চীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর আনাচে-কানাচে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। এতে করে শুরুর দিকে ছায়াঘেরা নির্মল প্রকৃতিতে বাস করা কিছু বিপন্ন প্রজাতির পাখি পড়েছিল সমস্যায়। কিছু পাখি চলে গিয়েছিল এলাকা ছেড়ে। আবার কিছু পাখি বিদ্যুতের খুঁটিতেই শুরু করেছিল বাসা তৈরি করা। তবে উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে পাখিরা যাতে আর সমস্যায় না পড়ে তা নিশ্চিত করতে সম্প্রতি অভিনব সমাধান নিয়ে এসেছেন চীনের বিদ্যুৎ সঞ্চালন বিভাগের কর্মকর্তারা।
উত্তর-পশ্চিম চীনের ছিংহাই প্রদেশের শানচিয়াংইউয়ান হলো চীনের অন্যতম একটি প্রাকৃতিক সংরক্ষিত বনাঞ্চল। নির্মল ও বুনো পরিবেশের কারণে এটি প্রায় ৩০০ বিরল প্রজাতির পাখির আবাসস্থল। এর মধ্যে ২০টিরও বেশি হলো শিকারি পাখি। এ তালিকায় আছে গোল্ডেন ঈগল, বাজপাখি এবং আপল্যান্ড বুজার্ড।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎসেবা পৌঁছে দিতে এই শানচিয়াংইউয়ানের ভেতর দিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন। যার জন্য দরকার হয়েছিল এখানে সুউচ্চ বেশ কিছু টাওয়ার নির্মাণের। আর শিকারি পাখিরাও উঁচু স্থান পেয়ে সেই টাওয়ারগুলোয় তৈরি করতে শুরু করে তাদের বাসা।
এ কাজে প্রথম দিকে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছিল চীনের স্টেট গ্রিডের অধীনে থাকা ইউশু পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানিকে। পাখি তাড়াতে তারা প্রথমে ব্যবহার করতে শুরু করেন বিশেষ ধরনের আল্ট্রাসনিক যন্ত্র বা বার্ড রিপেলার। এতে অবশ্য কাজ হয়নি।
স্টেট গ্রিড ইউশু পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানির কর্মকর্তা সু ওয়েনছি জানালেন, ‘রিপেলারগুলো প্রথম দুই বা তিন মাস কার্যকর ছিল। কয়েক মাস পরে পাখিরা এগুলোয় অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং খাপ খাইয়ে নেয়। আবার এই এলাকায় শক্তিশালী অতিবেগুনি রশ্মির উপস্থিতির কারণে, রিপেলারগুলো ভঙ্গুর হয়ে পড়ে এবং পাখিরা সহজে সেগুলোকে ফেলে দিতে পারছে।’
সমাধান হিসেবে সঞ্চালন লাইনের কর্মীরা নিয়ে আসেন অভিনব সমাধান। পাখিদের জন্য খুঁটির আগায় তৈরি করে দেওয়া হয় নকল বাসা। সেই বাসায় তারা বসিয়ে দিলেন একখানা ছাউনি। কিন্তু এখানেও বিপত্তি। নকল বাসাগুলোকেও এড়িয়ে চলতে শুরু করে পাখিরা।
প্রতিষ্ঠানটির সার্ভিস সেন্টারের কর্মকর্তা সোনাম সেরিং জানালেন, ‘প্রথম ধাপে আমরা যে বাসাগুলো তৈরি করি, সেগুলোয় ছাদ ছিল। আমরা ভেবেছিলাম এতে করে পাখিরা বাতাস ও বৃষ্টির হাত থেকে নিজেদের নিরাপদ ভাববে। পরে আমরা পূর্ণবয়স্ক আপল্যান্ড বুজার্ড সম্পর্কে জানতে পারি যে, তাদের পালকগুলো আসলে পানিরোধক। এতে করে যখন বৃষ্টি হয়, তখন তারা তাদের পালক দিয়েই ছানাদের সুরক্ষা দিতে পারে। আবার এ পাখিরা বেশ সতর্ক। তারা খোলা বাসায় থাকতে পছন্দ করে, যখনই কোনো বিপদের আভাস পাবে, মুহূর্তের মধ্যে যেন তারা পালিয়ে যেতে পারে।’
