শীতের বেলা, তাই চারদিকটা ঘোলাটে উজ্জ্বল রোদে মেখে আছে। সকালের পর বেরিয়ে পড়লাম দিনাজপুর শহর থেকে পার্বতীপুরের দিকে। ইচ্ছে, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিটা দেখা। কয়লাখনির প্রধান ফটকটা প্রায় বন্ধই থাকে, কিন্তু রাস্তার ধার থেকে দেয়ালের ওপারে স্তূপ করা কয়লার পাহাড় দেখা যায়। হঠাৎ মনে হলো, দেয়ালের এপারে রাস্তার ধারে ঝনঝন করে কী যেন বাজছে। হিমেল হাওয়ায় দুলছে কয়েকটা গাছের ডালে ডালে লম্বাটে ক্যাপসুলের মতো শুকনো ফল। বাতাসের দুলুনিতে সেসব শুকনো ফলের ভেতরের বীজগুলো ঝুনঝুনির মতো বাজছে। একটা ফল ছিঁড়ে হাতে নিয়ে চাপ দিতেই ফটাস করে সেই ফাঁপা ফলের খোসা দুই ভাগ হয়ে বীজগুলো বেরিয়ে হাতের ওপর পড়ল। বাদামি রঙের বৃত্তাকার খুদে বীজ, একটা ফলের ভেতর অনেক বীজ। বুঝতে বাকি রইল না যে, ওই শুকনো বীজগুলোই পাতলা প্লাস্টিকের মতো মচমচে খোসার সঙ্গে নড়াচড়া করে ঝুনঝুন শব্দ তুলছিল। এ জন্যই এ গাছের স্থানীয় নাম বন-ঝুনঝুনি, ইংরেজি নাম Smooth Rattlebox, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ক্রোটালারিয়া প্যালিডা (Crotalaria pallida) ও গোত্র ফ্যাবেসি (Fabaceae)।
ছোটবেলায় গাঁয়ের শিশুদের চিকন ও শক্ত ডাঁটার মাথায় ধরা অধোমুখী বা ঝুলানো থোকা ধরা শুকনো ফলগুলো হাতে ধরে ডানে-বামে দুলিয়ে বেশ মজা করে বাজাতে দেখেছি। সে যুগে এটাই ছিল অনেক শিশুর কাছে মজার এক খেলনা। সে যুগে আধুনিককালের মতো ঝুনঝুনি খেলনা ছিল না। কেউ কেউ অবশ্য শিশুদের জন্য বাজার থেকে এক ধরনের টিনের তৈরি ঝুনঝুনি কিনে দিতেন, যা তখন দুর্লভ ছিল না। তবুও প্রাকৃতিক এই ঝুনঝুনি ছিল শীতের দিনে এক মজার বাদ্য। বনের আগাছা, নাম তাই বন-ঝুনঝুনি। অন্য নাম ঘণ্টাকর্ণ, জংলিশান, কুতকুতি ও ঝুনঝুনিয়া। কিন্তু এ গাছেরও একটা পোশাকি নামের দেখা পাই কবি নজরুলের গানে- ‘কর্ণ-মূলে দুল দুলিও দুলাল চাঁপার কুঁড়ি,/ বন-অতসীর কাঁকন প’রো, কনক-গাঁদার চুড়ি।’ এ গানের দুটি পঙক্তিতে তিনটি ফুলের নাম পাই। দুলাল-চাঁপা বা দুলিচাঁপা ফুল, গাঁদা ফুল ও বন-অতসী। বন-ঝুনঝুনির চেয়ে বন-অতসী নামটা বেশি সুন্দর। কিন্তু কবি নজরুল বন-অতসী ফুলের সঙ্গে কাঁকনের সম্বন্ধ কী করে পেলেন, সেটাই ভাবছিলাম। কাঁকন তো বাঙালি মেয়েরা অলংকার হিসেবে হাতে পরে, ইংরেজিতে একে বলে ব্রেসলেট বা রিস্টলেট, বালার মতো এক ধরনের অলংকার। সে অলংকার পরলেও কি ঝুনঝুন করে শব্দ হয়? এ জন্যই কি কবি নজরুল পল্লীবালাদের বিভিন্ন পুষ্পালংকারে শোভিত হতে হাতে বন-অতসীর কাঁকন ও গাঁদা ফুলের চুড়ি পরতে বলেছেন? বাস্তবে তা না হলেও এর ঝুনঝুন করা শব্দের মধ্যেই কবি নজরুল হয়তো কাঁকন বা কঙ্কনের রিনিঝিনি শব্দ খুঁজে পেয়েছেন।
ঝুনঝুন করা ফলগুলো দেখার পর ইচ্ছে হলো গাছ ও ফুলগুলো দেখার। একই গাছের কোনো কোনো ডালে রয়েছে শুকনো ও কাঁচা ফল, কিছু ডালের মাথায় সারিতে ঠাসাঠাসি করে ফুটে আছে হলদে রঙের ফুল। ফুলগুলো অনেকটা মটরশুঁটি বা শিম ফুলের মতো হলেও পাপড়ির শীর্ষভাগ বেশ চোখা ও টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো বাঁকানো। পাপড়ির গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত সরু লালচে শিরার মতো রেখা। রেখাগুলো কোথাও স্পষ্ট, কোথাও অস্পষ্ট। ফুলগুলো ছোট হলেও কাছ থেকে দেখতে সুন্দর। ফোটা ফুলে মৌমাছিরাও উড়ে বেড়াচ্ছে। মধুপায়ী পতঙ্গরা বন-অতসীর সুধাপানে তৃপ্ত হলেও এ গাছের বীজগুলো কিন্তু পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণীদের জন্য বিষাক্ত। গাছ আবার মৃত্তিকাবান্ধব। বাতাস থেকে বন-অতসীগাছ নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে শিকড়ে তা জমা করে, যার দ্বারা মাটির উর্বরাশক্তি বাড়ে। প্রাচীনকালে এসব আগাছা ছোট অবস্থায় চাষ দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ও পচিয়ে ফসল চাষের জন্য সবুজ সার তৈরি করা হতো। অনুর্বর, বেলে ও কাঁকুরে শুষ্ক মাটিতেও এদের জন্মাতে দেখা যায়।
বন-অতসী একটি বর্ষজীবী বিরুৎ শ্রেণির গাছ। এ গাছ ১৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। কাণ্ড খাড়া, শক্ত, কাষ্ঠল ও সবুজ শাখা-প্রশাখা। তিনটি পত্রকবিশিষ্ট পাতা, পত্রফলক ডিম্বাকার ও অগ্রভাগ ভোঁতা। শীতকালে ফুল ও ফল হয়। ১৫-৪০ সেন্টিমিটার লম্বা একটি পুষ্পমঞ্জরিতে ২০ থেকে ৩০টি ফুল হয়। একটি ফলের ভেতরে ৩০ থেকে ৪০টি বীজ থাকে। বীজ থেকে সহজে বন-অতসীগাছ জন্মে। এ দেশে পথের ধারে আগাছা হিসেবে জন্মাতে দেখা যায়। বন-অতসীগাছ ইন্দোনেশিয়া, সুদান, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, শ্রীলঙ্কা, ভারত, মায়ানমার, বাংলাদেশ প্রভৃতি দেশে আছে। ২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ইউনিয়ন (আইইউসিএন) প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের উদ্ভিদ লাল তালিকা’ বইয়ে বন-অতসীগাছকে বিপন্ন নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।