ঢাকা ৭ ফাল্গুন ১৪৩১, বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
English
বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৭ ফাল্গুন ১৪৩১

সাহিত্যসভার মুক্ত কবিতা

প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৪৫ এএম
সাহিত্যসভার মুক্ত কবিতা
অলংকরণ: মেহেদী হাসান

দায় 
এস ডি সুব্রত

 
চলে গেছ দূরে বহুদূরে
বাহিরে নয় ভেতরেও
সমস্ত আকাশে শুধু মেঘের দল 
বিষণ্ণ শব্দে নামে বিষাদের জল, 
ছেড়ে যাবার এই নিশ্চিত আয়োজনে 
কেবল তুমিই দায়ী নও
আমারও আছে দায় ভীষণ 
ফিরে পাবার প্রতীক্ষায় আজও 
প্রহর গোনে ব্যথিত ব্যাকুল মন।

সাহিত্যসভার ছোটগল্প

প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭:১৯ পিএম
আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭:১৯ পিএম
সাহিত্যসভার ছোটগল্প
অলংকরণ: মেহেদী হাসান

 

ভালোবাসার লাল করবী
মো. রায়হান পারভেজ

‘তয় আমার জন্য লাল টকটকা একটা গোলাপ ফুল নিয়া আইসো, আমি মনে করমু তুমি আমার জন্য গোলাপ ফুল না, পুরা ভালোবাসাটাই নিয়ে আসছো…’ খুব অনুরক্ত কণ্ঠে শেফালী তার কামনাটি ব্যক্ত করে সুরুজের কাছে। সুরুজের মনে হয় শেফালীর থেকে শোনা এই কামনাটি এক আকাশ স্বপ্নের বাস্তবতার সৌন্দর্য নিয়ে তার সম্মুখে দৃশ্যমান হয়েছে। বাংলাদেশেরই দক্ষিণাঞ্চলের একটি মফস্বল শহর। ছবির মতো এই সুন্দর শহরেরই দুটি পান্থপথিক যেন সুরুজ এবং শেফালী। শৈশবেই বাবা-মা হারানো সুরুজ দারিদ্র্য নামক পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করে বেড়ে উঠেছে। চিরায়ত দারিদ্র্যের অনুপম সঙ্গী হিসেবেই যেন নিয়তির লিখনে তার জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় রিকশানামক ত্রিচক্রযানে যাত্রী আনয়ন। এই শহরেই অপর এক প্রান্তে রয়েছে শেফালীর আবাস। মা-মরা হতদরিদ্র পিতার একমাত্র অবলম্বন শেফালীকে জীবনের রুঢ় বাস্তবতায় বেছে নিতে হয় পোশাক কারখানার কর্মীনামক কঠোর পরিশ্রমের পেশা। শেফালী আর সুরুজের দেখাটি যেন ঠিক দৈবচক্রের মতোই। কর্মস্থলে যাওয়ার তাগিদে পথে দ্রুত হাঁটা শেফালীর সামনে যেন ঠিক ধ্রুবতারার মতোই আবির্ভূত হয় রিকশাচালকের আসনে থাকা সুরুজ। ‘Love at first sight’ তত্ত্বকে সত্যি করে ওই দিন থেকেই সুরুজের মনের পর্দায় একটিই মুখ ভেসে বেড়ায়- শেফালী। হৃদয়ে দোলনচাঁপার গন্ধটি বুকে ধারণ করে উপলব্ধি করলে বোঝা যায় শেফালীর মনেও দোলা দেয় সুরুজ নামের ঝাঁকড়া চুলের সুঠাম দেহের এক তরুণের আবহ। প্রতিদিন চৌরাস্তার মোড়ে পলকে পলকে দেখায় পুঞ্জীভূত ভালোবাসা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে রূপ নেয় পরিণত বৃক্ষে। একদিন আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ- বুকের ভেতর জমা সব সাহসকে একীভূত করে সুরুজ বলেই ফেলে শেফালীকে, ‘আমি তোমার লগে আইজ বিকেলে নদীর কিনারায় গিয়ে কয়ডা কথা কইবার চাই, তুমি কি আইজ কাম হইতে একটু তাড়াতাড়ি আইতে পারবা?’ সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে শেফালী সুধালো, ‘আইতে পারি, কিন্তু তোমারে কথা দিতে হইব, আমি যা চাই সেইটা তোমারে আমার জন্য নিয়া আইতে হইবো।’ সুরুজ প্রত্যুত্তর দেয়, ‘তোমার জন্য যেহানে আমার পরাণ-মন বরবাদ, সেহানে তোমার চাওয়া যেকোনো কিছুই আমি আইনা দিমু, তাতে যদি শরীরের রক্ত বেচা লাগে তয় লাগবে।’ শেফালী হেসে বলে, ‘আরে না না, তোমার রক্ত বেচা লাগবে না, তুমি আমার জন্য লাল টকটকা একটা গোলাপ ফুল নিয়া আইসো…’। অন্য আর হাজারটি দিনের চেয়ে আজকের দিনটি জনৈক সুরুজের জীবনে বিশেষ থেকে বিশেষতর। সে ঠিক করল খুব বেশি সময় আর আজকে রিকশা নিয়ে ঘুরে বেড়াবে না। ঠিক তাই হলো, দুপুরের মধ্যেই রিকশাটি গ্যারেজে রেখে সুরুজ ফিরল তার ছোট্ট সুখের কুঁড়েঘরে। নিজের যত্নের সঞ্চয়ে কেনা নীলাভ রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামাটি পরিধান করে সুরুজ বেরিয়ে পড়ে তার কাঙ্ক্ষিত পথের পানে। শহরের মধ্যখানেই গোলাপ ফুলের তিন-চারখানা সারিবদ্ধ বিপণি। কিন্তু সুরুজের স্বপ্নের জোয়ারে অনেকটাই ভাটা পড়ে, যখন সে দেখে প্রতিটি দোকানই তালাবদ্ধ। হতাশায় মুষড়ে পড়া সুরুজ ঠিক পাশেই দণ্ডায়মান স্টলের একজন কর্মীকে প্রশ্ন করে জানতে পারে গত দুই দিন ধরে গোলাপ চাষিদের ধর্মঘট চলছে, যার ফলে এই শহরের কোনো ফুলের দোকানেই গোলাপ ফুলের আমদানি হয়নি। সুরুজের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে, সে হন্তদন্ত হয়ে লাল গোলাপের হন্য করতে থাকে। কিন্তু ওই ছোট শহরে শখের গোলাপবাগান আছে এমন কারও সন্ধান তার নজরে আসে না। যখনই তার মনে হয় প্রিয়তমার প্রথম কথা রাখার স্নিগ্ধ অনুভূতি থেকে সে বঞ্চিত হচ্ছে, তখনই তার মনে ভেসে ওঠে বর্ষীয়ান ভিক্ষুক তার প্রতিবেশী বশির চাচার কথা, ভিক্ষার তাড়নায় যার পদার্পণ হয়েছে এই শহরের প্রায় প্রতিটি বাড়ির আঙিনায়। বশির চাচার মাধ্যমে সুরুজ জানতে পারে শহরতলির ঠিক কাছেই একটি খামারবাড়িতে ফুটে উঠেছে সাদা করবী ফুল। ঠিক গোলাপের মতোই আকৃতির এই সফেদ করবী ফুলই হতে পারে সুরুজের সেই আরাধ্য বস্তু। বশির চাচার থেকে শুনে সুরুজ ছোটে করবী ফুলের সন্ধানে। খামারবাড়ির মালিককে বলে-কয়ে সুরুজ তার বাগান থেকে তুলে নেয় শুভ্র, পবিত্র ও শ্বেত একটি উজ্জ্বল করবী ফুল। করবীর দিকে মুখ তুলে সুরুজের হৃদয়টি যেমন প্রশান্ত হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনি হৃদয়ের এক কোণে আশঙ্কা ও দুঃশ্চিন্তার কালো মেঘ তার মনকে বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। যে রক্তিম লাল বর্ণের গোলাপের বাকরুদ্ধ প্রতীক্ষায় তার প্রিয়তমা শেফালী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, সেই অপেক্ষার অবসান হবে এক ইচ্ছাভঙ্গের অবতারণায়, তা ভেবে সুরুজের মুহূর্তগুলো বিষাক্ত হয়ে ওঠে। এক রাজ্য প্রজাপতিমিশ্রিত ভালোবাসা উপহার দেওয়ার বদলে এক আকাশ কষ্ট শেফালীকে উপহার দেবে, এই চেতনা সুরুজকে মনের সঙ্গে এক নতুন যুদ্ধে অবতীর্ণ করে। প্রগাঢ় ভালোবাসার স্বর্গীয় প্রেষণা নিয়ে সুরুজ মনের সঙ্গে লড়াইয়েও জয়ী হয়, ঠিক নিকটবর্তী একটি ফলের দোকান থেকে সংগ্রহ করে ধারালো এক ছুরি। কালবিলম্ব না করে ছুরির এক তীক্ষ্ম আঘাতে কেটে ফেলে তার নিজ হাতের শিরা। রক্তাক্ত শিরা থেকে প্রবাহিত রক্তের স্পর্শে সাদা করবী ফুল ধারণ করে রক্তিম লাল বর্ণ। তীব্র ব্যথাকে ছাপিয়ে যায় সুরুজের প্রশান্ত মন থেকে উৎসারিত অট্টহাসি। এক নিঃশ্বাসে লাল গোলাপসদৃশ রক্তমাখা করবী নিয়ে সুরুজ ছোটে নদীর তীরে অপেক্ষমাণ প্রেয়সী শেফালীর পানে। ক্রমাগত রক্ত নির্গতের ফলে জীবনীশক্তি নিঃশেষিত হওয়ার পথেও রক্তভেজা করবী হাতে শেফালীর মুক্তাঝরা হাসি তার কাছে এক পৃথিবীর ভালোবাসার সংজ্ঞা নতুন করে জানায়। স্বার্থভরা কণ্টকময় পৃথিবীতে অনন্ত বেঁচে থাকার ক্ষণের থেকেও প্রেয়সীর স্নিগ্ধ মুখের মায়াভরা চাহনির এক চিলতে হাসি সুরুজের নিকট শ্রেয় থেকে শ্রেয়তর হয়ে ধরা দেয়…। 

