পর্ব-১৩
চারদিকে হাঁকডাকের অন্ত নেই। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে পুলিশের দল, কিশোর গ্যাঙের বখাটে শিশুর দল।
সূর্য ঢলেছে সেই কবে। মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ। বিকেলী সূর্যের তীর্যক আলো জনতার ওপর পুলিশের টর্চের মতো এসে পড়েছে।
এসময় বিরামপুর হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কিচিরমিচিরে মাঠের নৈঋত কোণটি ভরে উঠল। তারা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এদিক দিয়ে নেতা রিয়াজুল্লা মঞ্চে প্রবেশ করবেন।
-আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে; সকাল থেকে না খেয়ে আছি।
একজন সাদা শার্ট-কালো প্যান্ট পরা ছাত্র কাকে প্রশ্ন করল বোঝা গেল না। এ সময় শিক্ষার্থীদের দায়িত্বে থাকা একজন শিক্ষক বললেন, দুপুরে এক প্যাকেট বিরিয়ানি দেওয়া হবে, কিন্তু এই মন্দার বাজারে বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া হবে কিনা জানা গেল না।
শিক্ষক মহোদয় কার উদ্দেশে এ কথাটি বললেন তাও বোঝা গেল না। ছাত্রছাত্রীদের কল-কোলাহল, হকারদের হাঁকডাক আর থেকে থেকে মঞ্চ থেকে ভেসে আসা স্লেগানে ছাত্র-শিক্ষকদের কথাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর উত্থান-পতন নিয়ে বিমুখ কয়েকজন শিক্ষার্থী এর মধ্যে শিক্ষকের দৃষ্টি এড়িয়ে নিজেদের আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে-
-তুই বলেছিলি গতকাল শিরীষতলায় আসবি।
-আমি তো এসেছিলাম, স্যারকে দেখে চলে যেতে হয়েছে।
-কখন এসেছিলি?
-এই কীসের আলাপ হচ্ছে এখানে?
-কেমিস্ট্রি ক্লাস নিয়ে আলাপ স্যার। আচ্ছা ফুটন্ত ক্লোরিনের মধ্যে এসিটিক এসিড চালনা করলে কী হয়।
-আমি জানি না। দশটার দিকে এসেছিলাম।
-তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে। হাইড্রোজেনের পরমাণু গুলি একটির পর একটি প্রতিস্থাপিত হতে থাকে। রোল নম্বর বারো মেয়েটিকে দেখেছিস?
-তা আর দেখব না? এসিটিক এসিডের পরিবর্তে ফরমিক এসিড চালালেও কি একই বিক্রিয়া হবে?
-হবে। মাইরি বলছি। এমন মুখশ্রী জীবনে দেখিনি আর এমন হরিণের মতো চোখ দেখেছিস?
-দেখব না কেন? সে আমার, ওর দিকে নজর দিবি না বললাম, ফরমিক এসিডে তো কোনো হাইড্রোজেন প্রতিস্থাপন হয় না।
-এই, সবাই স্লোগান দাও,
-আমার ভাই, তোমার ভাই রিয়াজুল্লা ভাই, রিয়াজুল্লা ভাই। কচু আলু ঘণ্টা।
-এই কী বলছিস?
