প্রান্তরেখা
অরূপ তালুকদার
পথের বাঁকে এখনো দাঁড়িয়ে আছি, কোথায়
যাব সেটা না জেনে তুমিও চলে এলে ঠিক
গোধূলির প্রান্তরেখা ছুঁয়ে ছুঁয়ে এইখানে
দূর দিগন্ত থেকে তুলে আনা করতলের সেই
রঙিন বিকেল কোথায় যে হারিয়ে গেল
গাছের সবুজ পাতারা কী বার্তা দিয়েছিল
সেই চন্দনের বনে সব ভুলে গেছে?
মেঘমেয়ে
পৃথ্বীশ চক্রবর্ত্তী
প্রকৃতির রূপ বদলের সঙ্গে সঙ্গে মেঘমেয়েরও রং বদল
হয়েছে। শ্যামকালো হতে ধব ধবে শাদা। ভেলা নামে এখন সে
বেশ পরিচিত। নীল আকাশকে গভীর ভালোবাসায় ডুবিয়ে
রাখত গতকালও যে মেঘমেয়ে: আজ সে ঘুরে বেড়ায় এখানে
ওখানে বিচ্ছিন্নভাবে। কাঁদতে কাঁদতে আকাশের হয়তোবা
সবটুকু অশ্রুবিন্দু দূর পাহাড়ের চূঁড়ায় বরফ হয়ে জমে গেছে।
দিন-রাত আর অঝর ধারায় টাপুরটুপুর বৃষ্টিও করছে না
এখন। ‘থ্রি-স্পাইন স্টিক্যাল ব্যাক’র স্ত্রী মাছের মতোন উদর
দেখানোয় মত্ত সব পলিপূর্ণ উর্বর জমিন। হাওর-বাঁওড়ে নেই
শাপলার হাসি। কেয়া-কদম-চাঁপার ঘ্রাণ সেই কবেই মিলিয়ে
গেছে। তবে, ভোরের শিশির ভেজা দূর্বা ঘাসে শিউলির হাসি
আজ উল্লেখ করার মতো। আর সুরমার তীর ঘেঁষানো
কাশবনের মেঘশুভ্র কাশফুলের নরম ছোঁয়া আহা প্রেমিকার
সবুজ স্পর্শের সঙ্গে তুলনীয়। দিনের বেলায় সূর্যসনে মেঘ
মেয়ের দারুণ ভাব, কথোপকথন, বিচরণ রাতের বেলায় চাঁদ-
তারার মেলায়। মেঘ মেয়ের ওই লুকোচুরি খেলায় মজেই কেউ
কবি কেউ লেখক-গায়ক। কেউ সুখ করছে কেউ কেউ
আনন্দও করছে আর আমি খুব দুঃখ করছি। ছিলাম বর্ষা,
ভালোই ছিলাম; এখন তো শরৎ হতে হচ্ছে আমাকেও।
তপ্ত মনের গুপ্ত বাসনা
আজাদুল হক আজাদ
তুমি যদি না আস এই ভরা বসন্তে
শিমুল পলাশ কৃষ্ণচূড়ার বনে
জ্বালাব আজ দ্রোহের আগুন-
বাসন্তী রঙের উড়ন্ত সুখ করব লোপাট।
ঝরাপাতা ঝরে ঝরে বৈরাগী বৃক্ষের শাখায়
লটকানো ঘুড়ি উড়ছে উড়ুক
প্রজাপতি ফাঁদে পড়ছে পড়ুক।
তুমি যদি না আসো আজ এই বসন্তে
দখিনা বাতাসে ফুঁ দিয়ে
দামাল হাওয়া হয়ে ধুলোমাটি ওড়াব
নাগরিকজীবনে সুখের বসনে।
তুমি যদি না আসো আজ, ফাল্গুন হারাবার নেই ভয়-
তোমার আগমনী প্রতিশ্রুতিভঙ্গ আমার অস্থির পরাজয়।
তুমি যদি না আসো আজ মানবো না কোনো শাসন-বারণ
মানবো না কোনো অনুনয়ের সুড়সুড়ি।
দ্রোহের আগুনে চোখের কুঠুরিতে ফুটুক পলাশ
তপ্তমনের গুপ্ত বাসনা বেরিয়ে করুক উল্লাস।
সময়ের বেড়াজাল
নকুল শর্ম্মা
