হালকা শীতের দুপুর। আর কদিন পর আসবে বসন্ত। ঢাকার রমনা পার্কের উত্তরায়ণ গেটের কাছে পলাশগাছটিতে ফুলের কলি এসেছে এবং কিছু ফুলও ফুটেছে। পলাশগাছের ফুলে অনেক পাখি আসে মধু ও ফুলে বিচরণ করা পোকামাকড় খেতে। পলাশগাছটি থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে পলাশ ফুলে আসা পাখি দেখছি। সবুজ টিয়া, বাংলা কাঠঠোকরা, কাঠশালিক, হাঁড়িচাঁচা ফুলে-ফুলে বিচরণ করছে। মাঝে মাঝে একটি চঞ্চল পুরুষ মৌটুসি উড়ে এসে ফুলে বসে দুদণ্ড সময় কাটিয়ে আবার উড়ে যাচ্ছে অন্য কোথাও। তার ডাক রোমাঞ্চকর। বসন্তের আগমনে তার একজন সঙ্গী দরকার, এমনই তার ভাব-সাব।
পলাশগাছ থেকে একটু দূরে একটি মাঝারি বহেরা গাছ। বহেরার পাতাগুলো ঝরে পড়েনি। পাতার ভেতর থেকে একটি নীল রঙের পাখি উড়ে এসে অন্য পাতার ওপর বসে উড়ন্ত পোকা ধরে খাচ্ছে। পোকা ধরার কৌশলটা অন্য রকম। প্রথমে সে উড়ে এসে পাতার ভেতরে বা পাতার গায়ে লেগে থাকা পোকাদের উড়িয়ে দেয়। তারপর উড়ন্ত পোকা ধরে খায়। পাখিটির পালকের রং তীব্র নীল। শীতের সেই দিনে জীবনে প্রথম দেখা হলো পৃথিবীর সেই পাখিটির সঙ্গে, যার নাম হলো ‘নীল চটক’ বা ‘নীল কটকটিয়া’। পালকের নীল বর্ণের জন্য জুটেছে এমন নাম। পাখিটির অন্য নামগুলো হলো অম্বর চুটকি, নীলাম্বরি ও আকাশি চটক। এটি মূলত পোকা শিকারি পাখি। পাখিটি অনেকক্ষণ ধরে বহেড়াগাছের পাতায় উড়ে উড়ে পোকা ধরে খাচ্ছিল। কী সুন্দর তার পালকের নীল রং! যখন রোদ পড়ছিল, তখন নীল রংটি আরও তীব্র হয়েছিল। চোখের কাছে কাজলের মতো টান এবং নীলপালক পাখিটিকে অনন্য করে তুলেছে।
নীল কটকটিয়া আমাদের দেশে শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে এবং বাংলাদেশে বহুল পরিচিত একটি পরিযায়ী পাখি। শীত মৌসুমে দেশে সব বিভাগের বন, শহরের উদ্যানে এবং গ্রামের জঙ্গলে দেখা যায়। শীতে মূলত একাকী কিংবা ছোট দলে পাখিটি চরে বেড়ায়। প্রজনন মৌসুমে জোড়ায় থাকে এবং দলে মিশে না। গ্রীষ্মকালীন আবাসে সাধারণত মুক্ত বন, বনের প্রান্তর, বাগান ও জলাধারের কাছে ঝোপে বিচরণ করে। প্রজনন সময় এরা হিমালয়ে বাসা বানায়।
এ পাখির ইংরেজি নাম ভার্ডিটার ফ্লাইক্যাচার। নীল চটক হিমালয় থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে সুমাত্রা পর্যন্ত পাওয়া যায়। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নীল চটকের চোখের কালো দাগ এবং ধূসর ভেন্ট ব্যতীত শরীরের সমস্ত অংশে গাঢ় নীল। এই পাখির প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও অপ্রাপ্তবয়স্করা হালকা নীল ও কিছুটা অনুজ্জ্বল হয়। মার্চ থেকে জুন মাসে এরা গাছের মগডালে বসে গান গায়। এপ্রিল থেকে আগস্ট মাসে গাছের গর্তে, শিলার ফাটলে সবুজ শেওলা দিয়ে দুই স্তরের বাসা বানায়। তিন থেকে পাঁচটি পিত-বেগুনি রঙের ডিম পাড়ে। বাংলাদেশ ছাড়া পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াতে নীল চটক পাখির দেখা পাওয়া যায়।
লেখক: নিসর্গী ও পরিবেশবিদ, জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টার