-স্যার সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে-বিদেশে গল্প বলছিলাম।
-ও আচ্ছা।
-রিয়াজুল্লা ভাইয়ের চরিত্র, ফুলের মতো পবিত্র।
-এই সব চুপ কর।
এসময় মঞ্চ থেকে ঘোষিত হতে থাকে। ভাইসব, এখন আপনাদের সামনে মূল্যবান বক্তব্য পেশ করবেন আমাদের আজকের সভার মধ্যমণি, যার জন্য আজ আমরা এতক্ষণ অপেক্ষা করে আসছি, যার শাসনের জন্য সমগ্র দেশ অপেক্ষায় দিন গুজার করছে, বাংলার মেহনতি মানুষের কণ্ঠস্বর আমার আপনার সমাজের জনতার নেতা, জননেতা জনাব রিয়াজুল্লা। মুহুর্মুহু করতালিতে মুখরিত হলো চারদিক। একজন মঞ্চ থেকে স্লোগান ধরলেন,
-রিয়াজুল্লা তুমি এগিয়ে যাও। সমবেত জনতার কণ্ঠে পাল্টা স্লোগান;
-আমরা আছি তোমার পাশে।
নেতা মঞ্চে এসে জনতার দিকে হাত তুললেন প্রথমে। তার পর শুরু করলেন-
ভাইয়েরা আমার, সংগ্রামী নেতৃবৃন্দ; বাংলার আকাশ আজ আষাঢ়ের মেঘে আচ্ছন্ন। বাংলার জমিনে নুহের প্লাবনের পদধ্বনি। দিকে দিকে মায়ের কান্না, পিতার হাহাকার আর ভাইবোনের চিৎকার। আকাশে উড়ছে শকুনী। জাতির পতাকা আজ খামছে ধরেছে পুরনো শকুন। বাজারে জ্বলছে আগুন, গরিবের ঘরে জ্বলছে না উনুন। দেশের স্বাধীনতার দিকে নেকড়ে দৃষ্টি পড়েছে বিদেশি শক্তির।
তাই আজ সময় হয়েছে আমাদের জেগে ওঠার, রুখে দাঁড়ানোর। আজ যদি আমরা এই অনাচারের বীরুদ্ধে মুষ্টিবদ্ধ না হই, যদি এই অত্যাচার এখনো নীরবে সহ্য করে যাই, সেদিন দূরে নয়, যেদিন আমাদের ব্যক্তিগত ও রাষ্টীয় স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়বে। বিপন্ন হবে আমাদের ধর্ম; ওপরওয়ালার জমিনে তাকে উপাসনা করার অধিকার। ভাইয়েরা আমার, আজ আমাদের দরকার সে ঘোষণাকারীর যার কণ্ঠ শুনে লাখো জনতা যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করবে। ভাইয়েরা আমার যদি আমার মধ্যে আপনারা সেই পৌরুষের অস্তিত্ব অনুভব করেন, যদি...
যদি কী? অনেক অনেকক্ষণ যদি বলে থেমে রইলেন সংগ্রামী জননেতা। তার অঙুলি ঊর্ধ্বে আর দৃষ্টি সম্মুখে প্রসারিত। সেদিকে দিগন্ত-প্লাবী লাখো জনতা ‘যদি’র পরের অংশটুকু শোনার জন্য ফানা ফিল্লার চতুর্থ স্তরে যাওয়া ফকিরের মতো সমাধি মুদ্রায় স্তম্ভিত হয়ে গেছে।
স্তম্ভিত হয়ে গেছেন নেতাও। কথা নেই, বক্তব্য নেই, নিঃশ্বাস পর্যন্ত নেই। ওপরে মেঘভাঙা শ্রাবণ সূর্য রৌদ্রময়ী। নিস্তব্ধতার কানে কানে বাতাস শিস দিয়ে গেল, উত্তর দিল না কেউ।
মঞ্চে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ কি করণীয় ঠাহর করতে পারলেন না। অনেকে নেতার মুখের দিকে আবার কেউ কেউ তাঁর সামনে প্রলম্বিত আঙুল অনুসরণ করে মাঠ বরাবর দৃষ্টি প্রসারণ করলেন। তাদের দৃষ্টি নিস্তব্ধ জনতার দেয়ালে প্রতিহত হয়ে ফিরে এল, বারবার। বক্তৃতার তুঙ্গে উঠে হঠাৎ এভাবে তাবদা খেয়ে যাওয়ার মতো নেতা রিয়াজুল্লাহ নন। কিন্তু তাই হলো।
স্তব্ধ জনতা, নির্বাক পৃথিবী। সবচেয়ে আশ্চর্য হলো আলিমুল্লা- নেতার ডানহাত হিসেবে ইতোমধ্যেই যে একযুগ পূর্তি সম্পন্ন করেছে। তার মুখ দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণ হলো, কী হয়েছে নেতার?
