পর্ব-১০
এসবের বিপরীতে, মেঘ ক্লান্ত শ্রাবণ সকালে তার মনে প্রশ্ন জাগল রত্না কি তাকে সেই লম্পট পুরুষের রাহুগ্রাস থেকে বাঁচানোর জন্যই অমন করেছিল, নাকি আসলেই সে ছিল লেসবিয়ান? ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল সে। আর রত্নাই বা গেল কোথায়? সেই ঘটনার পর থেকে তার যে টিকিটিও মিলছে না।
মাসি বোধ করি চারুর অস্থিরতা টের পেয়ে থাকবেন। বললেন,
-তোমরা কালকে যা করেছ, ভালোই করেছ, আমি হলেও তাই করতাম! পুরুষরা যখন খুশি মেয়েদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, এটি কোন ধরনের সভ্যতা!
চারু বলল, সে মানুষটিকে কি ধরা হয়েছে? আমি তাকে নিজের হাতে জুতাপেটা করব।
প্রমাদ গুনলেন মাসি। এ কী বলে মেয়েটা! তাকে ধরা তো দূর কি বাত, হাজার রকম কৈফিয়ত দিতে দিতে জান শেষ, দুই লাখ টাকার চুক্তি বলে কথা! অনাঘ্রাতা কুসুমের সুবাস নেওয়ার চুক্তি!!
কিন্তু মনের ভেতরের ঝড় মুখে প্রকাশ হতে দিলেন না মাসি। এ পেশায় থাকতে থাকতে অভিক্ত ডিপ্লোমেট হয়ে উঠেছেন তিনি। তার কারবার সমাজের সব উঁচু তলার মানুষদের এসব নিচু কাজ নিয়ে। লোকটি ছিল পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তার কাঁচা মাংস চাই। একেবারে সদ্য দাঁত ওঠা গরুর মাংসের মতো কাঁচা, নরম, তুলতুলে মাংস।
হঠাৎ শিউরে উঠলেন মাসি। ঘটনা যেভাবে হলো, তার এই কাজের লাইসেন্স না বাতিল হয়ে যায়! তবে এ মাঠের পাকা ঘুঘু তিনি। তিনি জানেন, এসব লোক সমস্ত কিছু ত্যাগ করতে পারে, কিন্তু নতুন নতুন স্বাদের আস্বাদন ত্যাগ করতে পারবে না। এজন্য কুহকে পড়া পক্ষীর মতো তাদের তার কাছে আসতেই হবে। তবে নিজের ভাবগাম্ভির্য ধরে রাখলেন তিনি, পাছে চারু কিছু টের পেয়ে যায়।
শ্রাবণ সকালে পরিব্যপ্ত সূর্যালোকে দুই অসম বয়সী নারী বসে আছে। একজন গোপন ব্যবসায়ে হাত পাকানো অভিজ্ঞ নারী আর অন্যজন জগতের এইসব হীনতা তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে কোনো নন্দন কাননে সদ্য ফোটা ফুল-পবিত্রতায় স্নিগ্ধ, প্রসন্নতায় অনাবিল।
সদ্য শুরু হওয়া ঝিরিঝিরি বৃষ্টির বিপরীতে মাসির দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিল চারু। প্রথমে ভুল করে ভাবল, এ তার ফেলে আসা খালার মতো, আবার খেয়াল করে দেখল, না উনি অনেক সুন্দর। বিগত যৌবনা মাসির চোখে, চোখের কোণায়, নিজের অস্তিত্ব অনুভব করল সে।
বহু বহু দিন আগে, নয়নহারা কি তেঁতুলঝরা নদীর ধারে বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়েছেন মাসি। অল্প বয়স। বাদল আঁধারে বিরহী বধূর মতো চারদিকে অন্ধকার করে আছে। আর সেই অন্ধকারের আড়ালে লুকিয়ে ছিল মানবরূপী পশু। সেদিন সেই আঁধারে সর্বস্ব হারানো মাসি হয়তো কোনোদিন কাউকে কিছু বলেননি। নিজের বুকে একান্তে বয়ে চলেছেন সেই গোপন ব্যথা! নাকি কোনো চক্রের সাজানো ঘটনায় সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন সেদিন আর আজ, এতদিন পরে সেই মাসি সেই চক্রের একজন হয়ে চারুকে একই রকম ফাঁদে ফেলতে চাইছেন! এরকম কিছু চক্রের কথা চারু গ্রামে থাকতে শুনেছিল। তার অন্তরাত্মা ভয়ে অসহায় ঝড় কপোতীর মতো কাঁপতে থাকে।