সূর্যাস্ত দেখিনি কতদিন
তেমন সুযোগ হয়ে ওঠে না আর
সময়ের বেড়াজালে আটকে গেছে
মুক্ত বলাকার উড়ে চলার সুখ।
পশ্চিমের খোলা প্রান্তরও নেই
ইট-পাথরে গড়ে উঠেছে ইমারত,
জন কোলাহল আর কারখানা।
বাতাসে কালো ধোঁয়ার বিষবাষ্প,
আসর বসে না আর পাখির কলতানে
হারিয়ে গেছে কী জানি কোন অজানায়।
ক্লান্ত শরীর খুঁজে ফেরে অতীত
ইচ্ছের সাতকাহন বুনে আনমনে
দিনান্তে প্রাণ ফেরে চারদেয়ালের ভিড়ে।
স্বপ্ন স্বাধীনতার
এস ডি সুব্রত
ডানার স্বাধীনতা নিয়ে
দিনশেষে পাখিও তো ফিরে আসে নীড়ে
অনাবিল শান্তির পরশ নেয়
স্বজনের কাছে প্রাণভরে
প্রশান্তির নিদ্রাশেষে জেগে ওঠে
শান্ত স্নিগ্ধ সোনালি ভোরে,
অথচ সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের
নেই কোনো অধিকার
সুন্দর ও স্বভাবিক বেঁচে থাকার,
কে তবে নিচ্ছে কেড়ে
ফিলিস্তিনের স্বপ্ন-স্বাধীনতা?
বিবেকবর্জিতের ভিড়ে
পৃথিবী আজ বুঝি নষ্টদের অধিকারে
নিরপরাধ নর-নারী ও শিশুর কান্না
আটকে গেছে নির্মমতার ধ্বংসস্তূপে।
ফিলিস্তিন
ভূঁইয়া বুলবুল
নিবেদন: বোমায় নিহত ফিলিস্তিনি কবি হেবা কামাল আবু নাদাকে
এগিয়ে যাওয়া ঘড়ির কাঁটা ক্রমাগত
পিছিয়ে আসতে আসতে
আমাদের নিয়ে এসেছে জঙ্গল যুগে
অচেনা বৃক্ষের আড়ালে শিকারি সময়
পত্রপল্লবে হিসহিস হিংস্রতা
ফুলের বদলে ডালে ডালে ফুটে থাকা
বিস্ফোরণ্মুখ বোমা, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রসংঘ,
বোমারও বুক থাকে! তোমাদের নেই?
সুনীল সুন্দরে এখন শুধু অশান্তির উৎসব!
আবু নাদা, ভুল সময়ে জন্ম নেওয়া প্রজাপতি
সময় অক্ষম শোধাতে তোমার ঋণ
পৃথিবীর আরেক নাম ফিলিস্তিন।
সাদা হাতিদের নৃত্য
ফেরদৌস জান্নাতুল
ক্রমাগত এগোচ্ছে জীবন
দ্বন্দ্বে ছন্দে ও আনন্দে
সকলের।
এই রেললাইন ধরে এগোলে পৌঁছানো যায় শীতের দেশে,
চটুল বিন্যস্ততার আবহ হতে আরও দূরে।
মানুষ স্বভাবতই খোঁজে সম্ভোগের মুখচ্ছবি
চিত্রিত অতীত, অনাগত ভবিষ্যৎ।
শরতের স্নিগ্ধতা আঁকা একটি চিত্রপট কুড়িয়ে পেয়েছিলাম একদিন-
সেখানে নীলের ভাঁজে ভাঁজে সাদা মেঘ,
মেঘের সঙ্গে বোঝাপড়ায় ব্যস্ত একদল বেনামি পাখি;
বেদনায় ডানা ঝাপটায়।
এই রেললাইন শেষ হতেই নতুন একটি শহর-
দিগন্তের মতো মুখচ্ছবি একে
এ শহরে সাদা হাতিরা নৃত্য করে
সৌন্দর্য ও সম্ভোগের নির্জন অন্ধকারে।
দ্বিপদীগুচ্ছ
চন্দনকৃষ্ণ পাল
১.
