ঢাকা ৩০ মাঘ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
English
বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৩০ মাঘ ১৪৩১

ঈশ্বরদীতে দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবের উদ্বোধন

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:২৮ পিএম
ঈশ্বরদীতে দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবের উদ্বোধন
জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে সাহিত্য উৎসবের উদ্বোধন করা হয়। ছবি : খবরের কাগজ

পাবনার ঈশ্বরদীতে নোঙর সাহিত্যগোষ্ঠির আয়োজনে দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবের উদ্বোধন করা হয়েছে।
 
চেতনায় কবিতা, মননে কবিতা, চল বহুদুর’ শ্লোগানে দেশ-বিদেশীর কবি সাহিত্যিকদের অংশগ্রহণে এই উৎসব শুরু হয়েছে। 

শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) সকাল ১০টায় বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইন্সটিটিউট চত্বরে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্যে দিয়ে উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধন করেন নেপালী দান প্রাসাদ সুবেদি। 

উদ্বোধন শেষে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয়। বাংলাদেশ, ভারত, নেপালসহ দেশ-বিদেশের দুই শতাধিক কবি সাহিত্যিক শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন।

এরপর অনুষ্ঠান মঞ্চে দেশ-বিদেশি কবি সাহিত্যিক ও অতিথিদের উত্তরীয় পড়িয়ে সম্মাননা প্রদান করা হয়। 

এ পর্বে আলোচনা সভা শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন নোঙর সাহিত্যগোষ্ঠীর মুখ্য সমন্বয়ক ও সাহিত্য উৎসবের উদ্যোক্তা সাহিত্যিক ও সহকারী অধ্যাপক হাসানুজ্জামান। 

সভাপতিত্ব করেন শিক্ষাবিদ প্রফেসর ও কবি আখতার হোসেন।

বক্তব্য রাখেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. শেখ রাজিবুল ইসলাম, রাজশাহী কলেজের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. শিখা সরকার, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রফেসর ড. মীর হুমায়ন কবির, ঈশ্বরদী প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এস এম ফজলুর রহমান, ভারতের কবি মানিক পন্ডিত, নেপালের কবি শান্তা দাহল, নেপাল সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর টিকরাম সুদেসী প্রমুখ। 

এ সময় কবি রাজকুমারী কুনহার, বিমালা ক্যানাল, কিশোরী এ্যামাজান, ইন্দ্র বাহাদুর চৌধুরী, ঈশ্বরদী প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মোস্তাক আহমেদ কিরণসহ বিশিষ্টজনরা উপস্থিত ছিলেন।

যৌথভাবে অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন নোঙর সদস্য শাম্মী আক্তার স্মৃতি ও আতাউর রহমান বাবলু।

দুই দিনের সাহিত্য উৎসবে সেমিনার, কবিতা পাঠ, আড্ডাবিষয়ক অনুষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়া অতিথিদের সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করা হবে বলে আয়োজক সুত্রে জানা গেছে।

জাহাঙ্গীর হোসেন/জোবাইদা/

সাহিত্যসভার মুক্ত কবিতা

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৫৩ পিএম
আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৫৪ পিএম
সাহিত্যসভার মুক্ত কবিতা
অলংকরণ: মেহেদী হাসান

 

ফুলের গালে টোল
মোরশেদুল ইসলাম

এক শীতের মাসের গল্প
হৃদয়ের উঠোনজুড়ে
জেঁকে বসে বরফ সময়
দ্রাক্ষালতার মতো হৃদয়
স্রেফ আশাকে পেঁচিয়ে
চেয়ে ছিল ওপরের দিকে
কত ফুল দিয়ে গেছে
হেমন্ত মোহিনী
মাটি হিম হওয়ার খানিক আগে
তবু মন কার যেন প্রতীক্ষায়
তীব্র, তীব্রতর শীত শেষ
বসন্তের শুরু হয় হয় ভাব
ফুল আসলো অবশেষে
উজ্জ্বল হলুদ রঙে হেসে
নাগরেরা ভালোবেসে নাম দেয়
জুঁই
রৌদ্রোজ্জ্বল হৃদয়জুড়ে
ধূসর এক সময়
আলিয়া ভাটের মতো টোল পড়ে
জুঁইয়ের দুর্দান্ত গালে!