কিন্তু মাসির মুখের দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত হয় সে। সেখানে বেদনার্ত শ্রাবণ বেলায় জীবনের বনে জোনাক পোকার নেভানেভি।
চারু ভাবল, এ মুখকে বিশ্বাস করা যায়, এ চোখকে বিশ্বাস করা যায়। তার জন্ম-জন্মান্তরের খালা নিজের ভাই মহব্বত চাচাকে দিয়ে যেনতেন কারও হাতে চারুকে তুলে দেননি, দিতে পারেন না। সে যে তাকে মায়ের চেয়েও আপন খালা ডেকেছে, ডেকে এতগুলো বছর সুখে-দুঃখে গুজরান করেছে! মাসির অভিজ্ঞ চোখে চারুর মন, মনের ভাষা প্রাইমারি স্কুলের বইয়ের মতো পড়া হয়ে যায়। হাসিমুখে বলেন তিনি-
-রত্নার কাছ থেকে জানলাম, তুমি সাজগোজ পছন্দ করো। ভাবছি ওর মতো তোমাকে বিউটিশিয়ান বানাব, আবার ভাবছি, তোমার সৌন্দর্যের খাতিরে ভাবছি, তুমি অনন্য সুন্দর একজন গাইয়ে, নাচিয়ে হতে পার। জগৎজোড়া হবে তোমার সুনাম, টাকা-পয়সা, খ্যাতি আর ভক্তি, তুমি যেমনটি চাও, সেভাবে তোমাকে প্রশিক্ষণ দেব। বলো, কী হতে চাও তুমি।
চারু কথা খুঁজে পায় না। বাইরে এতক্ষণ ঝিরিঝিরি চলা বৃষ্টি এখন ঝেপে এসেছে। দিগন্ত অন্ধকার করে হেমন্ত বিকালে শিশিরের শব্দের মতো বৃষ্টি নেমেছে। এমন নরম পরিবেশে জীবনের এই কঠিনতম সিদ্ধান্ত কীভাবে দেবে চারু, ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। মাসিই সাহায্য করল তাকে।
-আমাদের এখানে দেশের সেরা নাচ আর গানের প্রশিক্ষক আছে। তুমি চাইলে এখানে ঘরের মধ্যেই তোমার ট্রেনিং হবে।
চারু কী জানি কী ভেবে রাজি হয়ে গেল। আর দুই নারীর ওপরে, বহু ওপরে বসে যার অঙুলি হেলনে আকাশ পৃথিবী ঘুরছে, ঘুরছে মানুষের ভাগ্যচক্র, চারুর সিদ্ধান্ত শুনে তিনি মৃদু হাসলেন। বললেন, তুমি যদি জানতে তোমার ভাগ্য তোমাকে কোথায় নিয়ে যায়, কোথায় নিয়ে যাবে; যদি এতটুকু শুধু জানতে!
চারু জানল না, সে জীবনের কঠিনতম সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো একটি কাজ করে আপতত খুশি। খুশি মাসিও। তিনি বললেন-
ট্রেনিং, নাচ, গান পরে হবে। আগে চলো এ শ্রাবণ বেলায় আজকে বিশেষ মেজবানি রান্না করি তোমার জন্য। এটিও শিখে রাখ।
পল্লির রান্নাঘরে মাসি নিজের হাতে চারুকে মেজবানি রান্না শেখান।
-এটি চট্টগ্রামের বিখ্যাত খাবার। এখন সারা দেশে, এমনকি বিদেশেও তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে।
চারু কিছু বলে না। সে মেজবানির নাম শুনেছে, কিন্তু খাওয়া হয়ে ওঠেনি কোনোদিন। পরের ঘরে সে বড় হয়েছে। সেই পর অর্থাৎ খালাও ছিলেন গরিব। সেখানে মেজবানির মাংস খাওয়া তো বিলাসিতা। কিন্তু কিছুই বলে না সে।
বিশাল রান্নাঘরে দুপুরের রান্নার এলাহী আয়োজন চলছে। কয়েকজন মহিলা উনানে ভাতের কি তরকারির ডেকচি চড়িয়ে দিয়েছে। হরেক রকম মসলা বাতাসে মিশে সুগন্ধ বিলাচ্ছে চারদিকে। রান্নাঘরের এক কোনায় একটি বিড়াল আর একটি কুকুর নিশ্চুপ বসে আছে। বাইরে বৃষ্টির বিরাম নেই।
