পর্ব- ১১
আজ নিজের মতো করে নিজেই সাজল চারু। সেদিন রত্নার হাতের সজ্জা ছাড়া সারা জীবন শিউলি না কেয়া নামের এক কোম্পানির রোজ পাউডারই ছিল তার একমাত্র অঙ্গসজ্জা। আজ এত এত সাজের উপকরণ একসঙ্গে পেয়ে নিজের ভেতরটা কেমন করে উঠল। হঠাৎ করে রত্নার কথা মনে পড়ল। সাজগোজের পর সেদিনের মতো কিছু হবে না তো!
চারু যখন নাচঘরে পৌঁছাল ততক্ষণে বৃষ্টি একটু ধরে এসেছে। কিন্তু টিনের চালে, গাছের শাখায় বৃষ্টির ফোটাগুলো ভোরের শিশিরের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। একটি পানকৌড়ি উড়ে গেছে বহুক্ষণ; কিন্তু এখনো বাতাসে তার ডানার গন্ধ মিশে আছে। দূরে নয়নহারা নদীর ওপর শ্রাবণের মেঘগুলো জড়ো হচ্ছে। শেষ বিকেলে বৃষ্টি নামতে পারে।
নাচঘরে মাসি নতুন শিক্ষকের সঙ্গে দ্রুত চারুর পরিচয় করিয়ে দিলেন। তার পর চলে গেলেন। বিশাল নৃত্যকক্ষে নতুন এক শিক্ষকের সমীপে নবীন এ ছাত্রী লাজ এবং ভাবের এক যুগল সম্মিলনে বসে থাকল।
নবীন শিক্ষক নিজের নাম বললেন, অধ্যাপক জীবন বহমান। চারু ভুল শুনেছে মনে করে বলল-
-বহমান?
-হ্যাঁ, অনেকে ভুলবশত আমার নাম মনে করে রহমান। আসলে নাম আমার জীবন বহমান। কারণ জীবন কখনো রয়ে থাকে না, জীবন সবসময় বইতে থাকে। তাই জীবন কখনো রহমান হতে পারে না।
চারু মনে মনে বলল, আঁতেল। কিন্তু সৌম্যদর্শন মানুষটির একহারা গড়ন তার দৃষ্টি কেড়ে নিল। সেই দৃষ্টিতে দ্রুতই ধরা পড়ল, একসময়ের যুবক শরীরটি যত্ন অথবা চর্চার অভাবে প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হতে চলছে।
চারু এতক্ষণে বুঝতে পারল, তার সামনে বিরাজমান লোকটি তার একান্ত পরিচিত, টেলিভিশনের টকশোতে তিনি ন্যায় এবং অন্যায়, সমাজ ও সংস্কৃতির একজন বোদ্ধা আলোচক। চারুর সন্দিগ্ধ দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো সামনে বসা লোকটির চোখে-মুখে। ব্যাকব্রাশ করা কালো চুলে জুলফির কাছে পাক ধরেছে যেন বা স্বয়ং জুলফিকার আলী ভুট্টো বসে আছেন। কিন্তু চারুর দৃষ্টি কাড়ল প্রৌঢ় মুখটিতে বসানো দুটি চোখ। নিকষ কালো চোখের মণি; কিন্তু কী যেন এক অশুভ চিহ্ন উঁকি দিচ্ছে সেখানে। শীতল কিন্তু অশুভ। চারুর একবার মনে হলো এ দৃষ্টি সাপের, আবার মনে হলো সাপের তো চোখ নেই।
চারু এখন দেখল, সে চোখে হাসি ফুটেছে, বিস্মৃত হচ্ছে মুখের ওপর দিয়ে, কান পর্যন্ত, সেই মুখ অবশ্য পুরুষালি লাবণ্যে ভরা। পুরুষদের জন্য লাবণ্য শব্দটি মানায় কিনা চারু বুঝে উঠতে পারছে না।
একহারা দেহে কুঞ্চিত জিনসের ওপর পপলিন কাপড়ের শার্ট পরেছেন ভদ্রলোক। চারু কীভাবে বুঝবে, এ শার্টটি বিশ্ববিখ্যাত আরমানি কোম্পানির ‘উত কুতুর’ ঘরানার শার্ট। তবে চারু বুঝল, শার্টটি, পরনের প্যান্টটি দামি; তবে শার্ট আর প্যান্টের ভেতরের মানুষটা দামি নয়। পুরুষ মানুষের এ ভেতরের গুণ বা দোষ মেয়ে মাত্রই বুঝতে পারে। চারুও বোঝে। তবে কেমন করে কোনো কৌশলে তার মস্তিষ্ক তা টের পায়, চারু বুঝে উঠতে পারে না।
-তোমার নাম চারু।
চারু প্রথমে বুঝতে পারল না, এ কথাটি তাকে কে বলল। কারণ যার মুখ দিয়ে এ কথাটি বের হলো তিনি নিমেষহারা চোখে চারুর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। চারুর মনে হলো, কেউ কোনো কথা বলেনি। অথচ একটি কথা বলা হয়েছে।
চারু বিব্রতভাব লক্ষ্য করে জীবন বহমান এবার ঠোট নেড়ে স্পষ্ট করে বললেন-
-তোমার নাম চারু। চারু অর্থ কি জান?