সাহিত্যসভার মুক্ত কবিতা

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:০৫ এএম
সাহিত্যসভার মুক্ত কবিতা
অলংকরণ: মেহেদী হাসান

 

অন্ধ মনের চোখ
মো.আশতাব হোসেন 

ক্ষতের উপর ক্ষত করলে ক্ষত হয় বিক্ষত
তার পরে করলে আঘাত নীলকণা হয় বিস্ফোরিত। 
একই কথা বারবার বললে লাগতে পারে তিতা
যে পাত্রে ধারণ হয়না সে পাত্র নয় কি ফুটা? 

বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে না পাইলে তার জবাব
তার ভিতরে কি আছে বিবেক জীবন্ত সজাগ? 
বিবেক বিহীনা বালির পুতুল ধরতেই ভেঙ্গে যায়
 করতে অপারগ নিজের সুবিচার। 

নিজের ভুল ধরতে পারেনা অন্ধ মনের চোখ
ভুলগুলি ভুল হিসাবে থাকে ভুলের গুদাম,
অন্যের ভুল ধরতে যাওয়া  সাধ্য নেই তার 
শুদ্ধি বুদ্ধি গজায় না প্রাণে ভুলেরই হয় পাহাড়। 

তারাই পারে ক্ষতের উপর আরো ক্ষত করতে
তাদের থেকে দূরসীমানায় বসত উত্তম স্থান, 
শুনতে মানা তাদের মুখের মিষ্টি সুরের গান 
তাদের মতো  মমতাহীনার মোম পরশে
বিবেকবিহীন পুতুলের হয় উত্থান।

সাহিত্যসভার মুক্ত কবিতা

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:০৩ এএম
আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:০৩ এএম
সাহিত্যসভার মুক্ত কবিতা
অলংকরণ: মেহেদী হাসান

 

বনসাই হাসি
এম এ রহমান

দিন দিন গায়ে গতরে যখন বড় হচ্ছি
ছোট হয়, ধ্রুপদী সে-
সাদা পায়জামা,পাঞ্জাবি ও জুতো জোড়া
সামাজিক চোখ থেকে বের হয়
একদল তীরন্দাজ 
তখন অগত্যা
নিজেকেই ছেঁটে ছোট করি
পায়জামা, পাঞ্জাবি,জুতোর মাপে

সভ্যতার পিচঢালা মুখস্ত রাস্তার দিকে
দেয়ালে দেয়ালে পোড়া মাটি ছুঁয়ে 
লোকারণ্যে একা একা হেঁটে হেঁটে 
সভ্যতাকে প্রশ্ন করি-
তুমি আসলেই কতটুকু সভ্য?

এই যে তোমার ঠোঁটে বনসাই হাসি নিয়ে
চোখের ভেতর কর্পোরেট রেল
মস্তিষ্কের বানিজ্যিক স্টেশনে স্টেশনে থামে
পুঁজিবাদী ফসলের গায়ে তোমারই নাম নিয়ে,
তুমি কি হৃদয়পুর চিনো?
তোমাদের রাজপথ থেকে দূরে,বহুদূরে
সোঁদাগন্ধ বিছানো মাটির মেঠোপথ,
অথবা পূর্বের পায়েদের মানচিত্রে
সেই সবুজ পৃথিবী, চিনো?

