাঝেই এমন গুরুপাকের কথা বলে, যার অধিকাংশই ডালিয়া ধরতে পারে না। এটাও পারেনি। তাই নিরুত্তর ছিল।
যা হোক, ডালিয়া নিশ্চিত নয়, এভাবে মিথ্যের উপর নির্মিত সৌধ কতদিন টেকসই হয়। কিন্তু এখানে কী-ইবা সে করতে পারে, প্রতীক্ষার প্রহর গোনা ছাড়া।
 
 

কবিতা

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:২৬ পিএম
আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:২৬ পিএম
কবিতা

তুই কি আমার হবি

মুনমুন চক্রবর্তী

 

তুই  কি আমার বৃষ্টি হবি?

যেন খুব মন খারাপেও ভিজতে পারি

যেন তোকে খুব খুশিতে ছুঁতে পারি

 

তুই কি আমার আকাশ হবি?

আমার সব বিষন্নতা নিজের করে নিবি

ভালোবাসার সবগুলো রং আমায় মাখাবি

 

তুই আমার সাগর হবি?

যেন আমি তোর বুকেতে ঢেউ হয়ে আঁচড়ে যেতে পারি

যেন তোর নীলিমা গায়ে মাখাতে পারি

 

তুই কি আমার চাঁদ হবি?

যেন আমি যখন তখন হাঁ হয়ে দেখতে পারি

যেন অমাবস্যায়ও আমি চাঁদ ছুঁতে পারি

 

তুই কি আমার গল্প হবি?

 রূপকথার রাজকুমার হবি?

তুই কি সত্যিই আমার হবি?

 

শ্রাবণ নিশিতে

শারমিন নাহার ঝর্ণা

বাহিরে ঝরছে শ্রাবণ নিস্তব্ধ নিশিতে

মুখোমুখি বসে দু'জন অপলক দৃষ্টিতে,

ঘুমিয়ে পরেছে সব গাছের সবুজ পাতা

জেগে আছে হৃদয় ঘরে অজস্র কথা

 

এই চেয়ে থাকার মাঝে যেন অপার সুখ

জানিনা কেন মহামায়ায় ভরে ওঠে বুক?

রিমঝিম শব্দে শ্রাবণের মেঘগুলো ঝরছে

শূণ্য পাত্র গুলো জলের ফোঁটায় ভরছে

 

নয়ন সরোবরে হারিয়ে গেছে এই মন

ঝিঁঝি পোকার গানে মধুময় হলো ক্ষণ,

শ্রাবণ নিশি ফুরিয়ে এলো রঙিন প্রভাত

সহস্র বছর মায়ায় জড়ানো থাক দুটি হাত

 

গণক

মামুন মুস্তাফা

 

গণকের হাতের তালুতে একটি মাছি

মাছি উড়ে গেলে সময় স্তব্ধ হয়;

 

গণকের হস্তরেখা ওলোটপালট

কুষ্ঠির প্রাণভোমরা এখন আঙুলের ডগায়

 

ওই হাতের রেখা ক্রমশ নিভে যাচ্ছে

গণক নিজেই উল্টোরথে

            সামনে আত্মহননের গাছ

 

বাঁশি বাজে অন্য লোকে...

 

 

মৃতবীজ

দ্বীপ সরকার

 

নির্মোহ রোদের কফিন খোলা শেষ হলে পরে

সারি সারি মৃতবীজ খসে পড়ে

মৃতবীজ মানেএই বীজে মৃত্যু লেখা আছে সকলের

 

অতঃপর কফিন থেকে আমার পিতা খসে পড়েন

আমার পিতামহ খসে পড়েন

তাদেরও পূর্বপুরুষরা খসে পড়েন সারি সারি

 

মৃতবীজ থেকে কবে যে আমিও খসে পড়বো

জানা নেই

সাহিত্যসভার এ সপ্তাহের বিশেষ আয়োজন

প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৪০ পিএম
আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৪১ পিএম
সাহিত্যসভার এ সপ্তাহের বিশেষ আয়োজন
অলংকরণ: মেহেদী হাসান

নদী শুকিয়ে যায় 
বাশার মাহফুজ 

বহুগামী দুঃখের ফোয়ারায় চোখের শহরে প্লাবন নামে
তবু, শাবক স্বপ্নের উর্বরতায় ফুটছে জুঁইফুল 
বুকের মানচিত্রে নতুন দ্বীপ নতুন অধ্যায় চাঁদ।
 
প্রিয় জোছনা। প্রিয় জানালায় উপেক্ষিত এই বেঁচে থাকা। 

সবগুলো নদীতে স্বপ্নের নামে পাল ওঠালাম
তবু নদী শুকিয়ে যায়
মৃত্যুর কঙ্কালে জেগে ওঠে অমানবিক চর
বাতাসের কানে ভুল সংগীত বেজে ওঠে। 

ভুলে মাখা এই পথ ফুরাতে চায় না
সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে 
সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে 
এই ভেবে কেটে গেল পুরো একটা জীবন! 

