এক ছিল রাজা
মহিবুল আলম
উনিশ শ সাতানব্বই সালের কথা। জানুয়ারির আট তারিখ আমি নিউজিল্যান্ডের মাটিতে পা রাখি। আমার একমাত্র মামা তখন মাউন্টমাঙ্গানুই শহরে থাকতেন। তাই অকল্যান্ড এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে মামার এক বন্ধুর বাসায় দুপুরের খাবার খেয়ে সরাসরি মাউন্টমাঙ্গানুই শহরে চলে আসি। কিন্তু এক সপ্তাহ পর কী এক কাজে অকল্যান্ড আসতে হয়। অকল্যান্ডের ওয়েস্টান স্প্রিংয়ের মর্নিং সাইডের এক বাসায় উঠি।
আমি যে বাসায় উঠি, সেটা ছিল ব্যাচেলরদের বাসা। ওরা দুজন থাকত। ওদের বাসার কাছাকাছি ওদের পরিচিত এক পরিবার বসবাস করত। স্বামী-স্ত্রী ও চার বছরের ছোট্ট একটি মেয়ে নিয়ে পরিবারটি। স্বামী-স্ত্রী দুজনই বাংলাদেশে ডাক্তার ছিলেন। কিন্তু নিউজিল্যান্ডে রেজিস্টার্ড ডাক্তার হওয়ার জন্য তখনো তিন পার্ট পরীক্ষা পাস করে শেষ করতে পারেননি বলে স্বামী-স্ত্রী দুজন অন্য জব করতেন। এক অর্থে সেই জবকে অড-জবও বলা যায়। স্বামী করতেন ক্যাসিনোতে গ্যাম্বলারদের তাস বিলির কাজ। আর স্ত্রী একটা কাপড়ের দোকানে সেলস পারসন।
আসলে গল্পটা সেই দম্পতিকে নিয়ে নয়, তাদের চার বছরের কন্যাসন্তানকে নিয়ে। ছাব্বিশ বছর আগের গল্প তো, তাই সেই কন্যাসন্তানটির নাম এই মুহূর্তে মনে আসছে না। যাক, যেটা বলছিলাম, একদিন এক ব্যাচেলরের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে সেই দম্পতির বাসায় যাই। ছোট্ট সেই মিষ্টি মেয়েটাকে দেখে আমি কাছে ডাকি। আদর করে বাংলায় জিজ্ঞেস করি, তুমি কেমন আছ?
মেয়েটা বাংলাটা ঠিক বুঝতে পারে না। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
আমার সঙ্গে যে ব্যাচেলর এসেছিল, সে বলল, মেয়েটি বাংলা বোঝে না। বলতেও পারে না।
আমি খানিকটা অবাক হই। ভাবি, বাবা-মা বাংলাদেশি, অথচ মেয়েটা বাংলা বলতে বা বুঝতে পারে না?
মেয়েটার বাবা তখন কর্মস্থলে ছিল। মেয়েটার মা বাসায়। তিনি লাউঞ্জে আমাদের জন্য চা নিয়ে আসতেই আমি ভূমিকা ছাড়াই জিজ্ঞেস করি, ভাবী, আপনার মেয়ে তো বাংলা বলতে বা বুঝতে পারে না। এটা কীভাবে হলো?
আমার প্রশ্ন শুনে ভদ্রমহিলা প্রথমে খানিকটা অবাক হন। পরক্ষণে বেশ বিরক্ত হয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করেন, তাতে কী?
একে তো বাংলাদেশ থেকে সবে এসেছি। মনে ও প্রাণে দেশপ্রেম টগবগ করছে। তাই আমি জোর দিয়ে বলি, তাতে কী মানে? ওমা, আপনারা বাংলাদেশি। বাংলা আমাদের ভাষা। সেই ভাষাটা মেয়েকে শেখাবেন না?
ভদ্রমহিলা আমার কথা শুনে চেহারা কালো করে ফেলেন। শালীনতা ধরে রেখেই কঠিন গলায় বলেন, এমন সস্তা আবেগকে প্রশ্রয় যদি দেবেন, তাহলে নিউজিল্যান্ড এসেছেন কেন?
আমি পাল্টা জিজ্ঞেস করি, আমার এই প্রশ্নের সঙ্গে নিউজিল্যান্ডে আসা না-আসার কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?
ভদ্রমহিলা জোর গলায় বললেন, এই জন্যই জিজ্ঞেস করছি, নিউজিল্যান্ড ইংলিশ-স্পিকিং কান্ট্রি। এখানে বাংলা শিখে লাভ কী? নতুন এসেছেন। ইংরেজিটা ভালোভাবে শিখুন।
আমি এ ব্যাপারে কথা বাড়ানোর প্রয়োজনবোধ না করলেও আস্তে গলায় বলি, ইংরেজিটা শিখেই আমি নিউজিল্যান্ড এসেছি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
দুই.