সাহিত্যসভার ছোটগল্প

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:২৩ এএম
আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:২৪ এএম
সাহিত্যসভার ছোটগল্প
অলংকরণ: মেহেদী হাসান

 

এক ছিল রাজা 
মহিবুল আলম 

উনিশ শ সাতানব্বই সালের কথা। জানুয়ারির আট তারিখ আমি নিউজিল্যান্ডের মাটিতে পা রাখি। আমার একমাত্র মামা তখন মাউন্টমাঙ্গানুই শহরে থাকতেন। তাই অকল্যান্ড এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে মামার এক বন্ধুর বাসায় দুপুরের খাবার খেয়ে সরাসরি মাউন্টমাঙ্গানুই শহরে চলে আসি। কিন্তু এক সপ্তাহ পর কী এক কাজে অকল্যান্ড আসতে হয়। অকল্যান্ডের ওয়েস্টান স্প্রিংয়ের মর্নিং সাইডের এক বাসায় উঠি।


আমি যে বাসায় উঠি, সেটা ছিল ব্যাচেলরদের বাসা। ওরা দুজন থাকত। ওদের বাসার কাছাকাছি ওদের পরিচিত এক পরিবার বসবাস করত। স্বামী-স্ত্রী ও চার বছরের ছোট্ট একটি মেয়ে নিয়ে পরিবারটি। স্বামী-স্ত্রী দুজনই বাংলাদেশে ডাক্তার ছিলেন। কিন্তু নিউজিল্যান্ডে রেজিস্টার্ড ডাক্তার হওয়ার জন্য তখনো তিন পার্ট পরীক্ষা পাস করে শেষ করতে পারেননি বলে স্বামী-স্ত্রী দুজন অন্য জব করতেন। এক অর্থে সেই জবকে অড-জবও বলা যায়। স্বামী করতেন ক্যাসিনোতে গ্যাম্বলারদের তাস বিলির কাজ। আর স্ত্রী একটা কাপড়ের দোকানে সেলস পারসন। 
আসলে গল্পটা সেই দম্পতিকে নিয়ে নয়, তাদের চার বছরের কন্যাসন্তানকে নিয়ে। ছাব্বিশ বছর আগের গল্প তো, তাই সেই কন্যাসন্তানটির নাম এই মুহূর্তে মনে আসছে না। যাক, যেটা বলছিলাম, একদিন এক ব্যাচেলরের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে সেই দম্পতির বাসায় যাই। ছোট্ট সেই মিষ্টি মেয়েটাকে দেখে আমি কাছে ডাকি। আদর করে বাংলায় জিজ্ঞেস করি, তুমি কেমন আছ? 


মেয়েটা বাংলাটা ঠিক বুঝতে পারে না। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। 
আমার সঙ্গে যে ব্যাচেলর এসেছিল, সে বলল, মেয়েটি বাংলা বোঝে না। বলতেও পারে না। 
আমি খানিকটা অবাক হই। ভাবি, বাবা-মা বাংলাদেশি, অথচ মেয়েটা বাংলা বলতে বা বুঝতে পারে না? 
মেয়েটার বাবা তখন কর্মস্থলে ছিল। মেয়েটার মা বাসায়। তিনি লাউঞ্জে আমাদের জন্য চা নিয়ে আসতেই আমি ভূমিকা ছাড়াই জিজ্ঞেস করি, ভাবী, আপনার মেয়ে তো বাংলা বলতে বা বুঝতে পারে না। এটা কীভাবে হলো? 
আমার প্রশ্ন শুনে ভদ্রমহিলা প্রথমে খানিকটা অবাক হন। পরক্ষণে বেশ বিরক্ত হয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করেন, তাতে কী?
একে তো বাংলাদেশ থেকে সবে এসেছি। মনে ও প্রাণে দেশপ্রেম টগবগ করছে। তাই আমি জোর দিয়ে বলি, তাতে কী মানে? ওমা, আপনারা বাংলাদেশি। বাংলা আমাদের ভাষা। সেই ভাষাটা মেয়েকে শেখাবেন না?  
ভদ্রমহিলা আমার কথা শুনে চেহারা কালো করে ফেলেন। শালীনতা ধরে রেখেই কঠিন গলায় বলেন, এমন সস্তা আবেগকে প্রশ্রয় যদি দেবেন, তাহলে নিউজিল্যান্ড এসেছেন কেন? 
আমি পাল্টা জিজ্ঞেস করি, আমার এই প্রশ্নের সঙ্গে নিউজিল্যান্ডে আসা না-আসার কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন? 
ভদ্রমহিলা জোর গলায় বললেন, এই জন্যই জিজ্ঞেস করছি, নিউজিল্যান্ড ইংলিশ-স্পিকিং কান্ট্রি। এখানে বাংলা শিখে লাভ কী? নতুন এসেছেন। ইংরেজিটা ভালোভাবে শিখুন। 
আমি এ ব্যাপারে কথা বাড়ানোর প্রয়োজনবোধ না করলেও আস্তে গলায় বলি, ইংরেজিটা শিখেই আমি নিউজিল্যান্ড এসেছি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

