
কালার পেনসিল
শৌনক দত্ত
শহরটা ছিল ছবির মতো, পিকচার পোস্টকার্ডে ঠিক যেমনটা দেখা যায়। চওড়া চওড়া অ্যাসফাল্টের মসৃণ রাস্তা, দুই ধারে বাগানওলা বাংলো ধরনের বাড়ি, পার্ক, ফোয়ারা, দুই রাস্তার ক্রসিংয়ে শ্বেতপাথরের পরী। এ ছাড়া ছোট একটা জু-গার্ডেন, স্টেট লাইব্রেরি, ঝকঝকে হাসপাতাল, সুসজ্জিত স্টেডিয়াম। যেদিকেই তাকানো যাক, তখন এখানে প্রচুর গাছপালা, ফুলের বাগান আর নির্জনতা। শহরটা যত বড়, সেই তুলনায় মানুষজন ছিল অনেক কম। দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে সেকালের পূর্ব পাকিস্তান থেকে মানুষের ঢল নেমেছিল সীমান্তের এ-পারে। তার ধাক্কা এই শহরেও এসে লাগে। স্বাধীনতার পর যে দুই বছর এই শহরে জনস্রোত ঠেকিয়ে রাখা গেছে। তার পর আর পারা গেল না। শহরটি আমূল বদলে যেতে লাগল। যেখানে যত বাগান, পার্ক বা ফাঁকা জায়গা ছিল, পূর্ব বাংলার শরণার্থীরা সবকিছু দখল করে তুলতে লাগল ছিরিছাঁদহীন, বেঢপ চেহারার বাড়িঘর। সন্ধ্যার পর রাস্তায় রাস্তায় গ্যাসের আলো জ্বলত। পরে মিউনিসিপ্যালিটি সেগুলো তুলে ফেলে লম্বা লম্বা ল্যাম্পপোস্ট বসিয়ে তার গায়ে একটা করে বাল্ব ঝুলিয়ে দিয়েছে। বাল্বগুলোর বেশির ভাগই জ্বলে না। রাস্তাগুলো খানাখন্দে বোঝাই। দুই ধারের নর্দমা কতকাল যে সাফাই হয় না। বছরের পর বছর সেগুলোতে থকথকে কালচে রঙের তরল অনড় দাঁড়িয়ে থাকে। এসব নদৰ্মা হলো যাবতীয় রোগের জীবাণু আর মশাদের মেটার্নিটি হোম। রাস্তার মোড়ের শ্বেতপাথরের যে পরীগুলো একদা এই শহরে অলৌকিক স্বপ্ন নামিয়ে আনত, কবেই তারা উধাও হয়ে গেছে। চারদিকে আবর্জনার পাহাড়। চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগের পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে শহরটি এখন নোংরা, ঘিঞ্জি, দুর্গন্ধে-ভরা এক শহর। অনন্যা ভৌমিক, মূলত নৃত্যই তার ধ্যানজ্ঞান কিন্তু পায়ের হাড়ে সমস্যা দেখা দেওয়ার পর সে নৃত্য ছেড়ে আঁকাআঁকিতে মন দিয়েছে। আঁকার হাতটা তার মন্দ না, তার বাবা শখের আঁকিয়ে হলেও ভালো আঁকেন, একাডেমিক শিক্ষা পেলে বড় চিত্রকর হওয়ার যোগ্যতা তার ছিল। অনন্যার ঠাকুরদা অনিল মাস্টার সরকারি চাকরির সুযোগ প্রত্যাখ্যান করে একটা গোটা জীবন বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে কাটিয়ে দিলেন। তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন তখন আঁকাআঁকিতে তার হাতও ছিল ঈর্ষণীয়। প্রথাগত কোনো শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও দারুণ ল্যান্ডস্কেপ আঁকতেন। অনন্যা ল্যান্ডস্কেপ ভালো আঁকলেও তার আঁকা চোখ যেন বাস্তব চোখের মতো কথা বলে। টেবিলে রাখা কালার পেনসিলটা অনন্যা পৈতৃক সূত্রে পেয়েছে।