দিন ভালো হোক, হাসি ফিরুক চাইছি শুধু এই,
দিন শুরু হোক আবার তোমার দাঁতের ঝিলিকেই।
২.
কুয়াশার আয়োজনে দেখি তার মুখ
হয়তো বা ঝাপসাই, তবু এটা সুখ।
৩.
তার চোখে জলবিন্দু আমাকে উতলা করে খুব
ভাবি আর দুঃসহ স্মৃতির সাগরে দিই ডুব।
৪.
মধুময় হাসি তার মুছে গেছে কী কারণে জানি
বিষণ্ন প্রতিমা এক, মেঘে মেঘে ঢাকা মুখখানি।
৫.
সোনায় মোড়ানো বিকেলে তুমি তো নেই
স্মৃতির কুয়াশা রেখেছে যে আড়ালেই।
৬.
গাছ কেটে সব করছ সাবাড় ভরাট করছ জলাভূমি
দেখতে তোমায় মানুষ লাগে আসলে কি মানুষ তুমি?
৭.
মরুকরণ হচ্ছে এ দেশ ঝড়ঝঞ্ঝা বন্যা খরা
তোমার মতো অমানুষেই আজকে ভরা বসুন্ধরা।
৮.
গলছে বরফ বাড়ছে সাগর উপকূলে বাড়ছে ভীতি
মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েও কোথায় ভালোবাসা প্রীতি?
৯.
পরিবেশকে ধ্বংস করে আনছ মরণ কাছে ডেকে
খুব দেরি নেই প্রকৃতিটা দেবেই মৃত্যু তিলক এঁকে।
১০.
মানুষ ভেবে তাকিয়ে দেখি তুমি একটা যন্ত্র
টাকা দিন আর টাকা রাত্রি এটাই তোমার মন্ত্র
যা চিঠি তুই বাবার কাছে
কাজল নিশি
তুমি চলে গেছ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে
অথচ হৃদয়ের বদ্ধ কোটিরে আজও পাই তোমার তীব্র নির্যাস।
জানতে বড্ড ইচ্ছে করে
কেমন আছ ওই ছোট্ট মাটির ঘরে?
জানো বাবা, আজকাল কেউ আর বাজার থেকে তোমার মতো করে-
সব সিজনের ফল কিনে আনে না!
স্কুল ছুটি শেষে ঘরে এলে বলতে, তোর পছন্দের আম এনেছি
ব্যাস, ভাতের সঙ্গে আড়ি!
পাকা আমের রস মুখ গড়িয়ে পড়ত বুকের ওপর!
নিয়তির কী নির্মম পরিহাস
আজ আর মুখের সামনে আম ধরে কেউ বলে না খেয়ে নে!
বাবা, তোমার সঙ্গে মায়ের দেখা হলে আচ্ছা করে বকে দিও কেমন
জানো, আমাকে পৃথিবীর বুকে ফেলে রেখে মা একাই
ওই দূর আকাশের তারা হয়ে গেছে!
ভীষণ পচা মা, সঙ্গে নিয়ে যায়নি!
একটা কথা বলতে ভুলে গেছি!