দুই.
বছর দুই পরের ঘটনা। উনিশ শ নিরানব্বই সাল। তখন আমি অকল্যান্ডের মাউন্ট ইডেন সাবার্বের ভিউ রোডের জাকারান্ডা লজে থাকি। জাকারান্ডা লজ মূলত দ্বিতল ঘরের পুরনো মোটেল বা হোটেল ছিল। পরে সেটা ব্যাচেলরদের বসবাসের জন্য বোর্ডিং হাউস বানায়। ওপর-নিচ মিলে মোট চব্বিশটা রুম ছিল। বেশির ভাগ রুম ও ডাইনিং রুম ছিল ওপর তলায়। বড় বড় রুমগুলোতে সিঙ্গেল দম্পতিও বসবাস করত। আমি বসবাস করতাম মাঝারি আকারের রুম নিয়ে নয় নম্বর রুমটায়।
অকল্যান্ডে যারা তখন বাঙালি ব্যাচেলর ছিল, তাদের জন্য জাকারান্ডা লজ বেশ প্রসিদ্ধ ছিল। জাকারান্ডা লজের চব্বিশটি রুমের মধ্যে তেরোটি রুমে বাঙালি ব্যাচেলর বসবাস করত। একবার যারা এই লজে ঢুকত, তারা আর বের হতে চাইত না। এ জন্য সহজে রুম পাওয়া যেত না। আমি সেই লজে পুরো দুই বছর ছিলাম। 
জাকারান্ডা লজের মালিক ছিলেন এক আইরিশ মহিলা। নামটা বেশ সুন্দর ছিল, প্যাম ব্যানেট। বয়স সত্তরের ওপরে হলেও তিনি দেখতে অদ্ভুত সুন্দর ছিলেন। সবসময় খুব সেজেগুজে থাকতেন। ঠোঁটে লাল রঙের টকটকে লিপস্টিক থাকত। খুব হাসতেন তিনি। একসময় লজের সামনে হয়তো বেগুনি রঙের জাকারান্ডা ফুলের গাছ ছিল, তাই লজের নাম জাকারান্ডা রাখা হয়েছিল। আমরা যখন ছিলাম, তখন অবশ্য ফুলের গাছটা ছিল না। 


জাকারান্ডা লজের পরিবেশ বেশ শান্তিপূর্ণ ছিল। সাদা চামড়ার ইংরেজ যারা বসবাস করত, তারা নয়টা-পাঁচটা বা শিফটিং ডিউটি করত। বাঙালি যারা ছিল, তাদের বেশির ভাগই ছাত্র ছিল। কেউ ডাক্তারির তিন পার্ট পাস করে নিউজিল্যান্ডের রেজিস্টার্ড ডাক্তার হওয়ার জন্য দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা লেখাপড়ার ওপর থাকত। কেউ অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করত। তাদেরও লেখাপড়ায় ব্যস্ত থাকতে হতো। কেউ কেউ লেখাপড়ার পাশাপাশি পার্টটাইম চাকরি করত। তাই আমরা সবাই চেষ্টা করতাম লজের পুরো পরিবেশটাকে নিরিবিলি রাখার।
কিন্তু একদিন আমি লজের পরিবেশটা পুরোপুরি নিরিবিলি রাখতে পারিনি। সকাল ১০টার দিকে স্টেরিওতে দেশাত্মকবোধক গান বাজাতে শুরু করি। আসলে সেদিন ছিল অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। শহিদ দিবস। স্টেরিওর ভলিউম হয়তো একটু উঁচু ছিল। হয়তো ভেবেছিলাম, সকাল ১০টা বাজে। অনেকেই ডিউটিতে। হয়তো আমার ভেতর আবেগটাও একটু বেশি কাজ করছিল। 