-জি! চারু অর্থ সুন্দর।
-ভেরি গুড! আচ্ছা অবিদ্যা অর্থ কি জান?
- না। তবে মনে হয় যার বিদ্যা নেই সেই অবিদ্যা।
-না, কথাটা সেরকম নয়, তবে তুমি অবিদ্যা। অবিদ্যাদের একজন।
-মানে, আপনি বলতে চাচ্ছেন, আমার বিদ্যা নেই?
-নাহ। অবিদ্যার অর্থ অন্য এক জিনিস। তোমাকে আমি তা শেখাব; ধীরে ধীরে; আহিস্তা আহিস্তা।
চারু খেই হারিয়ে তাকিয়ে থাকল। আবার অন্য জিনিস শব্দ শুনে ভয় পেয়ে গেল। সেদিনের মতো ভয়াবহ কিছু হতে যাচ্ছে না তো! তা কীভাবে হবে! অবিদ্যা শব্দের সঙ্গে তো বিদ্যার উল্লেখ আছে। নিজে নিজেকে আশ্বস্ত করে চারু, কিন্তু মনের অস্বস্তি তার দূর হয় না।
এসময় ঝেপে বৃষ্টি আসে আবার। একেবারে আকাশ অন্ধকার করা বৃষ্টি। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট লাগছে গায়ে। বিজুলি চমকায় দিকে দিকে। আর সে বিজুলি ঝলকে মনে হয়, প্রাচীন কোনো অরণ্য-তলে দুই সোমত্ত নর-নারী মুখোমুখি বসে।
এমন সম্মোহন মন্ত্রমুগ্ধ সময়ে জীবন বহমান মুখ খুললেন। চারু কিছুই বুঝতে পারল না; কিন্তু স্বরের উত্থান-পতন তাকে অফুরন্ত বাদল বরিষণে অবসন্ন শ্রোতায় পরিণত করল-
-আকাশ অন্ধকার। অন্ধকার পৃথিবী, থেমে গেছে চারদিকের কোলাহল। এমন নিস্তব্ধ পরিবেশ আকুল করে দিগন্ত ছাপিয়া বৃষ্টি ‘নামিয়া আসিতেছে’। আমার মনে, কানে সেই বৃষ্টি, বৃষ্টির শব্দ ব্যতীত বাকি পৃথিবী বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
এবার চারুর বুঝতে ভুল হলো না, এ কথাগুলো তার সামনে বিরাজমান ছন্দ ও নৃত্যের অধ্যাপক জীবন বহমানের মুখ থেকে বের হয়েছে। কিন্তু এমন অভিভূত বাংলায় এইরকম বৃষ্টি বিস্নাত রাত্রির বর্ণনা দেওয়ার উদ্দেশ্য কী ঠাহর করতে পারল না সে। তাকে উদ্ধার করলেন স্বয়ং জীবন বহমান।
-বৃষ্টির এ বর্ণনা কেমন লাগল তোমার?