তুমি যে গ্রামের মসজিদের জন্য বিশ শতক জমি লিখে দিয়েছিলে
সে মসজিদের অনেক উন্নয়ন হয়েছে।
জুম্মার নামাজের দিন হুজুর যখন মাইকে বয়ান করে
তোমার অমূল্য দানের স্মৃতি মনে পরে গর্বে বুক ভরে।
বৃষ্টি এলে
এম এ রহমান
বৃষ্টি এলে বিষণ্ন মেঘেরা ঝরে পড়ে
বাতাসে বাতাসে তাপ-অনুতাপ হিম হয়
মনের দেরাজ খুলে কারা যেন
ছিঁড়ে ফেলা কিছু অনুভূতি হাতে নেয়
সেলাই করতে থাকে
ফেলে আসা সময়কে, বেদনাকে
কারা যেন বেদনার ভেতর ঘুমিয়ে থাকা
তোমার ছায়াকে ডেকে আনে
তোমার মায়াকে বুনে বৃষ্টিভেজা শূন্য মাঠে
হৃদয়ে আমার; নাচঘরে টুপটাপ তুমি
বৃষ্টি এলে কারা যেন চিঠি লেখে
বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায়, নদীর কাছে
সমুদ্রের কাছে, ডাকবাক্স হেঁটে যায়...
কোনোদিন জবাব পায়নি
যদিও বরাবরে লিখেছিল, তুমি
তবে কি সুখেই আছ?
প্রিয়তমা আমার মৌসুমি!
ধারাপাত
সুশান্ত কুমার দে
নীলাকাশে রাশি রাশি ফুটল ঐ তারার হাসি
ঝলমল আলোয় ভাসি শুকতারা পাশাপাশি,
সাদা বক ভেসে ভেসে যায় কি মেঘের দেশে?
ঐ এল শারদ এল, নদীর বুকে নাইয়ে ভেসে।
শিউলি বনে সঙ্গোপণে মৌমাছিদের হুলুস্থুল
ভেজা ভেজা ঘাসে ঘাসে শিশিরের জুলজুল।
কাশবনে দোদুল মনে মৃদু মন্দ হাওয়ার সনে
চুপচাপ মাছরাঙাটি বসে ওই দীঘির কোণে।
পাখপাখালি বনে বনে মত্ত গানের জলসায়
নৌকা চলে পাল তোলে কোন সে ভিন গাঁয়?
সবুজ বনে জাগল বুঝি নব খুশির মঞ্জুরি
শারদ লক্ষ্মীর শস্য ভাণ্ডার কৃষকের অঞ্জলি।
শীতল হাওয়ায় মন মাতাল শারদীয় প্রভাত
আবির রঙে রাঙিয়ে শুরু দিনের ধারাপাত।
বাধার দেয়াল রক্তে ভেঙে
মো. আশতাব হোসেন
আসছে ধেয়ে রাজ পথে শোনা যাচ্ছে পদধ্বনি
মুষ্টিবদ্ধ হস্ত তুলে বুকের মাঝে আগুন জ্বেলে
ভাইয়ের লাশ কাঁধে করে অধিকারের দাবি নিয়ে
বাধার দেয়াল রক্তে ভেঙে আসছে সব দামাল ছেলে!
ভেঙে এবার জুলুমের হাত নিয়ে আসবে সুপ্রভাত
রোখার সাধ্য কার?
অন্যায়ের মহাশক্তি পুড়ে করবে ছারখার!
বেপরোয়া গতি তোদের এবার হবে খামুশ
ভীমরুল বাসায় ঢিল ছুড়লে পরিণাম হয় কি?
তোদের পশু কৃতি দেখে জানিস বন জঙ্গলের
সব পশু করছেরে ছিঃছিঃ!
তোদের কি নেই একটু শরম? রক্ত তোমার এতই গরম?
দয়ামায়া মানবতা কি খেয়েছিস সব বেচে?
এবার ঠেলা বুঝবি হাড় হয় কেমনে গুঁড়া
লাশের মিছিল আসছে ধেয়ে তাকিয়ে দেখ সামনে চেয়ে
রক্ত তেষ্টা মিটিয়ে দেবে আসছে জোয়ান বুড়া।