 


কালিদাসের মুখোমুখি 
সায়্যিদ লুমরান 

বড় অভিমান করে আছে মেঘগুলো! এই মুহূর্তেই পত্র প্রস্তুত করো। সম্বোধনের যথাযোগ্য শব্দ পেতে তরুণ কবিকে বসাও কালিদাসের মুখোমুখি।
অতঃপর বিস্তারিত লিখতে সমস্ত বাংলা কবিতা থেকে তুলে আনো অজস্র বর্ষার বাৎসায়নঃ
যে বাতাস যমুনাগামী তার ডানায় ডানায় কদম ফুলের রেণু, সে বাতাস শব্দে সঞ্চারিত করে পত্রে লিপিবদ্ধ করো।
আরও সঞ্চারিত করে দাও বাক্যের আত্মায় বংশীবাদকের বুক থেকে উঠে আসা রাগ- মেঘমল্লার। 
গভীর অরণ্যে নীলাম্বরীর ভাঁজে যে শরীর, তার নৃত্যের ভঙ্গিমার সাথে পত্রের পুনশ্চে এঁকে দাও রাধিকার পদচিহ্ন।
আলবৎ! পত্রের অপর পিঠে অঙ্কন করো বৃষ্টির সিলমোহর।  

বড় অভিমান করে আছে মেঘগুলো! এই মুহূর্তেই পত্র প্রস্তুত করোঃ কবুতর নয়, এ অনাবৃষ্টির কালে পানকৌড়ির পায়ে চিঠি বেঁধেই মেঘকে বার্তা পাঠাও।

 

ইচ্ছে
আহমেদ আশিক

ইচ্ছে আমার আকাশ সমান
ভেবে তো না পাই,
এই যে মাটির দেহখানা
সৃষ্টি মালিক সাঁই। 

প্রেম-পিড়িতের  মাখামাখি-
দেহের মাঝে দমের পাখি
কখন পাখি উড়ে যাবে
ঠিকঠিকানা নাই।

মালিক চালায় বলেই চলি
আমার মাঝে সাঁইকে খুঁজি,
আসলেই কি প্রভুর কাছে
আমার আছে ঠাঁই?

 

অপ্রস্তুত মেঘবালিকা 
মুহাম্মদ রফিক ইসলাম

সকালের খামে ওড়ে দুপুরের চিঠি!
মন খারাপের পাশে মেঘবালিকার 
নীরবতা, ভালো নেই  শ্রাবণ বিকেল।
কদম-কেয়ার বনে সন্ধ্যার বর্ণিল 
আয়োজনে বাদুড়ের রাতকানা চোখ।
নাড়ির টানের মতো আকাশের টান
পৃথিবীর, মৃত্তিকার সোঁদামাখা পথে।
বাতাসের ডানা জানে পাহাড়ের বাড়ি;
প্রণয়ের মানে বোঝে ঝরনার স্রোত!
কদম-কেয়ার বনে সন্ধ্যার পিদিম;
মেঘবালিকার মনে আলো ঢুকে গেলে 
মুছে যায় অন্ধকার, বির্বণ অতীত!

 


ফুডব্লগাররা কেন এত জনপ্রিয়
মেহেদী ইকবাল 

খিদে নিয়ে জন্মেছে মানুষ
অন্য প্রাণীর মতো
তবে তারা শৌখিন
কত শত রেসিপি আর মসলার ঘ্রাণ
বৈচিত্র্য আর চমকে ভরা খাবার টেবিল তাদের।

যদিও আছে অনিয়ম
বণ্টনে বঞ্চিত যারা থাকে তারা অনাহারে
আছে অপচয় আর জঘন্য কাড়াকাড়ি উচ্ছিষ্ট নিয়ে।

মানুষের লোভী চোখ খোঁজে রেসিপি শুধু
অনাহারে থাকে যারা
তাদেরও চোখ খাবারের দিকে।

মানুষ খেতে ভালোবাসে
আর লোভী কিংবা ক্ষুধার্ত চোখে
ভালোবাসে দেখতে

খাবার প্লেটভর্তি! 

 


মূল্যহ্রাস
দালান জাহান 

এই এলাকায় কোনো শিল্পী নেই 
অথচ রোজ রাতে কে যেন 
তিনটি মুমূর্ষু মহাদেশ এঁকে যায় কৃষ্ণঠোঁটে। 

এই এলাকায় কোনো জ্যোতির্বিদ নেই 
অথচ কম্পমান চোখের পাতায়
টেলিস্কোপ নিয়ে ঘুমিয়ে থাকে 
নিঃশ্বাস বেয়ে নিউরনে ওঠা ঠাণ্ডা সুতি সাপ। 

এই এলাকায় কোনো ঈশ্বর নেই 
নক্ষত্র নেই শত্রু নেই 
অথচ মূল্যহ্রাসের মায়াবাজারে 
দীর্ঘ হচ্ছে তোমার শাড়ির দাম।

 


ইন্দ্রজাল 
সাঈদুর রহমান লিটন 

আবার কোনো প্রজাপতি উড়ে আসে 
মনের বেখেয়ালে ঠাঁয় নেয় অন্তরে 
মমতা জন্ম নেয় মন-মননে। 
তার পরশ মন ছুঁয়ে যায়
দাগ কেটে যায় অন্তরে।
তার ডানার আদর আর অকৃত্রিম সৌন্দর্যে 
এক ইন্দ্রজাল তৈরি করে যায়
সেই প্রজাপতির উড়ে যাওয়া, ছুঁয়ে যাওয়া
সব কিছু ভালো লাগে।

 


শোকার্ত দুচোখ
পবিত্র মহন্ত জীবন 

অঝোরে কাঁদে শোকার্ত দুচোখ-
অধীর গতি, বিকর্ষ বিক্ষোভ মিছিল
হৃদ-গগনে সহস্র কষ্টের আবরণ 
তীব্র ক্ষোভ, অসহ্য যন্ত্রণা
জীর্ণ কাচের নল ক্ষতবিক্ষত 
ব্যথা, কাতরে ওঠে বুকের ভিতর,
নিন্দন ঘৃণা, অমীমাংসিত, তাচ্ছিল্য
কালো মেঘের আনাগোনা, শোকার্ত চোখ
অঝরে কাঁদে পাহাড়-পর্বত, ঝরনাধারা 
দুঃখের তরীতে ভাসে ভূমি সমতল;
সমুদ্র কোলাহল।

 

সেসব অবোধগম্যতা
গাজী গিয়াস উদ্দিন 

সহস্র রহস্যের জগতে আমাদের অদৃষ্ট বিচরণ!