ঘণ্টাখানেকের মতো গান বাজে। হঠাৎ দরজায় করাঘাত শুনি। আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলি। দেখি, আমার পাশের রুম ১০ নম্বরের বোর্ডার কবির আহমেদ। 
আমি কবির আহমেদকে দেখে সৌজন্যমূলক হাসি দিই। কিন্তু তিনি হাসেন না। তিনি অনেকটা গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করেন, আপনি এত জোরে গান বাজাচ্ছেন কেন?
আমি বলি, এত জোরে কোথায়? খুব বেশি জোরে তো নয়, কবির ভাই? 
-অবশ্যই জোরে। আর যত কম জোরেই বাজান, এতেও আমার ডিস্টার্ব হচ্ছে।
-কবির ভাই, আজ যে একুশে ফেব্রুয়ারি। শহিদ দিবস। 
-তাতে কী হয়েছে?
-একটু আবেগ কাজ করছে। বুঝতেই পারছেন।
-এসব সস্তা আবেগ বাংলাদেশে রেখে আসবেন। 
কবির আহমেদের সঙ্গে ব্যাপারটা সেখানে শেষ হলে ভালো হতো। কিন্তু আমার জেদ চেপে যায়। আমি সেদিন স্টেরিওর ভলিউম কমাইনি। তাকে বরং শান্ত গলায় বলি, আপনি আপনার রুমে যান। এটা আমার রুম। আমি যা ইচ্ছে তাই করব। 
কবির আহমেদ আমার রুমের সামনে থেকে সরে গিয়ে সরাসরি লজের মালিক মিসেস প্যাম ব্যানেটের কাছে গিয়ে যা নয় তা আরও বাড়িয়ে অভিযোগ দেন।
প্যাম ব্যানেট আমার রুমে আসেন। ভদ্র গলায় জিজ্ঞেস করেন, কাজী, তোমার কী হয়েছে?
আমি পাল্টা জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে, মিসেস ব্যানেট?
-তোমার পাশের রুমের কবির আহমেদ বেশ অভিযোগ করে এল যে, তুমি তাকে ডিস্টার্ব করছ। তোমার রুমে এসেও দেখলাম, তুমি গান বাজাচ্ছ। 
-আমি কি খুব জোরে গান বাজাচ্ছি?
-তা নয়। তার পরও। তুমি তো কখনো এভাবে গান বাজাও না। 
আমি বোঝানোর ভঙ্গিতে মিসেস প্যাম ব্যানেটকে আমাদের অমর একুশে ফেব্রুয়ারির মাহাত্ম্য, ভাষার জন্য শহিদের আত্মদান বুঝিয়ে বলি। তিনি অবাক হয়ে বলেন, ভাষার জন্য এভাবে কেউ শহিদ হয়?
আমি আবেগের গলায় বলি, জি, মিসেস ব্যানেট। পৃথিবীর একমাত্র দেশ বাংলাদেশ, যেখানে ভাষার জন্য মানুষ শহিদ হয়েছে। আমরা আমাদের ভাষা ফিরে পেয়েছি। 