অনন্যা ‘খুঁজে বের করে রং করো’ প্রতিযোগিতায় নাম লেখায়। চিত্রকরদের কাজ ছিল হারানো চোখ খুঁজে বের করে চোখটাকে রং দিয়ে রঙিন করে তোলা। অনন্যা চোখ খুঁজে পায় এবং কালার পেনসিল দিয়ে সেই চোখটাকে রঙিন করে তোলে। প্রতিযোগিতায় জেতার পর থেকেই একটা ভীতিকর স্বপ্ন দেখতে শুরু করে অনন্যা। একটা অস্পষ্ট চোখ। আউটলাইনটা খুব হালকা, মণির কিছু অংশ, ঝাঁপসা আইরিশ ও আইল্যাশ।
প্রতিদিন একই স্বপ্ন দেখতে দেখতে অনন্যা একদিন ঘুম থেকে উঠে ধাতস্থ হয়ে ঠিক করেছিল, স্বপ্নে আসা টুকরো টুকরো আদলগুলোকে যদি জোড়া লাগানো যায়! মানে ক্যানভাসে এঁকে ওদের একটা রূপ দিতে চেষ্টা করল। স্বপ্নের মধ্যে যে চোখটা সে দেখে, তাকে আঁকতে চাইল। কিন্তু যেই না অর্ধেকটা আঁকা শেষ হয়, ঠিক তখুনি তার হাতটা অসাড় হয়ে আসে। আর আঁকতে পারে না। ছবিটা অর্ধেকই রয়ে যায়। বাকি অর্ধেক কখনোই আর আঁকা হয়ে ওঠে না। এর পর থেকেই সে স্বপ্নটা যখনই দেখে, আর ঘুম থেকে উঠতে চায় না। ইচ্ছে করেই ঘুমের মধ্যে শুয়ে থাকে। ভাবে, এভাবে থাকলে হয়তো ওই চোখটাকে আরও বেশিক্ষণ দেখতে পাবে। টুকরোগুলোকে আরও জমাট করে একত্রে বেঁধে ফেলা যাবে। নিজেকেই সে বলতে থাকে, ‘ধৈর্য ধরো। চুপ করে শুয়ে থাকো। চোখ খুলো না।’ স্বপ্নের মধ্যেই সে অসম্পূর্ণ চোখটাকে পুরোপুরি দেখতে চায়। কিন্তু প্রত্যেকবারই সে জেগে ওঠে আর ছড়িয়ে থাকা টুকরোগুলো ছড়ানোই পায়। কিছুতেই আর এক করতে পারে না। তীব্র অস্থিরতা নিয়ে সে জেগে ওঠে, ঘামতে থাকে আর আবারও সেই ভাঙা টুকরোগুলোকেই ক্যানভাসে আঁকবার চেষ্টা শুরু করে।
রবিবার। আকাশের বুকে ভোরের আলো তখনো ফুটে ওঠেনি। ফজরের আজান ভেসে আসছে। পুবের আকাশটা কেমন রহস্যময় হয়ে উঠেছে, খোলা জানলা-পথে জলো হাওয়ায় ঠাণ্ডা শিরশিরানি। অনন্যার ঘুম ভেঙে যায়। আজ সে চোখের স্বপ্নটা দেখেনি। বিস্ময়ে বিছানা ছেড়ে সে অসম্পূর্ণ ক্যানভাসটির দিকে যায়। আশ্চর্য! গিয়ে দেখে এতদিন আঁকতে না পারা অসম্পূর্ণ ছবিটা ক্যানভাসে আঁকা হয়ে আছে। পুরোটা। যেভাবে সে দেখতে চেয়েছে, ঠিক সেভাবেই। চোখটা যেন তার দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। চোখ ধরে ধরে পুরো মুখাবয়বটা এঁকে ফেলে সে, সিলভিয়া প্লাথ! ওর পাশে গিয়ে বসে সে।
‘মেয়েদের যাপনে যদি বিদ্রোহ থাকে, তা হলে সেই দ্রোহ কোনো সৃষ্টিশীল নারীর মনেও অহরহ ছাপ ফেলে।’ -অনন্যা বিড়বিড় করে।