লাগসই ভাষা কই সেসব অবোধগম্যতা নিয়ে খেলে 
মার্জার ছানারাও অবাক দূরত্বে অপরিচিত পরিবেশে 
পরম স্বজনের মনোভাব কেন মুশকিলে ফেলে?

অথচ জলবায়ুর স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয় বায়ুবিদ
প্রণয়পুষ্পের সন্ধানেও মৌমাছির কাছে হই নাকাল 
রোবট ও রমণীর সুষম মিথস্ক্রিয়া এ আইয়ের ধ্রুব জয়-জাল,
শিশুর অভিমান ভাঙতেও হিমশিম অভিজ্ঞ মনোবিদ!

তবু চলে ঠিকঠাক সেলাইয়ের সব চটকল,
শত রহস্য বিফল এ কোন ম্যাজিক- কোন মিরাকল! 

তনুমন শুশ্রূষা- ঘুরপ্যাঁচ মৃত্যুর চতুর্ভুজ সমীকরণ! 

 


দিন কাটছে বেশ
সাদেকুর রহমান সাদিক

ফসল নাকি উদ্বৃত্ত
খাদ্যে গুদাম ভরা,
বিদেশ থেকে চাল না এলে
দেশের বাজার চড়া।

ঋণখেলাপির পকেট ভারী
বাড়ছে ক্রয়ক্ষমতা,
আমলা আর সাধারণে
আকাশ-পাতাল সমতা।

গিন্নি যখন সকালবেলা
হাতে ধরায় থলি-
পকেটে মোর ঘুঘু নাচে
কেমন করে বলি।

আয় বাড়েনি আমজনতার
তবু মধ্যবিত্ত দেশ,
ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে
দিন কাটছে বেশ।

ধারাবাহিক উপন্যাস গোপনীয়

প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৫২ পিএম
গোপনীয়
গ্রাফিকস: নাজমুল আলম মাসুম