মাসি একটি সসপ্যানে মাংস আর মসলা জোগাড় করে নিয়ে এসেছেন। তিনি চারুকে ডেকের পাহারায় বসিয়ে কি একটি মসলার জন্য আবার ঘরের বাইরে গেলেন। চারু একেলা উৎকণ্ঠিত হতে যাচ্ছিল, এ সময় ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে মাসি ফিরে এলেন। তার চুল বেয়ে, চারুর দেখা সেই ছোটোবেলার মোহন দুটি চক্ষু বেয়ে শরতের শিশিরের মতো বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ছে।
-মেজবানির মূল কথা হলো মাংস। সব জায়গার মাংস চাই, রান, ঘাড়, বুক সব জায়গার। তার পর লাগে বিশেষ এক মসলা।
-সেইটিই আনতে গেলাম। এটি ছাড়া তুমি আর যাই দাও, মেজবানির মাংস অচল।
মাসি চারুকে এমনভাবে সে মসলা দেখালেন, যেন বা বহু বহুদিন গোপনে সংরক্ষিত কোনো প্রত্ন বস্তু ‘নিলামে উঠিতেছে’। মাসির হাসিটা সংকেতপূর্ণ। তার পর প্রায় ফিসফিসিয়ে বললেন, ভয় নেই আমি তোমাকে এই মসলার গোপন রেসিপি শিখিয়ে দেব।
কিন্তু যার উদ্দেশে এই গোপনের প্রকাশ, সেই চারুর মধ্যে মেজবানির গোপন রেসিপি নিয়ে কোনো উৎসাহের প্রকাশ দেখা গেল না। তার চোখ দুটি মেঘমেদুর শ্রাবণ দিনে বাইরের মলিন দেয়ালে বসে চুপচাপ ভিজে যাওয়া একটি করুণ কোকিলের দিকে করুণভাবে তাকিয়ে আছে।
মেজবানির মাংস ভালোই হলো। কিন্তু চারুর মধ্যে তা নিয়ে উৎসাহের কোনো আতিশয্য দেখা গেল না। মাসি বললেন, মেয়েটিকে শ্রাবণে পেয়েছে। তিনি বললেন, তার অতীত দিনে এরকম ঝরো ঝরো বেলায় তিনিও উদাস হয়ে যেতেন। পরবর্তী জীবনে সংগীত ও নৃত্যের ওস্তাদগণ এ অবস্থার নাম দিয়েছেন পূর্বরাগ।
চারু বলল, পূর্বরাগ কী?
মাসি হাসলেন। বললেন, একটি মেয়ে যখন একটি ছেলের প্রেমে পড়ে তখন তার প্রথম লক্ষণ হলো পূর্বরাগ।
চারু অবাক তাকিয়ে থাকল। মাসি বললেন, তোমার কথা বলছি না। একটি পূর্ণাঙ্গ ক্লাসিক নাচের এটি প্রথম অংশ। অপেক্ষা করো, কালকে যখন তোমার ছন্দ ও নৃত্যের ওস্তাদ আসবেন, তখন হাতেকলমে জানতে পারবে। তোমার চোখ-মুখ দেখে বহুদিন আগে বহু কষ্টে শেখা আমার সেই ভাব মনে পড়ে গেল, তাই বললাম, একটি মেয়ের লুক এত ন্যাচারাল হয় কীভাবে!
চারু কিছুই বুঝল না। তবে নতুন ওস্তাদের কাছে নতুন কী পরীক্ষায় পড়তে যাচ্ছে ভেবে অস্থির হয়ে উঠল।
সন্ধ্যা এবং পরের দুই দিন জলে-বৃষ্টিতে কেটে গেল। এমন তুমুল, সবকিছু ভাসিয়ে নেওয়া বৃষ্টি অনেকদিন দেখেনি চারু। চারুর ভালোই লাগল, অন্তত এ দুই দিন ছন্দ ও নৃত্যের ওস্তাদ বা ওস্তাদ নামধারী কারও হাতে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়নি। চারুর মনে হলো, যদি এরকম তুমুল বৃষ্টিতে দিন-মাস-বর্ষ- সারাটি জীবন অতিক্রান্ত হয়ে যেত কতই না ভালো হতো। কিন্তু তৃতীয় দিন সকালে যখন পল্লির মেয়েরা একসঙ্গে ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া’ নামের এক হিন্দি ছবিতে বুঁদ, মাসি ঘোষণা দিলেন, আজ বিকেলে চারুর ওস্তাদ এসে পৌঁছাবেন। অতএব, চারু যেন সাজগোজ সেরে যথাসময়ে নাচঘরে হাজির হয়।