বছর দুই পরের ঘটনা। উনিশ শ নিরানব্বই সাল। তখন আমি অকল্যান্ডের মাউন্ট ইডেন সাবার্বের ভিউ রোডের জাকারান্ডা লজে থাকি। জাকারান্ডা লজ মূলত দ্বিতল ঘরের পুরনো মোটেল বা হোটেল ছিল। পরে সেটা ব্যাচেলরদের বসবাসের জন্য বোর্ডিং হাউস বানায়। ওপর-নিচ মিলে মোট চব্বিশটা রুম ছিল। বেশির ভাগ রুম ও ডাইনিং রুম ছিল ওপর তলায়। বড় বড় রুমগুলোতে সিঙ্গেল দম্পতিও বসবাস করত। আমি বসবাস করতাম মাঝারি আকারের রুম নিয়ে নয় নম্বর রুমটায়।
অকল্যান্ডে যারা তখন বাঙালি ব্যাচেলর ছিল, তাদের জন্য জাকারান্ডা লজ বেশ প্রসিদ্ধ ছিল। জাকারান্ডা লজের চব্বিশটি রুমের মধ্যে তেরোটি রুমে বাঙালি ব্যাচেলর বসবাস করত। একবার যারা এই লজে ঢুকত, তারা আর বের হতে চাইত না। এ জন্য সহজে রুম পাওয়া যেত না। আমি সেই লজে পুরো দুই বছর ছিলাম।
জাকারান্ডা লজের মালিক ছিলেন এক আইরিশ মহিলা। নামটা বেশ সুন্দর ছিল, প্যাম ব্যানেট। বয়স সত্তরের ওপরে হলেও তিনি দেখতে অদ্ভুত সুন্দর ছিলেন। সবসময় খুব সেজেগুজে থাকতেন। ঠোঁটে লাল রঙের টকটকে লিপস্টিক থাকত। খুব হাসতেন তিনি। একসময় লজের সামনে হয়তো বেগুনি রঙের জাকারান্ডা ফুলের গাছ ছিল, তাই লজের নাম জাকারান্ডা রাখা হয়েছিল। আমরা যখন ছিলাম, তখন অবশ্য ফুলের গাছটা ছিল না।
জাকারান্ডা লজের পরিবেশ বেশ শান্তিপূর্ণ ছিল। সাদা চামড়ার ইংরেজ যারা বসবাস করত, তারা নয়টা-পাঁচটা বা শিফটিং ডিউটি করত। বাঙালি যারা ছিল, তাদের বেশির ভাগই ছাত্র ছিল। কেউ ডাক্তারির তিন পার্ট পাস করে নিউজিল্যান্ডের রেজিস্টার্ড ডাক্তার হওয়ার জন্য দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা লেখাপড়ার ওপর থাকত। কেউ অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করত। তাদেরও লেখাপড়ায় ব্যস্ত থাকতে হতো। কেউ কেউ লেখাপড়ার পাশাপাশি পার্টটাইম চাকরি করত। তাই আমরা সবাই চেষ্টা করতাম লজের পুরো পরিবেশটাকে নিরিবিলি রাখার।
কিন্তু একদিন আমি লজের পরিবেশটা পুরোপুরি নিরিবিলি রাখতে পারিনি। সকাল ১০টার দিকে স্টেরিওতে দেশাত্মকবোধক গান বাজাতে শুরু করি। আসলে সেদিন ছিল অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। শহিদ দিবস। স্টেরিওর ভলিউম হয়তো একটু উঁচু ছিল। হয়তো ভেবেছিলাম, সকাল ১০টা বাজে। অনেকেই ডিউটিতে। হয়তো আমার ভেতর আবেগটাও একটু বেশি কাজ করছিল।
ঘণ্টাখানেকের মতো গান বাজে। হঠাৎ দরজায় করাঘাত শুনি। আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলি। দেখি, আমার পাশের রুম ১০ নম্বরের বোর্ডার কবির আহমেদ।
আমি কবির আহমেদকে দেখে সৌজন্যমূলক হাসি দিই। কিন্তু তিনি হাসেন না। তিনি অনেকটা গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করেন, আপনি এত জোরে গান বাজাচ্ছেন কেন?
আমি বলি, এত জোরে কোথায়? খুব বেশি জোরে তো নয়, কবির ভাই?
-অবশ্যই জোরে। আর যত কম জোরেই বাজান, এতেও আমার ডিস্টার্ব হচ্ছে।
-কবির ভাই, আজ যে একুশে ফেব্রুয়ারি। শহিদ দিবস।
-তাতে কী হয়েছে?