পর্ব-১০

এসবের বিপরীতে, মেঘ ক্লান্ত শ্রাবণ সকালে তার মনে প্রশ্ন জাগল রত্না কি তাকে সেই লম্পট পুরুষের রাহুগ্রাস থেকে বাঁচানোর জন্যই অমন করেছিল, নাকি আসলেই সে ছিল লেসবিয়ান? ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল সে। আর রত্নাই বা গেল কোথায়? সেই ঘটনার পর থেকে তার যে টিকিটিও মিলছে না।
মাসি বোধ করি চারুর অস্থিরতা টের পেয়ে থাকবেন। বললেন,
-তোমরা কালকে যা করেছ, ভালোই করেছ, আমি হলেও তাই করতাম! পুরুষরা যখন খুশি মেয়েদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, এটি কোন ধরনের সভ্যতা!
চারু বলল, সে মানুষটিকে কি ধরা হয়েছে? আমি তাকে নিজের হাতে জুতাপেটা করব।
প্রমাদ গুনলেন মাসি। এ কী বলে মেয়েটা! তাকে ধরা তো দূর কি বাত, হাজার রকম কৈফিয়ত দিতে দিতে জান শেষ, দুই লাখ টাকার চুক্তি বলে কথা! অনাঘ্রাতা কুসুমের সুবাস নেওয়ার চুক্তি!!
কিন্তু মনের ভেতরের ঝড় মুখে প্রকাশ হতে দিলেন না মাসি। এ পেশায় থাকতে থাকতে অভিক্ত ডিপ্লোমেট হয়ে উঠেছেন তিনি। তার কারবার সমাজের সব উঁচু তলার মানুষদের এসব নিচু কাজ নিয়ে। লোকটি ছিল পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তার কাঁচা মাংস চাই। একেবারে সদ্য দাঁত ওঠা গরুর মাংসের মতো কাঁচা, নরম, তুলতুলে মাংস।
হঠাৎ শিউরে উঠলেন মাসি। ঘটনা যেভাবে হলো, তার এই কাজের লাইসেন্স না বাতিল হয়ে যায়! তবে এ মাঠের পাকা ঘুঘু তিনি। তিনি জানেন, এসব লোক সমস্ত কিছু ত্যাগ করতে পারে, কিন্তু নতুন নতুন স্বাদের আস্বাদন ত্যাগ করতে পারবে না। এজন্য কুহকে পড়া পক্ষীর মতো তাদের তার কাছে আসতেই হবে। তবে নিজের ভাবগাম্ভির্য ধরে রাখলেন তিনি, পাছে চারু কিছু টের পেয়ে যায়।
শ্রাবণ সকালে পরিব্যপ্ত সূর্যালোকে দুই অসম বয়সী নারী বসে আছে। একজন গোপন ব্যবসায়ে হাত পাকানো অভিজ্ঞ নারী আর অন্যজন জগতের এইসব হীনতা তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে কোনো নন্দন কাননে সদ্য ফোটা ফুল-পবিত্রতায় স্নিগ্ধ, প্রসন্নতায় অনাবিল।
সদ্য শুরু হওয়া ঝিরিঝিরি বৃষ্টির বিপরীতে মাসির দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিল চারু। প্রথমে ভুল করে ভাবল, এ তার ফেলে আসা খালার মতো, আবার খেয়াল করে দেখল, না উনি অনেক সুন্দর। বিগত যৌবনা মাসির চোখে, চোখের কোণায়, নিজের অস্তিত্ব অনুভব করল সে। 
বহু বহু দিন আগে, নয়নহারা কি তেঁতুলঝরা নদীর ধারে বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়েছেন মাসি। অল্প বয়স। বাদল আঁধারে বিরহী বধূর মতো চারদিকে অন্ধকার করে আছে। আর সেই অন্ধকারের আড়ালে লুকিয়ে ছিল মানবরূপী পশু। সেদিন সেই আঁধারে সর্বস্ব হারানো মাসি হয়তো কোনোদিন কাউকে কিছু বলেননি। নিজের বুকে একান্তে বয়ে চলেছেন সেই গোপন ব্যথা! নাকি কোনো চক্রের সাজানো ঘটনায় সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন সেদিন আর আজ, এতদিন পরে সেই মাসি  সেই চক্রের একজন হয়ে চারুকে একই  রকম ফাঁদে ফেলতে চাইছেন! এরকম কিছু চক্রের কথা চারু গ্রামে থাকতে শুনেছিল। তার অন্তরাত্মা ভয়ে অসহায় ঝড় কপোতীর মতো কাঁপতে থাকে। 
কিন্তু মাসির মুখের দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত হয় সে। সেখানে বেদনার্ত শ্রাবণ বেলায় জীবনের বনে জোনাক পোকার নেভানেভি।
চারু ভাবল, এ মুখকে বিশ্বাস করা যায়, এ চোখকে বিশ্বাস করা যায়। তার জন্ম-জন্মান্তরের খালা নিজের ভাই মহব্বত চাচাকে দিয়ে যেনতেন কারও হাতে চারুকে তুলে দেননি, দিতে পারেন না। সে যে তাকে মায়ের চেয়েও আপন খালা ডেকেছে, ডেকে এতগুলো বছর সুখে-দুঃখে গুজরান করেছে! মাসির অভিজ্ঞ চোখে চারুর মন, মনের ভাষা প্রাইমারি স্কুলের বইয়ের মতো পড়া হয়ে যায়। হাসিমুখে বলেন তিনি-
-রত্নার কাছ থেকে জানলাম, তুমি সাজগোজ পছন্দ করো। ভাবছি ওর মতো তোমাকে বিউটিশিয়ান বানাব, আবার ভাবছি, তোমার সৌন্দর্যের খাতিরে ভাবছি, তুমি অনন্য সুন্দর একজন গাইয়ে, নাচিয়ে হতে পার। জগৎজোড়া হবে তোমার সুনাম, টাকা-পয়সা, খ্যাতি আর ভক্তি, তুমি যেমনটি চাও, সেভাবে তোমাকে প্রশিক্ষণ দেব। বলো, কী হতে চাও তুমি।
চারু কথা খুঁজে পায় না। বাইরে এতক্ষণ ঝিরিঝিরি চলা বৃষ্টি এখন ঝেপে এসেছে। দিগন্ত অন্ধকার করে হেমন্ত বিকালে শিশিরের শব্দের মতো বৃষ্টি নেমেছে। এমন নরম পরিবেশে জীবনের এই কঠিনতম সিদ্ধান্ত কীভাবে দেবে চারু, ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। মাসিই সাহায্য করল তাকে। 