সাহিত্যসভার মুক্ত কবিতা

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৫৩ পিএম
আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৫৪ পিএম
সাহিত্যসভার মুক্ত কবিতা
অলংকরণ: মেহেদী হাসান

 

ফুলের গালে টোল
মোরশেদুল ইসলাম

এক শীতের মাসের গল্প
হৃদয়ের উঠোনজুড়ে
জেঁকে বসে বরফ সময়
দ্রাক্ষালতার মতো হৃদয়
স্রেফ আশাকে পেঁচিয়ে
চেয়ে ছিল ওপরের দিকে
কত ফুল দিয়ে গেছে
হেমন্ত মোহিনী
মাটি হিম হওয়ার খানিক আগে
তবু মন কার যেন প্রতীক্ষায়
তীব্র, তীব্রতর শীত শেষ
বসন্তের শুরু হয় হয় ভাব
ফুল আসলো অবশেষে
উজ্জ্বল হলুদ রঙে হেসে
নাগরেরা ভালোবেসে নাম দেয়
জুঁই
রৌদ্রোজ্জ্বল হৃদয়জুড়ে
ধূসর এক সময়
আলিয়া ভাটের মতো টোল পড়ে
জুঁইয়ের দুর্দান্ত গালে!

সাহিত্যসভার মুক্ত কবিতা

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:০৫ এএম
সাহিত্যসভার মুক্ত কবিতা
অলংকরণ: মেহেদী হাসান

 

অন্ধ মনের চোখ
মো.আশতাব হোসেন 

ক্ষতের উপর ক্ষত করলে ক্ষত হয় বিক্ষত
তার পরে করলে আঘাত নীলকণা হয় বিস্ফোরিত। 
একই কথা বারবার বললে লাগতে পারে তিতা
যে পাত্রে ধারণ হয়না সে পাত্র নয় কি ফুটা? 

বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে না পাইলে তার জবাব
তার ভিতরে কি আছে বিবেক জীবন্ত সজাগ? 
বিবেক বিহীনা বালির পুতুল ধরতেই ভেঙ্গে যায়
 করতে অপারগ নিজের সুবিচার। 

নিজের ভুল ধরতে পারেনা অন্ধ মনের চোখ
ভুলগুলি ভুল হিসাবে থাকে ভুলের গুদাম,
অন্যের ভুল ধরতে যাওয়া  সাধ্য নেই তার 
শুদ্ধি বুদ্ধি গজায় না প্রাণে ভুলেরই হয় পাহাড়। 

তারাই পারে ক্ষতের উপর আরো ক্ষত করতে
তাদের থেকে দূরসীমানায় বসত উত্তম স্থান, 
শুনতে মানা তাদের মুখের মিষ্টি সুরের গান 
তাদের মতো  মমতাহীনার মোম পরশে
বিবেকবিহীন পুতুলের হয় উত্থান।

সাহিত্যসভার মুক্ত কবিতা

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:০৩ এএম
আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:০৩ এএম
সাহিত্যসভার মুক্ত কবিতা
অলংকরণ: মেহেদী হাসান

 

বনসাই হাসি
এম এ রহমান

দিন দিন গায়ে গতরে যখন বড় হচ্ছি
ছোট হয়, ধ্রুপদী সে-
সাদা পায়জামা,পাঞ্জাবি ও জুতো জোড়া
সামাজিক চোখ থেকে বের হয়
একদল তীরন্দাজ 
তখন অগত্যা
নিজেকেই ছেঁটে ছোট করি
পায়জামা, পাঞ্জাবি,জুতোর মাপে

সভ্যতার পিচঢালা মুখস্ত রাস্তার দিকে
দেয়ালে দেয়ালে পোড়া মাটি ছুঁয়ে 
লোকারণ্যে একা একা হেঁটে হেঁটে 
সভ্যতাকে প্রশ্ন করি-
তুমি আসলেই কতটুকু সভ্য?

এই যে তোমার ঠোঁটে বনসাই হাসি নিয়ে
চোখের ভেতর কর্পোরেট রেল
মস্তিষ্কের বানিজ্যিক স্টেশনে স্টেশনে থামে
পুঁজিবাদী ফসলের গায়ে তোমারই নাম নিয়ে,
তুমি কি হৃদয়পুর চিনো?
তোমাদের রাজপথ থেকে দূরে,বহুদূরে
সোঁদাগন্ধ বিছানো মাটির মেঠোপথ,
অথবা পূর্বের পায়েদের মানচিত্রে
সেই সবুজ পৃথিবী, চিনো?

সাহিত্যসভার ছোটগল্প

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:২৩ এএম
আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:২৪ এএম
সাহিত্যসভার ছোটগল্প
অলংকরণ: মেহেদী হাসান

 

এক ছিল রাজা 
মহিবুল আলম 

উনিশ শ সাতানব্বই সালের কথা। জানুয়ারির আট তারিখ আমি নিউজিল্যান্ডের মাটিতে পা রাখি। আমার একমাত্র মামা তখন মাউন্টমাঙ্গানুই শহরে থাকতেন। তাই অকল্যান্ড এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে মামার এক বন্ধুর বাসায় দুপুরের খাবার খেয়ে সরাসরি মাউন্টমাঙ্গানুই শহরে চলে আসি। কিন্তু এক সপ্তাহ পর কী এক কাজে অকল্যান্ড আসতে হয়। অকল্যান্ডের ওয়েস্টান স্প্রিংয়ের মর্নিং সাইডের এক বাসায় উঠি।


আমি যে বাসায় উঠি, সেটা ছিল ব্যাচেলরদের বাসা। ওরা দুজন থাকত। ওদের বাসার কাছাকাছি ওদের পরিচিত এক পরিবার বসবাস করত। স্বামী-স্ত্রী ও চার বছরের ছোট্ট একটি মেয়ে নিয়ে পরিবারটি। স্বামী-স্ত্রী দুজনই বাংলাদেশে ডাক্তার ছিলেন। কিন্তু নিউজিল্যান্ডে রেজিস্টার্ড ডাক্তার হওয়ার জন্য তখনো তিন পার্ট পরীক্ষা পাস করে শেষ করতে পারেননি বলে স্বামী-স্ত্রী দুজন অন্য জব করতেন। এক অর্থে সেই জবকে অড-জবও বলা যায়। স্বামী করতেন ক্যাসিনোতে গ্যাম্বলারদের তাস বিলির কাজ। আর স্ত্রী একটা কাপড়ের দোকানে সেলস পারসন। 
আসলে গল্পটা সেই দম্পতিকে নিয়ে নয়, তাদের চার বছরের কন্যাসন্তানকে নিয়ে। ছাব্বিশ বছর আগের গল্প তো, তাই সেই কন্যাসন্তানটির নাম এই মুহূর্তে মনে আসছে না। যাক, যেটা বলছিলাম, একদিন এক ব্যাচেলরের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে সেই দম্পতির বাসায় যাই। ছোট্ট সেই মিষ্টি মেয়েটাকে দেখে আমি কাছে ডাকি। আদর করে বাংলায় জিজ্ঞেস করি, তুমি কেমন আছ? 


