‘কোন ঘর-ছাড়া বিবাগীর বাঁশি শুনে উঠেছিল জাগি
ওগো চির-বৈরাগী!
দাঁড়ালে ধুলায় তবে কাঞ্চন-কমল-কানন ত্যাগি’-
ওগো চির-বৈরাগী।’
কাজী নজরুল ইসলামের ১৯২৫ সালে প্রকাশিত চিত্তনামা কাব্যের ‘রাজ-ভিখারী’ কবিতার এ লাইনগুলো পড়লে কাঞ্চন-কানন নিয়ে একটি দৃশ্য কল্পনায় ভেসে ওঠে। কাল যে রাজা ছিল, তার ছিল কাঞ্চন-কমল শোভিত রাজ উদ্যান। সে উদ্যানে শোভা পেত কাঞ্চন ফুল, জলাশয়ে পদ্ম। সুধাময় সে জীবন ছেড়ে রাজা কেন বেছে নিতে বাধ্য হলেন ক্ষুধাময় ভিখারির জীবন? এটাই বোধ হয় প্রকৃতির বিধান, আজ যে রাজা কাল সে ফকির। আজ যেখানে যে গাছ আছে, কাল সেখানে তা থাকবে না। রাজভিখারির মতো ভিক্ষা তো আমিও চাই, মানুষের কাছে- প্রকৃতির কাছে আমার সে ভিক্ষা সমগ্র মানবের কল্যাণের জন্য।
রাজোদ্যানেই আসলে মানায় কাঞ্চনকে। কাঞ্চন অর্থ সোনা, সোনা মানেই দামি। সেই সোনারঙা হলুদ কাঞ্চনও আছে এ দেশে, সেটা দুষ্প্রাপ্য বলেই দামি। তবে এই শীতে নগরজুড়ে উদ্যানে, রাজোদ্যানে ফুটে উঠেছে রক্তকাঞ্চন আর দেবকাঞ্চন ফুলেরা। খামারবাড়ি থেকে আড়ংয়ের দিকে যেতে জাতীয় সংসদ ভবন প্রাঙ্গণের ভেতরে কয়েকটি রক্তকাঞ্চন গাছে ফুল ফুটে আছে। শাখায় শাখায়, ডগায় ডগায় ফুলের মঞ্জরি, রোদমাখা বাতাসে দুলছে ফুলমাথায় সরু সরু ডাল। সবুজ পত্রপল্লবের মধ্যে যেন বসেছে প্রজাপতির মেলা।
কাজী নজরুল ইসলাম শতবর্ষ আগে যে কাঞ্চন ফুলকে ঠাঁই দিয়েছিলেন রাজ উদ্যানে, কাকতালীয়ভাবে সেই কাঞ্চনকেই দেখতে পেলাম বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবনের আঙিনায়। রমনা উদ্যান ও জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান তো বটেই, এ সময় ঢাকা শহরের অনেক ছাদের বাগানেও দেখা যাচ্ছে রক্তকাঞ্চনের শোভা। যদিও বইপত্রে লেখা আছে, রক্তকাঞ্চনের ফুল ফোটা শুরু হয় মাঘের মাঝামাঝি থেকে আর ফুল ফোটা চলতে থাকে গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত। সুসংবাদ হলো, এবার আর মাঘ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি, অগ্রহায়ণেই ফুল ফোটা শুরু হয়ে গেছে রক্তকাঞ্চনের। তেমনি তাকে সঙ্গ দিতে ফোটা শুরু করেছে হালকা গোলাপি রঙের সরু পাঁপড়ির দেবকাঞ্চন ফুলও। দুই সপ্তাহ আগেই মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে গিয়ে সে দৃশ্য দেখে এসেছি। ফুল ফোটার পঞ্জিকা অনুসারে দেবকাঞ্চনের ফোটার সময়টা ঠিকই আছে, কিন্তু রক্তকাঞ্চনের বেলায় কিছুটা উল্টোপাল্টা দেখছি। অথচ এ দুটি কাঞ্চনের প্রস্ফুটন প্রাচুর্যের মোক্ষম সময় হলো বসন্ত।
