ফুলে ফুলে ঢেকে গেছে মধুমালতী গাছটা।পশ্চিমের বারান্দায় বিকেলের রোদটা ঠিকরে পড়ছে সেই ফুলের উপর। রং বেরঙের ফুটন্ত ফুলের উপর রোদের খেলাটা চোখে এসে বিধছে অসহনীয়ভাবে আজ। তার উপর দিয়েই অপলক তাকিয়ে আছেন কবির স্যার।কত বছর এমন দৃশ্য দেখেননি তিনি তার হিসাব নেই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তার সময় কাটে ছাত্র ছাত্রী আর পড়ানোর ব্যস্ততায়।আকাশের এমন রূপ দেখার সময়ও হয় না তেমন।এতকাল শরতের আকাশ নিয়ে যত সাহিত্য রচিত হয়েছে, যত ছড়া কবিতা পড়েছেন তার সাথে আজকের আকাশের কোনো মিল নেই। নেই শরতের স্বচ্ছ নীল আকাশ।নেই আকাশ জুড়ে সাদা মেঘের ছড়াছড়ি। নেই শুভ্র কাশঁবনের দেখা।মনে হচ্ছে চির চেনা সেই শান্ত নীল আকাশটা এতকাল পুষে রাখা রাগটা উগরে দিচ্ছে রাক্ষসী বর্ণচ্ছটায়।
এ কোন শরতের মুখোমুখি মানুষ আজ!এই শেষ বয়সে এমন এক সময়ের সাক্ষী হতে হবে তা কল্পনাও করেননি।ভাবতে ভাবতেই চোখে জল এসে যায় কবির স্যারের।এই জনপদে তার জন্ম,বেড়ে ওঠা এবং আজ পৌঢ়ত্বে। সবুজের সমারোহে আন্দোলিত এই জন্মভূমি ছেড়ে কোথাও যাননি সুযোগ থাকা সত্ত্বেও।নিজ পরিশ্রমে এই বাড়িটি করেছেন গ্রামের শেষ দিকে যার পাশ ছুঁয়ে গেছে দীঘল মাঠ।সকালে ঘুম থেকে উঠে যেনো মাঠের প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন সেজন্য দোতলার বারান্দাটা গুছিয়ে করেছেন মাঠের দিকে।প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার অভিপ্রায়ে সব আয়োজন ।
নিজ হাতে কত ছেলেমেয়েদের জীবন গড়েছেন তিনি।এইতো কদিন আগেও সময় কেটেছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে। রাতের শেষ ব্যাচটা যখন শেষ করেন তখন প্রায় রাত ন'টা বাজে।নিজের সবটুকু জ্ঞান ও বোধ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছে থেকে এ বয়সে এসেও বাচ্চাদের পড়ান তিনি।যে যত টাকা পারে তাই দেয়।অবসর সময়টুকু বাচ্চাদের সাথে কাটানোর আনন্দে সব ভুলে যান তিনি।বয়সের ভার তাকে ক্লান্ত করতে পারে না। সেদিনও বাচ্চাদের বিদায় দিয়ে বাসায় ফেরেন প্রতিদিনের মত কিন্তু সকালটা আর প্রতিদিনের মত হয়নি।মধ্যরাতে গভীর ঘুমের মাঝেই বন্যার পানি ছুটে আসতে থাকে। ভারতের বাঁধভাঙা পানির প্রবল স্রোতে কাচা, আধাপাকা,টিনসেড বাড়িগুলো দুমড়ে মুচড়ে যায় মাটির সাথে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্লাবিত হয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম।গবাদি পশু হাস-মুরগি ভেসে যায় রাক্ষসী স্রোতে।কে কোথায় কিভাবে আছে তার কোনো খবর নেওয়া সম্ভব হয়নি।
সারা দেশের মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে।সাধ্যমত উদ্ধার করেছে।কে কোন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে তা জানা যায়নি। কবির স্যার কিছুতেই ভুলতে পারেন না রাতে বিদায় দেয়া সেই ছোট ছোট বাচ্চাদের মুখগুলো। পানি কিছুটা নেমে যাওয়ার পর কিছু খবর পাওয়া গেছে। স্যারের অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী ছিল গরীব অসহায় যাদের বাড়িঘর কাচা মাটির বা টিনসেড।আর এ ধরনের ঘরগুলো বন্যার পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে দূর কোনো সাগরে,সাথে নিয়ে গেছে ঐ ঘরের মানুষগুলো।চিরচেনা সেই জনপদ আজ বন্যার জলে ঢাকা পড়েছে। বারান্দা থেকে যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি।এতটুকু সবুজের চিহ্ন নেই।তীর্যক রোদটা স্যারের চোখের জলের উপর পড়ে চিকচিক করছে বারান্দার ওপারের জলেঢাকা মাঠের মতই।