-একটু আবেগ কাজ করছে। বুঝতেই পারছেন।
-এসব সস্তা আবেগ বাংলাদেশে রেখে আসবেন।
কবির আহমেদের সঙ্গে ব্যাপারটা সেখানে শেষ হলে ভালো হতো। কিন্তু আমার জেদ চেপে যায়। আমি সেদিন স্টেরিওর ভলিউম কমাইনি। তাকে বরং শান্ত গলায় বলি, আপনি আপনার রুমে যান। এটা আমার রুম। আমি যা ইচ্ছে তাই করব।
কবির আহমেদ আমার রুমের সামনে থেকে সরে গিয়ে সরাসরি লজের মালিক মিসেস প্যাম ব্যানেটের কাছে গিয়ে যা নয় তা আরও বাড়িয়ে অভিযোগ দেন।
প্যাম ব্যানেট আমার রুমে আসেন। ভদ্র গলায় জিজ্ঞেস করেন, কাজী, তোমার কী হয়েছে?
আমি পাল্টা জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে, মিসেস ব্যানেট?
-তোমার পাশের রুমের কবির আহমেদ বেশ অভিযোগ করে এল যে, তুমি তাকে ডিস্টার্ব করছ। তোমার রুমে এসেও দেখলাম, তুমি গান বাজাচ্ছ।
-আমি কি খুব জোরে গান বাজাচ্ছি?
-তা নয়। তার পরও। তুমি তো কখনো এভাবে গান বাজাও না।
আমি বোঝানোর ভঙ্গিতে মিসেস প্যাম ব্যানেটকে আমাদের অমর একুশে ফেব্রুয়ারির মাহাত্ম্য, ভাষার জন্য শহিদের আত্মদান বুঝিয়ে বলি। তিনি অবাক হয়ে বলেন, ভাষার জন্য এভাবে কেউ শহিদ হয়?
আমি আবেগের গলায় বলি, জি, মিসেস ব্যানেট। পৃথিবীর একমাত্র দেশ বাংলাদেশ, যেখানে ভাষার জন্য মানুষ শহিদ হয়েছে। আমরা আমাদের ভাষা ফিরে পেয়েছি।
তিন.
নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বড় বুকস্টোরের নাম ছিল হুইটকোল। এখনো আছে কি না জানি না। দুই হাজার চৌদ্দ সালে অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর কুইন্সল্যান্ডের কোথাও এই নামে বুকস্টোর চোখে পড়েনি।
উনিশ শ আটানব্বই সালের মাঝামাঝি। তখন অকল্যান্ডে থাকি। ওয়েস্টার্ন স্প্রিং সাবার্বের মর্নিং সাইডে এক বাসায় অস্থায়ীভাবে থাকি। তখনো অকল্যান্ডে খুব বেশি বাঙালি চিনি না। যে দুই-চারজন চিনি তারা কাজেকর্মে ব্যস্ত। তাই একেবারেই বাংলা কথা বলা হয় না। এমনিতেই নিউজিল্যান্ডে তখন খুব বেশি বাঙালি ছিল না।
একদিন হুইটকোল বুকস্টোরে ইংরেজি লেখকের বই ঘেঁটে দেখছি। এমনিই, কাজ নেই তো খই ভাঁজ। বুকস্টোরের একপাশে ছিল স্টেশনারির কয়েকটি তাক। তাকের এক স্থানে ছিল বিভিন্ন বলপয়েন্ট কলম ও ঝরনার কলম। আর্ট করার রংবেরঙের পেনসিলও ছিল অনেক। সাধারণত কলমের কালি বা আর্ট পেনসিলের রং পরীক্ষা করার জন্য ছোট ছোট সাদা কাগজের প্যাড শেলফের পাশেই ঝোলানো থাকে। হুইটকোলেও তাই ছিল।
আমি কলমের শেলফের পাশে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা প্যাডের পৃষ্ঠায় দেখলাম, কাঁচা হাতে বাংলায় লেখা- ‘এক ছিল রাজা’।
খুব সাধারণ একটি লাইন। কিন্তু আমি লেখাটার দিকে খুব মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। আমার কেন জানি মনে হয়েছিল, কতদিন পর যেন আমি বাংলা লেখা দেখছি। বুঝতেই পারছেন, উনিশ শ আটানব্বই সালে ইন্টারনেট তেমন ব্যাপাকভাবে আসেনি। সবার বাসায় কম্পিউটারও ছিল না। নেটে বাংলা পত্রিকা পড়ার কোনো সুযোগ ছিল না।
আমি লেখাটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে শেলফ থেকে একটা কলম নিয়ে লেখাটির নিচে লিখি, ‘তার ছিল দুই রানি। সুয়োরানি ও দুয়োরানি...!’