মেয়েটা বাংলাটা ঠিক বুঝতে পারে না। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। 
আমার সঙ্গে যে ব্যাচেলর এসেছিল, সে বলল, মেয়েটি বাংলা বোঝে না। বলতেও পারে না। 
আমি খানিকটা অবাক হই। ভাবি, বাবা-মা বাংলাদেশি, অথচ মেয়েটা বাংলা বলতে বা বুঝতে পারে না? 
মেয়েটার বাবা তখন কর্মস্থলে ছিল। মেয়েটার মা বাসায়। তিনি লাউঞ্জে আমাদের জন্য চা নিয়ে আসতেই আমি ভূমিকা ছাড়াই জিজ্ঞেস করি, ভাবী, আপনার মেয়ে তো বাংলা বলতে বা বুঝতে পারে না। এটা কীভাবে হলো? 
আমার প্রশ্ন শুনে ভদ্রমহিলা প্রথমে খানিকটা অবাক হন। পরক্ষণে বেশ বিরক্ত হয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করেন, তাতে কী?
একে তো বাংলাদেশ থেকে সবে এসেছি। মনে ও প্রাণে দেশপ্রেম টগবগ করছে। তাই আমি জোর দিয়ে বলি, তাতে কী মানে? ওমা, আপনারা বাংলাদেশি। বাংলা আমাদের ভাষা। সেই ভাষাটা মেয়েকে শেখাবেন না?  
ভদ্রমহিলা আমার কথা শুনে চেহারা কালো করে ফেলেন। শালীনতা ধরে রেখেই কঠিন গলায় বলেন, এমন সস্তা আবেগকে প্রশ্রয় যদি দেবেন, তাহলে নিউজিল্যান্ড এসেছেন কেন? 
আমি পাল্টা জিজ্ঞেস করি, আমার এই প্রশ্নের সঙ্গে নিউজিল্যান্ডে আসা না-আসার কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন? 
ভদ্রমহিলা জোর গলায় বললেন, এই জন্যই জিজ্ঞেস করছি, নিউজিল্যান্ড ইংলিশ-স্পিকিং কান্ট্রি। এখানে বাংলা শিখে লাভ কী? নতুন এসেছেন। ইংরেজিটা ভালোভাবে শিখুন। 
আমি এ ব্যাপারে কথা বাড়ানোর প্রয়োজনবোধ না করলেও আস্তে গলায় বলি, ইংরেজিটা শিখেই আমি নিউজিল্যান্ড এসেছি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

