সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার আলোচিত এক মুখ সোনামণি। যার দুই স্বামীর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। বাঘের আক্রমণে দুই স্বামী নিহত হওয়ার পর থেকে ‘অপয়া’, ‘অলক্ষ্মী’, ‘স্বামীখেকো’ অপবাদ মাথায় নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে সোনামণিকে। কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিলেও তাকে খেতে দেওয়া হয় সবার শেষে।
বর্তমানে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ বাজারের পেছনে জেলেপাড়ায় বসবাস তার। দুই স্বামীর সংসারে চার সন্তান থাকলেও সোনামণির দেখভাল করেন না তাদের কেউই। বলতে গেলে একাকী জীবনে সংকট নিত্যদিনের, নেই কোনো সমাধান।
বাঘ বিধবা সোনামণির বাবার বাড়ি সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে। ছোটবেলা থেকে বাবার অভাবের সংসারে বড় একটা বোঝা ছিলেন তিনি। এ জন্য বেশি দিন বাবার ঘরে থাকতে পারেননি। মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাবা তাকে বিয়ে দিয়ে দেন নিজ বংশীয় এক জেলের সঙ্গে।
ভালো ছেলে হওয়ায় পাত্রকে হাতছাড়া করেননি সোনামণির বাবা। বর শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ গ্রামের জেলেপাড়ার তরুণ রাধাকান্ত সরদার। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই জন্ম নেয় এক ছেলে। সোনামণি ও তার স্বামীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। বেশ ভালোই চলছিল তাদের জীবন ও সংসার।
সন্তানের বয়স যখন এক মাস, তখন (১৯৯৯ সাল) স্বামী রাধাকান্ত সরদার বন বিভাগ থেকে পাস-পারমিট নিয়ে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যান। সেখানে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারাতে হয় তাকে। বাঘের কবল থেকে রাধাকান্তের লাশ পর্যন্ত খুঁজে পাননি তার সঙ্গীরা। মর্মান্তিক এই ঘটনায় আকাশ ভেঙে পড়ে সোনামণির মাথায়। তছনছ হয়ে যায় সুখের সংসার। মাত্র এক মাস বয়সী শিশুসহ স্বামীর বাড়ি থেকে বিধবা এই নারীকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন তার শাশুড়ি। সমাজের লোকজন সোনামণিকে ‘অপয়া’ বলে আখ্যা দেন। যেন তার অপরাধের(!) কারণেই স্বামীকে বাঘে খেয়েছে।
কষ্টেসৃষ্টে দিন যেতে থাকে হতভাগিনী সোনামণির। কীভাবে সংসার চলবে? এই সংকটের কী সমাধান? সে সময় স্বামীহারা একজন নারীকে সমাজে অবহেলার চোখে দেখা হতো। অভাবী বাবার সংসারেও জায়গা হয়নি তার। সমাজ তাকে ‘অপয়া’ বলে ধিক্কার দিতে থাকে। একপর্যায়ে প্রতিবেশীরা সোনামণির এক মাস বয়সী শিশুসন্তানের কথা ভেবে তার অবিবাহিত দেবর ভুবেন সরদারের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করেন। এ সংসারে এক ছেলে ও দুই মেয়ের জম্ম হয়। এতে সোনামণির দুঃখ কিছুটা লাঘব হয়। পেছনের কালো শোকার্ত অধ্যায় মুছে ফেলে নতুনভাবে সংসার শুরু করেন।
২০০৩ সালে ভুবেন সরদার বন বিভাগ থেকে পাস-পারমিট নিয়ে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যান। কিন্তু আর ফিরে আসেননি। মন্দ কপাল আর কাকে বলে! প্রথম স্বামীর মতো দ্বিতীয় স্বামীও বাঘের শিকার হন। খুঁজে পাওয়া যায়নি স্বামী ভুবেনের লাশও।
দুই স্বামী বাঘের পেটে যাওয়ার পর সোনামণিকে স্থানীয় লোকজন ‘অলক্ষ্মী’ ও ‘স্বামীখেকো’ আখ্যা দিয়ে সমাজ থেকে আলাদা করে দেন। শাশুড়ি তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখেন, যাতে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে অকল্যাণ এড়াতে এই ‘অলক্ষ্মী’র মুখ দেখতে না হয়।
সোনামণি বলেন, ‘১৯৯৯ সালে আমার স্বামীকে বাঘে ধরে নিয়ে যায়। সে কারণে কোলের এক মাস বয়সী বাচ্চাসহ শাশুড়ি আমাকে তাড়িয়ে দেন। তখন আমাকে বাচ্চা নিয়ে পথে পথে ঘুরতে হয়েছে। পরে দেবর আমাকে বিয়ে করে। ২০০৩ সালে বাঘে ধরে তাকেও।’
সোনামণি আরও বলেন, “আমার এ জীবন তো মৃত্যুর মতোই। স্বামীরা গেল বাঘের পেটে, সেই সঙ্গে আমাকেও মেরে রেখে গেল। আমার মতো সব ‘বাঘ বিধবা’ নারীর জীবন চলছে অপমানে অবহেলায় ধুঁকে ধুঁকে।”
স্বামী হারানোর অবর্ণনীয় দুঃখকষ্টের সঙ্গে তাদের জীবনে যোগ হয়েছে সামাজিক নির্যাতন ও নিগ্রহ। পরিচিতি জুটেছে ‘অপয়া, ‘অলক্ষ্মী’ ও ‘স্বামীখেকো’ হিসেবে। স্ত্রীর মন্দভাগ্য স্বামীদের বাঘের মুখে ফেলেছে বলে মনে করে এই সমাজ। এই দায় মাথায় নিয়ে বহু ‘বাঘ বিধবা’ অসহায় নারী বাধ্য হন স্বামীর ঘর ছাড়তে। কিন্তু তার পরও বেঁচে থাকতে হয়। সন্তান লালন-পালন করতে হয়। রোজগারের জন্য যুদ্ধ না করে উপায়ই বা কী?। এমন হাজারও সংকটে বিপন্ন অভাগিনী ‘বাঘ বিধবা’রা। তাদের ভাঙাপোড়া জীবনে বিবর্ণ অন্ধকার ছাড়া অন্য কিছু নেই।