পাখিদের আচার-আচরণ সম্পর্কে জানার পরই বিদ্যুতের কর্মীরা প্রায় ২০০টি নকল বাসার কাঠামো বদলে দেয়। সেগুলোকে এমন স্থানে রাখা হয় যেখানে শিকারি পাখিদের অবাধ আনাগোনা রয়েছে। এতে করে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের বিপজ্জনক যে পয়েন্টগুলো রয়েছে, সেদিকে কমে আসে পাখির সংখ্যা, একই সঙ্গে কমে আসে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের হার।
শানচিয়াংইউয়ান রিজার্ভের আকাশে এখন নিরাপদেই উড়ে বেড়াতে দেখা যায় বুনো শিকারি পাখিগুলো।
অন্যদিকে শানতোং প্রদেশের তোংইয়িং শহরে আছে অরিয়েন্টাল হোয়াইট স্টর্ক বা অরিয়েন্টাল সাদা মানিকজোড় পাখি। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ ইউনিয়নের বিপন্নপ্রায় তালিকায় আছে পাখিটির নাম। ধারণা করা হয় বিশ্বে বড়জোর আর ৭ থেকে ৯ হাজার বুনো হোয়াইট অরিয়েন্টাল স্টর্ক আছে।
অনেক উঁচুতে বাসা বানায় এরা। তোংইয়িংয়ে তারা বাসা বানানোর জন্য বেছে নিয়েছিল বিদ্যুৎ সঞ্চালনের বড় বড় টাওয়ার।
এ পাখিদের নিয়েও এখানে চিন্তায় পড়তে হয়েছিল বিদ্যুৎ সাপ্লাই কোম্পানির কর্মীদের। যথারীতি তারাও নকল বাসা বানিয়ে সেগুলোকে স্থাপন করে টাওয়ারের ওপর। প্রথম দিকে হোয়াইট স্টর্ক পাখিরা এ নকল বাসাকে সাদরে গ্রহণ না করলেও একপর্যায়ে ধীরে ধীরে তারা এগুলোর ওপর খড়কুটো জড়ো করে বানাতে শুরু করে বাসা।
এরপর দেখা দেয় আরেক সমস্যা। হোয়াইট স্টর্কের বিষ্ঠা পড়ে নষ্ট হতে থাকে সঞ্চালন ব্যবস্থার সরঞ্জাম। কিন্তু বিপন্ন এ পাখিদের আবাস নষ্ট হোক বা পাখিরা চলে যাক, সেটা কিছুতেই চান না কোম্পানির কর্মকর্তারা। সমস্যার সমাধানে তারা বিদ্যুতের তারের জন্য তৈরি করলেন পাখির বিষ্ঠা প্রতিরোধের উপায়।
শানতোং ইলেকট্রিক পাওয়ার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের উপ-পরিচালক লিউ হুই জানালেন, যে বস্তুটি তারা তৈরি করেছেন সেটার নাম কম্পোজিট ইনসুলেশন অ্যান্টি-বার্ড-ড্রপিংস কভার। এর প্রধান কাজ হলো তার বা গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশে পাখির বিষ্ঠার পতন ঠেকানো।
মোটকথা, প্রকৃতিকে হুমকির মুখে ফেলে কখনোই বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পক্ষপাতি নয় চীন। আর তাই এখন তোংইয়িংয়ের বিদ্যুৎ সঞ্চালনের টাওয়ারগুলোর ওপর বেশ আরামেই ঘর সংসার করছে দুই শতাধিক অরিয়েন্টাল হোয়াইট স্টর্ক পরিবার। এদের মধ্যে ৭০টিরও বেশি বাসায় বড় হতে চলেছে বিপন্ন এ পাখির পরবর্তী প্রজন্ম।
লেখক: সংবাদকর্মী , সিএমজি