দুই.
বছর দুই পরের ঘটনা। উনিশ শ নিরানব্বই সাল। তখন আমি অকল্যান্ডের মাউন্ট ইডেন সাবার্বের ভিউ রোডের জাকারান্ডা লজে থাকি। জাকারান্ডা লজ মূলত দ্বিতল ঘরের পুরনো মোটেল বা হোটেল ছিল। পরে সেটা ব্যাচেলরদের বসবাসের জন্য বোর্ডিং হাউস বানায়। ওপর-নিচ মিলে মোট চব্বিশটা রুম ছিল। বেশির ভাগ রুম ও ডাইনিং রুম ছিল ওপর তলায়। বড় বড় রুমগুলোতে সিঙ্গেল দম্পতিও বসবাস করত। আমি বসবাস করতাম মাঝারি আকারের রুম নিয়ে নয় নম্বর রুমটায়।
অকল্যান্ডে যারা তখন বাঙালি ব্যাচেলর ছিল, তাদের জন্য জাকারান্ডা লজ বেশ প্রসিদ্ধ ছিল। জাকারান্ডা লজের চব্বিশটি রুমের মধ্যে তেরোটি রুমে বাঙালি ব্যাচেলর বসবাস করত। একবার যারা এই লজে ঢুকত, তারা আর বের হতে চাইত না। এ জন্য সহজে রুম পাওয়া যেত না। আমি সেই লজে পুরো দুই বছর ছিলাম। 
জাকারান্ডা লজের মালিক ছিলেন এক আইরিশ মহিলা। নামটা বেশ সুন্দর ছিল, প্যাম ব্যানেট। বয়স সত্তরের ওপরে হলেও তিনি দেখতে অদ্ভুত সুন্দর ছিলেন। সবসময় খুব সেজেগুজে থাকতেন। ঠোঁটে লাল রঙের টকটকে লিপস্টিক থাকত। খুব হাসতেন তিনি। একসময় লজের সামনে হয়তো বেগুনি রঙের জাকারান্ডা ফুলের গাছ ছিল, তাই লজের নাম জাকারান্ডা রাখা হয়েছিল। আমরা যখন ছিলাম, তখন অবশ্য ফুলের গাছটা ছিল না। 


জাকারান্ডা লজের পরিবেশ বেশ শান্তিপূর্ণ ছিল। সাদা চামড়ার ইংরেজ যারা বসবাস করত, তারা নয়টা-পাঁচটা বা শিফটিং ডিউটি করত। বাঙালি যারা ছিল, তাদের বেশির ভাগই ছাত্র ছিল। কেউ ডাক্তারির তিন পার্ট পাস করে নিউজিল্যান্ডের রেজিস্টার্ড ডাক্তার হওয়ার জন্য দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা লেখাপড়ার ওপর থাকত। কেউ অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করত। তাদেরও লেখাপড়ায় ব্যস্ত থাকতে হতো। কেউ কেউ লেখাপড়ার পাশাপাশি পার্টটাইম চাকরি করত। তাই আমরা সবাই চেষ্টা করতাম লজের পুরো পরিবেশটাকে নিরিবিলি রাখার।
কিন্তু একদিন আমি লজের পরিবেশটা পুরোপুরি নিরিবিলি রাখতে পারিনি। সকাল ১০টার দিকে স্টেরিওতে দেশাত্মকবোধক গান বাজাতে শুরু করি। আসলে সেদিন ছিল অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। শহিদ দিবস। স্টেরিওর ভলিউম হয়তো একটু উঁচু ছিল। হয়তো ভেবেছিলাম, সকাল ১০টা বাজে। অনেকেই ডিউটিতে। হয়তো আমার ভেতর আবেগটাও একটু বেশি কাজ করছিল। 


