একটি সুগন্ধি ফুলের ঘ্রাণ
সুশান্ত কুমার দে
বেলকনির জানালার গ্লাসটি সরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে শিউলি। খুঁজে পেল বহির্জগতের রূপলাবণ্যে ভরা অফুরন্ত সৌন্দর্যের ভাণ্ডার, তার মাঝেই প্রস্ফূটিত এক টুকরো ভালোবাসার উজ্জ্বল ঝকঝকে হীরের টুকরো।
হাজার মানুষের ভিড়ে শিউলির দৃষ্টিটা নিবন্ধিত হয় মিন্টুর দিকে।
হ্যাঁ, মিন্টু এসেছে, প্রতিদিনের মতো গাড়িটা থামিয়ে পাশের দোকান থেকে একটা ঠাণ্ডা কিনে ঢকঢক করে গিলতে লাগল।
না, ওটা নেহাত পানীয় পানের কিংবা খাদ্যের হজমশক্তি বাড়াতে নয়, কিছুটা সময় পার করে শুধু শিউলির রূপলাবণ্য সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। শিউলি ওকে কিছুটা খোলামেলা দেখার সুযোগ করে দেয়। বুকের ওড়নাটা টেবিলের ওপর রেখে দেয়। একটা পাতলা টাইট নীল রঙের কামিজ পরে কপালে একটা রঙিন টিপ দিয়ে বেলকনির জানালার কাচ সরিয়ে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
মিন্টুকে যতটা সম্ভব খুশি করার চেষ্টা করে। কেননা শিউলি মিন্টুকে অত্যন্ত ভালোবাসে।
মিন্টু শিউলির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তার সারা শরীর যেন এক মুহূর্তে প্রখর দৃষ্টিতে আটকে যায়।
শিউলিও কিছুটা আবেগের বশে লাজলজ্জা ভুলে দুজনায় মধ্যে চোখাচোখির ভাব বিনিময় করে।
একটু মিষ্টি হেসে কয়েক মুহূর্তের জন্য দুজনার দুকূলে দাঁড়িয়ে কিছুটা প্রেমসাগরে হাবুডুবু খাওয়ার প্রাণবন্ত চেষ্টা।
মিন্টুর অফিসের সময় হয়ে গেছে, মাত্র মিনিট পাঁচেক সময় হাতে আছে। হাতটা নেড়ে টা টা বাই বাই বলে বিদায় নেয়। শিউলিও একটু হাত নেড়ে মিষ্টি হেসে মিন্টুকে বিদায় জানায়।
এভাবে আর কতদিন চলবে, অন্তরের যে দাবানল ফুঁসে উঠেছে তা বোধহয় স্বয়ং বিধাতাও থামাতে পারে না।
অতি মেধাবী শিউলির ক্রমশই পড়াশোনার অবনতি হচ্ছে। পড়াশোনার ক্ষতি হওয়ার ভয়ে তার মা তাকে একটা মোবাইল ফোন পর্যন্ত দেয়নি।
মা রমনা অত্যন্ত কঠিন শাসনের মধ্যেই মেয়েটিকে রাখেন। ঘরের বাইরে একা একা মেয়েকে কোথাও যেতে দেন না।
সব সময় কড়া নজরেই রাখেন, বাবা নিবারণ বাইরে থাকেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাড়ি ফেরেন। সেই কারণেই মেয়েটার দেখভাল মাকেই কড়া নজরে রাখতে হয়।
যৌবনের প্রথম যে কুঁড়িটি প্রস্ফূটিত হয় সেই কুঁড়ির অন্তরে লুকায়িত থাকে অজস্র ভালোবাসার ঢেউ।
একটা নতুন অনুভূতির রঙিন স্বপ্ন। যেটা শিউলির অন্তরজুড়ে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
চন্দ্রের বিচ্ছুরণ যেন সারা অঙ্গে সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে মিতালি করে, বক্ষযুগল স্ফীত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা মনমাতানো প্রাচীরের শীর্ষ চূড়ায়।
ইতোমধ্যে শিউলি ও মিন্টুর মধ্যে যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা অনেকের দৃষ্টির গোচরে এসেছে।