রক্তের রং লাল, কিন্তু রক্তকাঞ্চন নাম হলেও এর রং লাল না, বেগুনি-গোলাপি বা মেজেন্টা। আগে ঢাকা শহরে দেবকাঞ্চনই বেশি দেখা যেত, এখন রক্তকাঞ্চনের গাছ বেড়েছে। কারণ আর কিছুই না, দেবকাঞ্চনের চেয়ে রক্তকাঞ্চন ফুলের শোভা বা সৌন্দর্য বেশি, রংটাও আকর্ষণীয়। আর ফুলে মৃদু সুগন্ধও আছে। আবার এর কিছু হাইব্রিড জাতও বিদেশ থেকে এসেছে, যেগুলোর ফুল বড় ও ঘন মেজেন্টা রঙের। রক্তকাঞ্চন ফুলের পাপড়ি পাঁচটি, পুরুষ কেশরও পাঁচটি, কিন্তু স্ত্রী কেশর একটি। এসব গাছ লাগানোর পরের বছর থেকেই ফুল ফোটা শুরু হয়। গাছ বাড়েও বেশ দ্রুত। বাড়তে বাড়তে একসময় রক্তকাঞ্চনের গাছ মাঝারি বৃক্ষের রূপ ধরে। এ গাছের দোলায়মান শাখা-প্রশাখা ঘন ছাতার মতো গাছের পত্রছায়া তৈরি করে। সব কাঞ্চনের পাতা দেখতে প্রায় একই রকম, উটের খুরের মতো আকৃতি, একটি পাতার দুটি ফলক বইয়ের দুটি পাতার মতো ভাঁজ করা থাকে। পাতার ফলক অনেকটা উপবৃত্তাকার, সবুজ, নিচের পিঠ ধূসর সবুজ। তবে গাছটা চিরসবুজ না। শীত ফুরালেই পাতারা ঝরে যায়। বসন্তে তখন নিষ্পত্র ডালে ডালে শোভা পেতে থাকে ফুলেরা। সে এক মধুর দৃশ্য!
ডালের আগায় লম্বা পুষ্পমঞ্জরিতে একটার পর একটা ফুল ফুটতে থাকে, ফুল ঝরে গেলে সেখানে ঝুলতে থাকে শিমের মতো চ্যাপ্টা ফল। শিম, কৃষ্ণচূড়া, কাঞ্চন একই বংশীয়, ফ্যাবেসি ওদের গোত্রের নাম। তাই ওদের ফলগুলোও দেখতে মোটামুটি একই রকম, শুধু আকারে ছোট-বড়। ফল পাকলে সশব্দে ফেটে দুভাগ হয়ে ভেতর থেকে বিচিগুলো ছড়িয়ে পড়ে। বীজ থেকে চারা হয়। তবে এখন শাখা কেটে কলম করেও চারা তৈরি করা হচ্ছে। রক্তকাঞ্চনের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Bauhinia variegata, গাছটি এ দেশে এসেছে ভারতের শুষ্কাঞ্চলের অরণ্যভূমি থেকে। ষাটের দশকে ঢাকা শহরে হেয়ার রোড ও পরীবাগে কদাচিৎ রক্তকাঞ্চন গাছ চোখে পড়ত বলে জানিয়েছিলেন নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা, বর্তমানে অঢেল। কাঞ্চন ফুলের শোভা দিক মনের প্রশান্তি, বৃক্ষ দিক বেঁচে থাকার প্রাণবায়ু। বাগানে বাগানে আরও ছড়িয়ে পড়ুক কাঞ্চনকন্যারা। শীত ঋতুর বরণ ঘটুক রক্তকাঞ্চনের শোভায়।