কোথায় কেমন আছেন বলুনতো মশাই? এইযে এতগুলো হেমন্ত কেটে গেলো আপনাকে ছাড়া, এ শূন্যতা টের পান আপনি? জানেন, পৃথিবীতে কারো চলে যাওয়াতে জীবন থেমে থাকে না, প্রকৃতি থেমে থাকে না। আপনার সেই প্রিয় ফিনিক ফোটা জ্যোৎস্না আজও জেগে ওঠে বিশ্ব চরাচর জুড়ে। টিনের চালে ঝুম বৃষ্টি জীবনের গল্প লেখে। এ শহরে জ্যোৎস্না উৎসব হয়। রূপারা নীল শাড়ি পরে বৃষ্টিতে ভিজে; হিমুদের কাছ থেকে একগুচ্ছ বৃষ্টিভেজা কদমফুল পাবে বলে। কিছুই থেমে নেই বিশ্বাস করুন। মানতে পারছেন আপনি? কষ্ট হচ্ছে না? তবে কী জানেন, আপনার চলে যাওয়াতে হাজার হাজার বইপাগল মানুষের মনে যে শূন্যস্থানটা তৈরি হয়েছে, সে শূন্যস্থান সবাই তৈরি করতে পারে না। আপনি পেরেছেন, সত্যিই পেরেছেন!
আপনি নেই বলে আজও কেউ কেউ নির্জন দুপুরে দখিনের জানালায় চোখ রেখে নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মধ্যরাতে আপনার সৃষ্টিকর্ম বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। আপনার সমাধির পাশে রেখে আসে একগুচ্ছ লাল গোলাপ। নীল শাড়ি পরলেই কারো কারো তীব্র মন খারাপ হয়ে যায়। আপনার না থাকাতে কিছু থেমে না গেলেও এলোমেলো হয়ে গেছে অনেককিছুই। এইযে এভাবে তোলপাড় করে সব এলোমেলো করে দিয়ে চলে গেলেন, এত ক্ষমতা খুব কম মানুষেরই আছে!
আমি আপনার গুণমুগ্ধ কোনো পাঠক নই, কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই বলছি। গন্ডগ্রামে বেড়ে ওঠা আমি ছোটবেলায় সবার আগে আপনার বইয়ের সাথেই পরিচিত হয়েছিলাম। যেহেতু তখন আমার আর কারো বই পড়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি, আপনার বই'ই মুগ্ধ হয়ে পড়তাম, নাওয়া খাওয়া সব ভুলে পড়তাম, পাঠ্যবইয়ের নিচে লুকিয়ে পড়তাম, লেপের নিচে লাইট জ্বেলে পড়তাম, তবু পড়তাম। অনেক বই পড়েছি আপনার। পরে আমার জগৎটা একটু বড় হলো, আরও অনেক লেখকের লেখনীর সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেলাম। তখন থেকে আমার ভীষণ পছন্দের লেখক হয়ে উঠলো, রবীঠাকুর, শরৎবাবু, সমরেশ, সুনীল'দা, নিমাই এবং আরও কয়েকজন।
যে লেখাগুলো পড়লে কোথাও একটা হারিয়ে যাওয়া যায়, সে লেখাগুলো ভীষণ টানে আমাকে, যা আপনার লেখার মাঝে কখনোই পাইনি সেভাবে। যতোটা সরলভাবে লিখেন আপনি, ততোটাই অবলীলায় স্বীকার করছি, কোনো অস্বস্তি হচ্ছে না। তবে "আমার ছেলেবেলা" বইটা আমাকে কাঁদিয়েছে। আপনার লেখা এই একটামাত্র বই আমাকে কাঁদিয়েছে!
তবে কী জানেন, আপনার লেখা প্রতিটা গান আমার ভীষণ প্রিয়। একেকটা গান যেন সারাজীবন ধরে শুনে যাওয়া যায়, বুকের খুব গভীরে গেঁথে থাকে, চোখে তোলপাড় করা শ্রাবণ নামায়। আপনার লেখা নাটক, সিনেমাও বেশ। সব মিলিয়ে প্রিয়তার একটা জায়গায় রয়েই গেলেন আপনি। যেদিন পৃথিবী থেকে চলে গেলেন, সেদিন থেকে যেন আপনাকে আরও অনেক বেশি ভালোবেসে ফেললাম; বুকের ভেতরটা এত ফাঁকা লাগছিলো, এত কান্না পাচ্ছিলো। আপনার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে যখন সবার এত অভিযোগ, তখন রোজ পত্রিকায় আপনার জীবন সম্পর্কে জেনে আরো মায়ায় পড়ে গেলাম, কী নিবীড় সে মায়া আপনাকে বোঝাতে পারবো না!
গুলতেকিনের জন্য খারাপ লাগে জানেন। মানুষটা ভীষণভাবে ঠকে গেছে। তবু আপনাকে ভুল বুঝতে পারিনি কখনো। আপনাকে যে ব্যক্তিজীবন দিয়ে মাপা ঠিক হবে না, আপনি যে সংসার ধর্মের ঊর্ধ্বে। তবে আপনার জীবনের প্রতিটা কোণায় যে কী ভীষণ মায়া রেখে গেছেন, আপনি নিজেই হয়তো জানেন না। অগণিত মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার ক্ষমতা যে রাখে, তাকে ভালো না বেসে পারা যায় না সত্যিই।
আপনার প্রতিটা সন্তানের জন্য আমার কষ্ট হয়। আমরা কেবল একজন গুণী মানুষ হারিয়েছি, কিন্তু তারা চিরদিনের মতো তাদের মাথার ছাদটাই যে হারিয়ে ফেলেছে! আমাদের শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয় জানি, কিন্তু তাদের যেই অপূরনীয় ক্ষতি হয়ে গেলো, তার রেশ থেকে যাবে বাকিটা জীবন। তবু জীবন চলছে, সময় থামার জিনিস নয় তাই। ফিনিক ফোটা জ্যোৎস্নারা আপনাকে খুব মিস করে জানেন, বৃষ্টিরা যেন আপনার নামেই ঝরে পড়ে, আর আমরা আপনার না থাকাজুড়েই আপনাকে বাঁচিয়ে রাখি। ওপারে ভালো থাকা হয় যেন জ্যোৎস্নাপ্রিয় মানুষ।