-চারু স্বয়ং স্বতঃস্ফূর্ততায় উচ্চারণ করল, দারুণ, অসাধারণ।
-এইবার যদি বলি; বলেই শুরু করলেন জীবন-
-রজনী শাঙন ঘন, ঘন দেয়া বরিষণ।
রিমি ঝিমি শব্দে বরিষে।
চারু কিছুই বলল না। দাঁড়াল নীরবে। তার চোখে জল।
জীবন বহমান বলল, হ্যাঁ। বৃষ্টির এই শেষ বর্ণনাটি মনে হয় বলা হলো, কিন্তু শেষ হলো না। এর নামই হলো রস। আর এই রস সৃষ্টি হয়েছে ছন্দোবদ্ধ বর্ণনার কারণে। এই ছন্দই কবিতা, এইটিই সংগীত, এইটিই তোমাকে শেখাব।
ছন্দ-তরঙ্গে দোলায়িত চারু অনেকক্ষণ কথা বলতে পারল না। বাইরে বৃষ্টির বিরাম নেই। ভেতরে একজন মৌনী ছন্দের জাদুকরের সামনে একজন কলাবতী নারীর ছন্দ দোলায় কেঁপে কেঁপে ওঠা।
চারু অতীত দিনের সমস্ত ব্যর্থতা ভুলে গেল। ভুলে গেল দু-দিন আগে তার ওপর হতে যাওয়া অনাচারের কাহিনি। তার মনে হলো, এই অফুরান আনন্দের উৎস-সন্ধানে বোধ করি, ওপরওয়ালা তাকে এখানে নিয়ে এসেছেন; নিয়ে এসে এই সৌম্য কান্তি তাপসের সম্মুখে মন্দিরে সমাধিমগ্ন ভক্তের মতো বসিয়ে দিয়েছেন।
তবে হঠাৎ তার মনে তাকে কুড়ে কুড়ে খাওয়া প্রশ্নটি নতুন করে জেগে ওঠল- এ লোকটিও কি আবার তার দিকে হাত বাড়াবে না তো? তার সমস্ত অন্তরাত্মা না না করে ওঠে। তার যুগল-নয়নে সামনে ভাসা মনীষীর মতো ধ্যানরত মানুষটির পবিত্র মূর্তি ডাকতে থাকে। না; এ মানুষটি সেরকম কিছুতেই না।
পরের দুই ঘণ্টা জনাব বহমান কখনো বাংলা অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ছন্দ নিয়ে, কখনো সংগীতের রাগ ও তাল নিয়ে একটানা বলে গেলেন। মাঝেমধ্যে কবিতা আর গানের অনুরণন বক্তৃতাটিকে উপভোগ্য করে তুলল। এর কিছু চারু বুঝতে পারল, অধিকাংশই তার মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল।
বিকেল। দুপুরের খাবারের পর নিদ্রাদেবী চারুর চোখে ঘুম নামান প্রতিদিন। কিন্তু আজ ছন্দ কি রাগের আকর্ষণ চারুকে সাজকক্ষে শিক্ষকের সামনে নীত করেছে। নতুন বিদ্যা শিক্ষার আনন্দে তার রক্তে এক অন্যরকম দোলা লেগেছে। আজ বিকেল কাটবে ছন্দ ও সংগীতের ব্যবহারিক প্রয়োগ অর্থাৎ নৃত্য শিক্ষণে।
হঠাৎ বাইরের পরিবেশে অন্যরকম হয়ে গেল। বৃষ্টির দাপটে অন্ধকার হয়ে গেছে চারদিক। বিজুলি চমকে থেকে থেকে আলোকিত হচ্ছে দুজনের ক্ষুদ্র নৃত্যগীতের আসর। এ সময় বৃষ্টিকাতর এক কোকিল এসে আশ্রয় নিল সাজকক্ষের কোণায়। তার চোখ মচকা ফুলের মতো লাল।
বাইরের এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পরিবেশের বিপরীতে ঘরের ভেতরে ঝড়ের পরের শান্তি। জনাব বহমান গানের প্রতিটি বস্তু কী দৃশ্য কীভাবে কপালে, ভ্রুতে চোখে, ঘাড়ে, বুকে আর হাত ও পায়ের সাহায্যে ফুটিয়ে তুলতে হয় দেখালেন। তিনি বললেন এর নাম মুদ্রা। তিনি কখনো পদ্ম-ফুল প্রস্ফুটনের দৃশ্য দুই যুক্ত কর উন্মোচিত করে ফুটিয়ে তুললেন। কখনো তুললেন সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের দৃশ্য, কখনো বা প্রিয়-সন্দর্শনে প্রিয়ার লাজুকতা।
চারু অখণ্ড মনোযোগে গোগ্রাসে গিলছিল ওস্তাদের প্রতিটি মুদ্রা। তাই ওস্তাদ যখন বললেন, এসো এইবার দেখি নিজে ট্রাই করো, চারু প্রথমে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। ধ্যানীর মৌনতায় এতক্ষণ ওস্তাদের নৃত্যকলা দেখছিল সে। এ যে তার জন্য শিক্ষা এবং তাকেই যে শেষ পর্যন্ত তা রপ্ত করতে হবে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল সে। তাই ওস্তাদের ডাকে ভয় পেয়ে গেল চারু। বলল, আমি পারব না।
-ভয় নেই, আমি তো আছি। প্রতিটি মুদ্রা আমি নিজে তোমাকে শেখাব, আসো।