তিন.    
নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বড় বুকস্টোরের নাম ছিল হুইটকোল। এখনো আছে কি না জানি না। দুই হাজার চৌদ্দ সালে অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর কুইন্সল্যান্ডের কোথাও এই নামে বুকস্টোর চোখে পড়েনি। 
উনিশ শ আটানব্বই সালের মাঝামাঝি। তখন অকল্যান্ডে থাকি। ওয়েস্টার্ন স্প্রিং সাবার্বের মর্নিং সাইডে এক বাসায় অস্থায়ীভাবে থাকি। তখনো অকল্যান্ডে খুব বেশি বাঙালি চিনি না। যে দুই-চারজন চিনি তারা কাজেকর্মে ব্যস্ত। তাই একেবারেই বাংলা কথা বলা হয় না। এমনিতেই নিউজিল্যান্ডে তখন খুব বেশি বাঙালি ছিল না। 
একদিন হুইটকোল বুকস্টোরে ইংরেজি লেখকের বই ঘেঁটে দেখছি। এমনিই, কাজ নেই তো খই ভাঁজ। বুকস্টোরের একপাশে ছিল স্টেশনারির কয়েকটি তাক। তাকের এক স্থানে ছিল বিভিন্ন বলপয়েন্ট কলম ও ঝরনার কলম। আর্ট করার রংবেরঙের পেনসিলও ছিল অনেক। সাধারণত কলমের কালি বা আর্ট পেনসিলের রং পরীক্ষা করার জন্য ছোট ছোট সাদা কাগজের প্যাড শেলফের পাশেই ঝোলানো থাকে। হুইটকোলেও তাই ছিল। 


আমি কলমের শেলফের পাশে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা প্যাডের পৃষ্ঠায় দেখলাম, কাঁচা হাতে বাংলায় লেখা- ‘এক ছিল রাজা’। 
খুব সাধারণ একটি লাইন। কিন্তু আমি লেখাটার দিকে খুব মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। আমার কেন জানি মনে হয়েছিল, কতদিন পর যেন আমি বাংলা লেখা দেখছি। বুঝতেই পারছেন, উনিশ শ আটানব্বই সালে ইন্টারনেট তেমন ব্যাপাকভাবে আসেনি। সবার বাসায় কম্পিউটারও ছিল না। নেটে বাংলা পত্রিকা পড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। 
আমি লেখাটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে শেলফ থেকে একটা কলম নিয়ে লেখাটির নিচে লিখি, ‘তার ছিল দুই রানি। সুয়োরানি ও দুয়োরানি...!’

সাহিত্যসভার প্রবন্ধ

প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:০৮ এএম
আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:০৮ এএম
সাহিত্যসভার প্রবন্ধ
অলংকরণ: মেহেদী হাসান

শহীদ কাদরী: কম লিখে পেয়েছেন বেশি খ্যাতি 
এস ডি সুব্রত

‘ভয় নেই
আমি এমন ব্যবস্থা করব যাতে সেনাবাহিনী
গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে
মার্চপাস্ট করে চলে যাবে
এবং স্যালুট করবে
কেবল তোমাকে প্রিয়তমা।’ (তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা- শহীদ কাদরী।) 