-আমাদের এখানে দেশের সেরা নাচ আর গানের প্রশিক্ষক আছে। তুমি চাইলে এখানে ঘরের মধ্যেই তোমার ট্রেনিং হবে। 
চারু কী জানি কী ভেবে রাজি হয়ে গেল। আর দুই নারীর ওপরে, বহু ওপরে বসে যার অঙুলি হেলনে আকাশ পৃথিবী ঘুরছে, ঘুরছে মানুষের ভাগ্যচক্র, চারুর সিদ্ধান্ত শুনে তিনি মৃদু হাসলেন। বললেন, তুমি যদি জানতে তোমার ভাগ্য তোমাকে কোথায় নিয়ে যায়, কোথায় নিয়ে যাবে; যদি এতটুকু শুধু জানতে! 
চারু জানল না, সে জীবনের কঠিনতম সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো একটি কাজ করে আপতত খুশি। খুশি মাসিও। তিনি বললেন-
ট্রেনিং, নাচ, গান পরে হবে। আগে চলো এ শ্রাবণ বেলায় আজকে বিশেষ মেজবানি রান্না করি তোমার জন্য। এটিও শিখে রাখ।
পল্লির রান্নাঘরে মাসি নিজের হাতে চারুকে মেজবানি রান্না শেখান।
-এটি চট্টগ্রামের বিখ্যাত খাবার। এখন সারা দেশে, এমনকি বিদেশেও তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে।
চারু কিছু বলে না। সে মেজবানির নাম শুনেছে, কিন্তু খাওয়া হয়ে ওঠেনি কোনোদিন। পরের ঘরে সে বড় হয়েছে। সেই পর অর্থাৎ খালাও ছিলেন গরিব। সেখানে মেজবানির মাংস খাওয়া তো বিলাসিতা। কিন্তু কিছুই বলে না সে।
বিশাল রান্নাঘরে দুপুরের রান্নার এলাহী আয়োজন চলছে। কয়েকজন মহিলা উনানে ভাতের কি তরকারির ডেকচি চড়িয়ে দিয়েছে। হরেক রকম মসলা বাতাসে মিশে সুগন্ধ বিলাচ্ছে চারদিকে। রান্নাঘরের এক কোনায় একটি বিড়াল আর একটি কুকুর নিশ্চুপ বসে আছে। বাইরে বৃষ্টির বিরাম নেই।
মাসি একটি সসপ্যানে মাংস আর মসলা জোগাড় করে নিয়ে এসেছেন। তিনি চারুকে ডেকের পাহারায় বসিয়ে কি একটি মসলার জন্য আবার ঘরের বাইরে গেলেন। চারু একেলা উৎকণ্ঠিত হতে যাচ্ছিল, এ সময় ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে মাসি ফিরে এলেন। তার চুল বেয়ে, চারুর দেখা সেই ছোটোবেলার মোহন দুটি চক্ষু বেয়ে শরতের শিশিরের মতো বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ছে।
-মেজবানির মূল কথা হলো মাংস। সব জায়গার মাংস চাই, রান, ঘাড়, বুক সব জায়গার। তার পর লাগে বিশেষ এক মসলা।
-সেইটিই আনতে গেলাম। এটি ছাড়া তুমি আর যাই দাও, মেজবানির মাংস অচল।
মাসি চারুকে এমনভাবে সে মসলা দেখালেন, যেন বা বহু বহুদিন গোপনে সংরক্ষিত কোনো প্রত্ন বস্তু ‘নিলামে উঠিতেছে’। মাসির হাসিটা সংকেতপূর্ণ। তার পর প্রায় ফিসফিসিয়ে বললেন, ভয় নেই আমি তোমাকে এই মসলার গোপন রেসিপি শিখিয়ে দেব। 
কিন্তু যার উদ্দেশে এই গোপনের প্রকাশ, সেই চারুর মধ্যে মেজবানির গোপন রেসিপি নিয়ে কোনো উৎসাহের প্রকাশ দেখা গেল না। তার চোখ দুটি মেঘমেদুর শ্রাবণ দিনে বাইরের মলিন দেয়ালে বসে চুপচাপ ভিজে যাওয়া একটি করুণ কোকিলের দিকে করুণভাবে তাকিয়ে আছে।
মেজবানির মাংস ভালোই হলো। কিন্তু চারুর মধ্যে তা নিয়ে উৎসাহের কোনো আতিশয্য দেখা গেল না। মাসি বললেন, মেয়েটিকে শ্রাবণে পেয়েছে। তিনি বললেন, তার অতীত দিনে এরকম ঝরো ঝরো বেলায় তিনিও উদাস হয়ে যেতেন। পরবর্তী জীবনে সংগীত ও নৃত্যের ওস্তাদগণ এ অবস্থার নাম দিয়েছেন পূর্বরাগ।
চারু বলল, পূর্বরাগ কী? 
মাসি হাসলেন। বললেন, একটি মেয়ে যখন একটি ছেলের প্রেমে পড়ে তখন তার প্রথম লক্ষণ হলো পূর্বরাগ।
চারু অবাক তাকিয়ে থাকল। মাসি বললেন, তোমার কথা বলছি না। একটি পূর্ণাঙ্গ ক্লাসিক নাচের এটি প্রথম অংশ। অপেক্ষা করো, কালকে যখন তোমার ছন্দ ও নৃত্যের ওস্তাদ আসবেন, তখন হাতেকলমে জানতে পারবে। তোমার চোখ-মুখ দেখে বহুদিন আগে বহু কষ্টে শেখা আমার সেই ভাব মনে পড়ে গেল, তাই বললাম, একটি মেয়ের লুক এত ন্যাচারাল হয় কীভাবে!
চারু কিছুই বুঝল না। তবে নতুন ওস্তাদের কাছে নতুন কী পরীক্ষায় পড়তে যাচ্ছে ভেবে অস্থির হয়ে উঠল।
সন্ধ্যা এবং পরের দুই দিন জলে-বৃষ্টিতে কেটে গেল। এমন তুমুল, সবকিছু ভাসিয়ে নেওয়া বৃষ্টি অনেকদিন দেখেনি চারু। চারুর ভালোই লাগল, অন্তত এ দুই দিন ছন্দ ও নৃত্যের ওস্তাদ বা ওস্তাদ নামধারী কারও হাতে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়নি। চারুর মনে হলো, যদি এরকম তুমুল বৃষ্টিতে দিন-মাস-বর্ষ- সারাটি জীবন অতিক্রান্ত হয়ে যেত কতই না ভালো হতো। কিন্তু তৃতীয় দিন সকালে যখন পল্লির মেয়েরা একসঙ্গে ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া’ নামের এক হিন্দি ছবিতে বুঁদ, মাসি ঘোষণা দিলেন, আজ বিকেলে চারুর ওস্তাদ এসে পৌঁছাবেন। অতএব, চারু যেন সাজগোজ সেরে যথাসময়ে নাচঘরে হাজির হয়।

