মামুন আর মুনিয়ার বিয়ে হয়েছিল পারিবারিকভাবেই। তাদের বিবাহিত জীবনের বেশ কয়েক বছর অতিবাহিত হয়েছে। অনেক চেষ্টার পরও বিয়ের চার বছরেও তাদের ঘরে কোনো সন্তান আসেনি।
সন্তান না আসায় শ্বশুরবাড়িতে মুনিয়ার জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ল। প্রতিনিহত সে কটু কথার আঘাতে জর্জরিত হতো। হাতে না মারলেও, কথার আঘাতে আহত হতো তার হৃদয়। তার স্বামী মামুন তাকে এ ব্যাপারে কিছু না বললেও পরিবারের বিপক্ষেও কখনো কিছু বলেনি। সে বরাবরই মা-ভক্ত।
মামুনকে পুনরায় বিয়ে করানোর জন্য তার পরিবার উঠেপড়ে লেগেছে। সেখানেও মামুন পালন করেছে নীরব ভূমিকা।
মুনিয়া নিরুপায়। একমাত্র আল্লাহই এখন তার ভরসা। নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে সে তার মনের আশা ব্যক্ত করে। মনে মনে তার একটাই চাওয়া, যাতে আল্লাহ তাকে একটি সন্তান দান করেন।
মহান আল্লাহ মুনিয়ার মনের আশা অপূর্ণ রাখেনি। অবশেষে বিয়ের পাঁচ বছর পর মুনিয়ার কোলজুড়ে ঘর আলো করে ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান আসে। তাকে নিয়ে কত খুশি, কত স্বপ্ন, কত আশা।
মুনিয়ার শ্বশুরবাড়ির লোক এ নিয়েও ক্ষিপ্ত। ছেলে সন্তান না হওয়ার কারণে তারা সবাই অখুশি। ব্যতিক্রম মামুন। সে তার কন্যাসন্তান পেয়ে যেন আকাশের একটা তারা হাতে পেয়েছে।
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। মামুন আর মুনিয়ার এক মাত্র আদরের ধন। তাদের নামের সঙ্গে নাম মিলিয়ে একমাত্র কন্যাসন্তানের নাম রাখা হয় ‘মুন’।
মুনিয়া অনেক যত্নে তার আদরের কন্যাকে বড় করে তোলে। মেয়েকে নিয়ে তার একটাই আশা, যাতে সে তার কন্যাকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। যাতে তার মেয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, নিজেকে উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে যেতে পারে। মেয়ে বলে আজ যারা মুনকে অগ্রাহ্য করেছে তারাই যেন মুনের সফলতায় ঈর্ষা করে। সে বুঝিয়ে দিতে চায় মেয়েরাও কম নয়। চাইলে তারাও সফলতার শিখরে পৌঁছতে পারে।
মুনের মুখে আধো আধো বোল ফুটতে থাকে। মুনিয়া অবাক তার মেয়ের স্মরণশক্তি দেখে। এত ছোট বয়সেই মুন বন্দে আলী মিঞার ‘আমাদের গ্রাম’ কবিতাটি শুনে শুনেই মুখস্থ করে নিয়েছে। তার বাবা অফিস থেকে ফিরলে সে ছোটো ছোট হাত-পা হেলেদুলে দারুণ ভঙ্গিমায় কবিতাখানি আবৃত্তি করে দেখানোর চেষ্টা করে।
কবিতার প্রতি এমন আগ্রহ দেখে মুনিয়া মুনকে আবৃত্তি শেখানোর কথা ভাবতে থাকে।
মামুনের ইচ্ছা সে মুনকে গান শেখাবে।
দুজনের দুরকম সিদ্ধান্তে কিছুটা আড়ষ্টতা দেখা গেলেও দুজনেই সিদ্ধান্ত নেয় মেয়েকে তারা আবৃত্তি এবং গান দুটোই শেখাবে।
ধীরে ধীরে মুন বড় হতে থাকে। সে তার মায়ের হাত ধরে আবৃত্তি শেখার প্রয়াস চালায়।
ছোটো বয়স থেকেই মায়ের হাত ধরে সে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করে।
মুন যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে তখন সে ১৬ লাইনের একটি কবিতা লিখে ফেলে তার ‘বাবা’-কে নিয়ে। বাংলাদেশ বেতার, রেডিও আমার, বাংলাদেশ টেলিভিশনে মুন নিয়মিত আবৃত্তি করা শুরু করে। তার ঝুলিতে আসে অসংখ্য পুরস্কার।
তার লেখা কবিতা বিভিন্ন প্রত্রিকায় ছাপা হয়। শিশু আবৃত্তিকার হিসেবে সবার কাছে বেশ পরিচিতিও লাভ করে সে।
মুন লেখাপড়ায় বেশ মনোযোগী। তার মনে রাখার ক্ষমতা প্রবল। তার হাতেখড়ি শুরু হয়েছিল তার মায়ের কাছেই। মায়ের কাছে পড়াশোনা করে সে এসএসসি পাস করেছে এবং জেলা পর্যায়ে বৃত্তি পেয়েছে। এইচএইচসিতেও করেছে অভাবনীয় রেজাল্ট।
মুনকে নিয়ে বাবা-মায়ের অনেক স্বপ্ন। মুনের বাবা-মায়ের স্বপ্ন আরেক ধাপ এগোয় যখন মুন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। মুন ঢাবির বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে, সেখানেও বেশ পরিচিতি পায় এবং নানাবিধ পুরস্কার লাভ করে।
মুন তার মেধা, শ্রম, সততা এবং বাবা-মায়ের দোয়ায় ভালো রেজাল্ট নিয়ে ভার্সিটি জীবন শেষ করে এবং গোল্ড মেডেল অর্জন করে। সে তার পরিশ্রমের দ্বারা এমফিল, পিএইচ.ডি সম্পন্ন করে।
তার মায়ের অদম্য ইচ্ছা ছিল তার মেয়ে যেন একসময় জাতীয়ভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, নিজেকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। যারা তাকে মেয়ে বলে অগ্রাহ্য করেছিল তারাই যেন তার সফলতায় তাকে বুকে টেনে নেয়।
ছোটবেলা থেকেই সৎ উপদেশ, শিক্ষা, মায়ের ইচ্ছা- সব কিছু সেই ছোট্ট মুনকে আজ তার অধিষ্ঠিত লক্ষ্যে নিয়ে গেছে।
বাবা-মায়ের চোখের মণি সেই ছোট্ট আদুরে কন্যাটি আজ হাজার হাজার শিক্ষার্থীর আইডল। তাদের পথপ্রদর্শক।
তবে বড় মুন তার মা-বাবার কাছে এখনো সেই ছোট্ট আদুরে বাচ্চা হয়েই আছে। যার জন্য তার মা অনেক আগেই বুনে রেখেছিল স্বপ্নের বীজ, যার সফলতায় দেখেছিল নিজের সফলতা।