কেউ কিছু বলছে না; ঝড়ের পরের শান্তি চারদিকে। এসময় পার্টির বর্ষীয়ান সভাপতি এগিয়ে এলেন, এগিয়ে এলেন মাইকের সামনে-
ভাইয়েরা আমার, আপনারা জানেন, কয়েক সপ্তাহজুড়ে নির্বাচনি প্রচারণা চলছে আমাদের পার্টির। আর এ প্রচারণার মধ্যমণি আমাদের সংগ্রামী সাধারণ সম্পাদক জননেতা রিয়াজুল্লা। কিন্তু তিনিও তো মানুষ। নিজের শরীরের প্রতি খেয়াল না করে দেশের জন্য, আপনাদের জন্য তিনি দিনরাত খেটে গেছেন। তাই শরীরের একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। আপনারা ধৈর্য ধরুণ। অল্পক্ষণেই তিনি বক্তৃতার জন্য ফিরে আসবেন, এখন চলবে আমাদের পার্টির সংগীত-
বহুদূর হেঁটে এসে ঘরের দাওয়ায় বসে
ভাবছি ঘুমানো যাক এইবার,
তুমি ডাকিলে হঠাৎ, মিছিলে ওঠাও হাত
এখন তো সময় নহে ঘুমাবার।
সাগরে মিলন আশে বহুপথ পাড়ি শেষে
নদী যবে সাগরে মিলে-
নিঠুর সাগর বলে মেঘ হয়ে যাও চলে-
ভেজাও তৃষিত ঐ মরু কান্তার।
জীবনচক্র শেষে ফুল ফোটে অবশেষে
ভাবে, লোকে দেখুক আমায়-
ফুলের বৃক্ষ শুধায় ফল হয়ে ঝরো ভাই-
বীজ হয়ে বাঁচাও বংশ তোমার।
প্রাণ ছেড়ে দেয় হাল, মন বলে তোলো
পাল যতক্ষণ বাঁচো বলো: আলি, আলি;
গাও সারি ভাটিয়ালি হাতে হাতে দাও তালি,
দিতে হবে পাড়ি এই জীবন পারাবার।
মঞ্চব্যাপী সংগীত চললেও চারদিকে খুনসুটির অন্ত নেই। কী হয়েছে নেতার? তিনি কি অসুস্থ? কেউ কেউ বলল, সরকারি দল শুনেছি বিরোধী নেতাদের ওপর বিষ প্রয়োগ করছে। সেরকম কিছু হয়নি তো!
এক কোণায় লাল-নীল দলের কর্মীরা তৎপর হলো সবার আগে। রিয়াজুল্লার জবান বন্ধ হওয়ার ঘটনাটি নেতৃবৃন্দকে এখনি জানানো দরকার।
অকস্মাৎ ছন্দপতনে এতক্ষণের নিস্তব্ধ জনতা আবার জেগে উঠেছে।
-লাল নীল পার্টির কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে।
-ডোরাকাটা পার্টি নিজেরাই সরকারের ঘাড়ে চাপানোর জন্য এ নাটক সাজাতে পারে।
-পার্টিতে তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা এ কাজে জড়িত।
দূরের মসজিদ থেকে আসরের আজান ভেসে আসছে। বহুদূরে এক বিরহী ঘুঘু ডেকে চলেছে। সামনের জটলা একটু ফাঁকা হতে চলেছে। কিন্তু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র অনড় বসে আছে। তারা নেতার বক্তৃতা শুনতে আসেনি, তারা এসেছে মিটিংয়ে আসা মেয়েদের দেখতে। এ ছোকরার দল জানে মিটিংয়ের পর যখন মিছিল বের হয় তখন সামনের সারিতে থাকে সুন্দরীদের দল। কিন্তু শহরের বাছা বাছা সুন্দরীদের নেতারা কেমন করে জড়ো করেন- এ তাদের কাছে এক বিরাট জিজ্ঞাসা। তাদের কলেজ কী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন মেয়ে কেন দেখা যায় না- এ জিজ্ঞাসাও তাদের কুড়ে কুড়ে খায়। তাই এ ধরনের মিটিংয়ে বক্তাকৌশল শেখার টানে না হোক, সুন্দরের আকর্ষণে ভিড় জমায় ছাত্রদের একটি অংশ।
চলবে...