পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে দেখলাম প্রাচীন দেয়ালের কোটরে আজও কয়েক জোড়া খুড়ুলে প্যাঁচার সংসার টিকে আছে। কোটরের মুখে নির্ভয়ে বসে প্যাঁচাগুলো আমাদের আনাগোনা দেখছে। ওরা জানে, কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে বিহারে উঠে আমরা ওদের বিরক্ত করতে পারব না। বলাবাহুল্য, নিশ্চিন্ত ওই নিশাচরদের নির্বিকার দৃষ্টির সামনে আমরা কিঞ্চিৎ বিমূঢ় হলাম। পেঁচকের অমন নিরুদ্বিগ্ন অবয়বের নেপথ্যে না জানি অতীতের কত ইতিহাস জমে আছে!
অষ্টম শতাব্দীতে ওদের পূর্বপুরুষরা এ বিহারের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী ধর্মপাল দেবকে এখানে পদধূলি দিতে দেখেছে। তারপর হাজার বছর বয়ে গেছে এবং শূন্য বিহারে জমেছে ধূলিমাটি; কিন্তু বংশপরম্পরায় প্যাঁচার বসতি ঠিকই টিকে গেছে। তাই উনিশ শতকে ওদের নিকটাত্মীয়রা বিস্ফারিত চোখে চেয়ে দেখেছে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারের অধিনায়ক মেজর জেনারেল অ্যালেকজান্ডার ক্যানিংহাম যখন পাহাড়পুরে এলেন প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য শুরু করার প্রবল বাসনা বুকে নিয়ে।
খুড়ুলে প্যাঁচার কাছে ধর্মপাল, বৌদ্ধ ভিক্ষু, ক্যানিংহাম কিংবা আমাদের মতো অজ্ঞাতকুলশীল পর্যটক, সবই এক। মানুষ এলেই ওরা খুশি। ওরা জানে যে মানুষ এলে বর্জ্য আসে এবং বর্জ্য এলেই আসে ইঁদুর-ছুঁচো ও ঝিঁঝিঁ-তেলাপোকারা। মূষিক মাত্রই পেঁচক-কুলের প্রিয় আহার্য; তদুপরি তেলাপোকাগুলো খুড়ুলে প্যাঁচার অতিশয় পছন্দসই খাবার। বিশেষ করে ছোট্ট ছানার মুখে তেলাপোকা তুলে দেওয়ার দুর্বার আগ্রহ ওদের। তেলাপোকার তেলেই সম্ভবত ছানাদের বেশি শ্রীবৃদ্ধি হয়। প্রতি শীতে প্রজনন হলেও অধিকাংশ পাখির মতোই ওদের ৮০ শতাংশ ছানা সাবালক হওয়ার আগেই অনাহারে ও অপঘাতে মারা যায়। তাই ১৫ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে বংশধারা রক্ষার জন্য ওরা প্রাণপণ চেষ্টা করে যায়; এবং যুগ যুগ ধরে সে কাজে সফলকামও হয়েছে।
ধর্মপালের বংশলতিকা লুপ্ত হয়েছে, অনূঢ় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তো বংশ প্রতিষ্ঠাই করেনি এবং ক্যানিংহাম ও তার সুযোগ্য পুত্ররা ফিরে গেছেন আপন দেশে; কিন্তু খুড়ুলে প্যাঁচারা আজও পাহাড়পুরে রয়ে গেছে। অনাদিকাল থেকে বংশধারা রক্ষায় নিবেদিত রয়েছে খুড়ুলে প্যাঁচার পুরো জীবন। একবার জোড়া বাঁধলে ওরা আর জোড়া ভাঙে না; যদিও এ দেশের অন্যান্য পাখি প্রতিবছর নতুন জোড়া বাঁধে। নতুন বছরে নতুন জোড়া বাঁধলে ‘ইনব্রিডিং’ বা অন্তঃপ্রজনন কম ঘটে এবং জিনভিত্তিক রোগ ও বিকৃতির আশঙ্কা কম থাকে। কিন্তু রহস্যজনকভাবে আজীবন জোড়া-বাঁধা এই প্যাঁচাদের মধ্যে অমন রোগ ও বিকৃতি বেশি নেই। কৌতূহলী পাখি বিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান চালিয়ে ইতোমধ্যে রহস্যভেদ করেছেন। রহস্যটা হলো এই যে আপাতদৃষ্টিতে বিশ্বস্ত স্ত্রী প্যাঁচারা আসলে পরকীয়ায় বেশ পটু। ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে ৩০ শতাংশ প্যাঁচার বাসায় একাধিক পুরুষের ছানা রয়েছে। সন্দেহ নেই, পোকা শিকারের নামে রাতের আঁধারে অনেক প্যাঁচা-বধূ অভিসারে যায়। পরকীয়া শব্দটি কটু হলেও সেটি অন্তঃপ্রজননের অভিশাপের বিরুদ্ধে শক্তিশালী এক রক্ষাকবচ।
খুড়ুলে প্যাঁচা মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাখি। বাংলাদেশের পশ্চিমে ইরান ও পূর্বে ভিয়েতনাম পর্যন্ত এর বসবাস। আট ইঞ্চি দীর্ঘ এই নিশাচর পাখির ইংরেজি নাম ‘স্পটেড আউলেট’। ইউরোপে এর অস্তিত্ব না থাকলেও একজন ফরাসি বিজ্ঞানী প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দুই ঈশ্বরের নামে পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম দিয়েছেন ‘এথেনা ব্রহ্মা’। এথেনা ছিলেন জ্ঞান, শিল্পকলা ও যুদ্ধের ঈশ্বরী এবং ব্রহ্মা হলেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা। তবে আমাদের কাছে সে ছিল শ্মশান, গোরস্তান ইত্যাদি স্থানের বিনিদ্র প্রহরী। বলতে পারি না, পরকীয়ার বিষয়টি জানার পর ওদের জন্য আমাদের ভালোবাসা কমবে না বাড়বে!