কবিতা

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩০ পিএম
আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩১ পিএম
কবিতা

জীবনস্রোত 

সুমন রেজা 

ক্ষণজন্মা শৈবালের মতো জীবন
জোয়ার-ভাটার আকর্ষণ, বিকর্ষণে
এ কূল-ও কূল ঘুরে-ফিরে অবশেষে
বানভাসি স্রোতে মিশে যায় নিয়মে

একফোঁটা ছন্দের খোঁজে এ যাত্ৰা
কখনো হয় না নিয়তির মতো মসৃণ
জেনেও, অন্ধের মতো এ ছুটে চলা
শুধু খুঁজে ফেরে জীবনের শিল্পকলা

পরজীবী সময়কে নিজের করে নিতে
ছাড়তে হয় কত প্রিয় সুখময় আশ্ৰয়
দীর্ঘ হয় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সমীকরণ
চুকে যায় লেনদেন, শরীরের হয় মরণ।

বিবাহবার্ষিকী

সাবিত্রী সাহা 

বছর ঘুরে শ্রাবণ এসেছে বন্ধন দৃঢ় হয়েছে। 
শ্রাবণ ঘুরে ঘুরে আসুক পাকাচুলে সিঁদুর দিই
তোমার নামে শঙ্খ পরি
তুমি আমি একসাথে বুড়ো হই।
ডায়াবেটিস মাপি, চশমার পাওয়ার বদল করি, 
তুমি আমার আমি তোমার হাতের লাঠি হই
কে আগে কে পরে, যাবার দিন গোনার আগে এ বন্ধন জন্ম-জন্মান্তরের হোক অভিলাষ রাখি।

জাগো বাঙালি ছাত্র-জনতা 

রুমানা আক্তার রত্না  

জাগো বাঙালি জাগো, বীরের বেশে 
এই বাংলায় আবার অস্ত্র ধরো
বিদ্যাপীঠে আছে যত সন্ত্রাসীর চেলা
শিকড়সহ উপরে ফেলো!
প্রতিরোধের প্রতিবাদে একতা গড়ো
আর কতকাল বোধির হয়ে  
দেখবে এদের ছলচাতুরী খেলা! 
হে বর্বর দৈত্য দানব অসুর পশুর দল
কোথায় তোমাদের শিক্ষাদীক্ষা?
ক্ষমতার লোভে অন্ধ তুমি, স্বৈরাচারীর বল!
আমি ঘৃণা করি! আমি ঘৃণা করি! 
তুমি মানুষ নও! তুমি মানুষ নও! 
তুমি এই সমাজে ছাত্র নামের কীট।
তুমি নিঃশ্বাস কাড়লে আমার, হয়ে মহাবীর 
রাজপথে ঝরা প্রতিটি রক্তের ফোঁটায়
এবার জন্ম হবে, দেখবে তুমি লাখো কোটি বীর! 
ভাই বোন হত্যার বিচার করতে 
এগিয়ে এসে সব, ছাত্র-জনতা সৈনিক। 
আমি রাজাকার নই! রাজাকার নই! 
কৃষক শ্রমিক দিনমুজুরের সন্তান। 
আমি বাঙালি, আমার রক্তে মিশে আছে 
সেই একাত্তরের প্রতিবাদী ঘ্রাণ।
অধিকার আদায়ে, আজও থাকব অবিচল
বাংলার মানুষই এই বাংলার বল,
মনে রেখো স্বৈরাচার জালিম সেনার দল।

শ্রাবণ 

সুশান্ত কুমার দে 

এসেছে শ্রাবণ নদী নালা প্লাবন
কদম ফুলের সৌরভে মুখরিত বন।
সারা দিন ঝরঝর কালো মেঘের ভর 
উঠোনে কাঁদা ঐ দেয়া কড়মড়!
ঐ দূরে তাল গাছে বজ্রপাতে 
আগুনে ঝলসানো পাতাগুলো তাতে।
গোয়ালে গরু দুটি, একটু ছোটাছুটি 
নীড়ে চড়াই ছানা থাকে গুটিসুটি।
ছাতি মাথায় হাটে যায়, গহর আলি ভাই 
ঘরে তার এতটুকু চাল-ডাল নাই !
পুকুর পাড়ে চ্যাং-শোল, কই আর পুঁটি 
হাবুল বাবুল দুই ভাই ধরে মুঠি মুঠি।
গহর আলি খানা সেচে মাছ ধরতে যায় 
দা-কোদাল, ঘুনচি ঘুনি খুঁজতে জীবন যায়।
কোলা ব্যাঙ মাথা তুলে ডাকে ঘ্যাঙর গ্যাং 
পা পিছলে পাতি হাঁসের ভেঙে গেল ঠ্যাং।
সবুজ বনের পাতাবাহার রূপবৈচিত্র্যে ভরা 
আহা  কী, অপরূপ সৌন্দর্যময় এ ধরা।
বৃষ্টিভেজা বনবনানী, কতক পাখির ছা 
সারাক্ষণ ভিজে ভিজে, জ্বরে কাঁপল গা।

সাহিত্যসভার এ সপ্তাহের বিশেষ আয়োজন

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৩২ পিএম
আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৩৪ পিএম
সাহিত্যসভার এ সপ্তাহের বিশেষ আয়োজন
অলংকরণ: মেহেদী হাসান