ঘণ্টাখানেকের মতো গান বাজে। হঠাৎ দরজায় করাঘাত শুনি। আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলি। দেখি, আমার পাশের রুম ১০ নম্বরের বোর্ডার কবির আহমেদ। 
আমি কবির আহমেদকে দেখে সৌজন্যমূলক হাসি দিই। কিন্তু তিনি হাসেন না। তিনি অনেকটা গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করেন, আপনি এত জোরে গান বাজাচ্ছেন কেন?
আমি বলি, এত জোরে কোথায়? খুব বেশি জোরে তো নয়, কবির ভাই? 
-অবশ্যই জোরে। আর যত কম জোরেই বাজান, এতেও আমার ডিস্টার্ব হচ্ছে।
-কবির ভাই, আজ যে একুশে ফেব্রুয়ারি। শহিদ দিবস। 
-তাতে কী হয়েছে?
-একটু আবেগ কাজ করছে। বুঝতেই পারছেন।
-এসব সস্তা আবেগ বাংলাদেশে রেখে আসবেন। 
কবির আহমেদের সঙ্গে ব্যাপারটা সেখানে শেষ হলে ভালো হতো। কিন্তু আমার জেদ চেপে যায়। আমি সেদিন স্টেরিওর ভলিউম কমাইনি। তাকে বরং শান্ত গলায় বলি, আপনি আপনার রুমে যান। এটা আমার রুম। আমি যা ইচ্ছে তাই করব। 
কবির আহমেদ আমার রুমের সামনে থেকে সরে গিয়ে সরাসরি লজের মালিক মিসেস প্যাম ব্যানেটের কাছে গিয়ে যা নয় তা আরও বাড়িয়ে অভিযোগ দেন।
প্যাম ব্যানেট আমার রুমে আসেন। ভদ্র গলায় জিজ্ঞেস করেন, কাজী, তোমার কী হয়েছে?
আমি পাল্টা জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে, মিসেস ব্যানেট?
-তোমার পাশের রুমের কবির আহমেদ বেশ অভিযোগ করে এল যে, তুমি তাকে ডিস্টার্ব করছ। তোমার রুমে এসেও দেখলাম, তুমি গান বাজাচ্ছ। 
-আমি কি খুব জোরে গান বাজাচ্ছি?
-তা নয়। তার পরও। তুমি তো কখনো এভাবে গান বাজাও না। 
আমি বোঝানোর ভঙ্গিতে মিসেস প্যাম ব্যানেটকে আমাদের অমর একুশে ফেব্রুয়ারির মাহাত্ম্য, ভাষার জন্য শহিদের আত্মদান বুঝিয়ে বলি। তিনি অবাক হয়ে বলেন, ভাষার জন্য এভাবে কেউ শহিদ হয়?
আমি আবেগের গলায় বলি, জি, মিসেস ব্যানেট। পৃথিবীর একমাত্র দেশ বাংলাদেশ, যেখানে ভাষার জন্য মানুষ শহিদ হয়েছে। আমরা আমাদের ভাষা ফিরে পেয়েছি। 

তিন.    
নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বড় বুকস্টোরের নাম ছিল হুইটকোল। এখনো আছে কি না জানি না। দুই হাজার চৌদ্দ সালে অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর কুইন্সল্যান্ডের কোথাও এই নামে বুকস্টোর চোখে পড়েনি। 
উনিশ শ আটানব্বই সালের মাঝামাঝি। তখন অকল্যান্ডে থাকি। ওয়েস্টার্ন স্প্রিং সাবার্বের মর্নিং সাইডে এক বাসায় অস্থায়ীভাবে থাকি। তখনো অকল্যান্ডে খুব বেশি বাঙালি চিনি না। যে দুই-চারজন চিনি তারা কাজেকর্মে ব্যস্ত। তাই একেবারেই বাংলা কথা বলা হয় না। এমনিতেই নিউজিল্যান্ডে তখন খুব বেশি বাঙালি ছিল না। 
একদিন হুইটকোল বুকস্টোরে ইংরেজি লেখকের বই ঘেঁটে দেখছি। এমনিই, কাজ নেই তো খই ভাঁজ। বুকস্টোরের একপাশে ছিল স্টেশনারির কয়েকটি তাক। তাকের এক স্থানে ছিল বিভিন্ন বলপয়েন্ট কলম ও ঝরনার কলম। আর্ট করার রংবেরঙের পেনসিলও ছিল অনেক। সাধারণত কলমের কালি বা আর্ট পেনসিলের রং পরীক্ষা করার জন্য ছোট ছোট সাদা কাগজের প্যাড শেলফের পাশেই ঝোলানো থাকে। হুইটকোলেও তাই ছিল। 


আমি কলমের শেলফের পাশে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা প্যাডের পৃষ্ঠায় দেখলাম, কাঁচা হাতে বাংলায় লেখা- ‘এক ছিল রাজা’। 
খুব সাধারণ একটি লাইন। কিন্তু আমি লেখাটার দিকে খুব মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। আমার কেন জানি মনে হয়েছিল, কতদিন পর যেন আমি বাংলা লেখা দেখছি। বুঝতেই পারছেন, উনিশ শ আটানব্বই সালে ইন্টারনেট তেমন ব্যাপাকভাবে আসেনি। সবার বাসায় কম্পিউটারও ছিল না। নেটে বাংলা পত্রিকা পড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। 
আমি লেখাটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে শেলফ থেকে একটা কলম নিয়ে লেখাটির নিচে লিখি, ‘তার ছিল দুই রানি। সুয়োরানি ও দুয়োরানি...!’