বাংলা সাহিত্যে যেসব কবি কম লিখে বেশি খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম শক্তিমান কবি শহীদ কাদরী। তার কবিতায় নিজস্ব চিন্তার বহিঃপ্রকাশের পাশাপাশি নাগরিক জীবন ও সংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ প্রকাশ পায়। মাত্র চারখানা প্রকাশিত গ্রন্থ এবং কিছু অপ্রকাশিত কবিতার জন্য একটি দেশের কাব্যভুবনে অসামান্য খ্যাতি পেয়েছেন তিনি। শহীদ কাদরীর কবিতার বিরাট একটা অংশে রয়েছে নাগরিক জীবনচিত্রের এক অনন্য স্বরূপ। কবি শহীদ কাদরী ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট কলকাতার পার্ক সার্কাসে জন্মগ্রহণ করেন। ১০ বছর বয়সে ১৯৫২ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৮০ সালের দিকে তিনি প্রবাসজীবন কাটাতে শুরু করেন জার্মানিতে। সেখানে বেশ কয়েক বছর ছিলেন। তার পর যুক্তরাজ্যের লন্ডনে এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাস জীবন কাটান। কবি শহীদ কাদরী ২০১৬ সালের ২৮ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। প্রবাস জীবনেও তিনি লেখালেখিতে খুব সক্রিয় ছিলেন। তিনি বাংলা কবিতায় নাগরিকতা ও আধুনিকতাবোধের সূচনা করেছিলেন অসামান্য দক্ষতায়। শহীদ কাদরী খুব একটা প্রথাগত ছন্দনির্ভর কবিতা লেখেননি। তার একটা নিজস্বতা রয়েছে। চৌদ্দ বছর বয়সে কবি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত একটি সংকলনে তার লেখা প্রথম কবিতা ছাপা হয়। কবি শহীদ কাদরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার’ প্রকাশ পায় ১৯৬৭ সালে। প্রথম গ্রন্থ প্রকাশ করেই পুরো সাহিত্যাঙ্গনে সাড়া ফেলে দেন কবি শহীদ কাদরী। তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে প্রকাশ পায় ‘প্রেম বিরহ ভালবাসার কবিতা’, ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ এবং প্রবাসে লেখা কবিতা নিয়ে প্রকাশ পায় ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দিও।’ শহীদ কাদরী প্রবাসে থেকে যে কবিতাগুলো লিখেছেন, তার অধিকাংশই স্বদেশভূমির জন্য তার বিরহকাতরতাপূর্ণ। তিনি দেশ থেকে বহু দূরে থেকেও কখনোই দেশকে ভোলেননি। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পালাবদলের ঘটনাকে কবি মেনে নিতে পারেননি। মৌলবাদের নখদন্ত তাকে প্রবলভাবে আহত করে। তাই তো তিনি ঘৃণাভরে তাদের প্রত্যাখ্যান করেন কবিতার পঙ্‌ক্তিতে। শৈশবের মাত্র ১০ বছর তিনি কলকাতা শহরে কাটিয়েছিলেন। অথচ, সেই শহরের স্মৃতি তিনি আজীবন লালন করেছেন। অভিজাত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম হলেও ভালোভাবে বাংলা শেখার আগে তিনি শিখেছেন উর্দু ও ইংরেজি। নাগরিক, শহুরে জীবনের আলো ও অন্ধকার দুটোই তার দেখা। তাই তো তার কবিতায় পাপচেতনার চরম উপলব্ধির দেখা মেলে। শহীদ কাদরীর কবিতা আমাদের নিয়ে যায় সম্পূর্ণ আলাদা এক জগতে। শহীদ কাদরী তরুণদের মধ্যে অনেক বেশি জনপ্রিয়। তিনি অনেক কম লিখেও অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়েছেন। এই তো বোধ হয় একজন কবির সার্থকতা। শহীদ কাদরী ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০১১ সালে রাষ্ট্রীয় অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদক লাভ করেন। প্রকাশক মফিদুল হক তার সম্পর্কে বলেছেন, ‘বাংলা কবিতার অতিসাম্প্রতিক সৃষ্টি-প্রাচুর্যের ভিড়ে তাকে কেউ খুঁজে পাবেন না। অথচ সাতচল্লিশ-উত্তর কবিতাধারায় আধুনিক মনন ও জীবনবোধ সঞ্চারিত করে কবিতার রূপ বদলে যাঁরা ছিলেন কারিগর, শহীদ কাদরী তাঁদের অন্যতম প্রধান। তাঁর কবিতা আমাদের নিয়ে যায় সম্পূর্ণ এক আলাদা জগতে, ঝলমলে বিশ্ব-নাগরিকতাবোধ ও গভীর স্বাদেশিকতার মিশেলে শব্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষার অভিনবত্বে তিনি যেন বিদ্যুৎ-চমকের মতো এক ঝলকে সত্য উদ্ভাসন করে পরমুহূর্তে মিলিয়ে গেলেন দূর দিগন্তের নিভৃত নির্জনতার কোলে।’ 


কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হক এক সাক্ষাৎকারে শহীদ কাদরী সম্পর্কে বলেন- ‘এক অসাধারণ মানুষ শহীদ কাদরী। বিশাল তাঁর ব্যক্তিত্ব। মেধায়, আড্ডায় সব মিলিয়ে একজন মানুষ হিসেবে শহীদ কাদরীর কোনো তুলনা চলে না। আমার জীবনে আমি যা কিছু কিঞ্চিৎ শিখেছি তা শহীদের জন্যই।’ 

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