রমনার কানে কে বা কারা ফিসফিস করে বলেও দিয়েছে।
রমনা আদৌ বিশ্বাস করতে পারেন না, শিউলির নামে কেউ আজেবাজে কোনো কথা বলুক, তিনি এটা আদৌ মেনে নিতে চান না।
তাছাড়া শিউলির রূপলাবণ্য নিয়ে মা রমনা, গর্ব বোধ করেন। আদরের মেয়েটিকে তো আর যেনতেন ঘরে সম্প্রদান করবেন না।
একটা উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরি পাওয়া ছেলের হাতে শিউলিকে তুলে দিতে চান। অথচ শিউলি একটা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষকের পদে সদ্য চাকরি পাওয়া স্বল্প বেতনের মিন্টুকে বিয়ে করতে চায়।
শিউলির সম্প্রতি চঞ্চলতা ও পড়াশোনার প্রতি অনাগ্রহ বেশ লক্ষণীয়।
ইতোমধ্যেই কলেজের অধ্যক্ষ নূর মোহাম্মদ জানিয়েছেন, টেস্ট পরীক্ষায় শিউলির রেজাল্ট খুবই খারাপ হয়েছে।
অভিভাবক হিসেবে রমনা শিউলিকে সঠিকভাবে পড়াশোনার ব্যাপারে একটু সজাগ থাকতে বললেন।
বিষয়টি নিয়ে রমনা শুক্রবার রাতে স্বামী নিবারণের সঙ্গে সবকিছু খুলে বললেন।
নিবারণ বললেন, মানসম্মান থাকতে থাকতে মেয়েটিকে সুপাত্রের হাতে তুলে দিতে হবে। কেননা, যে বাড়িতে একটা ভালো মেয়ে থাকে, সেই বাড়ির চারপাশের বাতাসে যেন একটা সুগন্ধি ফুলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে।
সেই সুযোগে মৌমাছিদের আনাগোনা বেড়ে যায়।
ওদিকে মিন্টু ও শিউলির ঘটনা বহুদূর পর্যন্ত গড়িয়েছে।
শিউলি তার বাবা, মায়ের পরিকল্পনাগুলো বুঝতে পারল।
আগামীকাল কলেজ যাওয়ার সময় বিষয়টি নিয়ে মিন্টুকে সবিস্তারে জানাতে হবে। প্রয়োজনে পালিয়ে বিয়েটা করাই শ্রেয়।
চারদিক নিস্তব্ধতা ভেঙে শিউলি খুব ভোরে মিন্টুদের বাড়ি হাজির হলো।
মধুলোভী মৌমাছিরা ফ্যালফ্যাল করে শিউলির দিকে তাকিয়ে আছে। এমন সুগন্ধযুক্ত ফুলের নির্যাস পেতে কে না চায়। মিন্টু খবরটি পেয়ে শিউলির দিকে এগিয়ে এল।
শিউলি বলল, মিন্টু দা এখুনি একটা উপায় কর। ততক্ষণে শিউলির মা, বাবাসহ প্রতিবেশীর বেশ কিছু লোক এসে হাজির হলো।
রমনা, শিউলির সাহসিকতার কাছে পরাজয় বরণ করল। দুই পক্ষের লোকজন একত্রে জড়ো হলো। সবার মুখে মুখে শিউলি ও মিন্টুর কুকীর্তিটা ফাঁস হয়ে গেল।
রমনা শিউলিকে বাড়ি ফিরে আসতে অনুরোধ করল; শিউলি মায়ের সব অনুরোধ নাকচ করে দিয়ে মিন্টুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। এ দৃশ্য দেখে রমনার দুচোখ বেয়ে দরদর করে জল গড়িয়ে পড়ল।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে উভয় পক্ষের মধ্যে একটা সমাধান চাই।
সবশেষে অতি শিগগিরই শিউলি ও মিন্টুর বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। হঠাৎ করে মিন্টুর ছোট ভাই পলাশ দৌড়াতে দৌড়াতে একখানা পঞ্জিকা নিয়ে রমনার হাতে ধরিয়ে দিল। মুহূর্তেই চারপাশের নিস্তব্ধতা ভেঙে উঠোন ভর্তি মানুষ ফ্যালফ্যাল করে রমনার দিকে তাকিয়ে রইল।