রক্তাক্ত স্বাধীনতা 
মো. আশতাব হোসেন 

তুমি এসেছিলে রক্তের সাগর পারি দিয়ে  
রুগ্ন কঙ্কাল শরীরে বিধস্ত পথ ধরে, 
আজও হয়নি আলোকোজ্জ্বল অবস্থান তোমার। 
হে স্বাধীনতা তুমি এসেছিলে ছুটে
এক হিংস্র বাঘের মুখ থেকে ক্ষতবিক্ষত শরীরে
না শুকাতেই ক্ষতচিহ্ন তোমার 
আবার শিকার হলে খ্যাপা ক্ষুধার্ত শৃগাল কবলে! 
হে স্বাধীনতা তুমি এখন বন্দি 
তৃষ্ণাতুর শৃগাল খাঁচায়,
সে শৃগাল তোমার হাড়গোড় কম্পিত হৃদপিণ্ড রেখে
আগে খাচ্ছে চামড়া মাংস গরম রক্ত,
আমরা তোমার অসহায়ত্বের কাছে নতজানু
পারছি না তোমাকে উদ্ধার করতে খালি হাতে! 
হে স্বাধীনতা ভয় পেও না ধৈর্য ধরো 
যতই হোক তোমার পতাকা রক্তিম ঝাঁঝরা 
রক্তের প্রতিটি ছিদ্র থেকে জন্ম লাভ করবে
তীব্র দাহের অগণন অগ্নিশিখা! 
অপেক্ষা করো হে স্বাধীনতা নিগুঢ় অন্ধকারে
তোমাকে আলোর ঝরনাধারায় স্নান করাতে 
খেপেছে বুকে বিরহের আগুন রক্তের ঝড় নিয়ে, 
তোমাকে মুক্ত করবেই তারা জেনে নাও
তুমি মুক্ত হবে আসবেই তোমার সোনালি দিন, 
তুমি অপেক্ষা করো হে কঙ্কাল স্বাধীনতা! 

 

এ কেমন জীবন
মো. আলমামুন হোসেন 

তোমাকে ভাবতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ি প্রতিনিয়ত ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে যায়।
আচ্ছা তুমি কি আদৌ জীবনের নিয়মে আছ,
শূন্যতাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা কি সম্ভব? 
মিথ্যার আড়ালে চাপা পড়ে যায় যত সত্য।

সম্পর্কের মৃত্যু হয়ে গেছে;
ফাটল ধরে দীর্ঘ দেয়াল নীরবে দিয়েছে উঁকি। 
ব্যর্থ জীবনে বেঁচে থাকার ছক কাটি অনিশ্চিত, 
দিনশেষে পথ হারিয়ে ফেলি চিরচেনা আঙিনায়। 
তবে শূন্যতাই হোক জয়ের লক্ষ্য,  
যদি থেমে যাই এ যাত্রায়, অভিযোগ রইল না আর 
জেনে রেখো মানুষ বারবার থেমে যায়; প্রতীক্ষার প্রহর গুনে।

 

দূরতম দিগন্ত 
মোখতারুল ইসলাম মিলন 

অবশ্যম্ভাবী ক্লান্তি আঁকড়ে ধরে,  
অনড় পথের প্রান্তে দাঁড়িয়ে,  
নির্ভারতা যেন দূরতম দিগন্তে বিলীন,  
নিঃশব্দে অপেক্ষার দুর্ভেদ্য দেয়ালে।  
প্রত্যাশার ভারে মন ক্লিষ্ট,  
অপ্রতিরোধ্য সময়ের প্রতিধ্বনি।  
অচঞ্চল হৃদয়ের গভীরে জমে থাকা  
অনুপ্রেরণার অপরিহার্য আহ্বান।  
নিরবধি সংগ্রামের প্রতিটা ধাপে,  
অধিকার জমাট বাঁধে প্রতিঘাতের ক্ষণে,  
অবিনশ্বর আত্মবিশ্বাসের শিখা জ্বলে,  
তবুও অদম্য সেই চলার প্রান্তে।

 

বদলের আওয়াজ
সুজন সাজু 

বিবর্ণ রোদ মেঘের লুকোচুরি 
স্থির দাঁড়ানো বট গাছ,
দীঘির জলতরঙ্গে পদ্ম দোলে
আড়ালে রবি আজ।
স্বয়ং ঈশ্বরে দেখাচ্ছে লীলা 
বৃষ্টির শাড়িতে রূপ,
ঝাঁঝালো ঝলকে চিত্র আঁকা 
নৈঋত দিকেতে ডুব।
ক্লান্ত দ্বীপে গোধূলি নামে আজ,
নূপুরের নৃত্যে বদলের আওয়াজ।

 

নিরীহ শরৎ
মান্নান নূর

বিকলাঙ্গ শরৎ ডুকরে ডুকরে কাঁদে
যথাযোগ্য শিশির নেই ধুয়ে দিতে প্রাতে
শিউলির পা।
বিরহরাতে নিরীহ শরৎ চিঠি লিখে
কাঁপা হাতে জ্যোৎস্না-তারায়,
উড়ো চিঠি উড়ে উড়ে ঢেউ ভেঙে
আঁচড়ে পড়ে কাশের ডেরায়,
যেখানে থাকে না প্রেম, থাকে না দোলে ওঠা নদীর দুকূল
লুটেরা লুটে নেয় কাশবন মাটি,
পাখির পালক ছেঁড়ে, ছেঁড়ে শুভ্র ভালোবাসা
ছেঁড়ে সাদা মেঘ আকাশ সমান।
মেঘদূত উবু হয়ে থুথু দেয়, ঘৃণা ছোড়ে স্তরে স্তরে গজিয়ে ওঠা অসভ্য সমাজ।

 

সরলছায়া
দালান জাহান 

ঈশ্বরের হাত ধরে অসংখ্য ইঁদুর 
পৌঁছে গেছে পাহাড়ের ছাদে
তারা এখনো চূড়ায় দাঁড়িয়ে হাততালি দেয়
বাঁশি বাজলে নেচে ওঠে দাঁত কামড়ায়।
একদিনের প্রার্থনা ভাঙা সরলছায়ারা 
হারিয়ে যায় লাল পাসপোর্টে। 
ক্ষতের কাগজে শব্দহীন কালো কান্না
উপোস ভোরে জলদৌড়ে আসে শিমুল ফুলের বিয়ে। 
মায়ের হাত থেকে রেখাগুলো কেড়ে নিয়ে 
তারা কুকুরকে দিয়ে দেয়
মস্তিষ্ক ছিঁড়ে ছিঁড়ে পালন করে বিশুদ্ধ মৃত্যু উৎসব। 
মুমূর্ষু ক্যালেন্ডার থেকে 
পৃথিবীতে নেমে এসেছে পতন দিবস 
আমি আকাশকে বলে দিয়েছি 
আমি ঈশ্বরকে বলে দিয়েছি 
আপনার ইঁদুরগুলো থামান। ইঁদুরগুলো নিয়ন্ত্রণহীন।

 

খণ্ড এক মেঘের আকাশ
চিরঞ্জীব চ্যাটার্জী

ঐ যে খণ্ড এক মেঘের  আকাশ,         
খুব সকালে ঘুম ভেঙে হয়তো সে আষাঢ় হবে-
হতে পারে শ্রাবণের অঝোর মায়াও;
হতে পারে, 
এমনও সে হতে জানে নীলাদ্রি নিরুপম!
ঐ এক খণ্ড মেঘের আকাশও বোঝে,
ও যে জানে কতটা কান্না হলে তবে সবুজ হাসে-
কতটা কান্না হলে তবে রোদ হয় উনুনে-উনুনে।
ঐ যে এক খণ্ড মেঘের আকাশও ডুবে গেলে-
ও জানে,
অনেক কান্নারে সে তো মরে যেতে হবে-
মৃয়মাণ হতে হবে অনেক মায়ার সবুজেরে...
উনুনের রোদে-রোদে অরুন্ধতী চোখে দেবে দেখা জিজ্ঞাসা অপার; 
              
ওগো তুমি খণ্ড এক মেঘের আকাশ, 
আবার কখন তুমি তাই মোর আকাশ আষাঢ়!
আবার কখন তুমি সে গো মোর শ্রাবণ আঁধার!

 

পড়ন্ত বিকেলে
এম এ রহমান

একদিন হঠাৎই আপনার মনে হবে
আপনি একটা
একমুখী রাজপথে দৌড়াচ্ছেন
পড়ন্ত বিকেলে শেষ রোদটুকু
আপনার সামনে দৌড়াচ্ছে
তাকে ছুঁতে চাইবেন অথচ পারবেন না
পা অনেক ভারী হয়ে যাচ্ছে
আপনি থামতে চাইবেন
কিন্তু সামন-পেছনে দ্রুত যান
ডানে বামে তাকাবেন
কিন্তু দাঁড়াতে পারবেন না
আপনার ভেতরে অনেক যাত্রী
নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই
পেছনের সিটে বসে আছেন আপনি
শরীরের জমে থাকা ক্লান্তি
মাঝে মাঝে কেউ খুলে দেবে
আপনি দাঁড়াতে চাইবেন
অথচ পারবেন না

একদিন দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎই 
দেখবেন আপনি কোথাও নেই
আপনার বরাদ্দের সিটটিও পূর্ণ...

 

কেন যে বোকার মতো
মেহেদী ইকবাল 

বেদনাকে বলেছি যাব না
যতই তীক্ষ্ণ হোক চঞ্চু তোমার
যত পার ঠোকরাও
কাঠ নয়, স্পর্শকাতর শরীরে আমার
রক্তাক্ত আহত কর
শুষে নাও টপ টপ ঝরে পড়া রক্তের ফোঁটা।

না, উঠব না কঁকিয়ে আমি যন্ত্রণায়
ঠোকরাও আনন্দে তুমি বিরতিহীন
তীক্ষ্ণ ঠোঁটে ছিঁড়ে নাও মাংসপিণ্ড 
যদি চাও ছিদ্র কর
বুকের এইখানে ঠুকরে যাও হৃদয় আমার।

না, যাব না যাব না কিছুতে আমি
কেন যে বোকার মতো 
রক্তবর্ণ চোখ

আমাকে দেখাও ভয়!

 

শঙ্খপাড়ের হেলেন
গাজী গিয়াস উদ্দিন 

শঙ্খ তুমি নীল থেকে 
নদীর উত্তরাধিকার দুঃখ মেলাও
এককালে লোক ভুলে কষ্টের শোক
যখন ইহকাল বেদনার পিরামিড!

বিজ্ঞানের ছায়াতলে বিরহের অববাহিকায় 
স্মৃতি-সম্রাজ্ঞী প্রেয়সীর সকাল বিকাল 
নশ্বর এত সুন্দর 
স্বর্ণলতা রূপে- পারফিউমে এশিয়া ঐশ্বরিয়ায়
পুরুষের চোখে পোড়ানো অন্তর্জাল, 

আজ তোমার কম্পিত স্মরণ 
খুঁজে আনে যন্ত্রণার অবিনশ্বর 
দুমড়ে-মুচড়ে হিয়া চোখজুড়ে শঙ্খের বিরহিণী পাল।

হিংসার নিষ্ঠুর প্রায়শ্চিত্ত করুক 
না ভাঙুক কুসংস্কার ঝড়ে পাখির বাসা,

সেসব চিত্তদাহ বিরহ ছড়ানো পথে 
প্রণয়ের বিদগ্ধ বিস্ময় শঙ্খের হরিণী হেলেন।